সম্পূর্ণা-১৯

0
680

সম্পূর্ণা-১৯
লেখনীতে : তামান্না আক্তার তানু

দিন পেরিয়ে ঠিক সন্ধ্যের পর পর বাড়ি ফিরলো আদনান। পুরোদিনে একবারের জন্যও বাচ্চাদের কথা জিজ্ঞেস করেনি সে। ওরা দুপুরে খেয়েছে কিনা, ঘুমিয়েছে কিনা, সুস্থ আছে কিনা, কোনোকিছুই জিজ্ঞেস করেনি। শুধু ফেরার আগে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, দরকারি কিছু লাগবে কিনা! নোভাও ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠে বলেছে, কিছু লাগবে না। ড্রয়িংরুমে পা ফেলে মারাত্মকভাবে চমকালো সে। বাচ্চাদের নিয়ে তার যতখানি উৎকণ্ঠা, দুঃশ্চিন্তা, ভয় ছিল। সবই যেন পাকাপোক্ত হয়ে পুরোদমে ঘিরে ধরলো তাকে। শুধু শান্ত চোখে রূহানীর দিকে তাকালো। মেয়েটা দিব্যি বাচ্চাদের কবজা করে নিয়েছে। বিভিন্ন গিফটস দিয়ে জারা, নোরাকে ভুলিয়ে ফেলেছে। ওরাও আদর খোঁজার ছুঁতোয় হুমড়ি খেয়ে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এটা অবশ্য দোষের কিছু না। বাচ্চারা একটু আদর পেলে যাকে-তাকে আপন ভেবে ফেলে। রূহানীর সাথে তো তাদের নাড়িরটান। না জানলেও, না বুঝলেও এই মমতাময়ীর মায়া দু’জনের কেউ-ই উপেক্ষা করতে পারছে না।

অবাকের মাত্রা তার দ্বিগুণ হলো। যখন দেখলো, রেদোয়ান হাসান খোশমেজাজে রূহানীর সাথে গল্প করছেন। নোভাও যথাসাধ্য আপ্যায়ের আয়োজন করে সামনে নিয়ে বসেছে। যেন কত দিনের চেনা পরিচিত আত্মীয় বাড়ির আঙিনায় পা রেখেছে। রাগ হলো আদনানের। মেয়েটা কথা দিয়ে কথা রাখলো না। বলেছিল এখানে আসবে না। লোকলজ্জার ভয় তাকে সারাক্ষণ আঁকড়ে থাকে, সেই সাথে এই শহরের প্রতি ঘৃ’ণাটাও তো কম না। সবকিছুকে তুচ্ছ করে, কেউ এত সহজে এই সীমানায় পা রাখে কী করে? বাচ্চাদের মায়া সবাইকেই কি সবকিছু সহজে ভুলিয়ে দেয়? কেনইবা এখানে আসলো মেয়েটা? ওদেরকে নিয়ে যেতে? ঘাবড়ে গেল আদনান। আগ বাড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না সে। ড্রয়িংরুম ক্রস করে সোজা রুমে আসতে চাইলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ততক্ষণে সে জারা, নোরার চোখে পড়ে গেছে। ওরাও বাবাকে দেখে প্রায় ছুটে এসেছে কাছে। ছোটো ছোটো হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরেছে। হুট করে ছাড়ানোও মুশকিল হয়ে গেল। কোলে না তুলে দু’হাত সরিয়ে উপরে তুলে বলল,

“পাপা নোংরা না? বাইরে থেকে এসেছি তো। এখন ছাড়ো, ফ্রেশ হয়ে আসি?”

