#অতঃপর_দুজনে_একা -১৫,১৬
লাবিবা ওয়াহিদ
—————————
–“নীলা! কেন বসালি আমাকে মাহবিনের পাশে?”
–“কী দরকার ছিলো মাহবিনকে নিয়ে আসার?”
–“জানিস তাঁর সামনে আমার কতটা অস্বস্তি হয়?”
–“আড্ডা কীভাবে দিবো? গলা দিয়ে-ই তো কথা বের হচ্ছে না।”
–“এই বেটি! রিপ্লাই কর। নয়তো তোরে এমন চ’ ড়ান চ’ ড়া বো যে দুইদিন সূর্যের আলো চোখে দেখবি না!”
এরকম প্রায় নয় প্লাস মেসেজ। যা আয়ন্তি মাহবিনের পাশে বসে করেছিলো। নীলা গালে হাত বুলাচ্ছে আর মেসেজগুলাও পড়ছে। ক্ষণে ক্ষণে তার হাসির তীব্রতা বেড়েই চলেছে। অবশ্য তার গালে, পিঠে আসলেই কয়েক ঘা পরেছে। আয়ন্তি চেয়ারে বসে বসে কোক খাচ্ছে আর নীলার তামাশা দেখছে। তাদের ছোটখাটো পার্টি শেষ হয়েছে আরও ঘন্টাখানেক আগেই। রিয়ন ভেবেছিলো হয়তো অফিস নিয়ে মাহবিন কিছু বলবে। কিন্তু মাহবিন ছিলো সম্পূর্ণ চুপ। অফিস নিয়ে কোনো কথাই সে বলেনি। রিয়নের দিকে তাকায়নি পর্যন্ত। নীলা আয়ন্তির দেয়া মেসেজগুলো পড়তে পড়তে বলে,
–“কই বলবে তার পাশে বসিয়ে ভালো করেছি, মোমেন্টটা রোমান্টিক ছিলো! তা না বলে সে আমাকে ঝাড়ে! মানে যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর!”
আয়ন্তি কোনোরূপ উত্তর দিলো না। মাহবিন আসায় ভালোও হয়েছে আবার খারাপও। একদিকে ভালো লাগা আর অপরদিকে অস্বস্তি। যাকে বলে দুই নৌকার চিপায় ছিলো সে। কোনটাকে প্রায়োরিটি দেয়া উচিত ছিলো বুঝতে পারেনি। দোষটা অবশ্য নীলার। হ্যাঁ, অবশ্যই নীলার।
–“আমাদের কাজিনমহলে ওনার কী কাজ?”
–“তুইও ইনডায়রেক্টলি মাহবিন ভাইকে বাইরের মানুষ বললি?”
–“আরে না, ধুর! তুই বুঝতে পারছিস না। আমি তোদের সামনে যতটা খোলামেলা ততটা তো মাহবিনের সামনে নই। হুট করে একটা অযাচিত বাক্য বলে ফেললে শেষমেষ আমি নিজেই লজ্জায় লাল হবো। নিজের প্রতি কনফিডেন্স নেই একদম!”
নীলা যেন এবার বুঝলো। আধশোয়া থেকে চট করে উঠে বসে বলে,
–“আচ্ছা যা, এবারের চ’ ড়- থাপ্প/ ড় মাফ করলাম!”
–“আমার লক্ষীটা।”
–“ঢং করবি না একদম।”
–“একদম করিনি। সত্যি বলেছি।”
–“ওহ, তাই তো। আয় ঘুমাই।”
আয়ন্তি হাসলো। নীলার ব্যবহার এতটা সরল। ভীষণ ভালো লাগে নীলাকে। নীলা আয়ন্তির বোন কম বেস্টফ্রেন্ড অধিক বেশি।
–“দাঁড়া মায়ের সাথে কথা বলে নিই। রাতে আর কল দেয়া হয়নি। তুই চাচীর সাথে কথা বলেছিস?”
