#অতঃপর_দুজনে_একা -০৬,০৭
লাবিবা ওয়াহিদ
০৬
–“এসবের মানে কী আয়ন্তি? তুই কেন খালামণি, খালুকে ফেলে আলাদা থাকবি?”
আয়ন্তি নিরুত্তর। শূন্য নজরে জানালা ভেদ করে বাহিরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে সে। ব্যস্ত শহরের মানুষদের আনাগোনা পেছনে চলে যাচ্ছে একে একে। নিলা ফোন টিপছে এবং আড়চোখে রিয়ন, আয়ন্তিকে দেখছে। রিয়ন ড্রাইভিং এ ব্যস্ত। তার পাশের সিটেই আয়ন্তি বসে আছে৷ রিয়ন আয়ন্তির উত্তর না পেয়ে আবারও প্রশ্ন করে উঠলো। আয়ন্তি অন্যমনস্ক হয়ে রিয়নের উদ্দেশ্যে বলে,
–“ভার্সিটি থেকে বাড়ি দূরে, তাই এসেছি৷ তুমি ড্রাইভিং এ মনোযোগ দাও ভাইয়া।”
–“তোর মনোযোগ মাই ফুট! আমারে শিখাতে আসছিস কেমনে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিতে হয়? এমনি এমনি লাইসেন্স পাই নাই আমি!!”
আয়ন্তি ফিচেল হাসলো। নিলাও মুচকি, মুচকি হাসলো। রিয়ন লুকিং গ্লাসে নিলার দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বলে,
–“হোয়াট? হাসির কী আছে এখানে?”
নিলা থতমত খেয়ে হাসি থামিয়ে দিলো। রিয়ন পুণরায় কোণা চোখে আয়ন্তিকে দেখে নিলো। আগের মতোই সে অন্যমনস্ক। রিয়ন স্পষ্ট শুনেছে নুরুল আলমের ঘরে আয়ন্তি এবং তার চেঁচামেচির শব্দ। এখন আয়ন্তি যদি কথা ঘুরিয়ে ফেলে তাহলে তারই বা কী করার আছে? দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো রিয়ন। সব কেমন এলোমেলো লাগছে তার। আয়ন্তির জন্যে বড্ড টেনশন হচ্ছে তার।
–“আরে আরে, রিয়ন ভাই কই যাচ্ছেন? আপনি তো আমার এপার্টমেন্টের গলি পিছনে ফেলে আসছেন। গাড়ি থামান!”
সম্বিৎ ফিরে রিয়নের। কিছুটা হকচকিয়ে কষিয়ে গাড়ি ব্রেক করে। খুব দ্রুত বেগ কষায় আয়ন্তি এবং নিলা উভয়েই কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। আয়ন্তিরও খেয়াল ছিলো না সিটবেল্ট বাঁধতে। ভাগ্যিস বড়ো কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি! রিয়ন এমনটি দেখে বেশ রেগে যায়। হুংকার ছেড়ে বলে,
–“কমনসেন্স নেই তোর? সিটবেল্ট বাঁধিসনি কেন? প্রাণের মায়া নেই? অ’ সভ্য মেয়ে!”
আয়ন্তি মুখ ভার করে রিয়নের দিকে তাকালো। রিয়ন প্রচন্ড রেগে। আয়ন্তি মুখ ভার করে বলে,
–“তুমি বকা ছাড়া আর কিছু বলতে পারো না ভাইয়া? আমার কী খেয়াল ছিলো?”
–“তো খেয়াল থাকে কোথায়? আমার ঘাড়ে চেপেছে যত্তসব যা-তা!”
রিয়ন ফুঁসতে ফুঁসতে গাড়ি ঘুরালো। আয়ন্তি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে সিটবেল্ট বেঁধে নেয়। সে বুঝতে পারছে রিয়নের মনের অবস্থা। জয়া যা করেছে তার রাগ এখনো রিয়নের যায়নি। জয়া চোখের সামনে থাকলে নির্ঘাত তাকে চি’বিয়ে খেত। তাই আয়ন্তি আর কথা বাড়ায় না। শুধু শুধু রাগিয়ে কাজ নেই। মনের অবস্থা আপাতত কারোই ভালো নেই। বিষণ্ণ সময়টা এভাবেই কেটে গেলো। এপার্টমেন্টের সামনে এসে গাড়ি থামলো। আয়ন্তি এপার্টমেন্ট দেখতে দেখতে গাড়ি থেকে নামলো। রিয়ন ততক্ষণে গাড়ির পেছন থেকে আয়ন্তির লাগেজগুলো নামিয়ে নিলো। নিলা আমতা আমতা করে শুধায়,
–“আমার লাগেজটাও নামিয়ে দিন রিয়ন ভাইয়া!”
–“নিজের কাজ নিজে কর!”