আহ্লাদী বাচ্চাদুটো ঝটপট বাবাকে ছেড়ে আবারও রূহানীর কাছে ছুটে গেল। সরে আসতে গিয়ে পিছু ঘুরে একবার তাকালো আদনান। নোভার চোখে চোখ পড়তেই জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। সেই চেহারায় ফুটে উঠলো, প্রবল রাগ। তড়িঘড়ি চোখ সরালো নোভা। কিছু লাগবে কি-না সেটা দেখতেই সোফা ছাড়লো। বাচ্চাদেরকে এড়িয়ে যাওয়ার অজুহাতটা রূহানী না বুঝলেও নোভা ঠিকই সেটা আন্দাজ করতে পারলো। এ-ও বুঝলো, রূহানীকে এখানে দেখে কতটা রেগে গেছে মানুষটা। তবে যতই রাগুক, সব শুনলে এই রাগ সরে অনুশোচনা জন্মাবে নিশ্চিত।

রুমে এসে সেন্টার টেবিলে থাকা পানির বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢাললো আদনান। মুখে দিয়ে দেখলো, তাতে পানির তৃষ্ণা মিটবে না বরং মাত্রাতিরিক্ত গরমের ফলে পানিটাও কিছুটা গরম আর স্বাদহীন। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মেহমান এসেছে বলে সেদিকে নজর খুব বেশি রাখা জরুরী? রুম চেক করা উচিত না। এখন এই গরম পানি পেটে চালান করে তৃপ্তি আসবে কী করে! এক চুমুক কোনোমতে গিলে সেটা আবার জায়গামতো রেখে দিল। ব্লেজার, টাই, হাতের ঘড়ি, জুতো, মুজো সব খুলে বিছানায় চিৎ হয়ে পড়লো। দৃষ্টি সিলিংফ্যানের দিকে। এই সিলিংফ্যানের মতোই জীবনটা তার ক্রমান্বয়ে ঘুরছে। ঘুরতে ঘুরতে একটা বিদঘুটে পরিস্থিতি এসে সামনে দাঁড়িয়েছে। এড়িয়ে যাওয়া যাচ্ছে না, আবার সহ্য করাও যাচ্ছে না। বাচ্চাদের জন্য বুকের ভেতর ক্রমশ ব্যথার সৃষ্টি হচ্ছে। কেন বাচ্চাদুটো তার হলো না? কেন সে এই দুটো বাচ্চার সত্যিকার বাবা না? যদি জারা, নোরা তার ঔরসজাত হতো, তবে কি বিচ্ছেদ আসতো?

দরজায় শব্দ শুনে চোখ ফেরালো আদনান। হাতে গ্লাস নিয়ে রুমে এসেছে তার অর্ধাঙ্গিনী। ভালোমতো তার দিকে তাকালোও না সে। একপলক তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। নোভা সোজা সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতে একটা গ্লাস। তাতে লেবু মিশিয়ে শরবত তৈরী করা। দুটো বরফের কিউব ভাসছে উপরে। গ্লাস রেখে আদনানের কাছাকাছি ঘেঁষলো। খানিকটা ঝুঁকে চেহারার ভাবভঙ্গি পর্যবেক্ষণ করে ফিক করে হেসে ফেললো। বলল,

“এমন চেহারা একদমই মানাচ্ছে না আপনাকে। কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগছে।”

“সরো এখান থেকে! কী চাই এখানে? যাও ওদের কাছে। এখন তো ওরাই তোমার সব। আমি কে?”

চোখ গরম করে দাম্ভিকতা বজায় রেখে বললো আদনান। নোভা সামান্যও বিচলিত হলো না। বরং হাসিমুখে বলল,

“বারে! আপনি আমার কে সেটা আপনি জানেন না?”

“না জানি না।”

মেজাজ ধরে রাখার চেষ্টা করলো আদনান। কিন্তু পারলো না। ততক্ষণে অর্ধাঙ্গিনীর অধর মৃদু স্পর্শে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার পুরো মুখে। আপনা হতেই সমস্ত রাগ ঝরে পড়েছে। দু’হাতে তাকে নিজের সাথে আগলে নিল সে। নোভা মোহময় সুরধ্বনিতে কানের পাশে ফিসফিস করে বলল,

“আপনি সেই ব্যক্তি, যার জন্য এই আমি পরিপূর্ণ হয়েছি। আমার নারীজন্ম স্বার্থক হয়েছে। বিশ্বাসটা জোড়ালো হয়েছে। সম্পর্ক মজবুত হয়েছে। যার সংস্পর্শ আমাকে দু’হাত ভরতি সুখ এনে দিয়েছে। দিয়েছে একটা সুন্দর, বিশ্বস্ত নীড়।”

“তাই…? তবে আমাকে না জিজ্ঞেস করে রূহানীকে বাসায় ডাকলে কেন? যদি আমি তোমার সবকিছু হই, তবে তো কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করা উচিত তোমার! কেন নিয়ে এসেছো তাকে? কী চাই তার এখানে?”

