#সুখবৃষ্টি-৪
মিসেস ইলোরা ভেতরে প্রবেশ করেই সর্বপ্রথম হাসাদের গালে চড় দিলেন। চড়ের সপাট শব্দে কেঁপে উঠল অরিন। সামনে তাকাতেই দেখল ইলহানের তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া তার দিকে চেয়ে আছে। হৃদয়ে বিস্ফোরণ শুরু হলো অরিনের। ইলহান অরিনের উপর নিষ্পলক দৃষ্টি রেখেই ধীরপায়ে ঘরে প্রবেশ করল। ওর ওই দৃষ্টি কেবল অরিনকে ব্যথা দিচ্ছে। অরিন টের পাচ্ছে তার ভেতরের ছিন্নতা, র’ক্তাক্ততা। মিসেস ইলোরা ক্রোধান্বিত স্বরে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,” এই অসভ্য, লম্পটের সাথে অরিনের সম্পর্ক বিয়ের আগে থেকেই ছিল। শুনেছি তোর সাথে বিয়ে হওয়ার আগে এই বদমাইশটার সাথেই নাকি অরিনের বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বার-বার জেলে যাওয়া, অশিক্ষিত, গুন্ডা ধরণের এই লোকটিকে অরিন কেন বিয়ে করবে? কিসের এতো বাধ্যতা তার? আর আজ কেনোই বা সবাইকে লুকিয়ে এই অসভ্যের সাথে এইরকম একটা হোটেলে দেখা করতে এলো সে? তোকে বলেছিলাম না, আমি অরিনের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছি? নবীন সাহেবকে দিয়ে অরিনের প্রত্যেকটি পদক্ষেপ আমি নজর রাখছিলাম। আর আজ তো হাতেনাতেই ধরলাম। এরপরেও কি আমার কথা বিশ্বাস করবি না?”
ইলহান মায়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। তার ধারালো অথচ ঠান্ডা দৃষ্টি তখনও অরিনের দিকে নিবদ্ধ। ধীরকণ্ঠে প্রশ্ন করল,” এখানে কেন এসেছো অরিন?”
অরিন নিজেকে সামলে নিয়ে কিছু বলতে নিচ্ছিল। তার আগেই ইলোরা,” ও আর কি বলবে? এখন ওর কথা শুনেও তো লাভ নেই। নিজের চোখে যেটা দেখলি সেটা অবিশ্বাস করে কি ওর মুখের কথা বিশ্বাস করবি তুই?”
অরিন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,” মা আমার বোন..”
” একটা কথাও বলবে না তুমি। তাহলে আমার হাতটা এখন তোমার উপরেও উঠবে। সেটা যদি না চাও তাহলে চুপ থাকো। আর এই ছেলে, তোমার সাথে অরিনের সম্পর্ক কয়দিনের বলো?”
হাসাদ আঁড়চোখে একবার ইলহানের দিকে চেয়ে বলল,” বিয়ের আগে থেকেই।”
” বিয়ের পরেও তোমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল?”
” হ্যাঁ। অরিন যোগাযোগ রাখতে চায়নি। পয়সাওয়ালা স্বামী পাওয়ার পর আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিল না। তখন আমি ওকে ব্ল্যাকমেইল করেছি যে আমাদের প্রাইভেট ভিডিও ভাইরাল করে দিবো।”
” তোমাদের প্রাইভেট ভিডিও আছে?”
” হ্যাঁ আছে। সেগুলো ডিলিট করার বিনিময়েই তো আজ অরিন আমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
ইলোরা অগ্নিদৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,” দেখেছিস? কাহিনী কতদূর? আমি আগেও বলেছিলাম এসব ফকিন্নীদের চরিত্র ঠিক থাকে না। আমার একটা কথাও যদি বিশ্বাস করতি তাহলে আজকে এইদিন দেখতে হতো না।”
অরিনের চোখ থেকে টপাটপ পানি ঝরতে লাগল। চোখমুখ কুচকে দুইহাতে মুখ চাপল লজ্জায়, অপমানে। ইলহান বলল,” তুমি অরিনকে নিয়ে বাড়ি যাও মা। আমি আসছি।”
” বাড়ি যাবো মানে? এই মেয়েকে আমি আবার আমার বাড়িতে প্রবেশ করতে দিবো এই কথা ভাবলি কি করে তুই? ওর ছায়াও আমি দেখতে চাই না আমার বাড়ির আশেপাশে। ”
মিসেস ইলোরা রাগে গজগজ করছেন। অরিন কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারল না। এই মুহূর্তে তার কথা কেউ সহ্যই করতে পারছে না; বিশ্বাস তো দূর।ইলহান শান্ত গলায় বলল,” ঠিকাছে, তাহলে অন্তত ওকে একটা ট্যাক্সি ডেকে দাও। ও নিজের বাড়িতে ফিরে যাক।”
” হ্যাঁ সেটাই করতে হবে। কিন্তু এখনি কেন? এতোবড় অন্যায় করার পরেও কি ওদের কোনো শাস্তি হবে না?”
