সম্পূর্ণা-৪
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু
হাসান মঞ্জিলে খুশির আমেজ! বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে দাওয়াতের কাজ সম্পন্ন। এবার শুধু সানাই বাজা বাকী। রেদোয়ান হাসান ভীষণ খুশি! বহুদিন পর তার সংসারে আলো আসবে, ঘরটা কানায় কানায় পূর্ণ হবে, যেন সব আঁধার বিলীন হয়ে সীমাহীন সুখে ভরে উঠতে যাচ্ছে তাঁর ঘর। এই সুখ, এই আনন্দ আর খুশি প্রকাশের ভাষা তাঁর জানা নেই। নোভাকে তিনি খুব ভালোভাবে চিনেন। তার স্বভাব-চরিত্র, আচার-আচরণ সবকিছুতে একটা আকর্ষণ আছে। কীভাবে মানুষের মন জয় করতে হয়, সেই চমৎকার গুণটাও লক্ষনীয়। সবকিছু জেনেই আদনানকে চেপে ধরেছেন তিনি, বাধা দেয়ার কোনো পথই আর ছেলের সামনে খোলা রাখেননি। তিনি বিশ্বাস করেন, দাম্পত্য জীবন শুরুর কোনো এক প্রান্তে পৌঁছে, ছেলে তার বাবার দু’টো হাত যত্নে আঁকড়ে ধরে বলবে,
“ধন্যবাদ তোমায় বাবা, এমন একজন সঙ্গিনীকে জীবনে এনে দেয়ার জন্য!”
তিনি জানেন, একদিন ছেলে মুখফুটে এই কথা বলবেই। খুব করে সেদিনের অপেক্ষায় রইলেন।
অফিসে বসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজ করছিল নোভা। আজকের মধ্যেই রিজাইন করবে সে। সব আলাপ মোটামুটি কনফার্ম। এবার শুধু বসকে জানানো বাকী! ডেস্কের সামনে আবারও জিসানের আগমন ঘটলো। তবে তার চেহারার গাম্ভীর্য ভাব স্পষ্ট। নোভা কয়েক সেকেন্ড সেটা লক্ষ্য করে বলল,
“কিছু বলতে চান?”
“শুনলাম আপনার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্রটা কে শুনি?”
“পাত্র আপনাদের পরিচিত। বিয়েতেই দেখবেন। অগ্রিম দাওয়াত রইলো। কার্ডটা আপনার বাসাতেই পাঠিয়ে দিব।”
মুচকি হেসে নিজের কাগজ গুছাতে শুরু করলো নোভা। জিসান আবারো বলল,
“তা, চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন যে?”
“দায়িত্ব বাড়বে। মেয়ে থেকে বউমা হবো, কারও অর্ধাঙ্গিনী হবো, সেসব দায়িত্ব সামলে এই চাকরিটা করা আর হবে না। তাই…!”
“বাহ্, একসাথে এত দায়িত্ব! আমাদের ব্রাদার ইন লো কী প্রফেশনে আছেন? মানে, কীভাবে আপনার সাথে পরিচয় হলো?”
“আপনি এতকিছু জানতে চাইছেন কেন? আমার বিয়ের খবর শুনে খুশি হোননি? আপনাদের মতো উদার মনের কলিগদের চাপ কমিয়ে দিলাম তো! জম্পেশ খাওয়া-দাওয়ার দিকে মনোযোগ দিন।”
“এমনি জানতে চাইছি!”
নোভা ঠোঁট চেপে হাসলো। আচ্ছা জব্দ হয়েছে। আর পিছনে লাগার সাহস পাবে না। অনেক তো ক’টু কথা শুনিয়েছে লোকটা! ঘড়িটা দেখে সবকিছু হাতে নিয়েই চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। জিসানকে বলল,
“বিয়ের দিন দেখা হচ্ছে তো?”
“হ্যাঁ অবশ্যই। অভাগা লোকটাকে দেখবো না? তা-ও হয়!”