“বিস্তারিত পরে বলি। আমি বাবার অনুমতি নিয়ে তাকে এখানে এনেছি। যেহেতু বাবার অনুমতি পেয়েছি, সে কারণে আপনাকে অযথা রাগাতে চাইনি। আমি জানি, এটা সহজে হজম হবে না আপনার। এখন উঠুন, ফ্রেশ হয়ে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটান। ওদের ইগনোর করে আপনি নিজেই বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। ওরা কিন্তু তা ধরতে পারছে না, বুঝতেও পারছে না। এভাবে দু’দিন চললে, বাচ্চাদুটো মানসিকভাবে আঘাত পাবে। আপনার এই পরিবর্তন আমি সহ্য করতে পারছি না। ওরা যদি বুঝতে পারে, তাদের পাপা অকারণ দূরত্ব তৈরী করছে, তখন কতটা ব্যথা পাবে মনে! অবুঝ বাচ্চা। ওদের কেন কষ্ট দিচ্ছেন?”

আদনান জবাব দিল না। ভেতরের ভয় কাটিয়ে উঠতে পারছে না সে। যার কারণে বাচ্চাদের সাথেও সহজ হতে পারছে না। মনে হচ্ছে, এইবুঝি রূহানী সবকিছু এলোমেলো করে দিল। আদরের বাচ্চাদুটোকে কে’ড়ে নিল তার থেকে। সোজা হয়ে বসে ঠাণ্ডা শরবতের গ্লাসটা আদনানের হাতে ধরিয়ে দিল নোভা। তার চিন্তিত চেহারা দেখে বলল,

“মিছেমিছি ভয় পাচ্ছেন আপনি! বাচ্চাদের সাথেও অন্যায় করছেন। রূহানী কিন্তু এখানে দুইদিন থাকবে। ওর সামনে বাচ্চাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করবেন না প্লিজ। শেষে ওর মনে সন্দেহ জাগবে। ভাববে, বাচ্চারা এখানে ভালো নেই।”

*****

খাবার টেবিলে আজ বাচ্চারা আদনানের পাশে বসলো না বরং রূহানীকে ঘিরে তাদের ভাব-ভালোবাসার ঢালি সাজিয়ে বসলো। যেন অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো সুখকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরেছে দু’জন। আদনানের একটু মেজাজ খারাপ হলেও মুখের ভাবভঙ্গিতে সেটা প্রকাশ পেতে দিল না। ভয় আরও গভীরভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো তাকে। এইতো, বাচ্চাদুটো একটু একটু করে দূরে সরে গেছে। হাত বাড়ালেও সে তাদের ছুঁতে পারছে না, কাছে টানতে পারছে না। এই দূরত্বটাই বুঝি সবসময়ের জন্য! নাড়িরটান বুঝি এত গভীর? কত অল্পসময়ে বাচ্চারা রূহানীকে আপন করে নিয়েছে! বুক ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। মনে হলো, সাজানো গোছানো সংসারটা একটু একটু করে ভাঙছে। বাচ্চাদের সাথে বিচ্ছেদ তৈরী হয়েছে, এরপর তৈরী হবে দূরত্ব! কতটা দূরত্ব আসবে? রাস্তার দূরত্ব নাকি মনের দূরত্ব? এভাবে একটু একটু করেই কি বাচ্চারা ভুলে যাবে, জন্মদাতা না হয়েও কতটা আদরযত্নে তাদেরকে সে আগলে নিয়েছিল? ভুলে যাবে সব? মিথ্যে হয়ে যাবে সব ভালোবাসা?

