#গল্পঃ প্রেমকাব্য,পর্ব_০৩
#লেখিকাঃজিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
জানালার ফাঁক দিয়ে টুকরো টুকরো রোদ উঁকি দিচ্ছে।রোদের প্রখরতা আর সূর্যের উত্তাপ জানান দিচ্ছে ভোর ছাড়িয়ে এখন বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে।দোলন এখনো কাঁথা জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে।আজ শুক্রবার কলেজ যাওয়ার প্যারা নেই।কিন্তু সূর্যের উত্তাপ আজ এতই বেশি যে ফ্যানের সাথেও তার গরম হাওয়া ছেড়ে দোলনের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে।দোলন বিরক্ত হয়ে ঘুম থেকে উঠে যায়।ঘড়িতে ০৯ঃ৩৫ মিনিট বাজে।ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ গিয়ে দেখে দেলোয়ার হোসেন সোফায় বসে পত্রিকায় চোখ বুলাচ্ছেন।
দোলন গিয়ে বাবার পাশে বসতেই দেলোয়ার হোসেন একগাল হেসে বললেন,ঘুম ভেঙেছে মামনীর?
দোলন নাক ফুলিয়ে বলল,সূর্যি মামা আজ খুব রেগে আছে।তার রাগের উত্তাপে আমি ঘুমাতে পারিনি।মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেলোয়ার হোসেন ফিক করে হেসে দিলেন সাথে দোলন ও খিলখিল করে হাসতে লাগলো।বাবা মেয়ে দুজনে সকালের নাস্তা করে বসেছে লুডু খেলতে।দোলনের প্রায় সব গুলো গুটি পেঁকে গেছে আর মাত্র তিনটা গুটি বাকি।এক এক করে বাবার সবগুলো গুটি কেটে দিয়েছে।দেলোয়ার হোসেন মেয়ের সাথে না পেরে শেষে সব গুটি এলোমেলো করে দিলো।
দোলন ক্ষেপে গিয়ে বলল,এটা কি হলো?তুমি কিন্তু চিট করেছো আব্বু।আজকে জিৎ আমারই হতো।দেলোয়ার হোসেন ভাব নিয়ে বললেন,জিৎ আমারই হতো তুমি হেরে গিয়ে কান্না করলেতো আমার কষ্ট হতো তাই আমি গুটি এলোমেলো করে দিলাম।
দোলন ধ্যাত বলে রাগ দেখিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে।ও জানে ওর রাগ ভাঙানোর জন্য ওর বাবা পেছন পেছন আসবে।ঠিক হলোও তাই দেলোয়ার হোসেন মেয়ের রাগ ভাঙাতে পেছন পেছন ছুটে আসেন।দেলোয়ার হোসেন কানে হাত দিয়ে সরি বলছেন।কোনো কিছুতেই দোলনের রাগ কমছে না।শেষে বললেন,আচ্ছা ঠিক আছে আমরা আজ বিকালে ঘুরতে বের হবো।বাইরে ডিনার করে তারপর বাসায় ফিরবো।তারপর মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললেন,এবারতো মাফ করে দাও মামনী।
দোলন হেসে উঠে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে।
তানজু এতক্ষণ দরজায় দাঁড়িয়ে এদের বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখছিলো।গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিলো,উহুম উহুম!
দোলন আর তার বাবা সামনে তাকিয়ে তানজুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দোলনের বাবা বলল,তোমরা দুজন গল্প করো আমি যাই।
তানজু দোলনের খাটে বসে বলল,কি ব্যাপার আপু আজ দুদিন আমাদের বাসায় যাচ্ছো না কেন?দোলন মুখ বাঁকিয়ে বলল,আমি আর তোমাদের বাসায় যাবোনা।তোমার ভাই সেদিন আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে আবার কালকে বাইক থেকে ও নামিয়ে দিয়েছে।
তানজু ভ্রু কুচকে বলল,তুমি কবে থেকে ভাইয়ার কাজে পাত্তা দিতে শুরু করেছো?আম্মু বলে দিয়েছে তুমি আজ আমার সাথে না গেলে তোমার সাথে আর কথা বলবেনা।
উপায় না পেয়ে দোলন তানজুর সাথে ওদের বাসায় গেলো।নাজমা বেগমের গলা জড়িয়ে বসে আছে দোলন।নাজমা বেগম মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন উদ্দেশ্য দোলনের সাথে কথা বলবেন না।দোলন মুখটাকে ইনোসেন্ট করে বলল,আমি কি ইচ্ছে করে কিছু করেছি নাকি?তোমার ওই বজ্জাত ছেলেটাই তো আমাকে সহ্য করতে পারেনা।সেজন্যই আমি কালকে আসিনি।
নাজমা বেগম দোলনের দিকে ঘুরে বললেন,তাহিম তোর কাছে বড় হয়ে গেলো আর আমি কিছুনা।তাইতো আমার সাথে কাল দেখা করতে আসিস নি।দোলন কানে হাত দিয়ে ছোট্ট করে বলল,সরি!আর হবেনা এরকম ভুল।
নাজমা বেগম দোলনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,তুই এখন থেকে একদম তাহিমের কথায় পাত্তা দিবিনা।
দোলন ঠিক আছে বলে নাজমা বেগমকে জড়িয়ে ধরে।
উপর থেকে পুরো ঘটনাটা তাহিম লক্ষ্য করেছে।আজ এই মেয়ের একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে।একটা কথা বললে সেটা ঠিক মতো শুনেনা।এক নাম্বারের ঘাড় ত্যাড়া।
দোলন আজকে তাহিমের আশেপাশে ও যায় নি।তাহিমকে দেখলেও মুখ ভেংচি দিয়ে অন্যদিকে চলে যেতো।
করিডোর দিয়ে একা একা হাটছে দোলন।হঠাৎ হাতে টান দিয়ে তাহিম দোলনকে একটা রুমে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
সামনে তাহিমকে দেখতেই দোলন ভ্রু নাচিয়ে বলল,কি?
তাহিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,তোমার সমস্যা কি?কথা বললে কথা শুনোনা কেন?
দোলন হালকা ঘাড় কাত করে বলল,একদিন আসিনি বলে এত পাগল হয়ে গেলেন আমার জন্য?আর মুখে বলেন আমাকে নাকি পছন্দ করেন না।
তাহিম চোখ বন্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে।এই মেয়ে সব সময় এক লাইন বেশি বুঝবে।
দোলন বলল,কাল আবার আমাকে হুমকি ধমকি দিলেন পোস্ট ডিলিট না করলে আমার খবর আছে,জ্বলে?জেলাস হচ্ছেন আমাকে নিয়ে?হুম হুম?
তাহিম একটা রাম ধমক দিলো,শাটআপ!দুহাতে দোলনের হাতের কব্জি চেপে ধরে বলল,কি ভাবো নিজেকে হ্যাঁ?পোস্ট দিয়েছো কাশবন ঘুরতে যাবে তাইনা?ছেলেরা সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করছে এসব দেখতে ভালো লাগছে?আসলে তোমরা মেয়েরা কি বুঝো ছেলেরা তোমাদের এরকম পোস্টে মজা নেয়।অনেকে মেয়েই আছে “ঠোঁটে তিল,বুকে তিল,গলায় তিল,গালে তিল থাকলে সাড়া দাও”এসব পোস্টে নাচতে নাচতে গিয়ে কমেন্ট করে।তোমরা জানো?ছেলেরা তোমাদের এসব অঙ্গে তিলের উপস্থিতি কল্পনা করে?কি বিচ্ছিরি ব্যাপার ছিঃ!তেমরা এসব পোস্টে লাইক,কমেন্ট করা ছেড়ে দাও দেখবে ছেলেরা আর এই ধরনের বাজে পোস্ট করবেনা।তোমাদের সাড়া পেয়ে তারা আরো বেশি বেশি করে এইধরনের ফালতু পোস্ট করে থাকে।
দোলন হাতের কব্জিতে ব্যাথা পাচ্ছে তাই হাত মোচড়ামুচড়ি করছে।তাহিম আরেকটা ধমক দিয়ে বলল,এরকম মোচড়ামুচড়ি করছো কেনো?একদম চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকো।
দোলনে ছলছল চোখে বলল,আমি হাতে ব্যাথা পাই।তাহিম হাতের বাঁধন ঢিলে করে কিন্তু ছাড়ে না।
তারপর শান্ত কন্ঠে বলে,আমি কি বলেছি মনে আছেতো?
দোলন মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ জানাতেই তাহিম বলল,এখান থেকে বাসায় গিয়ে কি করবে?