গাল ফুলালো নিলা। তারটা মিডিয়াম সাইজের লাগেজ। কাপড়-চোপড় খুব একটা নেই। কিন্তু ভাব এমন যেন ওটা পঞ্চাশ কেজি চালের বস্তা। নিলাকে অবাক করে দিয়ে রিয়ন নিলার লাগেজও নামিয়ে দিলো।
আয়ন্তির সামনে লাগেজ গুলো আনতেই আয়ন্তি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“আজকের জন্যে ধন্যবাদ ভাইয়া। আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।”
–“এ পর্যন্ত যেহেতু বিরক্ত করেছিস তাহলে আরেকটু বিরক্ত কর। তোর ফ্ল্যাট অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি। নিলা, যা চাবি নিয়ে দ্রুত দরজা খুল!”
নিলা ইতিবাচক মাথা নাড়িয়ে দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে গেলো। আয়ন্তি তার এক লাগেজ ধরতে গেলে রিয়নও সেই লাগেজে হাত রাখে। যার ফলস্বরূপ এখন একে অপরের হাত স্পর্শ করেছে। আয়ন্তি চমকে রিয়নের দিকে তাকালো। মুহূর্তে-ই চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাহবিন, মাহবিনের সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত। আয়ন্তি দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। রিয়নও গলা খাঁকারি দিয়ে পরিবেশ স্বাভাবিক করার প্রচেষ্টা চালালো। কোনো দিক না তাকিয়ে রিয়ন লাগেজ নিয়ে ভেতরে ছুটলো। আয়ন্তি রিয়নের যাওয়ার পানে কিছু সময় তাকিয়ে নিজেও ভেতরে চলে গেলো।
রিয়ন লাগেজ রাখতে রাখতে নিলা সরবত বানিয়ে আনলো তার জন্যে৷ আয়ন্তি ততক্ষণে ঘুরে ঘুরে সবটা দেখছে। দুই রুমের একটা ফ্ল্যাট, একটা লিভিংরুমও আছে। তবে লিভিংরুমে দুইটা চেয়ার ছাড়া কিছুই নেই। একরুম তো পুরোই খালি, ওটা নিলা তালাবদ্ধ করে রেখেছে। আরেকটা রুম আছে, সেটায় এটার্চ ওয়াশরুম এবং সাথে ছোট একটি বারান্দা। বায়ু চলাচলে এই মাঝারো সাইজের রুমটিতে কোনো কমতি নেই। রুমের মধ্যে একটা খাট, একটি টেবিল আর একটি কাপড়ের র্যাক। কিছুটা অগোছালো রুমটি, তবে আয়ন্তি ম্যানেজ করে নিবে।
রিয়ন সরবত পান করে উঠে দাঁড়ায়। আয়ন্তির উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়ে। আয়ন্তি চটজলদি রুম থেকে বেরিয়ে আসে। আয়ন্তি আসতেই রিয়ন বলে,
–“কোনো হেল্প লাগবে? লাগলে বল, নয়তো আমি যাচ্ছি!?”
আয়ন্তি মাথা নাড়ায় এবং বলে,
–“যতটুকু করেছো ততটুকুই বেশ। এখন চলো, তোমায় এগিয়ে দেই!”
আয়ন্তি রিয়নের পাশাপাশি সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো,
–“আব্বুকে বলে দিও, এখানকার অবস্থা!”
–“তুই বলে দিস। আমি কেন বলতে যাবো?”
–“তুমি বুঝবে না। তুমি-ই বলে দিও, প্লিজ!”
–“আহ! হাটুর বয়সী বাচ্চা মেয়ে আমায় বলে বুঝবো না। তুই বুঝি গাছ পাকা কাঁঠাল?”
হাসে আয়ন্তি। খুবই ক্ষুদ্র সেই হাসি। হাসি দিয়েই বলে,
–“তুমি তো আমার বড়ো ভাইয়ের মতো। তোমাকে সব বলে লজ্জিত হতে চাই না। সময় হোক, সব বলবো!”
অদ্ভুতভাবে বড়ো ভাই শব্দটি শুনে রিয়ন দমে গেলো। কোনো কথাও বললো না সে। আয়ন্তিও খুব একটা ঘাটলো না রিয়নকে। গাড়ির কাছে আসতেই আয়ন্তি বলে ওঠে,
–“খালার খেয়াল রেখো। তার আপডেট জানাতে ভুলিও না!”
–“তুই চিন্তা করবি না। ভালো ভাবে থাকবি!”
আয়ন্তি অধর জোড়া প্রসারিত করে ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। রিয়ন গাড়িতে উঠেই আয়ন্তির উদ্দেশ্যে বলে,
–“তুই ভেতরে যা। আমি এখান থেকে তোকে দেখবো!”
আয়ন্তি বিনা-বাক্যে ভেতরে চলে গেলো। রিয়ন তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় কিছুক্ষণ। অতঃপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে রওনা হয় নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। অনেকটা পথ আসার পর রিয়নের খেয়াল এলো আয়ন্তি এবং নিলার খাবারের কথা। ওরা তো দুপুরে কিছুই খায়নি। বাসায় বাজার আছে কি না তাও জানা নেই! রিয়ন রাগে গাড়ির স্টেয়ারিং এ এক থাবা বসালো। কীভাবে ভুলে গেলো আয়ন্তিদের খাবারের কথা? রিয়ন পিছে তাকালো। এত বড়ো জ্যাম টপকে পুণরায় আয়ন্তির দিকে যাওয়া সম্ভব না। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেললো রিয়ন।
আয়ন্তি যখন তার জামাকাপড় গুছাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ কলিংবেল বেজে ওঠে। আয়ন্তি চমকালো কিছুটা। নিলা কাজ ফেলে উঠতে নিলে আয়ন্তি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
–“তুই গুছা, আমি গিয়ে দেখছি!”