–“হ্যাঁ। তুই তাহলে কথা বল, আমি শুচ্ছি। ভীষণ টায়ার্ড।”
বলেই নীলা শুয়ে পরলো। বালিশের নিচ থেকে ফোন বের করে নিত্যদিনের মতো ওয়ালপেপারের দিকে তাকিয়ে রইলো। নীলার হঠাৎ মনে পরে গেলো কোনো এক বিকালের ঘটনা। সেই বিকালে নীলা রিকশার চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে ফেলেছিলো। ঘুরতে বেরিয়েছিলো নিলয়ের সাথে। নীলা ভয়ে সে কী কান্না। আরেকটু হলেই গলায় ফাঁস পরতো তার। ভাগ্যিস সময়মতো বুঝতে পেরেছিলো। নিলয় সাবধানে রিকশার চাকা থেকে ওড়না ছাড়িয়ে নিতে নিতে বেশ শীতল কন্ঠে বলে,
–“কিছু হয়নি নীলু। কান্নার কিছু নেই তো। দেখ, তোর কিছু হয়নি।”
নীলা সেদিন শুধু ফোপাঁচ্ছিলো আর নিলয়কে দেখছিলো। সেদিন কালো কেরাসিনে নীলার ওড়নাটা নষ্ট হয়ে গেলেও সেই ওড়না ভীষণ আগলে রেখেছে সে। যতই হোক, নিলয়ের ছোঁয়া আছে এটায়। নীলার খুব ইচ্ছে হয়, সেই দিনটায় ফিরে যেতে। সেই দিনটায় ফিরলে হয়তো চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথা জানাতে পারতো। জানাতে পারত নিলয়ের কিছু না জানা গল্প। হয়তো তখনো নিলয়ের জীবনে অন্য নারীর জায়গা হয়ে ওঠেনি।
—————-
ভার্সিটির উদ্দেশ্যে নিচে নামতেই দেখলো গেটে মাহবিনের গাড়ি রাখা। গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সুজন। আয়ন্তি চিনলো গাড়ি এবং সুজনকে। সুজন আয়ন্তিকে দেখতেই সৌজন্যমূলক হাসি দিলো। আয়ন্তি হাসার চেষ্টা করে বলে,
–“আপনার বসকে নিতে এসেছেন বুঝি?”
আয়ন্তির প্রশ্নের মাঝেই মাহবিন এসে উপস্থিত হলো। আয়ন্তি তার পেছনে কাউকে নিবিড়ভাবে অনুভব করলো। শুকনো একটি ঢোঁক গিলে ঘাড় বাঁকিয়ে পিছে তাকাতেই থতমত খেলো৷ মাহবিন মাথা নত করে আয়ন্তির পানেই তাকিয়ে। আয়ন্তি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাতেই মাহবিন বললো,
–“ভার্সিটি যাচ্ছো?”
আয়ন্তি আলতো স্বরে উত্তর দিলো, “জ্বী।”
–“আসো ড্রপ করে দিই।”
আয়ন্তি নাকোচ করার পূর্বেই নীলা বলে ওঠে,
–“অবশ্যই। জানেন ভাইয়া রিকশা পাচ্ছি না। ওদিকে ভার্সিটি যেতে লেট হচ্ছে। প্রথম ক্লাসটাও ভীষণ ইম্পর্ট্যান্ট। লেট করা যায় বলেন তো?”
সুজন বুঝলো সব কথা মিথ্যা। তাও অধরে অধর চেপে মিটিমিটি হাসলো। নিরবে। মাহবিন নীলার দিকে তাকিয়ে বলে,
–“ওহ। তাহলে চলো।”
নীলা আয়ন্তিকে চোখ টিপ মেরে ফন্ট সিটে বসে পরলো। আয়ন্তি অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে,
–“আরে..”
