#সুখবৃষ্টি- ৫(শেষ পর্ব)
বিছানার বালিশ, চাদর টেনে-ছিঁড়ে এলোমেলো করল অরিন। পুরো একটি দীর্ঘ দিন ও একটি দীর্ঘ রাত কাটিয়ে দিল না খেয়ে, না ঘুমিয়ে, শুধু কান্নাকাটি করেই। হালিমাও অরিনকে বিশেষ বিরক্ত করলেন না। মাঝে শুধু কয়েকজন পাত্রের সিভি এনে বললেন,” দ্যাখ তো পছন্দ হয় কি-না?”
অরিন তখন রেগে-মেগে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে ফেলল। হালিমা উচ্চস্বরে বললেন,” মানুষের কি সংসার ভাঙে না? এমন ভাব করছিস যেন তুই-ই প্রথম মেয়ে যার সংসার ভেঙেছে। মানুষ তো আর একা থাকতে পারে না সারাজীবন। বিয়ে-শাদী তো একটা করতেই হবে। ইলহান যদি তোকে ছাড়া সুখে থাকতে পারে তাহলে তুই কেন পারবি না?”
অরিন নিশ্চুপ কেঁদে যায়। মায়ের কথার জবাব দেয় না। নিজের মনের ভয়াবহ দহন কাউকে বোঝাতে পারে না। নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে। বেঁচে থাকাও যে এতো কষ্টদায়ক হতে পারে তা অরিন আগে বুঝেনি। অরিন নিজের বাড়িতে এসেছে দুইদিন হবে। প্রথম দিন শুধু ইলমি দেখা করতে এসেছিল। এরপর আর কেউ আসেনি। তৃতীয়দিন ইলহান নিজে থেকে অরিনকে ফোন করল। অরিন বাথরুমে ছিল। ফোনটা ধরতে তাই অনেক দেরি হয়ে গেল। ততক্ষণে লাইন কেটে গেছে। অরিন বাথরুম থেকে এসে ইলহানের নাম্বার দেখেই চমকে উঠল। হাত-পা কাঁপতে লাগল উত্তেজনায়। মোবাইলটা চেপে ধরে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল কখন আবার ফোনটা আসবে! কিন্তু এলো না। সারাদিন আর একবারও ফোন এলো না। অরিনের মন বিষণ্ণতায় ছেয়ে গেল। অভিমান হলো তীক্ষ্ণ। মানুষটা এমন কেন? একবার অরিন ফোনটা ধরতে পারেনি বলে কি আর একটাবারও ফোন দিবে না?অরিনের সারাদিন কাটল অপেক্ষায়। অবশেষে রাতে আবার এলো সেই কাঙ্ক্ষিত ফোন কল। অরিন এবার একটুও দেরি করল না। ঝটপট রিসিভ করে নিল। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারল না। অহেতুক একটি দ্বিধা গলার কাছেই আটকে রইল। ইলহান শীতল স্বরে বলল,” হ্যালো।”
অরিন মোবাইল নিয়ে এক ছুটে মায়ের কাছে চলে গেল। ফোনটি মায়ের দিকে বাড়িয়ে বলল,” একটু কথা বলো না মা।”
হালিমা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন,” কে?”
” ও।”
” ও টা কে?”
” আরে বুঝতে পারছো না? যাকে তুমি জামাই ডাকো।”
” ইলহান ফোন করেছে নাকি? তো আমাকে দিচ্ছিস কেন? তোকে ফোন করেছে তুই না কথা বলবি।”
অরিন মাথা নিচু করে বলল,” আমার ভয় লাগছে।”
” কেন?”
” যদি বকা দেয়? কিংবা ডিভোর্সের কথা বলে?”
” বললে বলবে। তুইও ডিভোর্স দিয়ে দিবি। এতো সস্তা? নাকি বাংলা সিনেমার সাবানার মতো স্বামীর পায়ে ধরে কাঁদবি? যেও না গো স্বামী, তুমি ছেড়ে গেলে এই জীবনে একলা হবো আমি!”
” উফ মা, এসব কি বলছো? ও শুনছে তো।”
” শুনলে শুনুক। আমি কি ভয় পাই নাকি? তোর মতো ভীতু আমি?”