নিলা মাথা নাড়িয়ে কাজে মনোযোগ দিলো। আয়ন্তি উঠে সদর দরজার দিকে অগ্রসর হয়। দরজা খুলতেই দেখে দারোয়ান হাতে একটি প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশ চমকালো আয়ন্তি। গোল গোল চোখে একবার দারোয়ান তো একবার প্যাকেটের দিকে তাকাচ্ছে। দারোয়ান প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে থমথমে গলায় বলে,
–“আপনাদের পার্সেল এসেছে।”
বলেই দারোয়ান প্যাকেটটি আয়ন্তির হাতে ধরিয়ে দিলো। আয়ন্তি পিছে ডাকলো। কিন্তু দারোয়ান কানে নেয়নি। যেন তিনি কোনো বিরাট কাজ ফেলে এসেছে। আয়ন্তি মিনমিন করে আওড়ায়,
–“আমাদের আবার কিসের পার্সেল? আর এত ভারই বা কেন? একটা পরিচিত সুগন্ধীও নাকে বিঁধছে?”
আয়ন্তি দরজা লাগিয়ে ভেতরে চলে গেলো। নিলা তখন কিচেনে ছুটাছুটি করতে ব্যস্ত। ছুটতে ছুটতে নিলা বিলাপ করছে,
–“দেখেছিস কান্ড? এতক্ষণ ধরে আসলাম অথচ কিছুই খেলাম না। তোকেও খেতে দিলাম না। ভুলে গেলি এখন বিকাল হয়ে এসেছে, দুপুরে তো কিছু খেলামই না! আজব!!”
আয়ন্তি প্যাকেট খুলতে খুলতে কিচেনে আসলো। প্যাকেটের ভেতরে চোখ বুলাতেই আয়ন্তি হাসলো। হেসে হেসে বললো,
–“খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে!”
নিলা দমে আয়ন্তির পানে তাকায়। এমন ভাবে তাকায় যেন কোটর হতে চোখ বেরিয়ে আসবে তার। নিলা ভ্রু কুচকে অস্ফুট স্বরে বলে,
–“মানে?”
–“রিয়ন ভাইয়া বিরিয়ানি পাঠিয়েছে। চার প্যাকেট!”
নিলা হাসি দিলো অমায়িক হাসি। খুশিতে পাগল হবার জোগান তার। নিলা উচ্ছ্বাসের সাথে বলে,
–“সত্যি? কই, দেখি!”
আয়ন্তি নিলার হাতে প্যাকেটটি দিলো। নিলা একে একে সকল বিরিয়ানির প্যাকেট বের করলো। নিলা খাবার দেখতে দেখতে বলে,
–“রিয়ন ভাইয়াটা আসলেই জোস।”
হাসে আয়ন্তি।
–“হইছে, এখন ফ্রেশ হতে চল। বহুত কাজ করেছি। ফ্রেশ হয়ে খাবো।”
নিলা মাথা নাড়ায়। যেহেতু দুইটা ওয়াশরুম সেহেতু দুজনে আলাদা আলাদা ওয়াশরুমে ঢুকে পরলো।
——————–
নুরুল আলম মাথায় হাত গুঁজে বসে আছে। আয়েশা তার মুখোমুখি বিছানাতে ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে বসে আছে। কিছুক্ষণ চললো তাদের মাঝে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। একসময়ে আয়েশা কাতর স্বরে বলে ওঠে,
–“আমার মেয়েটা দুপুরে কিছু খেয়েছে নাকি গো?”
নুরুল আলম পলক ফেলে আয়েশার দিকে তাকালেন। আয়েশা পূর্বের ন্যায় ভাবলেশহীন। আয়েশা পুণরায় অন্যমনস্ক হয়ে বলতে লাগলো,
–“বাড়িটা বড্ড প্রাণহীন, ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কী ক্ষতি হতো মেয়েটাকে আটকালে?”