মাহবিন যেন খেয়ালই করলো না নীলার ফন্ট সিটে বসাটা। মাহবিন ডোর খুলে দিয়ে আয়ন্তির দিকে তাকালো।
–“ওঠো।”
আয়ন্তি বিষম খেলো। আমতা আমতা করে বললো,
–“আপনি আগে উঠুন, আমি উঠছি তো!”
–“ভদ্রতার সাথে ডোর খুলে দিলাম। তাও তোমার জন্যে।”
আয়ন্তি এবার লজ্জা পেলো। কী বো’ কামী করলো সে? মাহবিন এখন তাকে কী ভাববে? লাল হয়ে আয়ন্তি গাড়ি বসলো। গাড়ির বাইরে থাকা আয়ন্তির ওড়নার অংশটুকু কুড়িয়ে আয়ন্তির কোলে রেখে দরজা আটকে দিলো। মাহবিনের এই কেয়ারটুকুতে আয়ন্তি যেন আকাশ থেকে পরলো। বিষ্ময়ের সীমা সমুদ্রসম। শক্ত হয়ে বসে আছে সে। ঘটনাটা কী হলো? মাহবিন ঘুরে অপরপাশ দিয়ে আসলো। সুজন বসলো ড্রাইভিং সিটে। নীলা লুকিং গ্লাসে একপলক আয়ন্তিকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। পুরো রাস্তায় আয়ন্তি একটা টু শব্দও অবধি করেনি। মাহবিন এবং নীলা টুকটাক কথা বলেছিলো। তবে আয়ন্তি যেন নিরব স্রোতা। ভার্সিটি পৌঁছাতেই আয়ন্তি প্রথমে নামলো। আয়ন্তি নামতেই মাহবিন নীলার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,
–“কোন বিষয়ে এত সুযোগ করে দিচ্ছো নীলা?”
নীলা থতমত খেয়ে পিছে ঘুরে তাকায়। মাহবিন হেলান দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে উত্তরের অপেক্ষায়৷ নীলা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে আটকে গলায় বলে,
–“কি..কিসের সুযোগ ভাইয়া? ঠিক বুঝলাম না।”
–“আমি তো জানি, তুমি আমার কথার মানে বুঝেছো। অস্বীকার করে কী লাভ?”
নীলা চুপসে গেলো। একদিনেই এমন ধরা খেয়ে গেলো? মাহবিনকে এত চালাক কে হতে বললো? নীলা আমতা আমতা করে বললো,
–“আ..আসলে, আয়ন্তি আপনাকে পছন্দ করে ভাইয়া।”
–“সেটা তোমার বোনকে দিয়ে বলাও। তাহলে বিশ্বাস করবো।”
———————
–“আরে! আমার নয়নমণি’রা! রিহাব! তুই বাবা এই অসময়ে দেশে ফিরলি? আর শায়লা বেটা, তুমিও!”
রিহাব, শায়লা হেসে একসাথে সোনিয়াকে জড়িয়ে ধরলো। এই দু’জন হচ্ছে সোনিয়া এবং শাকিলের ছেলে- মেয়ে। যারা এতদিন এবোর্ডে পড়াশোনার খাতিরে গেছিলো। হঠাৎ চলে আসায় বেশ অবাক হয়েছে অবশ্য। রিহাব হাসতে হাসতে বললো,
–“এইত তোমাদের সারপ্রাইজ দিতে এলাম। কেমন আছো? আর বাবা কোথায়?”
–“তোদের বাবা তো অফিসে। আমি তো লাঞ্চ টাইমে বাসাতেই আসি। ভাগ্যিস এসেছি, নয়তো তোদের দেখার সৌভাগ্য হতো নাকি? দাঁড়া বসকে কল করে ছুটি নিয়ে নেই। তোরা নিজেদের রুমে যা, ফ্রেশ হয়ে নে।”
শায়লা এবং রিহাব বিনা-বাক্যে উপরে চলে গেলো। ওরা উপরে চলে যেতেই সোনিয়া কিচেনে ছুটলো ভালো-মন্দ খাবারের আয়োজন করতে। ছেলে- মেয়ে’ রা দেশে এসেছে এতদিন পর। ভালো কিছু খাওয়া- দাওয়া না হলে হয় নাকি?