“তিনি অভাগা কিনা জানি না, তবে আমি অভাগী নই এটা নিশ্চিত হয়ে যান। শুনুন, স্বাস্থ্য কখনো কোনো দোষ-গুণের মধ্যে পড়ে না, কিংবা ফিট বডি নিয়েও মানুষ সুখী হতে পারে না। টেলিভিশনের পর্দায় দেখুন, দীপিকা, কাটরিনা, কারিনা এরা প্রত্যেকেই যথেষ্ট স্লিম! কিন্তু ভেতর খুঁজে দেখুন, শারিরীক দিকে এরা যতটা ফিট মানসিক দিক থেকে আনফিট! এখানেই তারা অসুখী! মানুষের বাইরের রূপ দেখে তার ভেতরটা বিচার করবেন না! মন-মানসিকতা সবার এক হয় না।”
নোভা দ্রুত বসের কেবিনের দিকে এগোলো। জিসান শার্টের টাই টেনেটুনে পিছু ঘুরতে গিয়েই আদনানের মুখোমুখি পড়লো। হাসিমুখেই সালাম দিয়ে বলল,
“স্যার আপনি! আজ হঠাৎ অফিসে?”
“বাবার কাছে এসেছি।”
“স্যার ভেতরেই আছেন।”
আদনান এগোতে গিয়েই পিছিয়ে এসে জিসান সাহেবকে আটকে দিল। জিসান বলল,
“কিছু বলবেন স্যার?”
“ওই মেয়েটা কে ছিল?”
“আর বলবেন না, আমাদেরই কলিগ। দেমাগ দেখলে মনে হবে, কোটিপতির মেয়ে। হাবভাব চাল-চলনে যথেষ্ট স্মার্ট। কিন্তু হাতির মতো মোটা। নিজেকে নিয়ে তার বড়াইয়ের শেষ নেই। এতদিন বিয়ে হয়নি এই বডি ফিটনেসের কারণে! শুনেছি আগামী সপ্তাহে বিয়ে। কোন অভাগার কপাল পুড়লো কে জানে!”
“কেন? তার চরিত্র ভালো না? মানুষ হিসেবে খারাপ?”
“না স্যার! তা হবে কেন? একটু মোটা হওয়ার কারণে অফিসের সবাই-ই একটু খুঁচিয়ে কথা বলে ওনার সাথে! প্রথম প্রথম তিনি বিরক্ত হতেন, কিন্তু ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হলেন। লোকের কথায় কান দেন না। বড়োজোর গলা উঁচিয়ে বলেন, আমি মোটা তাতে আমি দুঃখী নই। বরং নিজেকে নিয়ে গর্বিত। কেউ আমাকে ভালোবাসুক কি নাই বাসুক, তাতে আমার কী? আমি নিজেই নিজেকে ভালোবাসি। এজন্য এই ফিগার নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই। বরং আলহামদুলিল্লাহ! বিধাতা আমাকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে গড়ে নিয়েছেন। তিনি আমাকে ভালোবেসে এইরূপে সৃষ্টি করেছেন, আমি কেন সেই সৃষ্টিকে অপমানের চোখে দেখবো?”
“তার কথায় যথেষ্ট লজিক আছে। বুদ্ধিমান যে সে কখনো বাহ্যিক চাকচিক্যকে মূল্যায়ন করবে না বরং অভ্যন্তরীণ গুণটা খুঁজে বের করবে।”
জিসান হতভম্ব! চেয়েছিল একটু নিজের স্মার্টনেস তুলে ধরে নোভাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে হেয় করবে। অথচ আদনানের কথা শুনে নিজেকেই তার বকতে ইচ্ছে করছে।
*****
রিজাইন লেটারটা হাতে নিয়ে নোভার দিকে তাকিয়ে আছেন রেদোয়ান হাসান। মেয়েটার মধ্যে আজ বড্ড জড়তা টের পাচ্ছেন তিনি। এই চাকরিটার উপর সে কতটা ডিপেন্ডেড তিনি তা জানেন তবুও তাকে তার চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হলো। বাড়ির বউ অফিসের সামান্য বেতনের কর্মচারী এটা কেমন দেখায় তাই বাধ্য হয়েই নোভাকে চাকরি ছাড়তে বলেছেন তিনি। নোভা সেটা হাসি মুখেই মেনে নিয়েছে। কারণ ভদ্রলোক তার সবচেয়ে বড়ো উপকারটাই করেছেন। নোংরা কথার হাত থেকে বাঁচিয়ে তাকে সম্মানের আসনে বসাচ্ছেন, এর থেকে বড়ো প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! দরজায় ঠকঠক আওয়াজ তুলে অনুমতি নিল আদনান।
“আসবো বাবা?”