এবার ক্ষেপে গেলেন নুরুল আলম। স্ত্রীর পানে কিড়মিড় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে,
–“তোমার কী মনে হয় আমি ইচ্ছাকৃত ওকে ছেড়েছি? কম তো বুঝাইনি তোমার মেয়েকে। তোমার মেয়ে আমার কথা শুনলে তো! সে নিজেই জেদ ধরে চলে গেলো। যাওয়ার সময় আমার দিকে ফিরেও তাকালো না।”
–“তাকাবে কেন আপনার দিকে? আপনি তো মেয়ের জীবনটাই অর্ধেক নষ্ট করে দিলেন। পুরো মহল্লায় বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পরেছে গতকালের ঘটনা। সেগুলো কী হাতের মোয়া? কী হতো মেয়েটাকে একটু বুঝলে? আমার মেয়ে দূরে গিয়েছে যদি আপনাকে শিক্ষা দিতেই তাহলে আমাকে কেন আপনার সাথে ঝুলিয়ে দিলো? একপট্টিও সময় দিলো না তার পাশে দাঁড়াবার, চলে গেলো আমার মেয়েটা।”
আয়েশা আর বসলো না। চোখে জল নিয়ে বেরিয়ে পরলো রুম থেকে। মেয়ের রুমে বসে আজ ভিষণ কাঁদবে, ভিষণ। সেই কান্না তার একার। কাউকে দেখাতে রাজি নয় সে। নুরুল আলম নানান প্রেশারে চোখ বুজলো এবং পেছনে মাথা এলিয়ে দিলো। এক মুঠো শান্তির সন্ধানে সে বড্ড তৃষ্ণার্ত।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।
#অতঃপর_দুজনে_একা – [০৭]
লাবিবা ওয়াহিদ
——————————-
–“নিলয়? দেখো তো কে এসেছে? কলিংবেল বাজছে তো। এই নিলয়! শুনতে পাচ্ছো?”
–“হ্যাঁ শুনেছি। এতবার বলা লাগে? যাচ্ছি তো!”
মেঘার কথায় নিলয় হাই তুলতে তুলতে সদর দরজা খুলে দিলো। অনাকাঙ্খিত মানুষকে দেখে নিলয় স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রাণপ্রিয় ভাইয়ের দর্শন পেতেই আয়ন্তির চোখ জোড়া ঝাপসা হয়ে এলো। কতদিন সরাসরি দেখা করতে পারেনি ভাইয়ের সাথে। নীলা পাশ থেকে আয়ন্তির কাঁধে হাত রাখলো। নীলা আসতে চায়নি, অথচ আয়ন্তি তাকে জোর করে এনেছে। নিলয়ের নীলার দিকে নজর নেই, সে তার বোনের দিকেই পলকহীন তাকিয়ে আছে। আয়ন্তি টলমলে চোখ নিয়ে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললো,
–“ভেতরে আসতে দিবি না? দাঁড়িয়ে থাকবো?”
নিলয়ের সম্বিৎ ফিরতেই সেও হেসে দিলো। হেসে হেসে বললো,
–“আমিও কী বোকা। আয় ভেতরে আয়।”
নিলয়ের হঠাৎ নজর পরে নীলার দিকে। নীলা কেমন প্রাণহীন নজরে তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয় জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“কী হলো, নীলু? আয়। তোকে কী এখন এক্সট্রা রিকুয়েষ্ট করতে হবে ভেতরে আসার জন্যে?”
কতদিন পর নিলয়ের কন্ঠে সেই আকাঙ্খিত ডাক। “নীলু”। নীলা নিজেকে সামলে অধরে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলে,
–“তা কেন? এইতো আসছি!”
বলেই আয়ন্তির পিছে নীলা ভেতরে প্রবেশ করলো। মেঘা নিলয়ের কন্ঠস্বর শুনে রান্নাঘর থেকে ধীর পায়ে এগিয়ে আসলো। নিলয় কার সাথে কথা বলছে তা দেখার আশায়। বৈঠক ঘরে আসতেই দেখলো তার দুই ননদ এসেছে। মেঘার মুখজুড়ে আনন্দের রেশ ফুটে ওঠে। অস্ফুট স্বরে ডেকে ওঠে,
–“আ..আয়ন্তি?”
আয়ন্তি মেঘার দিকে তাকায়। মেঘা পেট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘা ছয় মাসের অন্তসঃত্ত্বা। আয়ন্তি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ভাবীর কাছে ছুটে চলে গেলো। মেঘাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে ধীরে মেঘাকে সোফায় বসিয়ে দিলো। আয়ন্তি মেঘার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“কেমন আছো ভাবী?”
–“আল্লাহ রেখেছে ভালো। তুমি কেমন আছো? এতদিন আসোনি কেন?”
আয়ন্তি একবার নিলয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ব্যস্ত ছিলাম।”
নিলয় হুট করে কাঠ কাঠ গলায় বলে ওঠে,
–“তোর এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে?”
আয়ন্তি বেশ চমকালো ভাইয়ের কথাতে। ভাই জানলো কীভাবে? পরমুহূর্তে মাথায় এলো, হয়তো তানজিলা বা মুনিয়া নিলয়কে জানিয়েছে। মেঘা বিষ্ময়ের সাথে বললো,
–“এঙ্গেজমেন্ট? কিসের এঙ্গেজমেন্ট নিলয়?”
–“তোমার ননদের!”
এবার মেঘা বিষ্ময়কর চাহনি নিক্ষেপ করে আয়ন্তির পানে। আয়ন্তি ফিক করে হেসে দিয়ে বলে,
–“এঙ্গেজমেন্ট হয়নি। তোমাদের ছাড়া আমি বিয়ে করবো ভাবলে কী করে?”
