#সুখ_নীড়
#পর্ব_৮
“তুমি তো তাকে এমনিতেই ডিভোর্স দিতে চেয়েছিলে। সেই ঝামেলায় যেতেই হয়নি। ভালোই তো হয়েছে। নিজের মতো সে নিজেই লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। তোমার তো খুশি হবার কথা। উলটো বলছ পুলিশ কম্পলেইন করবে! স্ট্রেঞ্জ! বাড়ির মান ইজ্জত সব ধুলায় মেশাবার পায়তারা করছ কেনো? আজ বউ হারানোর পুলিশ কম্পলেইন করবে কাল পেপারে নিউজ হবে ‘অন্যের হাত ধরে সাজেদা চৌধুরীর পুত্রবধূ ভেগেছে। এমনিতেই এই মেয়ে কম ঝামেলা করেনি। তোমার কি মনে হয় ওর মতো ঝানু মেয়ে বাসা ছেড়ে গিয়েছে কোনো হিসেব নিকেশ না করেই। ও ওর আখের গুছিয়ে নিয়েই বেরিয়েছে। এতদিনে বুঝেছে এ বাড়িতে ও যে উদ্দেশ্য নিয়ে ঢুকেছে সেটা সম্ভব নয়। তাই হয়ত যতটা পেরেছে নিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়েছে। ভালোই হয়েছে। ঝামেলা কমেছে। এবার তুমি নতুন করে আর কোনো ঝামেলা পাকাবে না আশা করছি । বিজনেসে মন দাও। সামনে আমি ইলেকশানে বিজি থাকব। বিজনেস তোমাদেরই দেখতে হবে। এই জয়ীতা নামের চ্যাপ্টার এ বাড়িতে এখানেই শেষ। আমি চাই না ওই মেয়েকে নিয়ে আর কোনো আলোচনা হোক। ”
বলতে বলতে গটগট করে উপরে চলে গেলেন সাজেদা চৌধুরী।
পল্লব কী করবে বুঝতে পারছে না। জয়ীকে খোঁজার জন্য সে তার সাধ্যমতো সবকিছু করেছে। এখন পুলিশে জানানো ছাড়া আর কোনো উপায় তো নেই। তার মায়ের দিক থেকে যে কোনো সাহায্য সে পাবে না এটা সে জানে।
উপায়ান্তর না পেয়ে বুদ্ধির জন্য হান্নান সাহেবের কাছে যায় পল্লব। কিন্তু হান্নান সাহেবও সাজেদা চৌধুরীর মতো জয়ী চলে যাওয়াতে খুশি। সেও এ নিয়ে আর কোনো ঝামেলায় যেতে দিতে চায় না পল্লবকে।
কোনো সাহায্য করার পরিবর্তে উলটো সে পল্লবকে বলে,
” লাইফের একটা উটকো ঝামেলা বিদায় হয়েছে। আল্লাহ মেহেরবান। কোনো কাহিনী ছাড়াই এই জয়ীতা অধ্যায় শেষ হয়েছে তোমার জীবনের। এবার মন দিয়ে মায়ের বাধ্য ছেলে হয়ে যাও আগের মতো। মায়ের থেকে ব্যবসা বাণিজ্য বুঝে নাও। কল্লোলকে ছাড়িয়ে যেতে হবে তোমার। তোমাকে প্রমাণ করতে হবে তুমিই সেরা। আমি চাই শিপিং আর গার্মেন্টস এর দায়িত্ব তোমার হাতে আসুক। আর এখনই সুযোগ। এগুলির দায়িত্ব একবার নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে আর পিছে ফেরবার সুযোগ নেই।
পল্লব রেগে যেয়ে বলে, আমার মায়ের ব্যবসা সে তো দিন শেষে আমাদেরই। এখানে আমি কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়াতে চাই না। আপনার নোংরা স্বার্থ হাসিল করার জন্য আপনি যে পায়তারা করছেন সেটা কখনোই সাকসেস হবে না। আর দয়া করে আমার লাইফে আপনার কোনো ইন্টারফেয়ার চাই না। আমি আপনার কাছে ভালো কোনো সাজেশন চাইতে এসেছিলাম কিন্তু আপনিও আমার আম্মির থেকে কম নয়।
পল্লব রাগ করে চলে আসে। কার কাছে যাবে, কী করে জয়ীতাকে খুঁজে পাবে কিছুই মাথায় আসছে না তার। জয়ীর মুখখানা ভেসে উঠলেই তার বুকের মধ্যের ব্যথাটা যেন বাড়তেই থাকে। জয়ীর সাথে করা অন্যায়গুলো তার সব মনে পড়ে।
খুব রাগ হচ্ছে জয়ীতার উপর তার। সে না হয় রাগ করে জয়ীকে চলে যেতে বলেছে তাই বলে তার চলে যেতে হবে। একবারের জন্যও তার জন্য একটু মায়া হলো না তার?