বিকালের দিকে রিহাব মাহবিনকে কল করলো। সুজন ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বলে,
–“স্যার, আপনার ভাই কল করেছে।”
মাহবিন চট করে ফোনের স্ক্রিনে তাকালো। রিহাব কল করেছে। মাহবিন ভালো করে নাম্বারটা চেক করলো। বাংলাদেশি নাম্বার। এর মানে কী রিহাব বিডিতে চলে এসেছে? মাহবিন সেলফোন হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলো। কল রিসিভ করতেই রিহাব বলে ওঠে,
–“এটা কেমন হলো ব্রো? তুমি নিজে আমাদের আসতে বলে কি না নিজেই এবসেন্ট? দ্যাট’স নট ফেয়ার!”
মাহবিন সুজনের দিকে এক নজর তাকালো। কলম ঘুরাতে ঘুরাতে বেশ সময় নিয়ে উত্তর দিলো,
–“অফিসের কাজে মাসখানেকের জন্যে বাইরে আছি। ব্যাপার না, দেখা হবে আমাদের! ভেরি সুন।”
–“ওয়েটিং ফর ইউ ব্রাদার। শায়লাও তোমায় মিস করছে।”
–“আমি এড্রেস দিলে চলে আসিস ওকে নিয়ে। আই অলসো ওয়ানা মিট।”
–“ওকে। আমি ফ্রেশ হতে যাই। বাড়ি এসেই তোমায় কল করেছি। দেখলাম তোমার রুম লক।”
–“আচ্ছা। টেক ইওর টাইম।”
মাহবিন কল কাটলো। সুজন একপলক বসের দিকে নজর বুলিয়ে নেয়। অতঃপর আমতা আমতা করে বললো,
–“স্যার, একটা কথা জানার জন্যে মন অশান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
–“কী সুজন? বলে ফেলো।”
–“আসলে… আপনি কী আয়ন্তি ম্যামকে পছন্দ করেন? একচুয়ালি আপনার সব কাজ…”
–“ভেতরের কথা ভেতরেই পুষতে শিখো সুজন।”
সুজন দমে গেলো। গলা দিয়ে আর কথা বের হলো না। বসের অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠস্বর তাকে রীতিমতো ঘামিয়ে তুলেছে। মিনিটখানেকের মাঝেই রিয়ন আসলো মাহবিনের কেবিনে৷ দরজা নক করলো। মাহবিন ল্যাপটপে টাইপিং চালাতে চালাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধায়,
–“কাম!”
রিয়ন আসলো। হাতে তার ফাইল। রিয়ন একপলক সুজনের দিকে তাকিয়ে বলে,
–“এটার কাজ কমপ্লিট স্যার। আপনি একটু চেক করে নিতে পারেন।”
মাহবিন ল্যাপটপের কাজ রেখে রিয়নের দিকে তাকায়। ইদানীং রিয়নের কাজে সে ভীষণ সন্তুষ্ট। রিয়ন তার পরিশ্রম দ্বারা নিজ গন্তব্য দেখিয়ে দিয়েছে সে। তার কাজ দেখানোর জন্যে গত এক মাস যথেষ্ট ছিলো। গত এক মাসে মাহবিন যা চাপে রেখেছিলো রিয়নকে। তাতে করে রিয়নও ভালো-ই কর্মমুখর হয়েছে বটে। মাহবিন গলা পরিষ্কার করে ফাইলটা নিলো। মনোযোগ দিয়ে পুরো ফাইলটা দেখতেই মাহবিনের অধরে হাসি ফুটলো। নৈঃশব্দ, নিরব সেই হাসি।
–“গ্রেট মিস্টার রিয়ন। আপনি সত্যি অনেক ভালো কাজ করেছেন। কী নিবেন? চা না কফি?”
