#সুখবৃষ্টি-৩
হাসাদ ভাইয়ের ব্যপারটি নিয়ে সারাদিন চিন্তা করল অরিন। শেষে সিদ্ধান্ত নিল, আর লোকটার ফোনই ধরবে না। অরিন যদি ফোন না ধরে তাহলে মানুষটা তাকে জ্বালাবে কিভাবে? এটাই সবচেয়ে ভালো সমাধান। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার অরিনের ভয় লাগল। অরিনের উপর ক্ষীপ্ত হয়ে হাসাদ ভাই যদি আবার তার বোনদের কোনো ক্ষতি করে? তখন কি হবে? বিচলিত হয়ে অরিন চিন্তা করল, ইলহানকে সব জানিয়ে দিবে। তারপর আবার চিন্তা করল, ইলহান কি তার সবকথা অন্ধের মতো বিশ্বাস করবে? যদি এমন হয় যে অরিন ইলহানকে সবকিছু বলার পর সে হাসাদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে চাইল। তখন হাসাদ ভাই তাকে ভুজুংভাজুং বুঝিয়ে ব্রেইনওয়াশ করে দিল। লোকটা তো ভীষণ ধূর্ত। তাছাড়া ইদানীং খুব বেশিই দুঃস্বপ্ন দেখছে অরিন। বেশিরভাগ স্বপ্নেই ইলহান তার উপর রেগে থাকে। অরিন বিভিন্ন কায়দায় ইলহানের রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে। কিন্তু লাভ হয় না। যদি স্বপ্নটাই সত্যি হয়? ভাবতে ভাবতে অরিনের মাথা ব্যথা শুরু হলো। সে গভীর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে লাগল।
সন্ধ্যায় ইলহান বাড়ি ফিরতেই দেখল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে অরিন। সাদা শাড়িতে, খোলা চুলে তাকে দেখাচ্ছে বেলীফুলের মতো। ইলহান ধীরপায়ে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে জাপটে ধরল। তার বেসামাল হাত পৌঁছে গেল অরিনের চিকন কোমড়ে, নির্মেদ, মসৃণ পেটে। অরিনের শরীরে লজ্জার শিহরণ বয়ে গেল। নিঃশ্বাস হয়ে উঠল ভারী। সামনে তাকালেই অরিনের স্নিগ্ধ মুখদর্শন করল ইলহান। বিভোর হলো, খৈ হারালো, মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। রূপোলী কানের দুল, কাজলমাখা চোখ আর হালকা লিপস্টিকে অরিনকে বৃষ্টিভেজা পদ্মফুলের মতো থেকেও স্নিগ্ধ লাগছে। ইলহান অরিনের গাল স্পর্শ করল। তার ছোট্ট মুখমন্ডলে ঠোঁটের উষ্ণ পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,” খুব সুন্দর লাগছে।”
অরিনের গাল রক্তাভ হলো। মাথা নিচু করে সাত-পাঁচ ভেবে বলেই ফেলল,” তোমাকে কিছু কথা বলার ছিল।”
” বলো।”
মুখে বলতে বললেও ইলহানকে দেখে বোঝা যাচ্ছে কথা শোনার ন্যূনতম আগ্রহ তার নেই৷ সে বিভোর হয়ে অন্যকাজ করছে। অরিন ইতস্তুত করে বলল,” কথাটা জরুরী।”
ইলহান অরিনকে উঁচু ডিভানে বসালো। তার ঘাড়ে হাত রেখে, চোখে চোখ রাখল, কপালে কপাল ঠেকালো। আবেশী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,” কি কথা?”
অরিন বলতে নিয়েও বলতে পারল না। এখন বললেই সুন্দর এই মুহূর্তটা নষ্ট হয়ে যাবে। যদি এমন হয়, আর কখনোই এমন স্বর্গীয় মুহূর্ত ফিরে না আসে! অরিনের বুক অজানা শংকায় ধড়াস করে কাঁপল। সে ভয় পেল। চুপসে গেল। প্রসঙ্গ বদলে ফেলে বলল,” ভাবছি তারিন আর জেরিনকে কয়েকদিনের জন্য এখানে এনে রাখবো।”
” তো রাখো না। কবে আনতে চাও?”