কোনো কাজেই মন বসাতে পারে না পল্লব ।
জয়ীতা কোথায় আছে, কেমন আছে, এই অসুস্থ শরীর নিয়ে কীভাবে ম্যানেজ করছে কিছুই বুঝতে পারছে না। নাকি জয়ী কোন বড় ধরনের বিপদে পড়েছে কিছুই বুঝতে পারছে না। বুঝবে বা কী করে জয়ীতার সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম তার জানা নেই।
সকাল থেকে পল্লবের সাথে দফায় দফায় কয়েকবার কথা কাটাকাটি হয়েছে কল্লোলের। ব্যবসা সম্পর্কিত নানান ইস্যু নিয়ে ইদানিং ঝামেলা লেগেই থাকে তার সাথে কল্লোলের। দোষটা অবশ্য তারই। জয়ীতা চলে যাবার পর থেকে কোনো কিছুতেই তার মন বসে না। মন চাইলে কাজ করে, না চাইলে না। ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেয়ে সে যাই করছে তাতেই ভুল হচ্ছে। তার উপর বড় ভাইয়ের সবকিছুতে এমন কর্তৃত্ববাদী আচরণ তাকে যেনো বার বার মনে করিয়ে দেয় সে নাজায়েজ, তার এই পৃথিবীতে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে অথচ জয়ীর কোনো খোঁজখবর নেই। তার বাড়িতেও লোক পাঠিয়েছিল সেখান থেকেও একই খবর। জয়ীর বাড়ির মানুষও জয়ীকে পাচ্ছে না। সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজ করেছে জয়ীতাকে। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। কী করবে কিছুই বুঝতে পারে না।
এদিকে ক’দিন ধরে খালেক সাহেব পল্লবকে কল দিয়েই যাচ্ছে কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। একবারের জন্যও সে কল ধরেনি তার। জয়ীতার মুখের দিকে তাকালেই তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। সে নিজেই সিদ্ধান্ত নেয় পল্লবের সাথে দেখা করতে ঢাকা যাবে সে। জয়ীতাকে তার সংসারে ফিরিয়ে দিতে হলে আগে বুঝতে হবে পল্লবের মানসিক অবস্থা কেমন। সেকি সত্যিই জয়ীতাকে ভালোবাসে না নাকি অন্য কোনো সমস্যা?
আজ সকালেও কয়েকবার কল দিয়েছে পল্লবের নাম্বারে। কল্লোলের নাম্বারেও দিয়েছিল। কল্লোল রিসিভ করে টুকটাক কথাবার্তা বললেও পল্লব একবারের জন্যও তার কল রিসিভ করেনি।
পল্লব ইচ্ছে করেই খালেক সাহেবের কল রিসিভ করে না। পল্লবের ফোনে যখন খালেক সাহেবের কল ভেসে ওঠে তখনই পল্লবের মাথায় শুধু একটা দৃশ্যই ঘোরে যে সে তার মায়ের নাজায়েজ সন্তান। এই লোকটার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এই লোকটার সাথে একটা মিথ্যে বন্ধনে সে জড়িয়ে আছে। এই মানুষটির কাছে তার জন্মের এই সত্যটুকুকে অন্ধকারে রাখতে একদমই মন চায় না তার। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে খালেক সাহেবের কাছে সব সত্যি সে স্বীকার করবে। এরপরও যদি তার মনে হয় সে তাকে ছেলে হিসেবে স্বীকৃতি দিবে তবেই সে তাকে বাবা বলে ডাকবে । নয়তো না। একদিকে নিজের জন্ম পরিচয় অন্যদিকে জয়ীতাকে হারানোর কষ্ট সবমিলিয়ে মানসিকভাবে খুব অস্থির হয়ে পড়ে পল্লব।
সে মনে মনে আর একটা সিদ্ধান্ত নেয় তার আম্মি তাকে যাই বলুক সে জয়ীকে খোঁজার জন্য পুলিশের সাহায্য নিবে। নইলে তার একার পক্ষে জয়ীকে খুঁজে পাওয়া কখনই সম্ভব না। আজ রাতেই তার আম্মিকে সবকিছু জানাবে। সে মানলে মানবে না মানলেও তার কিছু করার নেই।