রুমের ভেতর পায়চারি করছে আদনান। ঘুম আসছে না। ভেতরের অস্থিরতাও কমছে না। খাবার শেষে বাচ্চারাও আজ তার কাছে আসেনি, পাশে আসেনি, খাইয়ে দেয়ার জন্য বায়না ধরেনি। কী অদ্ভুত! চোখের পলকে সব নিয়ম পালটে যাচ্ছে। দুটো হাত নিশপিশ করছে তার। ওদের কাছে ছুটে যেতে মন চাইছে। বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে। অথচ সে চাইলেও পারছে না ওদের কাছে ছুটে যেতে। কেন এমন হচ্ছে? কেন তার সবকিছু অগোছালো হয়ে যাচ্ছে? সারাটাদিন কতটা কষ্টে কাটিয়েছে সে! বাচ্চাদের না ছুঁয়ে, না দেখে, বুকে আগলে নিতে না পেরে দম তো তার আটকে আসছে। একদিনেই এমন হলে, বাকি দিন? বাকি দিনগুলো কীভাবে কাটাবে সে?

বেশ কিছুদিন আগে স্বর্ণের দোকানে দুটো স্বর্ণের চেইন অর্ডার দিয়েছিল আদনান। ফেরার পথে সেগুলো নিয়েও এসেছে। সারাদিন বাচ্চাদের খোঁজ নেয়নি, ভেবেছে এইদুটো চেইন দিয়ে দু’জনকে চমকে দেবে। এ-ও হলো না। বাচ্চারা আজ তার ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেল। হয়তো আগামীতেও এমনই থাকবে। সে চাইলেও পারবে না কাছে ছুটে যেতে। চেইনদুটো হাতে নিয়ে লকেটে হাত বুলালো সে। কত সুন্দর করে তাতে দুটো নাম চকচক করছে! উপহারদুটো দিতে না পেরে মনটা আরও ভার হয়ে গেল তার। দ্রুত হাতে সেটা আলমারিতে তুলে রাখলো। থাক! ওখানেই পড়ে থাক। এসবের চেয়ে রূহানীর ভালোবাসাটাই তাদের কাছে অনেক দামী! এই উপহারটা এখন তুচ্ছই। খুব বেশি তুচ্ছ।

রুমে ঢুকে আদনানকে ওভাবে আলমারির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় দেখে ঘাবড়ে গেল নোভা। তার হাতদুটো বুকের কাছে ভাঁজ করা। চোখের কোলে শূন্যতা। চেহারায় হাসি নেই, নেই উজ্জ্বলতা। সবকিছু কেমন গুমোটবাধা, থমথমে পরিবেশ।

দরজা আটকালো নোভা। সামান্য শব্দ হলো। সেই শব্দে হুঁশ ফিরলো আদনানের। তড়িঘড়ি করে বারান্দায় চলে গেল সে। বাইরের পরিবেশটাও বোধহয় আজ তার মনের খবর টের পেয়েছে। সবকিছুই কেমন নীরব, শান্ত। আকাশে চাঁদ নেই, নেই তারাদের ছোটাছুটি। জ্যোৎস্নার একফোঁটা আলোও কোথাও নেই। সবকিছুর এমন পিনপতন নীরবতা তাকে আরও বিষণ্ণ করে দিল। রাত্রির নিস্তব্ধতাকে ছুঁয়ে দেখতে বাইরে চোখ বুলিয়ে রাখলো। তখনই নোভা এসে পাশে দাঁড়ালো। হাতে থাকা কফির মগটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“মনকে শান্ত করুন। সবকিছু ঠিক আছে। কোথাও কোনো ভুল হচ্ছে না কারও।”

ঠোঁটে মলিন হাসি ফুটালো আদনান। হাত বাড়িয়ে কফির মগটা টেনে আনলো। তাতে চুমুক দিয়ে খানিকটা স্বস্তিবোধ করলো। বলল,