আয়ন্তির কথায় নিলয় বেশ চমকালো।
–“মানে? গতকালই না তোর এঙ্গেজমেন্ট পার্টি ছিলো?”
–“বিয়ে ক্যান্সেল।”
অতঃপর আয়ন্তি দু’জনকে একে একে সব ঘটনা খুলে বললো। নিলয় অবাকের চরম পর্যায়ে। কিছুক্ষণ বোনের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলল,
–“এটা তুই ঠিক করিসনি আয়ন্তি। কেন বাবাকে ছেড়ে আলাদা থাকবি?”
–“আব্বুর দাম্ভিকতা ছাড়ানোর জন্যে ভাইয়া। তাকে উপলব্ধি করাতে চাই ছেলে-মেয়ে দূরে থাকলে সময় কেমন কাটে। আমি চাই আব্বু তার ভুলগুলো শুধরে নিক, বোঝাতে চাই জোর করে কিছু চাপিয়ে দিলেই ছেলে-মেয়ে সুখী হয় না!”
আয়ন্তি কথাগুলো বলে নীলার দিকে তাকালো। নীলা নাক লাল করে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। আয়ন্তি তাকাতেই নীলা সপ্তপর্ণে নজর ঘুরিয়ে ফেললো। মেঘা কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় থেকে বলে,
–“এটা ঠিক করেছো কিন্তু মায়ের কী হবে?”
–“মায়ের সাথে আমি যোগাযোগ বন্ধ রাখিনি তো। মায়ের সাথে দিনে চার বেলা হলেও কথা হবে।”
–“আচ্ছা। থাকো, আমি তোমাদের জন্যে কিছু বানিয়ে আনছি।”
–“এই না না। তোমার প্রোপার রেস্ট জরুরি।”
মেঘা মমতার সাথে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে আনমনে বললো,
–“প্রথমজনকে তো নিজ গাফিলতির কারণে হারিয়ে ফেলেছি। ইন শা আল্লাহ তাকে হারাতে দিবো না।”
আয়ন্তি মেঘার দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে রয়। নিলয় বললো,
–“আমি গিয়ে তোদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি।”
–“আচ্ছা।”
নিলয় চলে গেলো। মেঘা এর আগেও কনসিভ করেছিলো। কিন্তু মেঘা সেবার পরে যাওয়ায় তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যায়। এতে মেঘা অনেকদিন মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পরেছিলো। ধীরে ধীরে মেঘা স্বাভাবিক হয়, আর দ্বিতীয়বারের জন্যে কনসিভ করে। নীলা সেই প্রথম থেকেই চুপ আছে, একটা টু-শব্দও করছে না। আয়ন্তি মেঘাকে নিলয়ের কাছে রেখে বললো,
–“ভাই৷ আমার মনে হচ্ছে এখন যাওয়া জরুরি।”
–“মানেহ? এলি তো সবে এক ঘন্টা হলো। এত তাড়া কিসের?”
–“সত্যি ভাইয়া যাওয়া প্রয়োজন। বুঝিস-ই আজ প্রথম উঠেছি বাড়িতে। আমি তো আসবোই, কাছাকাছি-ই তো আছি এখন। যাওয়া আসা হবেই। প্লিজ। জোর করিস না!”
নিলয়, মেঘা দুজনেই আয়ন্তিদের রাখতে চাইলো৷ কিন্তু আয়ন্তি শুনেনি। একসময় তারা রাজি হলো। তবে শর্ত হচ্ছে নিলয় দিয়ে আসবে। আয়ন্তি সাথে সাথেই না করে দিলো।
–“শুধু শুধু পেরাশানির কী দরকার ভাইয়া? আমরা দু’জন একটা রিকশায় উঠেই চলে যেতে পারবো।”
–“তোর কোনো কথা শুনবো না। অন্তত রিকশায় উঠিয়ে দেই তোদের?”
–“তাও করা যায়। আসি ভাবী!”
মেঘার থেকে বিদায় নিয়ে ওরা বাসা থেকে নেমে গেলো। বাসার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই রিকশা পাওয়া গেলো। নিলয় নিজ দায়িত্বে ওদের রিকশায় উঠিয়ে ভাড়া দিয়ে দিলো। আয়ন্তির গালে হাত রেখে আলতো স্বরে বলে,
–“সাবধানে যা!”
নিলয় এবার নীলার দিকে তাকালো। নীলা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলে,
–“বাই।”
নিলয় ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। রিকশা চলতে শুরু করলেই নীলা চোখ বুজলো। চোখের কোণ বেয়ে তার দু ফোটা জল গড়িয়ে পরলো। আয়ন্তি নিরবে নীলাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
–“এখনো ভালোবাসিস ভাইয়াকে?”