নোভা রীতিমতো চমকে গেছে। চোখদুটো বড়ো বড়ো করে মাথানিচু করে রেখেছে। রেদোয়ান হাসান অনুমতি দিয়ে বললেন,
“বদলালি না! বাবার কাছে আসতে অনুমতি নিতে হবে কেন?”
“যতই হোক, এটা তোমার নিজস্ব এড়িয়া! এখানে কাজ বেশি, আত্মীয়তা কম।”
ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কথাগুলো বলছিল আদনান। নোভাকে দেখেও কিছু বললো না। হাসিমুখেই বাবার সাথে পরবর্তী আলাপ চালিয়ে গেল। নোভা জড়োসড়ো হয়ে নিজের চেয়ারে বসে রয়েছে। অনুমতি ছাড়া উঠতেও পারছে না। কেমন অস্বস্তি লাগছে তার। কথাবার্তার এক পর্যায়ে আদনান নিজেই বলল,
“অনুমতি দিলে নোভাকে সাথে নিয়ে যেতাম। বাচ্চারা অপেক্ষা করছে।”
“ঠিক আছে। ফেরার পথে ওকে ওদের বাসায় পৌঁছে দিস।”
বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে নোভা। সেদিন বললো বাচ্চাদের কথা বাবাকে না জানাতে অথচ আজকে বাবার সামনেই বলছে, বাচ্চাদের সাথে দেখা করতে যেতে। এই লোকটার ভেতরে কী যে চলছে কে জানে! বাহির-ভেতরের আচরণ কেন যেন মিলাতে পারছে না নোভা! বড্ড অদ্ভুত লাগছে। রেদোয়ান হাসান রিজাইন লেটারটা রেখে নোভাকে বললেন,
“যাও মা, এবার নিজের দায়িত্ব সামলাও। অফিসে তোমার জায়গায় অন্য কাউকে নিয়ে নিব।”
নোভা কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আদনান দ্রুত বাবার থেকে বিদায় নিল। পিছন পিছন নোভাও এগোলো। অফিসের মাঝখানের ফাঁকা অংশ দিয়ে ধীরপায়েই হাঁটছে নোভা। কেমন যেন একটা জড়তা কাজ করছে মনে। বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করা উচিত! মুখ খোলার আগেই আদনান হাসিমুখে বলল,
“প্রতি সপ্তাহে জারা আর নোরা বাসায় এসে বাবার সাথে খেলে। এজন্য বাবাকে ম্যানেজ করা এতটাও কঠিন না। সকালে একবার ওদের দেখতে গিয়েছিলাম, নোরা বায়না ধরেছে আপনাকে দেখবে। বাবা কী যে বুঝিয়েছে কে জানে! দু’জনেই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য।”
কথা বলতে বলতে জিসানের ডেস্কের কাছাকাছি আসলো দু’জনে। জিসান আগ বাড়িয়ে বলল,
“আরে ম্যাডাম চলেই যাচ্ছেন তবে? শুভ কামনা দিতে পারছি না, তবে বদদোয়াও দিচ্ছি না। সুখী হোন আপনি।”
নোভা ঠোঁট চেপে হাসলো। জবাবটা দিতে বড্ড ইচ্ছে করছে কিন্তু আদনানের সামনে এইভাবে এমন পরিস্থিতিতে পড়ে বাধ্য হয়ে চুপ থাকতে হচ্ছে। কিছু বলার আগেই আদনান ফট করে বলল,
“শুভ কামনার দরকার নেই জিসান সাহেব। দোয়া কিংবা বদদোয়া তাও চাইছি না। মানুষকে মানুষ মনে করে একটু সম্মান দিতে শিখুন, এতে অপরপক্ষ খুশি না হয়ে থাকতে পারবে না। একটু আগে কী যেন বলছিলেন, কোন অভাগার কপাল পুড়েছে? আমার কপালটা একটু ভালো করে দেখুন তো, কোন জায়গাটা পুড়ে কালসিটে দাগ পড়েছে?”