দোলন একটা ঢোক গিলে বলল,আগে পোস্ট ডিলিট করবো।
তাহিম দোলনকে ছেড়ে দিয়ে বলে,কাল থেকে তোমার জন্য বাসায় কেমিস্ট্রি টিউটর রাখা হবে।বাকি সাবজেক্টগুলোর সাথে কেমিস্ট্রি ও কলেজের টিচারের কাছে পড়বে।আবার বাসায় এসেও টিচারের কাছে পড়বে তুমিতো আবার কেমিস্ট্রি কম বুঝো।
বাসায় হোম টিউটর রাখার কথা শুনে দোলনের মুখটা চুপসে একটুখানি হয়ে যায়।চোখ ছোট ছোট করে তাহিমের দিকে তাকাতেই তাহিম বলল,এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই পড়তে হবে।এখন যাও।
দোলন নাজমা বেগমকে বলে বাসায় চলে আসে।ভালো লাগছেনা এখন আবার বাসায় ও টিচার আসবে পড়াতে।
বিকালে দোলন বাবার সাথে ঘুরতে বেরিয়েছে সাথে তানজুকেও নিয়েছে।বিকেল থেকে ঘোরাঘুরি করে দোলন কিছু কসমেটিকস ও কিনেছে।এখন ডিনার করেই বাসায় চলে যাবে।দেলোয়ার হোসেনের ফোনে একটা কল আসতেই উনি ফোন কানে নিয়ে বললেন,জ্বি জ্বি আমি আসছি একটু অপেক্ষা করুন।
কল কেটে তাহিমের নাম্বারে কল দিলো।তাহিম তখন ল্যাপটপে অফিসের পোডাক্টের উপর দেওয়ার জন্য একটা ডিজাইন করছিলো।দেলোয়ার হোসেনের কল আসায় রিসিভ করে সালাম দিলো।
দেলোয়ার হোসেন জানালেন উনার একটা কাজ পড়ে গেছে।দোলন আর তানজুকে যেন ওদের বাসায় নিয়ে আসে।উনার কাজ শেষ হলে দোলনকে তাহিমের বাসা থেকে নিয়ে আসবেন।
তাহিম গায়ের টিশার্ট চেঞ্জ করে বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।দেলোয়ার হোসেনের বলা জায়গায় চলে আসে।সবাই মিলে একসাথে ডিনার করে দেলোয়ার হোসেন দোলনের মাথায় চুমু দিয়ে বললেন সাবধানে যাবে আব্বু এসে তোমাকে বাসায় নিয়ে যাবো।
দোলন মুচকি হেসে ওর বাবাকে বলল,তুমিও সাবধানে যাবে।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বাসায় যাওয়ার পথে বাঁধলো বিপত্তি।তাহিমের বাইকে দুজন বসলে সর্বোচ্চ দূরত্ব রাখা যাবে।কিন্তু তিনজন বসলে একজনের সাথে আরেকজনের শরীর লেগে যাবে।
তাহিম ভাবছে এখন কি করা যায়।এদেরকে একা সিএনজিতে ও ছাড়া যাবেনা।এদিকে দোলনের এক কথা সে তাহিমের বাইকে করে যাবেনা।কালকে বাইক থেকে নামিয়ে দিয়েছে তাহলে আজ কেনো তার বাইকে করে দোলন বাসায় যাবে?তানজু নিরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে আছে।অবশেষে তাহিম সিদ্ধান্ত নিলো ওদের দুজনকে সিএনজিতে তুলে দিয়ে সে বাইক নিয়ে পেছন পেছন আসবে।দোলনের ত্যাড়া কথা শুনে তাহিমের প্রচুর রাগ লাগে।
দোলন বলছে,কি একটা স্টুপিড মার্কা বাইক নিয়ে আমার সাথে ভাব দেখায়।আমি আর জীবনেও এই বাইকে উঠবোনা।তাছাড়া তিনজন উঠলে বাইকের মদন মালিকের কাঁধে হাত দিয়ে বসতে হবে যেটা আমি চাইনা।
মদন বলাতে তাহিম রেগে বোম হয়ে যায়।সিরিয়াসলি?ওকে কি মদনের মতো লাগে?তাই ক্ষেপে গিয়ে বলল,আজকে তোমাকে আমার এই স্টুপিড বাইকে করেই যেতে হবে।
দোলন কটাক্ষ করে বলল,কখনো না।দরকার হলে আমি বাসায় যাবো না তবুও আপনার বাইকে উঠবো না।
ঠিক আছে তাহলে তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকো বলে তাহিম তানজুকে ইশারা করে বাইকে উঠতে বললে তানজু ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,কিন্তু ভাইয়া দোলন আপুকে ছাড়া আমি কিভাবে বাসায় যাবো?
তাহিম তানজুকে চোখ রাঙিয়ে বলল,তোকে উঠতে বলেছি উঠ নয়তো এখানে রেখেই চলে যাবো।ওর ব্যাপারটা আমি দেখছি।দেখি কতকাল এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে।
তাহিমের ভয়ে তানজু বাইকে উঠে বসতেই তাহিম বাইক স্টার্ট করে চলে যায়।
দোলনের চোখে পানি চলে এসেছে সত্যি সত্যি তাহিম ওকে এখানে একা রেখে চলে গেলো?এখন বাসায় যাবে কিভাবে?ওর কাছেতো কোনো টাকা নেই।যদি কোনো বখাটে ছেলের খপ্পরে পড়ে এসব ভেবে একেবারে কেঁদে দিয়েছে দোলন।
হঠাৎ কানে বাইকের শব্দ হতেই দোলন চোখ তুলে সামনে তাকায়।তাহিম বাইক নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বলল,উঠে পড়ো তাড়াতাড়ি।তানজু ও বলছে আপু উঠে এসো।তাহিমকে দেখে দোলনের কলিজায় পানি এসেছে তবুও একটু ভাব দেখিয়ে বলল,বললামনা আমি এই বাইকে করে যাবো না।
তাহিম শক্ত কন্ঠে বলল,এবার কিন্তু সত্যিই ফেলে চলে যাবো।এই রাস্তায় কিন্তু বাজে ছেলেদের অভাব নেই।
দোলন একটা ঢোক গিলে তানজুর পেছনে বসে ওর ঘাড়ে হাত রাখে।
তাহিম আয়নায় একবার তাকিয়ে ঠোঁট কিঞ্চিৎ বাঁকা করে হাসলো।সেইতো আমার স্টুপিড বাইকেই উঠলে।
#চলবে……।