জয়ীতার এখানে দিনগুলো খুব ভালো কাটছে। নতুন একটা সীম কিনেছে। তার মায়ের সাথে মাঝেমধ্যে কথা হয়। তাকে বলেছে এক বন্ধুর বাসায় আছে। সে কোথায় আছে এ কথা আর কাউকে জানাতে মানা করেছে জয়ী। পল্লবকে তো একেবারেই না। খালেক সাহেবও যেনো নিঃসঙ্গতা ভুলে এক নতুন জীবন পেয়েছে। আজ জয়ীতাকে নিয়ে সে তার খামারে এসেছে। বিশাল মাছের ঘের। ঘেরের চারপাশে সবুজ শাকসবজির আবাদ করেছেন খালেক সাহেব। জয়ীতার এখানে এলে মন ভালো হয়ে যায়। শীতের সবজী দিয়ে ভরপুর চারপাশে। এখানে ছোট ছোট দুইটা বাঁশের মাচা দিয়ে তৈরি ঘরও আছে। সেখানে বসে বঁড়শী দিয়ে মাছ ধরেন খালেক সাহেব। আজকে জয়ীকেও একটা বঁড়শী দিলো মাছ ধরতে। খুব ভালো লাগছে জয়ীতার। মনে হচ্ছে সে তার বাবাকে যেনো ফিরে পেয়েছে।
এ ক’দিনে খুব আন্তরিকতা তৈরি হয়েছে খালেক সাহেবের সাথে তার। আজ হঠাৎ সাহস করে জয়ী বলেই ফেলল, বাবা, আম্মির সাথে আপনার সম্পর্কটা এমন হলো কেনো? আপনি এত ঠান্ডা মানুষ! আপনাদের তো ডিভোর্সও হয়নি। তাহলে আলাদা থাকছেন কেনো আপনারা?
খালেক সাহেব এতদিন পরে আবার একই প্রশ্ন শুনে কিছুসময় চুপ থাকলেন।
জয়ী বুঝল সে হয়ত ভুল করেছে এ কথা জিজ্ঞেস করে। উনাকে এ কথা জিজ্ঞেস করা তার উচিত হয়নি। সে লজ্জিতভাবে বলল,
– আমি দুঃখিত, বাবা। আপনাকে মনে হয় এই ব্যক্তিগত কথাগুলি আমার জিজ্ঞেস করা ঠিক হয়নি। আসলে কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলাম। আপনার মতো এমন একজন ভালো মানুষ সবকিছু ছেড়ে এভাবে একা এসে নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন। তাই খুব খারাপ লাগছিল। এজন্যই মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।
– না,না। তোমার এখানে লজ্জিত হওয়ার কিছু নেই। তুমি আজকে আমাকে যে কথা জিজ্ঞেস করেছ এই সেইম প্রশ্ন অনেকেই জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু কাউকেই আমি সদুত্তর দিতে পারি না। অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয় কিন্তু বলার জায়গা নেই। কল্লোল আর পল্লব ওরা ওদের মা বলতে অজ্ঞান। আমিও চাই ওরা ওর মায়ের কাছাকাছি থাকুক। মা ছাড়া সন্তানের বেড়ে ওঠা কতটা কষ্টের সেটা আমি ছোটবেলা থেকে অনুভব করেছি। মাত্র সাত বছর বয়সে মাকে হারিয়ে আমি যে কষ্টের সাগর পাড়ি দিয়েছি আমি চাই না ওরা কখনো তেমনটা করুক।
– কিন্তু বাবা, এটা ঠিক যে ওদের খারাপ থাকতে হচ্ছে না কিন্তু ওরা বাবাকেও তো কাছে পাচ্ছে না। সেই কষ্টটাও কি কম নয়? বাবাকে ছাড়া থাকা অনেক কষ্টের। প্রতিনিয়ত আমি সেটা ফিল করি।
– কষ্ট তো হয়ই। কিন্তু একজন মা যেভাবে একটা সন্তানকে মানুষ করতে পারেন একজন বাবা কিন্তু সেভাবে পারেন না। তাছাড়া ওরা হয়তো কখনো আমাকে সেভাবে ফীলই করে না। ওর মা সেই সুযোগটা ওদের কোনোদিনই দেয়নি। আমিও চাই না আমার জন্য ওরা কষ্ট পাক। আমি সবসময় দূর থেকে ওদের জন্য দোয়া করি। ওরা ভালো থাকুক, বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন খালেক সাহেব।
– সরি বাবা, এসব পুরনো কথা মনে করে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