জিসান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে আদনানের দিকে। কী জবাব দিবে খুঁজেই পাচ্ছে না। আদনানের কথাও বোধগম্য হচ্ছে না তার। আদনান মুচকি হেসে আবারও বলল,
“আমার কপালটা পুড়েনি তাই দাগটা আপনার চোখে পড়ছে না। ভবিষ্যতেও পুড়বে না আশাকরি! আপনার ভাষ্যমতে যে ব্যক্তি অভাগা, আমার কাছে সে ব্যক্তি সুখী। কারণ আমি বর্তমানটা বুঝি। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারি না, তাই সেটা নিয়ে আপাতত কোনো চিন্তা করছি না। তবে আপনাকে বলি, কাউকে অপমান করার আগে নিজের দিকে একবার দেখবেন, উপরে থুতু ছুঁড়ে মারলে সেটা কিন্তু নিচের দিকেই পড়ে! বুঝতে পারছেন তো নিশ্চয়ই?”
“স্যার! ইয়েএ মানে…! আ’ম সরি স্যার।”
“নোভার সাথে যে ব্যক্তির বিয়ে ঠিক হয়েছে, যার জীবনে সে জড়াতে যাচ্ছে, অভাগা বলুন কি ভাগ্যবান, সেই ব্যক্তি আর কেউ না; আমিই। আপনাদের বসের একমাত্র ছেলে! মেহরাব হাসান আদনান। আর কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতে, নোভাকে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেন না। সে চুপ থাকলেও আমি থাকবো না। মাইন্ড ইট…!”
গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অপলকে আদনানকে দেখছে নোভা। পুরুষ মানুষের মধ্যে এতটা ভালো গুণ লুকিয়ে থাকতে পারে জানা ছিল না তার। সর্বক্ষেত্রে মেয়েদের সম্মান দিতে পারে এমন পুরুষ এই সমাজে খুবই কম আছে। আদনানকে সে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। ধীরে ধীরে সম্মানটা যেন বেড়ে যাচ্ছে তার। সংকোচ থাকলেও মনোযোগ তার আদনানের দিকে। গাড়ির দরজা খুলে নোভার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এত কী ভাবছেন? উঠুন। বাচ্চারা অপেক্ষা করছে।”
“আমার স্কুটার!”
“ওটা পৌঁছে যাবে জায়গামতো। আপনি আসুন তো। দেরী হলে শেষে ওরা কান্না জুড়ে দিবে।”
“আপনি ওদেরকে বাসায় আনলেই পারেন। ওখানে রেখেছেন কেন?”
“বাসায় কে দেখবে? আমি ওসবে অভ্যস্ত নই। আগে বাচ্চাদের মা’কে বাসা অবধি নিই, তারপর বাচ্চাদেরও নিয়ে আসবো। কী, হবে?”
লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললো নোভা। ধীরপায়েই গাড়িতে উঠে সিট বেল্ট বেঁধে নিল। আদনানের শেষ কথায় অদ্ভুত সম্মোহন লুকিয়েছিল। খুব কাছের সেই কথা, হৃদয়ে নাড়া দিয়ে উঠে। হৃদস্পন্দন বাড়ানোর সাথে সাথে বাড়িয়ে দেয়, দায়িত্ববোধ। মনে মনে এক স্বচ্ছ প্রার্থনায় ডুব দেয় নোভা। এই নির্ভেজাল মানুষটা শুধু তার হোক, পুরোপুরি তার! সম্পর্কটা দ্রুত জোড়া লাগুক খোদা, এমনটাই যেন বিড়বিড় করলো নোভা। অন্তত তার ঠোঁটের ভাবভঙ্গি আর মুচকি হাসি সেটাই প্রমাণ করে।
*****
আশ্রমের ভেতরে প্রবেশ করে জারা আর নোরাকে সাথে নিয়ে আসলো আদনান। ওদেরকে একটু বাইরে কোথাও থেকে ঘুরিয়ে আনার জন্যই আজকের প্রোগ্রাম। অনেকদিন ধরে বায়না ধরছে দু’জনে, একই জায়গায় থাকতে থাকতে বিরক্তই ওরা। বাচ্চারা চায় চারপাশে ছুটতে, দৌড়াতে! অথচ আশ্রমে থাকা এইসব বাচ্চারা সেইসব সুখ থেকে অনেকটা দূরে। এখানে তারা সবকিছু পেলেও নিজস্ব স্বাধীনতাটা খুঁজে পাচ্ছে না। পাচ্ছে না, বাবা-মায়ের সান্নিধ্য, আদর, স্নেহ, মায়া, মমতা। ফলস্বরূপ দিনের বেশিরভাগ সময়ই কাটছে, পড়াশোনা আর অল্পস্বল্প খেলাধুলার সাথে জড়িয়ে। মাঝেমধ্যে যাদেরকে দত্তক নেয়া হয় তারাই সুন্দর পরিবার পায়, বেঁচে থাকার আশ্রয় পায়, পায় মাথার উপর ছাদ এবং ছায়াও।
রেস্টুরেন্টে মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও আদনানকে দেখে দ্রুত ছুটে আসলো সায়েম। সালাম দিয়ে ঝটপট একটা স্পেশাল টেবিলের কাছে নিয়ে গেল। জারা আর নোরাকে দু’পাশে নিয়ে বসলো নোভা। গত কয়েকদিন আগেও আদনান, তার পরিবার, তাদের দৈনন্দিন জীবনের শৃঙ্খলা নিয়ে বড্ড দুঃশ্চিন্তা ছিল নোভার মনে। তবে আজকের অফিসের টুকরো আলাপনে সেসব দুঃশ্চিন্তা উবে গিয়ে তাৎক্ষণিক ভালো লাগায় অন্তরাত্মা ছেয়ে গেল তার। ভালো লাগা হোক কিংবা শ্রদ্ধাবোধ, কোনো এক অজানা কারণে আদনানের কিছু কিছু কাজে বারংবার মুগ্ধ হচ্ছে নোভা নিজেও। মানুষ সম্পর্কে, কিংবা তার সম্পর্কে মানুষের যে ভুল ধারণা ছিল, ক’টু কথা ছিল, সবই এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ এসেছে জীবনে, তাকে সম্মানের সাথে আগলে নেয়ার জন্য। পৃথিবীর সব মানুষ এক হয় না, সব রঙের সৌন্দর্যও এক হয় না। পার্থক্য আছে বলেই ভালো-মন্দের দোষ-গুণ খুঁজতে যায় মানুষ। মানুষ হিসেবে মানুষকে ভালোবাসার যে সুপ্ত একটা মন দরকার, নোভা টের পেল সেই সুপ্ত মনের মানুষটা তার সামনে বসা পুরুষ। তাকে ঠিক পুরুষ বলা যায় না, উত্তম পুরুষ কিংবা সুপুরুষ তাকে উপাধি দেয়া মানানসই। যার চেহারার মধ্যে পুরুষালি একটা চমৎকার ভাব মিশে থাকে সবসময়। মনে হয়, সে পারফেক্ট! একদমই পারফেক্ট। শুধু মানুষ হিসেবে নয়, একজন ভালো বাবা এবং জীবনসঙ্গী হিসেবেও।