“বাবা যখন বললেন, ‘বিয়ে কর, বিয়ে কর। বাচ্চাদের জন্য আর কত ভাববি। নিজেকে নিয়ে ভাব। জীবনটা গুছিয়ে নে।’ উত্তরে বলেছিলাম, ‘পারফেক্ট কাউকে এনে দিও। যে শুধু আমাকে নয়, আমার বাচ্চাদেরকেও মায়ের মমতা দিয়ে আগলে রাখবে।’ তখনই বাবা তোমার কথা বললেন। প্রথমে মনে হয়েছিল, এ-ও সম্ভব? একটা মেয়ে নিবে পরের দুটো বাচ্চার দায়িত্ব? বাবা কনফিডেন্টের সাথে বললেন, ‘নোভার মতো মেয়ে হয় না!’ তিনি তোমার রান্নার এত পাগল ছিলেন যে, রোজ রোজ সে খাবার অর্ডার দিয়ে ঘরভরতি করে ফেলতেন। আমিও তাতে তৃপ্তি খুঁজে পেতাম। একটা সময় তোমার রান্নাটা আমার ভালো লেগে গেল। তখন বাবাকে বললাম, ‘বিয়ে করলে এই মেয়েকেই করবো। তুমি আলাপ করতে পারো!’ বাবা সরাসরি বললেন, ‘দেখলে রিজেক্ট করবি না তো?’ আমিও বললাম, ‘পছন্দ না হলে রিজেক্ট তো করবোই।’ ব্যস। তোমাদের বাড়িতে আলাপ পাঠালাম। সবাইকে জারা, নোরার ব্যাপারে সবকিছু জানালাম। শুধু তোমাকে জানতে দিলাম না। আমি দেখতে চেয়েছিলাম, জারা, নোরার প্রতি তোমার মনোভাবটা কী! বুঝতে চেয়েছিলাম, যার হাতে জাদু আছে, তার মনে কতটা মায়া আছে!”

এইটুকু বলে চুপ করলো আদনান। কফিতে দ্বিতীয় বার চুমুক দিল। নোভা আগ্রহী শ্রোতার মতো তাকিয়ে রইলো বাকিটুকু শোনার জন্য। সে-ও বলল,

“তোমাকে দেখে শপিংমলের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লো। কথাবার্তা শুনে প্রথম আলাপেই টের পেলাম, একটা মানুষ কতটা আত্মকেন্দ্রিক! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, বিয়ে আমি তোমাকেই করবো। এরপর তোমার সাথে টুকটাক আলাপ, বাচ্চাদের প্রতি তোমার টান, মায়া, মমতা সব দেখে মনে হলো, একটা মানুষ পেয়েছি, যে পুরোটাই মনমতো। যাকে বিশ্বাস করে নির্দ্বিধায় বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো। সবসময় একটা প্রকৃত মানুষ খুঁজেছি! যার হাতে আমি নিজেকে সঁপে দিতে চাই, সে কতটুকু সহ্যশীল হবে এটাই ভেবেছি। তুমি আসাতে সবকিছু পরিপূর্ণ হলো। বাচ্চারা মা খুঁজে পেল। আমিও পেলাম বিশ্বস্ত একজন সঙ্গিনী। যাদের উছিলায় আমি তোমাকে পেলাম, আজ তাদেরকেই হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি! নিয়তি এত নিষ্ঠুর আমার জানা ছিল না।”

আদনানের এই ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। এতগুলো বছর বাচ্চাদের আগলে রেখেছে সে। হুট করে গর্ভধারিণী মায়ের দাবী নিয়ে, রূহানী এসে চাইলেই সে দিয়ে দিবে? এতটাও সহজ সবকিছু? দিতে না চাইলেও জোর করে আটকে রাখারই বা অধিকার কোথায়? পরের বাচ্চাকে কতই আর নিজের বলে চালানো যায়। তবুও একটা দাবী, একটু জোর, একটু ভালোবাসা, একটু অধিকারবোধ জন্মে যায়। সেই অধিকার আর ভালোবাসা থেকেই বাচ্চাদের ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়াটা কঠিন হয়ে পড়েছে। যার কারণে সেই কঠিন সিদ্ধান্তকে সহজ করতে একটু একটু করে বাচ্চাদের দূরে সরাচ্ছে আদনান। তার এমন মনোভাব যখন নোভা বুঝতে পারলো, কষ্টটুকু উপলব্ধি করলো, তখনই সমস্ত কষ্টকে দূরে সরিয়ে দিতে বলল,