রিয়ন হাসলো। হাসি বজায় রেখে বললো,
–“ছুটি চাইছি স্যার। লাঞ্চ ব্রেকেই বাসায় চলে যেতে চাই।”
–“শিওর। ওভারটাইম তো অনেক করলেন। আপনারও বিশ্রামের প্রয়োজন। টেক ইওর টাইম!”
–“থ্যাঙ্কিউ স্যার।”
রিয়ন চলে গেলো। রিয়ন চলে যেতেই সুজন বড়ো বড়ো চোখে মাহবিনের দিকে তাকালো। মাহবিন তখনো ফাইল ঘাটছে।
–“রিয়ন আসছে যেনেই আপনি তখন আমায় থামিয়ে দিলেন স্যার?”
–“বলতে পারো।”
–“সো সরি স্যার। আমি মনিটরে একদম খেয়াল করিনি। বাট আপনি তো রিয়নকে সহজে ছাড় দেন না। আজ তাহলে দিলেন কেন স্যার?”
মাহবিন ফাইল থেকে নজর উঠিয়ে সুজনের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। সুজনের চোখে-মুখে একরাশ কৌতুহল৷ এই কৌতুহল না মিটলে যেন আজ তার খাওয়া গলা দিয়ে নামবে না। মাহবিন টাই কিছুটা ঢিলে করে বলে,
–“আমি এতদিন জাস্ট পার্সোনাল বদলা নেয়ার জন্যেই এমন করেছি।”
–“আয়ন্তি ম্যামের সাথে..?”
–“নো। ওয়াসিফের ঘটনা মনে আছে? রিয়নের দোষ একটাই ছিলো ও আমায় ওয়াসিফের সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলো। আমার ক্যারেক্টারে আঙুল তুলেছিলো, যেই রাইট আমি কাউকে দিই নাই। আমার চুপ থাকা দুর্বলতা নয় বরং ভদ্রতা। এই ভদ্রতাতেও আঘাত এনেছে। তাই ভদ্র ভাবেই শোধ তুলেছি আমি।”
–“কী করে?”
–“ওর প্রিয় মানুষগুলোর থেকে দূরে রেখে। ওর নিজের কাছে বড়ো শা’ স্তি কী জানো? আমার কোম্পানিতে কাজ করা। এটার-ই ফায়দা নিয়েছি। বাট নাও, আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। শোধ ছিলো আমার ক্ষণিকের।”
–“এখন যদি আবার আয়ন্তি ম্যামের কাছে যায়?”
–“হু কেয়ার’স?”
উত্তরটা সুজনের মোটেও পছন্দ হলো না। মাহবিনকেও এ বিষয়ে সিরিয়াস মনে হলো না। কী চলছে তার মন ও মস্তিষ্কে সেটা উনি আর আল্লাহ্ সুবহানাল্লাহ তা’য়ালা ছাড়া কেউ জানে না। মাহবিন হঠাৎ ফাইলটা সুজনের দিকে ছুঁড়ে মেরে বলে,
–“এগুলো ই-মেইল করে দাও। ফাস্ট! এবারের প্রজেক্টটি অনেক জরুরি।”
সুজনের ধ্যান ফিরে। চমকে ওঠে। বেসামাল ভঙ্গিতে হাতে ফাইলটা নিতে নিতে বলে,
–“ওকে স্যার।”
————————-
–“আয়ন্তি। কই আছিস তুই?”
–“কেন রিয়ন ভাই?”