– নারে মা, মাঝে মাঝে এসব কথা বলে নিজেকে হালকা করা যায়। আমার সেই হালকা করার জায়গাটাও নেই কত বড় দুর্ভাগা আমি দেখ। সন্তানদের কাছে পাবার বা ওদের আমার কথা শোনার সময় নেই। স্ত্রী সে তো থেকেও নেই।
আর কাছের তেমন আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। আছে একটা বড় বোন সেও থাকে সেই দূর দেশে। এ ক’দিন তোকে কাছে পেয়ে মনে হচ্ছে আমি একটা অন্য ভুবনে আছি। আমার বাসায় কোন গেস্ট আসে না। আসে যাদের প্রয়োজন হয়। তারা আসে প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়, আবার চলে যায়। আমার সাথে মন খুলে কথা বলার কারো সময় হয় না।
আজ তুই যখন জানতে চাইলিই তোর কাছে একটু জীবনের গল্প শেয়ার করি।
মা মারা যাওয়ার পরে আমার আব্বা আবার বিয়ে করলেন। সে ঘরে আমার আরো ভাই বোন হলো। আব্বা ব্যস্ত থাকতেন তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের সংসার নিয়ে। মা না থাকলে জীবনটা যেভাবে চলে ঠিক সেভাবেই আমারও কেটেছে। ব্যতিক্রমী বা মিরাকল কোনোকিছু ঘটেনি আমার লাইফে। আমি খুব ভালো স্টুডেন্ট
ছিলাম। শিক্ষকরা খুব ভালোবাসতো আমাকে।
আমার বড় বোনও আমাকে খুব ভালোবাসতো৷ এখনো বাসে। অনেক বয়স হয়েছে তার। বয়সের ভারে এখন চাইলেও আসতে পারে না। ছেলে মেয়ের সাথে অস্ট্রেলিয়াতে থাকে। খুব অল্প বয়সে স্কুল পাশ করার আগেই ওকে বাবা বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল। বছরখানেক সংসার করার পরে সেখানে ওর সংসারটা টিকল না। এরপরে আবার বাবার বাড়িতে। বড় আপারও মেধা খুব ভালো ছিল। আমি তখন ঢাকাতে আমার ছোট মামার বাসায় থেকে পড়াশুনা করছি। পরে বাবাকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে বড় আপাকে আবার স্কুলে ভর্তি করা হল। আমার থেকে নিচের ক্লাসে পড়ত আপা। আমি কলেজে যাবার পর যখন টিউশনি করে কিছু রোজগার করা শুরু করলাম তখন আপাকেও ঢাকা নিয়ে গেলাম। আমি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম আপা পড়তো তখন কলেজে। আমি আর বড় আপা ছোট একটা বাসা ভাড়া নিলাম।
আমার এক ফ্রেন্ড মাঝে মাঝে আমার বাসায় আসত। ওরা বেশ সম্পদশালী হলেও ওর মধ্যে অহংকারের ছিটেফোঁটাও ছিল না। কীভাবে কীভাবে ওদের মধ্যে সম্পর্ক হল আমি কিছুই টের পায়নি । একদিন ও-ই আমার কাছে আপাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। আমি কিছুটা ঘাবড়ে যাই। ওকে আপার অতীত সম্পর্কে জানাই। ও সব কিছু আগে থেকেই নাকি জানে এবং আপাই ওকে বলেছে। পরে আপার সাথে কথা বলে বুঝলাম আপার কোনো আপত্তি নেই।
কিছুদিন পরে আমার বন্ধু তার মা বাবা নিয়ে আসে আমার সাথে কথা বলার জন্য। উনারা খুব মাটির মানুষ ছিলেন। আপা আমার বন্ধুর থেকে বয়সে দু-তিন বছরের বড় ছিল। তাতে তাদের কোনো আপত্তি ছিল না। এর পরে দুই পরিবারের সম্মতিতে জমকালো আয়োজনে আপার আর আমার বন্ধু আফজালের বিয়ে হলো। বিয়ের কিছুদিন বাদেই আফজাল আপাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী হয়।
দুই ছেলে আর এক মেয়ের মা আপা। আফজাল মারা গিয়েছে বছর দু’য়েক আগে। আপার সাথে যখনই কথা হয় তার একটাই কথা আমি যেনো অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাই। ভাগ্নে-ভাগ্নিরাও চায় আমি ওদের কাছে যেয়ে থাকি। আপাতো ফোন ধরলেই কান্না শুরু করে। আমার একা একা এভাবে থাকাটা তার কখনোই পছন্দ না।