হালিমা ফোন কিছুতেই নিলেন না। বাধ্য হয়ে অরিনকেই কথা বলতে হলো। আড়ষ্ট গলায় বলল,” হ্যালো।”
এতোক্ষণ ইলহান লাইনেই ছিল। কিন্তু যেই মাত্র অরিন ‘হ্যালো’ বলল, ওমনি সে ফোনটা কেটে দিল। অরিন চমকে উঠল। ভাবল হয়তো ভুল করে কেটে গেছে৷ তাই আবার ফোন করল। কিন্তু এবার ইলহান ধরল না। অরিনের জীবনের আরও একটি রাত কাটল বিদীর্ণ হৃদয়ের তীব্র হতাশা নিয়ে।
পরদিন ঘুম থেকে উঠেই টাশকি খেল অরিন। ইলহান বসে আছে তার বিছানায়। অরিন চোখ কচলে আবার ভালো করে তাকাল। সত্যিই কি ইলহান? কিন্তু এটা কি করে সম্ভব? অরিন আবার চোখ বুজে ফেলল। সে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে। ইদানীং তো ঘুমালেই শুধু ইলহানকে স্বপ্ন দেখে। প্রতিটি স্বপ্নেই ইলহান এমন গুমোট মুখ নিয়ে অরিনের সামনে বসে থাকে। অরিন নিশ্চিত যে এইবার তাকালে আর ইলহানকে দেখবে না। সময় নিয়ে অরিন আবার চোখ মেলল এবং পুনরায় টাশকি খেল। ইলহানই বসে আছে তার সামনে। অরিন উঠে বসে ইলহানের হাতে চিমটি কাটল। ইলহান তৎক্ষণাৎ ভ্রু কুচকে হাতটা সরিয়ে ফেলল। বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দও বের করল। অরিনের হাত বিস্ময়ে মুখে চলে এলো। এর মানে ইলহান সত্যিই এসেছে! অরিন অনুনয়ের স্বরে বলল,” স্যরি, স্যরি, বেশি ব্যথা পেয়েছো? আমি বুঝতে পারিনি। আসলে বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।”
ইলহান নির্বিকার মুখে প্রশ্ন করল,” একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সবচেয়ে বেশি কি লাগে বলোতো?”
হঠাৎ এমন প্রসঙ্গ বহির্ভূত প্রশ্নে থতমত খেল অরিন। একটু ভেবে নিয়ে উত্তর দিল,” ভালোবাসা!”
ইলহান তাকালো গম্ভীর দৃষ্টিতে। দুইদিকে মাথা নেড়ে বলল,” উহুম। সবার আগে প্রয়োজন বিশ্বাস তারপর সম্মান। ভালোবাসা ছাড়াও মানুষ বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারে যদি তাদের মধ্যে বিশ্বাস আর সম্মানটা বজায় থাকে।”
অরিন বড় বড় চোখে অবুঝের মতো চেয়ে রইল। এতো কঠিনভাবে কথা কেন বলছে ইলহান? কখনও তো এইভাবে বলে না! অরিনের নিশ্চুপতা দেখে ইলহান মুখ ফিরিয়ে নিল৷ দেয়ালে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,” এই কয়দিন একবারও ফোন করোনি, ইলমি এসেছিল তার সঙ্গেও দেখা করোনি, আমি ফোন দিলাম তুমি কথাও বলোনি। কেন? কি সমস্যা তোমার?”
” ভয় লাগছিল।” অরিনের অপরাধী কণ্ঠস্বর। মন ভিজল না ইলহানের। রূঢ় কণ্ঠে বলল,” এই ভয়ের অর্থ কি জানো? তুমি আমাকে অবিশ্বাস করো।”
অরিন চকিতে মাথা তুলে তাকাল। অস্থিরভাবে বলল,” একদম না। কেন তোমাকে অবিশ্বাস করবো? ইলমি এসে মাকে বলেছে তুমি নাকি আবার বিয়ে করছো?”
” ঠিকই বলেছে। বিয়ে তো আমি করবোই। একটা না,আরও দশটা করবো। আর তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। তুমি শুধু এভাবেই ঘরের দরজা বন্ধ করে কাঁদবে। এটাই তোমার কাজ।”
অরিন সত্যিই কেঁদে ফেলল। ইলহান বিরক্ত কণ্ঠে ধমক দিল,” তুমি এতো বোকা কেন অরিন?”