–“আজ ছুটি পেলাম। চল না দূরে কোথাও ঘুরে আসি।”
–“এই কাঠফাটা রোদে ঘুরাঘুরি একদম ইমপসিবল ভাইয়া।”
–“সমস্যা কী? একদিন রোদে ঘুরলে কিছু হবে না।”
আয়ন্তির মাথায় বারংবার মাহবিন ঘুরছে। সে কীভাবে রিয়নের সাথে ঘুরতে বেরুবে? অসম্ভব। একদম অসম্ভব আয়ন্তির জন্যে। আয়ন্তি থমথমে গলায় বলে ওঠে,
–“আমি খেয়ে-দেয়ে বাসায় যাবো ভাইয়া। আজ বাসাতেই গিয়ে থাকবো।”
–“তাহলে আয়, আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
–“না, না ভাইয়া। আমি বাসায় যাই। তুমি বরং খালামণিকে নিয়ে চলে আসো।”
–“আইডিয়া খারাপ না। আচ্ছা৷ মাকে নিয়ে আসবো। এছাড়া আম্মুও অনেকদিন কোথাও ঘুরতে পারে না।”
–“আচ্ছা তাহলে তাই করো। রাখছি, আল্লাহ হাফেজ।”
আয়ন্তি কল কেটে নীলার দিকে তাকালো। নীলা মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সেই তখন থেকে নীলা আয়ন্তির সাথে একটা কথাও বলেনি। কী হয়েছে, কেন কথা বলছে না কিছুই বুঝতে পারছে না সে। আয়ন্তি যে নীলাকে জিজ্ঞেস করেনি এমনটাও নয়। আয়ন্তি জিজ্ঞেস করেছে ঠিকই কিন্তু নীলা বারংবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কী চাইছে আল্লাহ মালুম। আয়ন্তি এবার অতীষ্ঠ হয়ে পরলো। বিরক্তির সাথে বলে ওঠে,
–“কী সমস্যা কী তোর নীলা? এমন থম মেরে আছিস কেন? কিছু তো বল? না বললে বুঝবো কেমনে?”
–“তোর বোঝার প্রয়োজনও নেই। আমি যেমন আছি তেমনই ঠিক আছি।”
–“এবার লিমিট ক্রস করে ফেলছিস কিন্তু। কী হয়েছে বলবি তো!”
–“মাহবিন ভাইকে প্রপোজ করতে হবে, পারবি?”
আয়ন্তি যেন আকাশ থেকে পরলো। কী বলছে এই পাগল মেয়ে? মাথা গেছে নাকি তার? এই একটা বাক্য শুনেই তো আয়ন্তির মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। অসম্ভব ভ্রু কুচকে নীলার দিকে তাকালো। নীলা আয়ন্তির মুখ-ভঙ্গি দেখেই বললো,
–“জানতাম আমি তোর রিয়েকশন এমনটাই হবে। পাপ করেছি তোকে বলে। যা তো এখান থেকে, ভালো লাগছে না।”
–“ভালো কেন লাগবে না? আজব! এই তোর মাথায় এই ভূত কে ঢুকিয়েছে রে? সত্যি করে বল। সকালে তো ঠিকই ছিলি!”
নীলা মুখমন্ডল জুবুথুবু করে ফেললো। কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলল,
–“মাহবিন ভাইকে আমি বলেছি তুই তাকে পছন্দ করিস, কিন্তু ভাইয়া আমার কথা যেন তোয়াক্কাই করলো না। সোজাসুজি বললো তুই বললে নাকি বিশ্বাস করবে।”
আয়ন্তির চোখ জোড়া বড়ো বড়ো হয়ে যায় মুহূর্তে। পরক্ষণে বলে ওঠে,
–“পাগল নাকি তুই? এসব বলতে গেলি কেন?”
–“তোর কী মাহবিন ভাইকে কাঁচা খেলোয়াড় মনে হয়? সে সব বুঝে। ধরা খেয়েছি বলেই তো বাধ্য হয়ে সব বলেছি।”
আয়ন্তি ধপ করে বসে পরলো বিছানায়। কপালে বাম হাত। মুখশ্রীতে বিষ্ময় লেপ্টানো। বক্ষঃস্থলে উথাল পাথাল অবস্থা। শক্ত হয়ে বসে আপনমনে আওড়ায়,
–“কী করবো এখন?”