” হবে। কিন্তু এখানে না।”
মিসেস ইলোরা আরও কিছুক্ষণ ক্ষোভ ঝারলেন। ইলহান তাকে শান্ত করে হোটেল থেকে বের করে আনল। অরিনকে ট্যাক্সি ডেকে দিল। যাওয়ার আগে অরিন ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,” শোনো,তারিনকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”
ইলহান শক্ত গলায় বলল,” তারিন বাড়িতেই আছে। গেলেই দেখতে পাবে।”
অরিন অবাক হলো। ইলহান তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিল না। হাসাদের কাঁধে হাত রেখে বলল,” চলুন যাওয়া যাক।”
হাসাদ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করল,” কোথায় যাবো ভাই?”
” আসুন বলছি। আমার স্ত্রীর ব্যাপারে এখনও অনেক কিছু জানার আছে। আপনি সব বলবেন আমাকে।”
অরিন নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল। ট্যাক্সি ততক্ষণে ছেড়ে দিয়েছে। সে আর বাহিরে তাকাল না। বুঝে নিল দুঃস্বপ্নটাই সত্যি হয়ে গেছে। ইলহান যদি তাকে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করতো তাহলে হাসাদের কাছে এভাবে সব জানতে চাইতো না। মিসেস ইলোরাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে হাসাদের সাথে বাইকে উঠল ইলহান। হাসাদ বাইক স্টার্ট দিয়েই জিজ্ঞেস করল,” আমরা কোথায় যাচ্ছি ভাই?”
” সামনে চলুন।”
অরিনকে অসময়ে বাড়ি আসতে দেখে অবাক হলেন হালিমা। প্রশ্নের উপর প্রশ্ন শুরু করলেন। বড় আপাকে ফিরতে দেখে তারিন আর জেরিন ছুটে এলো। তাদের মুখ হাসি-খুশি। অরিন দূর্বল কণ্ঠে জানতে চাইল,” তারিনকে কোথায় পেলে মা?”
” ওর একটা বন্ধুর নাকি জন্মদিন ছিল আজ। আমাকে বললে তো যেতে দিতাম না। তাই না বলেই চলে গেছে। সারাদিন ধরে আমি খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।”
” তাহলে ওকে পাওয়ার পর আমাকে জানালে না কেন?”
” তোকে ফোনে পেলাম না তো। তারপর জামাইয়ের মোবাইলে ফোন করে বললাম যেন তোকে জানিয়ে দেয়। জানায়নি?”
অরিন কোনো জবাব দিল না। হালিমা মেয়ের হাতে হাত রেখে প্রশ্ন করলেন,” কি হয়েছে তোর? হঠাৎ কিছু না বলে চলে এলি যে?”
অরিন বিরস মুখে বলল,
” এসে কি তোমাকে খুব সমস্যায় ফেলে দিলাম? বলো তাহলে চলে যাই।”
” ওম্মা, এমন ত্যাড়া জবাব দিচ্ছিস কেন? আমি তো এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। জামাই আসেনি যে? নাকি রাতে আসবে?”
” তোমার জামাই আর কোনোদিনও আসবে না মা।”
” মানে?”
অরিন জবাব না দিয়ে নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিল। ডিনারের সময় হালিমা খুব ডাকাডাকি শুরু করলেন। অরিন লাইট নিভিয়ে মাথায় বালিশ চেপে কাঁদছিল। দরজা ধাক্কানোর শব্দে বিরক্ত লাগল ভীষণ। পুরো পৃথিবী জ্বালিয়ে অঙ্গার করে দিতে ইচ্ছে হলো। হৃদয়ের দহনটা যদি একটু কমে তাতে। এদিকে হালিমা এমনভাবে দরজা ধাক্কাচ্ছেন যেন ভেঙেই ফেলবেন।
” অরিন দরজা খোল।”
” আমার খেতে ইচ্ছে করছে না মা। যাও, ঘুমাচ্ছি।”
” আরে, একটা জরুরী কথা শোন। তোর ঘুম-টুম সব পালিয়ে যাবে।”
এমনিতেও অরিনের ঘুম পালিয়ে গেছে। আর কোনোদিন সে শান্তিতে ঘুমাতে পারবে বলে মনে হয় না। হালিমা নাছোড়বান্দার মতো একস্বরে ডেকে যাচ্ছেন। অরিন অধৈর্য্য হয়ে দরজা খুলল। চিৎকার করে বলল,” কি সমস্যা? বলছি না ভালো লাগছে না? তুমি কি একটুও বোঝো না? মা হয়েছো কেন যদি মেয়ের মনের কথাই বুঝতে না পারো? আমাকে শ্বশুরবাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। আমার সংসার ভেঙে যাচ্ছে মা। আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। কাউকে বোঝাতে পারিনি। আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে।”
এগুলো বলতে বলতে অরিন ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল। হাঁটু জড়িয়ে কাঁদতে লাগল অসহায়ের মতো। হালিমা কিছুক্ষণ অবাক চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে থেকে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,” সংসার ভাঙা তেমন কোনো বিষয় না। এক সংসার গেলে আরেক সংসার হবে। এই নিয়ে এতো কাঁদার কি আছে?”