“রূহানীর সাথে কী আলাপ হয়েছে জানেন? সে কী চায়? কেন এসেছে এখানে? আমি-ই বা কেন তাকে বাড়ি অবধি টেনে আনলাম? একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে মনে হচ্ছে তাই না? আমি যা করেছি, নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে করেছি। মেয়েটা কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আদি! যে সত্য চাইলেও উপেক্ষা করা যায়।”

কথার সারমর্ম কিছুই বুঝলো না আদনান। ভ্রু কুঁচকে নোভার দিকে তাকালো। নোভাও বিশ্বস্ত চোখে পলক ফেললো। আইসক্রিম পার্লারে দু’জনার কী আলাপ হলো সেটাই তুলে ধরলো!

*****

ফ্ল্যাশব্যাক :
___________

“জানেন তো, আমি খুব স্বার্থপর। নিজের সুখের জন্য এক মায়ের বুক খালি করে দিয়েছিলাম। সেই মায়ের আর্তনাদ আর কান্নার মূল্য দিলাম বিধ*বার সাজ গ্রহণ করে। তিনি সন্তান হারালেন, আমিও হারালাম স্বামী। এই শহরটা আমার সব কে*ড়ে নিয়েছে। আমার মা, স্বামী, সুখ, এমনকি আমার সন্তানদেরও! যা আমি চাইলেও আর আমার করে ফিরে পাব না।”

রূহানীর এমনধারা কথাতে প্রচণ্ড অবাক হয়েছিল নোভা। তার স্বাভাবিক চেহারায় কত আকুলতা, কত ছটফটানি ফুটে উঠেছিল তখন। না পাওয়ার বেদনাগুলো তাকে খুব করে আগলে নিয়েছিল। একাকীত্ব তাকে দিনরাত যন্ত্রণার কাতরানি অনুভব করিয়েছে। এক মায়ের আর্তনাদে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল সে। হৃদপিণ্ড খুব জুড়েই কাঁপছিল। ভেতরের কাঁপুনিকে থামিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছিল। নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল,

“যা কিছু আপনার তা সবসময়ই আপনার। বাচ্চারাও!”

নাম না ধরেই কথার সুর ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল নোভা। পক্ষান্তরে মুচকি হাসলো রূহানী। বলল,

“সেটা শুধু জন্ম দিয়েই। ওইযে, মায়ের চোখের পানি কখনও বৃথা যায় না। মায়ের কোল খালি করে নিজের সুখকে বড়ো করে দেখেছিলাম, এখন আমার কোলও খালি।”

“আপনি চাইলেই তা ভরে উঠতে পারে! ওরা তো আপনারই নাড়িছেঁড়া ধন! আপনি যদি চান তবে সেই দাবী থেকে তাদের নিয়েও যেতে পারেন। একজন মায়ের চাওয়াকে কখনওই ভুল হিসেবে দেখবো না আমরা।”

“আপনি খুব সুন্দর মনের মানুষ। তাইতো সবকিছু এত সহজভাবে দেখছেন। সহজেই মা হয়ে উঠতে পেরেছেন। সত্যি কথা কী জানেন, আমি এখন চাইলেও ওদের মুখে মা ডাক শুনতে পারবো না। যা মন থেকে আসে না, তা জোর করে আদায় করে নিতে চাই না।”

রূহানীর এরূপ কথাবার্তাও সহজে হজম হলো না নোভার। খুব বেশি নার্ভাস দেখালো তাকে। ভয়ে চোখদুটো অশান্ত হয়ে গেল তার। বুকের কাঁপন বাড়লো। আতঙ্কিত কণ্ঠে বলল,

“তবে? হুট করে সিলেট আসা?”

ঠোঁটে বেদনাজনিত মলিন হাসি ফুটিয়ে রহস্যময় শব্দে কিছু কথা উচ্চারণ করলো রূহানী। বলল,

“ওপারে যাওয়ার টিকিট এসেছে আপু। ছোট্ট জীবনটা এইটুকুতেই হার মেনে নিয়েছে!”