আয়ন্তি চেয়েছিলো আজ নিজের বাড়ি গিয়ে আয়েশার সাথে দেখা করবে। কিন্তু তা আর হলো না। নীলা যা শুনিয়েছে তাতে তার বাহিরে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। একদমই নেই। রিয়নকেও কল করে জানিয়ে দিয়েছে। আয়ন্তি আসবে না দেখে রিয়ন শুধু তার মাকেই আয়েশার কাছে রেখে এসেছে। দুই বোন সাথে থাকুক নাহয় কটা দিন। রিয়ন বাকিটা সময় বন্ধুদের সাথে কাটিয়েছে। আয়ন্তি যেহেতু দেখা করতে চাইছে না সেহেতু জোর করে লাভ নেই। হয়তো আয়ন্তির মন ভালো নেই।
রাত বাজছে বারোটা। আকাশ মেঘলা। ক্ষণে ক্ষণে গুরুম গুরুম শব্দে মেঘ গর্জন দিয়ে উঠছে। ঠান্ডা পরিবেশ। বাতাসের তীব্রতায় জানালার পর্দাগুলো অসমান্তরাল ভাবে উড়ছে। এরকম মৌসুমে যে কারোর-ই ঘুমে কাত হয়ে যাবার কথা। কিন্তু আয়ন্তির চোখে ঘুম নেই। তীব্র এক দোটানা তার মধ্যে কাজ করছে। সে গভীর দৃষ্টি আকাশের পানে নিক্ষেপ করে আছে। চোখ জোড়া ভীষণ শান্ত। মুখটাও ফ্যাকাসে হয়ে আছে। অধর জোড়া শুষ্ক। যেন তাদের ভেঁজানো হয়নি অনেকক্ষণ। আয়ন্তির পাশেই নীলা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। বৃষ্টি নামলো। খুব জোরে। আয়ন্তির হঠাৎ তীব্র এক ইচ্ছে জাগলো। বৃষ্টিত্র ভেঁজার ইচ্ছে। আয়ন্তি ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখলো না। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দার দরজা, জানালা সব লাগিয়ে ওড়নাটা গলায় ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। বাসায় থাকলে মাঝেমধ্যেই আয়ন্তি ছাদে গিয়ে ভিঁজতো। এটা তার অন্যতম ভালো লাগা। খুব সাবধানে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল আয়ন্তি। সিঁড়ি বেএয় উঠে সোজা ছাদে চলে আসলো। ছাদের দরজাটা লাগানো ছিলো। তবে তালা ছিলো না। নরমালি লাগানো ছিলো। বিকট শব্দের সাথে আয়ন্তি দরজাটা খুললো। নির্বিকার ভঙ্গিতে ছাদে প্রবেশ করে চুপচাপ কিছুক্ষণ ভিঁজলো। চোখ তার বদ্ধ। একসময় আকাশের দিকে মুখ করে দুই হাত মেলে দিয়ে মনমতো ভিঁজতে লাগলো। সময় কিছুটা অতিক্রম হতেই শোনা গেলো প্রচন্ড ভারী গলার হাঁক।
–“আয়ন্তি! এই রাতে ভিঁজছো কেন?”
আয়ন্তি চমকায়। পিছে ফিরে দেখে মাহবিন হাতে ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে৷ গায়ে তার সকালের স্যুট। এর মানে এখন অফিস থেকে ফিরেছে? মাহবিন এগিয়ে এলো। আয়ন্তি পিটপিট করে তাকাচ্ছে মাহবিনের পানে। বৃষ্টির ঝাপটায় তাকাতে সমস্যা হচ্ছে যেন। মাহবিন আয়ন্তির মাথায় ছাতা ধরে। দু’জন একই ছাতার নিচে। কাছাকাছি। উষ্ণ নিঃশ্বাসের শব্দে তাদের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করা যাচ্ছে। আয়ন্তির নিঃশ্বাস গাঢ়, গভীর। সে স্তব্ধ! সবটা বুঝতে তার মস্তিষ্ক সময় নিচ্ছে। মাহবিন বেশ রাশভারী কন্ঠে শুধাল,
–“এই অসময়ের বৃষ্টিতে ভিঁজছো কেন?”