মায়ের কথা শুনে স্তব্ধ প্রতিবিম্ব হয়ে গেল অরিন। তার জীবন ধ্বংস হতে যাচ্ছে আর সে কাঁদবে না? মা কি আদৌ বুঝতে পারছে অরিনের কষ্টটা? হালিমা আগ্রহপূর্ণ গলায় বললেন,” এসব নিয়ে এতো চিন্তা করিস না। তার চেয়ে ভালো তোকে একটা মজার খবর দেই শোন। হাসাদকে কে যেন মে’রে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে তো। অবস্থা খুবই খারাপ। মা’রার আগে নাকি নেশা-টেশা করানো হয়েছিল৷ যে মে’রেছে সে খুব কৌশল জানে। আবার হসপিটালেও ভর্তি করে দিয়ে গেছে। ডাক্তার যখন জিজ্ঞেস করল,’ উনার এই অবস্থা কি করে হলো?’ তখন নাকি সগৌরবে বলেছে,’আমি করেছি।’ চিন্তা কর কত সাহস! তুই কি হসপিটালে যাবি একবার দেখতে?”
অরিন আবার চিৎকার করে বলল,” আমি ম’রে যাওয়ার মতো কষ্ট পাচ্ছি মা। আর তুমি হাসাদ ভাইকে নিয়ে পড়ে আছো? উনার জন্যই আমার জীবনের এই অবস্থা।”
” তাহলে তো তোর আরও বেশি করে যাওয়া উচিৎ। এখন বেহুশ হয়ে পড়ে আছে। তুই নাহয় গিয়ে আরও কয়েক ঘা মে’রে দিয়ে আসলি।”
” মা, তুমি আমার সাথে আর একদম কথা বলবে না। তাহলে আমি নিশ্চিত বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবো।”
এইটুকু বলেই দরজা আটকে দিল অরিন। হালিমা আর মেয়েকে বিরক্ত করলেন না। পরদিন ইলমি এলো অরিনের সাথে দেখা করতে। অরিন তখন ঘুমিয়ে ছিল৷ সারারাত কান্নাকাটির কারণে একটুও ঘুমাতে পারেনি। তাই সকালের ঘুমটা বেশি গভীর হয়ে গিয়েছিল। মা ডাকলেও সে শুনতে পায়নি। ইলমি চলে যাওয়ার পর অরিনের ঘুম ভাঙল। হালিমা রাগান্বিত স্বরে বললেন,” তোর ননদ এসেছিল।”
অরিন অস্থিরচিত্তে প্রশ্ন করল,” আমাকে ডাকলে না কেন?”
” ডেকেছিলাম। উঠিসনি তুই। ভালোই হয়েছে উঠিসনি। কেন এসেছিল জানিস?”
অরিন উদগ্রীব হয়ে বলল,” কেন?”
” তোকে অপমান করতে।”
” মানে?” অরিনের কথাটা বিশ্বাসই হলো না। ভেবেছিল অন্তত ইলমি তাকে বুঝবে। ঠান্ডা মাথায় বসিয়ে সবকিছু জানতে চাইবে। কিন্তু সেও বুঝল না? গাঢ় হতাশাময় দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। হালিমা রাগে গজগজ করে বললেন,” ভাইয়ের নাকি আবার বিয়ে দিবে। পাত্রীও নাকি রেডি আছে। শুধু ডিভোর্সটা হওয়ার অপেক্ষা। আমিও বলে দিয়েছি, আমার মেয়ে কোনোদিক দিয়ে পঁচে যায়নি। তোকেও আমি আবার বিয়ে দিবো। এর চেয়েও হাজারগুণ ভালো পাত্র দেখবো।”
অরিন খাওয়া ছেড়ে উঠে এলো। দরজা বন্ধ করে মেঝেতে বসল। বিছানা, বালিশ সব খামচে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। অরিন মনের রাগকে প্রশ্রয় দিল।
চলবে
লিখা- Sidratul Muntaz