হাসলো নীলা। হাসতে হাসতে বলল,
–“কীসব বলিস আয়ন্তি।”
–“লুকিয়ে লাভ নেই। তোর আচরণ-ই সব বলে দিয়েছে।”
আয়ন্তি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নীলা উত্তরে কিছু বললো না। আয়ন্তি অনুতপ্তের সুরে বললো,
–“তখন আমি শুধু ভাইয়া এবং ভাবীর সুখটাই দেখলাম। অথচ তোকে আমি নিঃশ্ব করে ফেললাম।”
–“চুপ। আমি কই নিঃশ্ব হলাম? আমি নিজেই তোকে পারমিশন দিয়েছি যাতে নিলয় তোর সাহায্যে পালিয়ে যায়। যেখানে সে আমায় ভালোই বাসতো না তাকে আমি জোর করে কীভাবে বেঁধে রাখতাম বল? এজন্যই আমি নিলয়কে আর আটকাইনি, করে নিক সে বিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। জানিস কী, ভালোবাসা পাওয়ার চাইতে ভালোবাসা মানুষটার সুখ দেখা অতি সুখের, গৌরবের!”
নীলার কথাগুলো শুনে আয়ন্তির চোখে ভেসে উঠলো মাহবিনের মুখশ্রী। অন্যান্য সময় হয়তো আয়ন্তি নীলার কথাগুলো উপলব্ধি করতে পারতো না। তবে এখন সে একজনকে ভালোবাসে, তাইতো এই কথাগুলোর গভীরতা অনুভব করতে পারছে। আয়ন্তি তাও মিনমিন স্বরে বলে ওঠে,
–“সরি।”
–“বেশি বলছিস এবার। রিকশা থেকে ধা’ক্কা দিয়ে ফেলে দিবো কিন্তু।”
আয়ন্তি ফিক করে হেসে দেয়। নীলাও হাসে। চোখের জল সে আগেই মুছে নিয়েছে।
—-
রাতে মায়ের সাথে কথা বলে ফোন রাখতেই রিয়নের কল এলো। আয়ন্তি সময় ব্যয় না করে দ্রুত কল রিসিভ করে। অতঃপর সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে বলল,
–“হ্যাঁ ভাইয়া!”
–“এতক্ষণ ধরে কল দিলাম, বিজি বলছিলো কেন? কার সাথে কথা বলছিলি?”
–“মায়ের সাথে। কেন?”
–“ওহ। কিছু না এমনি। খেয়েছিস কিছু? আমার খেয়ালই ছিলো না তোকে খাবার কিনে দেয়ার কথা। এখন দেখ, সেই বিকাল থেকে একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না। কিছু খেয়েছিস নাকি আমি আবার আসবো? কী খাবি বল!”
একনাগাড়ে সব বলে রিয়ন থামলো। আয়ন্তি এদিকে থতমত খেয়ে বসে আছে। রিয়ন বিরিয়ানি না পাঠালে কে পাঠালো? দুশ্চিন্তায় বারংবার পলক ফেলছে আয়ন্তি। অপরপাশ থেকে পুণরায় শোনা গেলো রিয়নের ডাক।
–“কী হলো আয়ন্তি? চুপ আছিস কেন? কিছু বলছি আমি। এন্সা আমি!”
আয়ন্তি আমতা আমতা করে বললো,
–“খেয়েছি ভাইয়া।”
–“কী খেয়েছিস?”
–“পাশের বাড়ির আন্টিটা আমাদের খাবার দিয়ে গেছিলো। আর ডিনারের জন্যে বিরিয়ানি অর্ডার করেছি।”
–“টাকা আছে তোর কাছে? তুই বললে আমি এখনই পেমেন্ট পাঠিয়ে দিচ্ছি!”
আয়ন্তি চোখ বড়ো বড়ো করে দ্রুত ভঙ্গিতে বললো,
–“না, না। আমার বিকাশে এনাফ টাকা আছে। তুমি চিন্তা করিও না।”
–“বলছিস তাহলে?”
–“হ্যাঁ, বলছি। কল রাখো, আমি ঘুমাবো!”
রিয়নের উত্তরের অপেক্ষা না করে আয়ন্তি কল খট করে কেটে দেয়। রিয়নকে ইচ্ছাকৃত মিথ্যা বলেছে সে, কারণ রিয়ন আগে থেকেই ডিপ্রেসড। এমতাবস্থায় আলাদা প্রেশার বা চিন্তা দিতে একদমই রাজি নয় আয়ন্তি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পেছনের দেয়ালে মাথা এলিয়ে চোখ বুজে রইলো। তার সকল চিন্তা বিরিয়ানি পাঠানো আগন্তুককে নিয়ে। কে পাঠালো? নীলা গিয়েছে পাশের ফ্ল্যাটে। নীলার ফ্ল্যাটে কোনো ফ্রিজ নেই বিধায় বিরিয়ানি গুলো হালিমা আন্টির ফ্রিজেই রেখেছিলো। মহিলা আবার নীলাকে নিয়ে বড্ড যত্নশীল। আয়ন্তিও পরিচিত হয়েছে হালিমা আন্টির সাথে। বিরিয়ানিগুলো নষ্ট হতে পারে বলে আয়ন্তি রিস্ক নিতে চায়নি। এখন আয়ন্তির মাথায় একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে, নীলাকে কী এসব সম্পর্কে অবগত করবে? নাহ, এখন কিছু বলার দরকার নেই। আগামীকাল দারোয়ান থেকে সবটা জেনে নেয়া যাবে।
আয়ন্তির ভাবনার মাঝেই নীলা বিরিয়ানি গুলো নিয়ে আসলো। সে একেবারে গরম করেই এনেছে। সন্ধ্যার সময় বিরিয়ানি গুলো আয়ন্তির গলা দিয়ে নামলেও এখন একদমই নামছে না। কারণ তখন জানতো রিয়ন দিয়েছে, কিন্তু এখন জেনেছে তার পরিচিত কেউ দেয়নি। অজানা কেউ পাঠিয়েছে। গলা দিয়ে আদৌ নামবে এই খাবার? কখনো না। তাও একপ্রকার বাধ্য হয়ে গলা দিয়ে নামাতে বলো। নয়তো নীলা সন্দেহ করবে। খুব কষ্টে অর্ধেক খেলো আয়ন্তি। বাকি অর্ধেক ফেলে রাখলো। আর খাওয়া সম্ভব না তার পক্ষে। নীলা খাবার চিবুতে চিবুতে বললো,
–“কী হলো? ফেললি কেন?”