” কালকে হলেই ভালো হয়। মা আবার বলছিলেন একটু খালার বাসায় যাবে। অসুস্থ তিনি। ওদের তো সাথে করে নিয়ে যেতে পারবে না। তাই আমার কাছে রেখে যাবে।”
” ঠিকাছে, সকালে আমি আর তুমি গিয়ে ওদের নিয়ে আসবো।”
অরিনের বুক থেকে দুশ্চিন্তার ভার নামল। কিন্তু এইভাবে বোনদের সে কয়দিন পাহারা দিয়ে রাখবে? সারাজীবন তো আর তাদের নিজের কাছে এনে রাখা যাবে না। ইলহান অরিনকে কোলে তুলে ফেলল। বিছানার দিকে যেতে যেতে প্রশ্ন করল,” এটাই কি তোমার জরুরী কথা ছিল?”
” হ্যাঁ।”
ইলহান বালিশ টেনে অরিনকে শোয়ালো। তার গালে, ঠোঁটে আঙুল বুলিয়ে বলল,” বোকা, এমন একটা কথা এতো ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করার কি আছে? আমি তো ভাবছিলাম সিরিয়াস কিছু।”
অরিনের বুক তখনও ধুকপুক করছে। ইলহানকে হারিয়ে ফেলার একটা অহেতুক ভয় জমে গেছে মনে। ছোটবেলায় মা বলতেন, যে জিনিস খুব সহজে পাওয়া যায় তা নাকি খুব সহজে হারিয়েও যায়। অরিন কি ইলহানকে হারিয়ে ফেলবে? ভয়ে কান্নারা দলা পাকিয়ে গলায় আটকে গেল। ইলহান তখন অরিনের গলায় মুখ ডুবিয়ে শরীরের উষ্ণতা অনুভব করছে। অরিন চোখ বন্ধ করল। ইলহানের আদুরে স্পর্শ উপভোগ করতে পারছে না সে। অহেতুক ভয়টি তার হৃদয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ হতাশ লাগছে। দরজায় কারো টোকা পেতেই সম্বিৎ ফিরল অরিনের। ইলহানও যেন কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো।
” এতোরাতে কে আসবে?”
অরিন সচকিত হয়ে বলল,” এতোরাত কোথায়? মাত্র নয়টা বাজে।”
ইলহান ঘড়ির দিকে তাকালো। আসলেই তো। অরিন দরজা না খুলেই বলল,” রিমা এসেছে। আমি যাই।”
” কোথায় যাচ্ছো?”
” স্যরি, তোমাকে বলতে ভুলে গেছি। আজকে আমরা ফ্রেন্ডরা মিলে সারারাত মুভি দেখবো। তোমাকে একা ঘুমাতে হবে।”
ইলহান বালিশ চেপে ধরে হতাশ কণ্ঠে বলল,” সেজন্যই কি এতো সাজ?”
” হুম।”
অরিন দরজা খুলেই রিমার সাথে বেরিয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ইলহান। অথচ সে ভেবেছিল অরিন বুঝি তার জন্য এতো সুন্দর করে সেজেছে!
ইলমি ভার্সিটির ছয়জন বান্ধবিকে দাওয়াত করেছে আজ। সবাইকে নিয়ে নাইট পার্টি হবে। মেঘাকেও আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু সে আসেনি। অরিনের সাথে ইলহানের বিয়ে হওয়ার পর থেকে মেঘা ইলমি অথবা অরিন কারো সাথেই কথা বলছে না। ইলমিও নিজে থেকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আরশি বলল,” কিরে, এতোক্ষণ হলো এসেছি। অরিন কোথায়?”
ইলমি গ্লাসে কোক ঢালতে ঢালতে বলল,” আসছে। শোন তোদের বুদ্ধি শিখিয়ে রাখছি। ও যদি আজ ঘরে যাওয়ার তালবাহানা করে তাহলে কিন্তু মোটেও যেতে দিবি না। দেখা গেল আমরা গল্প করছি আর ও একফাঁকে রুম থেকে বের হয়ে যাবে।”
অনু কৌতুহলী হয়ে বলল,” রুম থেকে বের হয়ে কোথায় যাবে?”