–“বৃষ্টি কখনো অসময়ের হতে পারে নাকি? মেঘের যখন কান্না পাবে, সে তো অশ্রু ঝড়াবেই।”
–“আমার উত্তর এটা নয়।”
আয়ন্তি মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বললো,
–“ইচ্ছে হচ্ছিলো।”
মাহবিনের নজর এবার অন্যদিকে চলে গেলো। যাকে বলে আউট অফ লিমিট। মাহবিন তড়িৎ আয়ন্তির দিক থেকে নজর সরিয়ে নিলো। অন্যদিকে তাকিয়ে ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
–“এটা ধরো।”
আয়ন্তি বোকা চাহনি নিক্ষেপ করলো। হতভম্ব হয়ে ছাতাটা নিজের হাতে নিলো। মাহবিন গা থেকে কোটটা খুলে আয়ন্তিকে পরিয়ে দিলো। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বললো,
–“ভিঁজবে যখন, তখন সকল সতর্কতা অবলম্বন করেই ভিঁজো। সবাই তো আর মাহবিন হয় না। ডার্টি মাইন্ডেড মানুষে সমাজ ভরা।”
মাহবিনের ইঙ্গিতের কথা বুঝতে আয়ন্তির সময় লাগলো। মাহবিন তাকালো আয়ন্তির সেই চোখ জোড়ার দিকে। আয়ন্তির চোখের বিষ্ময় দৃশ্যমান। বৃষ্টি যেন আজ থামবে না। তাঁরা সকল কালো দাগ ধুঁয়ে মুছে দিচ্ছে, আজ যেন প্রকৃতিকে সতেজ করেই মেঘ গুচ্ছ ক্ষান্ত হবে। গরমে অতীষ্ঠ প্রকৃতি এবং জীব-প্রাণীদের শান্তি দিবে, পরম শান্তি। দুর্বল মনের কালো দাগ মুছিয়ে দিয়ে যাবে। অতঃপর দু’জনে একা হয়ে একে অপরকে নিবিড়ভাবে অনুভব করবে। ছুঁতে অগ্রসর হবে। অবশ্য মাহবিন দাঁড়ালো না। মাথায় হাত ধরে লম্বা লম্বা পায়ে দ্রুত ভেতরে চলে গেলো। আয়ন্তি সেখানেই বো’ কা চাহনি দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে যে আয়ন্তির মস্তিষ্ক বুঝতে সময় নিচ্ছে। আয়ন্তির গায়ে এখনো কোট এবং হাতে ছাতা। আয়ন্তি নিজের দিকে একপলক তাকালো। ভিঁজে পুরো কাকভেঁজা হয়ে গেছে। জামা-কাপড়ও গায়ের সাথে একদম লেপ্টে গেছে। এর মানে কী মাহবিন তাকে ওই অবস্থায় দেখে নিয়েছে? ইশ! কী লজ্জা! লজ্জায় আয়ন্তির মাথা নত হয়ে গেলো। এতটা বেক্কল কেন সে? ইদানীং প্রেমে পরে ঠিক-বেঠিক সব ভুলে যাচ্ছে। আয়ন্তি কোটের কলারটা নাকে ঠেকিয়ে ঘ্রাণ নিলো। হ্যাঁ, মাহবিনের কড়া পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এসে বিঁধছে। কী দারুণ সেই ঘ্রাণ, যেন মাহবিন তার কাছে, খুব কাছে।
—————————
~চলবে, ইন-শা-আল্লাহ্।