–“খুদা নেই।”
–“বললেই হলো? আচ্ছা যা, আমি-ই খেয়ে নিবো।”
আয়ন্তি উত্তরে কিছু বললো না। হাত ধুঁয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। প্যাকেট থেকেই খেয়েছে বিধায় আলাদা প্লেট ওদের নষ্ট হয়নি, তাই বাসন ধোঁয়ার ব্যাপারটাও থাকলো না। নীলা খাওয়া শেষ করে প্যাকেটগুলো ফেলে নিজেও এসে শুয়ে পরলো আয়ন্তির পাশে। নীলা শুতেই আয়ন্তি ছাদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শুধায়,
–“ওই রুমটা তালাবদ্ধ করে রেখেছিস কেন?”
–“আমি করিনি। এছাড়া আমি তো এক রুমের-ই ভাড়া দেই!”
আয়ন্তি ঘাড় বাঁকিয়ে নীলার পানে তাকিয়ে বলে,
–“মানে?”
–“দেখ এটা ভার্সিটি এরিয়া। অনেক স্টূডেন্ট-ই ভাড়া বাসাতে অথবা হোস্টেলে উঠে। তাই এদিকে বাড়িগুলাতেও স্টুডেন্টদের জন্যে কিছুটা সুবিধা আছে। আমি হোস্টেলে থাকতে পারি না, কেমন সব গুমোট লাগে। তাইতো বাবা এই ফ্ল্যাটে ভাড়া নিলেন। এছাড়া আমার এক রুমের সামর্থ্য ছিলো বিধায় এক রুমেই উঠেছি। বাড়ির মালিক চাইলেই ওই ঘরটা ভাড়া দিয়ে দিতে পারবে।”
–“এক ফ্ল্যাটে আলাদা দুইজন মানুষ?”
–“হ্যাঁ। দুইজন, চারজন, পাঁচজন থাকতেই পারে। আমি তো একাই থাকি, এখন তুই এসেছিস ভালো হলো। একা একা আর থাকতে হবে না!”
–“আচ্ছা। ঘুম পাচ্ছে আমার, গুড নাইট!”
আয়ন্তি পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পরলো। ঘুমানোর পূর্বে মাহবিনের নাম্বারে একবার নজর বুলিয়ে নিলো সে। ইচ্ছে করে নাম্বারটিতে কল দিতে কিন্তু কল দেয়ার মতো সাহসটা নেই। আয়ন্তি ঘুমিয়ে পরতেই নীলা উঠে বসলো। হাটু উঠিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে কিছুক্ষণ বসে রয়। কী মনে করে ফোনটা হাতে নিলো। গেলারি থেকে একটা ছবি বের করলো। ছবিটা হলুদের ফাংশনে। নীলা এবং নিলয় পাশাপাশি বসে আছে। সেদিন ছিল নীলা এবং নিলয়ের হলুদ সন্ধ্যা। নীলা সেজেছিলো নিলয়ের জন্যে। নীলার গায়ে হলুদ লাগানো হয়েছিলো নিলয়ের জন্যে। ছবিটায় নীলাকে লাজুক হাসতে দেখা গেলেও নিলয়ের মুখে ছিলো না কোনো হাসি। হ্যাঁ, তাদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছিলো। নীলা ছিলো তখন উঠতি বয়স, ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী। সেই সময়টায় নীলা তার মন-প্রাণ সবটা উজাড় করে দিয়েছিলো নিলয়ের ভালোবাসায়। নিলয় ছিলো তার প্রথম প্রেমিক পুরুষ। যাকে নিয়ে তার পরিবার স্বপ্ন দেখিয়েছে, আয়ন্তির বাবা স্বপ্ন দেখিয়েছে। গভীর স্বপ্ন। অলমোস্ট ওদের বিয়ে হয়েই যাচ্ছিলো। কিন্তু বিয়ের আগের দিন রাতে হঠাৎ আয়ন্তি তার কাছে আসে এবং তাকে জানায় নিলয় আরেকটি মেয়েকে ভালোবাসে, তাদের সম্পর্কও চলছে প্রায় পাঁচ বছর। মেয়েটির কথা জানতে পেরেই মূলত নুরুল আলম একপ্রকার জেদের বশে নিলয় এবং নীলার বিয়ে ঠিক করেছে। এমনটা শুনে নীলার এক নিমিষেই সকল স্বপ্ন ভেঙ্গে চুড়মাড় হয়ে যায়। খুব বাজেভাবে তার মন ভাঙ্গে। পরবর্তীতে আয়ন্তি এও বলে,