” কোথায় আবার? ভাইয়ার রুমে! সারাদিন তো ওখানেই পড়ে থাকে।”
রূপন্তী আঁড়চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” নিজের হাসব্যান্ডের রুমেই পড়ে থাকবে না তো আর কই থাকবে? এটা নিয়ে এতো সমস্যার কি আছে? ওইটা তো এখন ওর নিজেরও রুম।”
ইলমি প্রতিবাদী গলায় বলল, ” তবুও সমস্যা আছে। জানিস, অরিনের বিয়ের পর আমি কতকিছু ভেবে রেখেছিলাম? অন্তত এক দিন পর পর দুই বান্ধবী একসাথে ঘুমাবো। সিনেমা দেখবো। রাত জেগে গল্প করবো। বৃষ্টিতে ভিজবো। আরও কত মজা করবো। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। ভাইয়াকে পেয়ে তো অরিন আমাকে ভুলেই গেছে। ভুল করেও যদি কখনও আমার রুমে চলে আসে তাও ভাইয়া কোনো না কোনো বাহানা দিয়ে ডেকে নিয়ে যাবে। শার্ট পাচ্ছি না, প্যান্ট পাচ্ছি না, মোজা পাচ্ছি না, জুতো পাচ্ছি না। কখন যেন সে নিজেকেও হারিয়ে ফেলে…”
তানিয়ার চোখের ইশারায় থামল ইলমি। পেছনে তাকিয়ে দেখল অরিন দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় চাপা হাসি। ইলমি তাকাতেই বলে উঠল, ” থামলি কেন? আরও বল। নিজের নামে বদনাম শুনতে ভালোই লাগছিল।”
ইলমি সপ্রতিভ স্বরে উত্তর দিল,” বদনাম কিভাবে করলাম? সত্যি কথাই তো বলছি। তুই কি এসব করিস না?”
অনু মজা করে বলল,” আরে অরিন, তুই তোর জায়গায় ঠিকই আছিস। আমার যদি এমন সুন্দর বর থাকতো তাহলে আমিও সারাক্ষণ তোর মতো বেডরুমে দরজা দিয়ে বসে থাকতাম। আর সারাদিন তাকিয়ে তাকিয়ে তার চেহারা দেখতাম।”
অরিন চোখ বড় করে বলল,” তোর কি ধারণা? আমি সারাক্ষণ ঘরে বসে ওর চেহারার দিকে চেয়ে থাকি?”
তানিয়া বলল,” না, না, শুধু চেয়ে থাকবি কেন? আরও কত কাজ আছে!”
এই কথায় হাসির স্রোত বয়ে গেল ঘর জুড়ে। অরিন ক্ষেপে বলল,” অনেক হয়েছে। এবার থাম তোরা। নাহলে কিন্তু আমি উঠে চলে যাবো। বদের হাড্ডি একেকটা।”
রূপন্তী মুখ টিপে বলল,” হুম। কথায় কথায় খালি বরের কাছে যাওয়ার ধান্দা। বুঝি তো আমরা!”
অরিনের চেহারা লাল হলো। তার বন্ধুগুলো হয়েছে একেকটা অসভ্য! কিছুক্ষণ পরই বেডরুম থেকে ইলহানের ডাক এলো,” টিভির রিমোটটা খুঁজে পাচ্ছি না অরিন। একটু দেখবে এসে?”
ইলমি বিরক্ত কণ্ঠে বলল,” এইযে, শুরু হয়ে গেছে।”
রিমা অরিনকে ঠেলা মে’রে বলল,” যা, যা, বেচারা রিমোট খুঁজে পাচ্ছে না৷ একটু গিয়ে খুঁজে দিয়ে আয়।”
ইলমি সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বলল,” রিমোট খুঁজতে গিয়ে আবার তুই নিখোঁজ হয়ে যাস না।”
অরিন ক্ষীপ্ত হলো। খিটমিট করে বলল,” আমি যাবোই না।”
আবার খিলখিল করে হেসে ফেলল সবাই। অরিন হাতের গ্লাসে থাকা কোকটা একঢোকে খেয়ে শেষ করল। তার উঠতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুক্ষণ সবার মাঝখানে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ইলহানের ডাকাডাকিতে উঠতেই হলো। নয়তো যেকোনো সময় এখানেও চলে আসতে পারে পাগলটা। এই নিয়ে বন্ধুরা আরও বেশি হাসাহাসি করবে। অরিন হাঁটতে নিয়েই খেয়াল করল তার মাথাটা ঘুরছে। চোখেমুখে সে কিছুটা ঝাপসাও দেখতে পাচ্ছে। গ্যাস্ট্রিকের কারণে কি এমন হতে পারে? অরিন কিছুক্ষণ আগে কোক খাওয়ার সময় খুব তেঁতো লাগছিল৷ তখনি বুঝেছে পেটে গ্যাস হয়েছে। কিন্তু গ্যাসের জন্য চোখেমুখে ঝাপসা দেখবে কেন? মনে হলো বাড়িটা দুলছে। ভূমিকম্প হচ্ছে নাকি?
অরিনকে অপ্রকৃতস্থ অবস্থায় ঘরে ঢুকতে দেখে ইলহান চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে অরিন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”
অরিন হাসল কেবল। কিছু বলল না। তার চলা-ফেরা অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঠেকল ইলহানের কাছে।
অরিন চলে যাওয়ার সাথে সাথেই রিমা বলল,” এই ইলমি, তুই কোকে কি মিশিয়েছিস? এতো তিতা কেন?”