হুটহাট এই অদ্ভুত ভাবনা থামলো আদনানের হাতের ইশারাতে। চোখের সামনে হাত নাড়া পেয়েই চমকে তাকালো নোভা। আদনান মেন্যু কার্ডটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আজ আপনার পছন্দের খাবারটাই অর্ডার হবে! বলুন কী খাবেন? এখানে সব ধরনের খাবার পাওয়া যায়।”
নোভা কিছু বলার আগেই জারা আর নোরা মেন্যু কার্ড নিয়ে রীতিমতো যু’দ্ধ শুরু করে দিল। একজন একটা খাবে, অন্যজন আরেকটা খাবে। বিস্মিত চোখে দুই মেয়ের দিকে দৃষ্টি দিল সে। আদনান জবাবে বলল,
“ওরা এই রেস্টুরেন্টের খাবারে অভ্যস্ত! এই দৃশ্য প্রায়ই চলে।”
অন্য একটা মেন্যু কার্ডে চোখ বুলালো নোভা। পছন্দের খাবার মানেই, চকলেট, কেক, সুইটস, এছাড়াও অন্যসব খাবারই মোটামুটি পছন্দ তার। হুট করে কী অর্ডার দিবে সেটা নিয়েই মারাত্মক দ্বিধায় ভুগছিল নোভা। তার এমন হাবভাব আর দ্বিধা দেখে মুচকি হাসলো আদনান। বলল,
“চিল। জীবনকে পুরোপুরি উপভোগের সময় এটাই। যা কিছু পছন্দ, যা কিছু পাওয়াতে শান্তি, তা থেকে নিজেকে দমিয়ে রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনি নির্দ্বিধায় নিজের পছন্দের খাবারটা অর্ডার করুন। দেখি, দু’জনার পছন্দ-অপছন্দের মিল আছে কি-না।”
“যদি মিল না থাকে?”
শান্ত চোখে প্রশ্ন করলো নোভা। চোখে চোখ পড়লো। কোনোপ্রকার বিরক্তি প্রকাশ করলো না আদনান। বরং স্বচ্ছ এক হাসি ফুটালো ঠোঁটে। বলল,
“মানিয়ে নিব। সবকিছু পারফেক্ট হতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। পছন্দ-অপছন্দ এগুলো ব্যক্তি স্বাধীনতা! মানুষে মানুষে যেমন পার্থক্য আছে, পছন্দ-অপছন্দের ক্ষেত্রেও আছে। তার মানে এই না যে, অন্যের পছন্দের জিনিসটা আমার অপছন্দ দেখে নাক সিটকে তাকে তুচ্ছ করে দিব! সবার পছন্দ এক হবে, চাহিদা এক হবে, এমন নিয়ম কি কোথাও লেখা আছে?”
নোভা দু’দিকে মাথা। নির্ভার প্রাণোচ্ছল হাসির মাধ্যমে আদনানের কথার মর্মার্থ উদ্ধার করে ফেললো কয়েক সেকেন্ড ব্যবধানেই। আনমনেই মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো,
“মানুষের অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য আর অপমান হজম করেছি! একটা সময় মনে হতো, ধরনীতে আসাটাই বুঝি ভুল। এ জীবন আমার জন্য নয়, কেউ নেই যে হাসিমুখে বলবে; তুমি কেবল নিজের জন্য বাঁচো। প্রতিনিয়ত শুনেছি, শুধু মামা-মামীর বোঝা নই, স্বাস্থ্যবতী মেয়েরা সংসারের অভিশা’প। তাদের খাওয়ার পরিমাণ বেশি, জায়গার পরিমাণ বেশি, এমনকি পোশাক-আশাকের ব্যাপারটাও। সবকিছুকে প্বার্শবর্তী মানুষ চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিত, সমাজে কেবল ক’টু কথা শোনার জন্যই জন্ম হয়েছে আমাদের। কিন্তু আমি সয়ে নিয়েছিলাম। চারপাশের মানুষের আচরণ আর কানাঘুঁষাতে বুঝে গিয়েছিলাম, এ সমাজে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের বড্ড অভাব। চারিদিকে যারা আছে, সবাই একই মানসিকতার! সবাই-ই বাহ্যিক সৌন্দর্যকে খুঁজতে চায়, ভেতরটা দেখে না!”