“মানে!”

চট করে কথার পুরো অর্থ বোধগম্য হলো না নোভার। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো রূহানীর দিকে। মেয়েটাও পুনরায় চেহারায় হাসি ধরে রেখে বলল,

“চিকিৎসার জন্য বাইরে যাচ্ছি। জানি না, সুস্থ হয়ে ফিরবো কি-না। হয়তো বাচ্চাদের সাথে এটাই আমার শেষদেখা।”

“কী হয়েছে?”

“ব্রে*স্ট ক্যা’নসা’র!”

“ডাক্তার দেখাননি?”

“দেখিয়েছি। একেবারে শেষ পর্যায়ে! প্রথম বুঝতে পারিনি। যখন বুঝলাম, তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।”

চরম বিস্ময়ে চোখদুটো বড়ো হয়ে গেল নোভার। রূহানী ফের বলল,

“আপনার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি।”

“বলুন।”

“আপনার হাজব্যান্ডকে একটু বলবেন, যদি মৃ’ত ফিরি তবে আমার দাফনটা যেন তানভীরের পাশে হয়! ইহকালে তো তার সাথে সংসারটা পরিপূর্ণ হয়নি, একই কব’রে জায়গা না হলেও পাশাপাশি যেন থাকি।”

অজান্তেই নোভার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়লো। বাচ্চারা তখনও আইসক্রিম খাওয়াতেই ব্যস্ত। দু’জনার কথা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। নোভা এতক্ষণে খেয়াল করলো, রূহানীর চেহারাটা পুরোটাই উজ্জ্বলতাহীন। শরীরের হাড়গোড় বেরিয়ে আসার উপক্রম! কী খায় মেয়েটা? কিছুই কি খেতে পারে না? দাঁড়িয়ে আছে কী করে? এমন সুন্দর চেহারার মানুষ, ধীরে ধীরে তার রূপ, শক্তি সবকিছু হারিয়ে ফেলছে। সামান্য একটা রোগের কাছে জীবন এত অসহায়! নীরবতা কাটিয়ে রূহানী ফের বলল,

“মা হওয়া অনেক কষ্টের। দ্বিগুণ কষ্টের, মা হয়েও বাচ্চাদের মুখে মা ডাকটা শুনতে না পাওয়া! এইযে, ওদেরকে দেখছি, ভেতরে কত শান্তি পাচ্ছি বলে বুঝাতে পারবো না। ইচ্ছে করছে সৃষ্টিকর্তার কাছে জীবনটা ভিক্ষা চাই! অথচ এমন একটা পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছি যে, এখন অপারেশনটাও কোনো কাজে আসার নয়। মা অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছে। শেষ চেষ্টা করতে দেশের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার মন বলছে, এতসব চেষ্টা সব জলে যাবে। মানুষটাকে প্রতিনিয়ত স্বপ্নে দেখি আমি। সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে ছোট্ট একটা সংসার সাজাই। এই জন্মে সবকিছু পেয়েও কেমন অধরাই থেকে গেল! না ছুঁতে পারলাম, আর না আঁকড়ে ধরতে পারলাম। সব হারালাম। সব।”

“আপনি যদি চান, দেশের বাইরে যাওয়ার আগে কয়েকটাদিন বাচ্চাদের কাছে থাকতে পারেন!”

“ফ্লাইট আগামী পরশু। মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা দেশে আছি।”

“সেইটুকু সময় ওদের কাছে থাকুন, মন শান্ত হবে।”

“মায়ায় পড়ে যাব! তখন মৃ’ত্যুটাও যন্ত্রণার হবে।”

“মৃ’ত্যু তো এমনিতেই যন্ত্রণার! সুযোগটা কেন হাতছাড়া করছেন। মনের কষ্ট দূর করতে, ওদের সংস্পর্শ আপনার অনেক প্রয়োজন! আপনি আসুন আমার সাথে। দু’দিন আপনি ওদের কাছেই থাকবেন। এখান থেকেই ফ্লাইট ধরবেন।”