এই পৃথিবীতে এখন আপনজন বলতে এই একটি মানুষই আছে আমার জন্য যার চোখ থেকে পানি ঝরে। নিঃস্বার্থভাবে যে আমাকে নিয়ে ভাবে।
আপার বিয়ের পর ভারমুক্ত হলাম। আমি উঠে পড়ে লেগে গেলাম বিসিএসের জন্য। এবং আল্লাহর রহমতে আমি টিকেও গেলাম।
চাকরি পাবার পরে প্রায় বছর পাঁচেক পরের কথা। তখন কৃষি মন্ত্রণালয়ের একটা বড় পদে আছি। তখন সাজেদার বাবা মানে তোর নানা শ্বশুর কৃষি মন্ত্রী ছিলেন। প্রফেশনের খাতিরে উনার সাথে আমার প্রায়ই নানান ধরনের মিটিং আলাপ-আলোচনা, যোগাযোগ হতো। মাঝে মাঝে তার বাসাতেও আমরা দাওয়াত পেতাম। উনি বেশ ভালো লোক ছিলেন। তখন জানতাম না উনি আমাকে কেনো খুব পছন্দ করতেন। পরে অবশ্য বুঝেছি ওনার পছন্দের কারণ।
উনি কারণে অকারণে একটু কোনো উপলক্ষ পেলেই উনার বাসায় আমাকে দাওয়াত করতেন। আমারও ব্যাপারটা খুব ভালো লাগত। আসলে আমারও কোনো আপনজন ছিল না যে আমাকে দাওয়াত করে খাওয়াবে। বড় আপাও ততদিনে অস্ট্রেলিয়ায় চলে গিয়েছেন। তাছাড়া একজন মিনিস্টারের প্রিয় পাত্র হওয়া কম কথা তো নয়। আমার ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই আমাকে ঈর্ষা করতেন। অনেকে আবার এটা নিয়ে ঠাট্টাও করতেন। আমি অবশ্য ব্যাপারটাকে এনজয় করতাম।
এভাবেই আমার পরিচয় হয় সাজেদার সাথে। সাজেদার মাও বেঁচে ছিলেন না।সাজেদা তখন মাত্র ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারি যে তোর নানা শ্বশুর কেনো আমাকে তার বাড়িতে এত বারবার দাওয়াত দিতেন৷ আমার সাথে এত ভাল সখ্য গড়ে তুলেছিলেন। তিনি আসলে আমাকে মনে মনে সাজেদার জন্য পছন্দ করেছিলেন। সাজেদার বড় বোন মাজেদা আপা সাজেদার থেকে বেশ সিনিয়র। ওনার বড় ছেলে প্রায় সাজেদারই সমবয়সী। সাজেদা আমার শ্বশুর-শাশুড়ির বুড়ো বয়সের সন্তান। তাই ছোটবেলা থেকেই অতি আদরে অনেকটা বাঁদর স্বভাবে চলে গিয়েছিল। খুব অহংকারী। কাউকে তোয়াক্কা করত না এবং অনেক বেশি স্মার্ট এবং ফ্যাশন সচেতন ছিল। তাই ওকে নিয়ে আমার শ্বশুরের খুব দুশ্চিন্তা হতো। এজন্যই হয়তো উনি মেয়ের জন্য আমার মতো একজন নিরীহ প্রাণী খোঁজ করছিলেন।
যাই হোক আমিও গোবেচারা কীভাবে কীভাবে যেন সাজেদার প্রেমে পড়ে যাই। না পড়ার অবশ্য কোনো যুক্তিও নেই। আমারও বিয়ের বয়স ততদিনে পার হয়ে যাচ্ছিল। সাজেদা উঠতি বয়সের সুন্দরী নারী। সবচাইতে বড় কথা মন্ত্রীর মেয়ে। সাজেদার কাছে ভালোবাসার কথা প্রকাশ করার কখনো সাহস পাইনি। হঠাৎ একদিন দেখি মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সাজেদা নিজে এসে আমাকে তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করল।
এই ঘটনার তিন মাস পরেই আমাদের বিয়ে হয় । তোর শাশুড়ি আমাকে ডাকত বুড়ো ভাম বলে। কারণ তার থেকে আবার বয়সের পার্থক্যটা বেশ ভালোই ছিল। ব্যাপারটা আমার কাছে খারাপ লাগত না। বিয়ের প্রথম বছরটা খুব ভালো কেটেছিল আমাদের।
জয়ীতা খেয়াল করল কথাগুলো বলতে বলতে খালেক সাহেব যেন অন্য জগতে ততক্ষণে। পানির দিকে তাকিয়ে ছল ছল নয়নে সে কথাগুলো বলেই যাচ্ছে।
চলবে……