স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো আদনান। মানুষ ভেতরে ভেতরে কতখানি ভে’ঙে গিয়েও উপরে স্বাভাবিক থাকতে পারে, হাসতে পারে, বাঁচতে পারে, তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত যেন নোভা। সামনে থাকা টিস্যু হাতে তুলে নোভার দিকে বাড়িয়ে দিল সেটা। বলল,
“ডোন্ট ক্রাই! কান্নায় দুর্বলতা প্রকাশ পায়! নিজেকে দুর্বল ভাববেন না। প্রত্যেক মানুষের আলাদা আলাদা সৌন্দর্য আছে। কারও সাথে কারও তুলনা চলে না। সৃষ্টিকর্তা যাকে যেভাবে সৃষ্টি করেছেন, সেই সৃষ্টি সেভাবেই সুন্দর। সব মানুষের সৌন্দর্য খালি চোখে দেখা যায় না, কিছু সৌন্দর্য ভেতরের চোখ দিয়ে দেখতে হয়! আপনিও সেরকমই একজন। গভীর সমুদ্রের জলে বাস করা ঝিনুকের মতো। তার বাইরেরটা যতই শক্ত আর অসুন্দরই হোক না কেন, ভেতরে থাকা মুক্তোটা কিন্তু দৃষ্টিনন্দন, দুর্লভ বস্তুর একটা! যা সহজেই পাওয়া যায় না, আর যে পায় সে হয় ভাগ্যবান। আমি মনে করি, যা কিছু দামী, যা কিছু মুল্যবান তা সবার জন্য উন্মুক্ত নয়! সেটা শুধু যোগ্য মানুষটার জন্যই গচ্ছিত রাখা হোক। বুঝতে পারছেন তো কী বলছি?”
মানুষের চিন্তাভাবনা কতখানি পজেটিভ হলে এমন সুন্দর কথা প্রকাশ পায় জানা নেই নোভার। জীবনের এতগুলো বছর পর, সে অনুভব করলো প্রেম তার অস্তিত্বে বসতী গড়ে তুলছে। জবাবে শুধু উপরনিচ মাথা নাড়লো সে। টিস্যু চেপে চোখের পানি মুছলো। অনেকদিন পর ভেতরে থাকা ভারী পাথরের বোঝাটা নেমে গেল তার। কিছু তিক্ত কথাও হাওয়ায় ভেসে যায়, যদি সেখানে একটুখানি মাধুর্য মিশিয়ে যুক্তিসঙ্গত কথার জা’ল কেউ তৈরী করে। একটা মানুষকে সম্মান দিতে, তার ত্রুটিকে খারাপ দিক থেকে বিচার না করে, পজেটিভ মনোভাব প্রকাশ করার মতো মানুষের বড্ড অভাব। দীর্ঘ পঁচিশ বছরের জ্বালাময়ী অধ্যায়ের পর নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা উপলব্ধি করলো নোভা! মনে হলো, এইটুকুর জন্যই বেঁচে থাকাটা স্বার্থক, নিজেকে ভালোবাসা স্বার্থক, স্বার্থক মানুষ হিসেবে জন্ম নেয়াটাও। বুক চিনচিনে অদ্ভুত এক ব্যথার আবিষ্কার করলো হঠাৎ! অন্তরে প্রশান্তি নিয়ে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজারও শুকরিয়া জ্ঞাপন করলো সে।
*****
চলবে…