ইলমি দুষ্টমির স্বরে বলল,” একটু ওয়াইন মিশিয়েছিলাম।”
” সর্বনাশ!”
অরিনের ঘুম ভাঙল খুব জঘন্য একটি দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্নে ইলহান অরিনের সাথে কথা বলছিল না। অরিন এতো চেষ্টা করল, বার-বার ক্ষমা চাইল, যদিও সে নিজের ভুল সম্পর্কে অজ্ঞ তবুও কানে ধরল। কিন্তু ইলহানের রাগ কমানো গেল না। সারাদিন অরিন কাঁদল। তারপর রাতে ইলহান বাড়ি ফিরল একজন উকিল ও একটি এফিডেভিড নিয়ে। অরিনের দিকে ফাইলটি এগিয়ে দিয়ে বলল,” এটা আমাদের ডিভোর্স পেপার। আমি কোনো বিশ্বাসঘাতকের সাথে থাকতে চাই না।”
অরিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মিনতির স্বরে বলল,” বিশ্বাস করো আমি কিছু করিনি৷ তোমাকে ঠকাইনি। তোমার মা মিথ্যে বলেছেন।”
ইলহান রূঢ় কণ্ঠে বলল,” নিজে অন্যায় করে আমার মাকে দোষারোপ করছো? নির্লজ্জ!”
অরিন হড়বড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠল। চোখ মেলে দেখল সে সত্যিই কাঁদছে। ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বাজে। ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়! এই স্বপ্নটাও সত্যি হয়ে যাবে না তো? কপাল ঘামতে লাগল অরিনের। পাশেই ইলহান শুয়ে ছিল। অরিনের নড়াচড়া টের পেয়ে তার তন্দ্রায় ছেদ পড়ল। মৃদু হেসে বলল,” গুড মর্ণিং।”
অরিন ঢোক গিলল। নিজেকে ধাতস্থ করে সেও বলল,” গুড মর্ণিং।”
ইলহান একহাতে অরিনকে কাছে টানল। অরিন মাথা রাখল ইলহানের উন্মুক্ত বুকে। আনমনে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, তুমি কখনও আমাকে অবিশ্বাস করবে না তো?”
হঠাৎ এমন খাপছাড়া প্রশ্নে কিঞ্চিৎ অবাক হলো ইলহান। অরিন তাকাল কৌতুহল নিয়ে। দেখল ইলহান তার সুন্দর ঠোঁট প্রসারিত করে হাসছে। ভ্রু কুচকে বলল,” তোমাকে অবিশ্বাস করবো কেন?”
” যদি কোনো কারণে করতে হয়?”
” হবেই না। এমন কোনো কারণ থাকা অসম্ভব। যে কারণে আমি তোমাকে অবিশ্বাস করবো।”
” সত্যি?”
” হুম।”
অরিনের দৃষ্টি ছুটে গেল অদূরে বারান্দার জানালায়। কাঁচের গ্লাস হালকা খোলা। শীতল বাতাস ঢুকছে ফুরফুর করে। সাদা পর্দা দুলছে। আকাশটা খানিক মেঘলা। বৃষ্টি নামতে পারে যেকোনো সময়। অরিন বিভোরতায় মগ্ন থেকে বলল,” আই লভ দিজ ওয়েদার।”
ইলহানও একইভাবে বলল,” এন্ড আই লভ দিজ গার্ল।”
অরিন খেয়াল করল সে যতটা মুগ্ধতা নিয়ে বারান্দায় তাকিয়ে ছিল ঠিক ততটা মুগ্ধতা নিয়েই ইলহান তার দিকে তাকিয়ে আছে। অরিন মুচকি হাসল। ইলহান মোহাচ্ছন্নের মতো অরিনের ঠোঁটে হাত বুলালো। তারপর গভীরভাবে চু’মু দিতে লাগল। অরিন চোখ বন্ধ করে ফেলল। অচিরেই তার চোখের কার্নিশ বেয়ে একবিন্দু জল গড়াল সুখবৃষ্টি হয়ে।
সকালে ইলহান আর অরিন তৈরী হলো অরিনদের বাড়ি যাওয়ার জন্য। নিচে ইলহান গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে গিয়েছিল। অরিন আয়নায় দাঁড়িয়ে শাড়িটা ঠিক করছিল। এমন সময় মোবাইলে ফোন এলো। হালিমা কাঁদতে কাঁদতে জানালেন,” তারিনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
অরিন স্তব্ধ হলো। মোবাইলটা হাত থেকে খসে পড়ে গেল। কিছুক্ষণ পর অরিন নিজেও বসে পড়ল ভূমিতে। কতক্ষণ যে কেটে গেল হিসাব নেই। হঠাৎ সম্বিৎ ফিরল ম্যাসেজ টোনের শব্দে। অপরিচিত নাম্বার দেখে অরিন বাতাসের গতিতে ফোন হাতে নিল।
” তারিনের ভালো চাইলে কাউকে কিছু না জানিয়ে সেদিনের ওই আবাসিক হোটেলেই আজ বিকাল পাঁচটায় আমার সাথে দেখা করতে আসবে তুমি। নাহলে তারিনের লাশ তোমার বাড়ির সামনের পঁচা নর্দমায় পাওয়া যাবে।”
অরিন আৎকে উঠল। অতর্কিতে সিদ্ধান্ত নিল, সে হাসাদ ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কিছুক্ষণ পরেই ইলহান ফোন করল। অরিন নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ফোনটা রিসিভ করল,” হ্যালো।”
” কতক্ষণ লাগবে অরিন? বের হও?”