কষ্ট কিছুটা কম উপলব্ধি করলো রূহানী। জীবনে যত মানুষের দেখাই সে পেয়েছে, সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে তাকে বাঁচিয়েছে, আগলে নিয়েছে। এতিম হয়েও জীবনে এত সুখ পাওয়া বোধহয় ভাগ্যেরই ব্যাপার। সেদিক থেকে সে তো ভাগ্যবতীই। যার কেউ ছিল না, তার সুখ হলো, সংসার হলো, সন্তানও হলো, সে এতিম রইলো কই? নোভার কথাগুলোকে কিছুটা ভরসা খুঁজে পেল সে। মন বললো, বাচ্চারা এক যোগ্য মায়ের সান্নিধ্যে এসেছে। এই মায়ের ভালোবাসায় কোনো ছলনা নেই। সে পৃথিবীতে থাকা, না থাকা এখন সমান। বাচ্চারা ঠিকই ভরসা খুঁজে নিয়েছে!

অবিশ্বাস্য চোখে নোভার দিকে তাকিয়ে রইলো আদনান। তার মনে হলো, সে ভুল শুনছে। এজন্যই কি তবে রূহানীর চেহারাটা এত উদাসীন! মেয়েটা শরীরে এত বড়ো রোগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে? না জেনে ভুলকে প্রশ্রয় দিয়ে বড্ড অন্যায় করলো সে। কারও প্রতি এতটা অভিযোগ কীভাবে পুষে রাখা যায়? একটা মা অসুস্থ হয়ে, জীবনের শেষপ্রান্তে এসে নাড়িছেঁড়া ধনদের একটুখানি সংস্পর্শ চাইছে, আর সে কিনা স্বার্থপরের মতো রূহানীকে ভুল বুঝে এসেছে। নিজেকে বড্ড ছোটো মনে হলো তার। কী করে সে এমনটা করতে পারলো! না বুঝে বাচ্চাদের সাথেও অন্যায় করলো। তড়িঘড়ি করে রুম ছেড়ে বাইরে যেতে চাইলো আদনান। এক্ষুণি বাচ্চাদের কাছে যাওয়া প্রয়োজন। ওদেরকে বুকে আগলে রাখা প্রয়োজন। ওরা যে এত মান-অভিমান আর দূরত্বের কিছুই বুঝে না। নোভা তাকে বাইরে যেতে দিল না। রুমের ভেতরেই আটকে রাখলো। বলল,

“ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। রূহানী এখন ওখানেই আছে। ও আপনার সন্তানদের কে’ড়ে নিবে না। বিশ্বাস করুন, বাচ্চাদের কে’ড়ে নিতে আসেনি ও। শুধু একটু ছুঁয়ে দিতে এসেছে। ওর বাচ্চাতো, খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। আমরা সেটা উপলব্ধি করতে পারছি না আদি। দুটোদিন থাকুক এখানে। বকবেন না প্লিজ। আপনার রাগ হলে, আমাকে বকুন। তবু রূহানীকে কিছু বলতে যাবেন না। মেয়েটা ম’রে ম’রে বেঁচে আছে। দুটোদিন তাকে একটু হাসতে দেই? পারি না আমরা?”

জবাবে মাথা নাড়লো আদনান। পুনরায় বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। তার কষ্ট কিছুটা কমলো। বুঝতে পারলো, এই মুহূর্তে তার চেয়েও দুঃখী একটা মানুষ এই ঘরে আছে। যে শুধু দুঃখকে সঙ্গী করেই পৃথিবীতে এসেছিল, আবারও দুঃখকে সঙ্গী করেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে! যার জীবনটা পরিপূর্ণ হয়েও অসম্পূর্ণ থেকে গেল পুরোটাই। সবকিছু জীবনে এসেও আবারও হারিয়ে গেল। সুখ নামক সুখের ঘুড়ি সবসময় দূরেই থেকে যায়! শক্ত হাতে নাটাই টানার পরেও কাছে এসে ভিড়ে না। উলটে সুঁতো ছিঁড়ে দূরে আটকে যায়। না তাকে ধরা যায়, না ছোঁয়া যায়, সে থাকে সবসময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে।

*****

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here