–“ওই আপুটা সুইসাইড করতে যাচ্ছে নীলা। এখন ভাইয়া না গেলে সত্যি-ই মহা বিপদ হয়ে যাবে। নীলা, আমি তোর থেকে পারমিশন নিয়ে ভাইয়াকে পালাতে সাহায্য করতে চাই। প্লিজ বোন আমার, নিজের সাথে আরও দুইটা জীবন নষ্ট করিস না।”
সেদিন নীলা থমকে যায়। তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে নিলয়ের গোমড়া মুখো মুখশ্রী। এতক্ষণে নীলা উপলব্ধি করেছে কেন নিলয়ের মুখে হাসি ছিলো না, কেন সে সবকিছু এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলো। সত্য’রা যেন চোখের সামনে আঙুল তুলে সবটা বুঝিয়ে দিলো। কল্পনা করলো ওই মেয়েটি সুইসাইড করলে তার পরিবারের কী হবে? নিলয়ের কী হবে? তাদের সংসার কখনোই সুখের হবে না। নীলা তখনই বড়ো এক সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো। আয়ন্তির উদ্দেশ্যে বললো,
–“নিলয়কে যেতে বল আয়ন্তি। গিয়েই যেন বিয়ে করে ফেলে আপুটাকে। তাদের জন্যে আমার দোয়া এবং নতুন জীবনের জন্যে শুভেচ্ছা রইলো।”
আয়ন্তি সেদিন হাসিমুখে নীলাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,
–“থ্যাঙ্কিউ নীলু। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোর খারাপ হতে দিবে না।”
নীলা সেদিন স্বচক্ষে দেখেছিলো নিলয়ের চলে যাওয়া। সেদিন নীলা কাঁদেনি। একদম কাঁদেনি। কথায় আছে না মানুষ অতি শোকে পাথর হয়ে যায়? তার বেলাতেও সেরকমই হয়েছিলো।
অতীত চোখের সামনে ভেসে উঠতেই নীলার চোখের কোণ বেয়ে অবিরাম জল গড়াতে লাগলো। নীলা চোখ বুজে পিছে খাটের ডিজাইন করা জায়গাটায় মাথা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ চোখ বুজে নিলয়ের ছবিটায় গভীরভাবে চোখ বুলিয়ে আপনমনে বিড়বিড়ায়,,
–“ভালোবাসার মানুষটিকে যেখানে ঘৃণা করার কথা কখনো কেউ ভাবতেও পারে না, সেখানে একসময় তাদের প্রতি-ই জমা হয় তীব্র ঘৃণা। তাহলে আপনার প্রতি কেন ভালোবাসাটা-ই থেকে গেলো নিলয়?”
———————
পরেরদিন সকালে আয়ন্তি আগে ঘুম থেকে উঠে যায়। ফ্রেশ হয়ে কিচেনে চলে যায় নাস্তার ব্যবস্থা করতে। নাস্তা হিসেবে আপাত দৃষ্টিতে ব্রেড-ই দেখলো। তাইতো সময় বিলম্ব না করে আয়ন্তি ব্রেডে জেল লাগিয়ে নিলো। আলাদা ঝামেলার ইচ্ছে নেই তার। নীলা এখনো ঘুমাচ্ছে দেখে আয়ন্তি ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখলো। সাতটা বেজে পয়তাল্লিশ। এখনই সুযোগ নিচে দারোয়ানের সাথে দেখা করার। নীলার ঘুম এত সহজে ভাঙবে বলে মনেও হয় না। আয়ন্তি মাথায় ওড়না জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে। নিচে নেমে দারোয়ানকে খুঁজতে গিয়ে দেখলো অন্য দারোয়ান। এ কী? গতকালকের দারোয়ান কই? নীলা সেই দারোয়ানের কাছে গিয়ে বলে,
–“আসসালামু আলাইকুম চাচা। এখানে কী আরেকজন দারোয়ান আছে?”
–“ওয়া আলাইকুম আসসালাম। জ্বী মা, আছে। দুই বেলার দারোয়ান আছে। আমার ডিউটি সন্ধ্যার পর থেকে শুরু হয়। কেন মা? কিছু দরকার?”
–“না চাচা এমনি। ওই দারোয়ান আসবে কখন?”
–“নয়টার দিকে।”
–“আচ্ছা ধন্যবাদ চাচা। আমি আসি!”
বলেই আয়ন্তি নিরাশ হয়ে চলে আসলো। নাহ, হার মানলে চলবে না। যে করেই হোক খবর তার বের করতেই হবে।
~চলবে, ইনশাল্লাহ।