অরিন কিছুসময় চুপ থেকে ঢোক গিলল। তারপর বলল,
” শোনো, প্ল্যানে একটু পরিবর্তন হয়েছে। আজকে আমি যেতে পারবো না। মা নিষেধ করেছে আজকে যেতে। ওদের কয়েকদিন পর নিয়ে আসবো।”
” ও। আচ্ছা ঠিকাছে। এজ ইউর উইশ।”
অরিন ইলহানের ফোন কেটে মায়ের নাম্বারে কল দিল। হালিমা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। অরিন মাকে শান্ত করতে বলল,” মা তুমি কিচ্ছু চিন্তা কোর না। আমি তারিনকে নিয়ে আজকে বিকালের মধ্যে বাসায় আসবো।”
” কি বলছিস? তুই কই পাবি ওকে?”
অরিন এই প্রশ্নের জবাব দিল না। ফোন রেখে লম্বা শ্বাস টানল। হাসাদ ভাইয়ের কথামতো বিকাল পাঁচটায় অরিন সেই নির্দিষ্ট জায়গায় হাজির হলো। একজন অপরিচিত লোক অরিনকে উপরে নিয়ে এলো। একটা রুমে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে বলল। অরিন কঠিন গলায় প্রশ্ন করল,” আমার বোন কোথায়?”
লোকটি জবাব দিল না। এর কিছুক্ষণ পরেই হাসাদ ভেতরে প্রবেশ করল। অরিনের হৃদকম্পন তাড়িত হলো। ত্রাসিত কণ্ঠে বলল,” আপনি যা বলেছিলেন তাই করেছি। এবার আমার বোনকে ছেড়ে দিন।”
হাসাদ হাসল। অস্বাভাবিক শয়তানি হাসি। অরিনের আর্তচিৎকার দিতে মন চাইল। হাসাদ ঠোঁটে হাসি রেখেই বলল,” এখনও কিছুই করোনি। আসল কাজ বাকি আছে। যেটা বিয়ের আগে হয়নি, সেটা বিয়ের পরে হবে। দুঃখ শুধু একটাই। আমার সাথে বিয়েটা হলো না তোমার। হয়েছে অন্যকারো সাথে। কিন্তু তাতে কি?”
অরিন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আওড়াল,” কি বলতে চান?”
” তোমাকে আমি আগেও বলেছি অরিন। আমি সোজা কথার মানুষ। এতো ন্যায়-অন্যায় বুঝি না। যেটা আমি একবার কামনা করি, সেটা যে-কোনো মূল্যে আদায় করেই ছাড়ি।”
অরিন কান্না ছেড়ে দিয়ে বলল,” তারিন কোথায়?”
” পাবে। বলছি তো পাবে। কিন্তু তার আগে আমাকেও যে কিছু দিতে হবে। মুক্তিপণ হিসেবে তোমাকে লাগবে আমার। মাত্র কিছুসময়ের জন্য।”
অরিন ঘৃণায় চোখমুখ কুচকে ফেলল। একবার ইচ্ছে হলো আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করতে। কিন্তু এর আগেই দরজায় ঠকঠক শব্দ হলো। হাসাদ বিরক্ত হলো প্রচুর। ভ্রু কুচকে বলল,” অসময়ে মানুষ কেন যে আসে! ”
কথা বলতে বলতে সে দরজা খুলতেই ভয়ে জমে যাওয়ার মতো দৃশ্য দেখল অরিন। ইলহান এবং মিসেস ইলোরা দাঁড়িয়ে আছে।
চলবে