অরিন চুপসে গেল। কান্নার গতি একটু কমল। বিনিময়ে বাড়ল ভয়,আতঙ্ক। ইলহান রাগী স্বরে বলল,” আমাকে হাসাদের ব্যাপারটা কি একবার জানানো যেতো না? কি ভেবেছো? আমি এসবের জন্য তোমাকেই দোষারোপ করবো? এই বিশ্বাস আমার প্রতি? এই চিনলে আমায়?”
” স্যরি। হাসাদ আমাকে হুমকি দিয়েছিল। যদি কাউকে কিছু জানাই তাহলে তারিনকে গুম করে ফেলবে। আর তখন তারিনকে কোথাও খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিল না।”
” তবুও তুমি একটাবার আমাকে বলে দেখতে। আমাকে বিশ্বাস করতে পারলে না অথচ ওই হাসাদকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে হোটেলে চলে গেলে?”
ইলহানের গলা অনেক বেশি চড়ে যাচ্ছিল। অরিন ভয়ে মুখে হাত চেপে ধরল৷ কেঁপে কেঁপে কাঁদতে লাগল। ইলহান ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে বলল,” কতবড় বিপদ হতে পারতো জানো? যদি মা তোমার উপর নজর না রাখতো আর আমাকে ঠিক সময় খবর দিয়ে ওই জায়গায় না নিয়ে যেতো তাহলে তোমার কি হতো অরিন? নিজের বোকামির জন্য নিজের কপালেই সর্বনাশ ডেকে আনতে যাচ্ছিলে। যদিও মায়ের উদ্দেশ্য তোমাকে রেসকিউ করা ছিল না। তিনি তোমাকে সন্দেহ করছিলেন। আর তার সন্দেহ এখন বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে শুধু তোমার একটা বোকামির জন্য।”
” এখন কি হবে? তিনি যদি আবার তোমার বিয়ে দিতে চায়? যদি আমাদের ডিভোর্স করায়?”
” একদম ঠিক হবে। ভালোই হবে।যে মেয়ে আমাকে বিশ্বাস করে একটা প্রবলেম পর্যন্ত শেয়ার করতে পারে না তার সঙ্গে সারাজীবন থাকার প্রশ্নই আসে না।”
অরিনের কান্নার জোর আবার বাড়ল। গুমরাতে গুমরাতে বলল,” আমি আর কখনও তোমার কাছে কিছু লুকাবো না। কিছু করার আগে সবসময় তোমাকে জানাবো৷ প্রমিস করছি।”
ইলহানের ভাবান্তর হলো না৷ অরিনের দিকে একটা ফাইল বাড়িয়ে দিল। অরিন বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো। একদম তার দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনা ঘটছে যেন। আহত কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
” এটা কিসের পেপার? তুমি কি আমাকে ডিভোর্স দিতে চাও?”
ইলহান একবার অরিনের চেহারার দিকে তাকালো। বেদনায় নীল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ডাগর চোখ দু’টো ফোলা ফোলা। যেন এখনি ঝর্ণা নামবে সেই চোখের কল বেয়ে। ইলহান সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলল,” হুম। ডিভোর্স পেপার। তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে আবার একটা বিয়ে করবো। শুনেছো না ইলমির কাছে?”
অরিন চট ইলহানের পায়ে ধরে ফেলল। তারপর নিজের কানে হাত রেখে বলল,” ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ মাফ করে দাও।”
” সব ভুলের মাফ হয় না। তুমি এখন আমার সাথে আমার বাড়িতে যাবে। তোমার যা যা জিনিসপত্র আছে সব নিয়ে এইখানে চলে আসবে। নাহলে আমি নতুন বউ ঘর তুলবো কি করে?”
অরিন বেদনাসিক্ত নয়নে চেয়ে রইল। ব্যথাতুর কণ্ঠে, বিমূঢ় হয়ে প্রশ্ন করল,” সত্যিই তুমি বিয়ে করবে?”
” হুম।”
” কাকে করবে?”
” সেটা জানবে খুব শীঘ্রই।”
অরিন মুখে হাত দিয়ে কান্নার দমক সামলালো। যা ভয় পেয়েছিল তাই হচ্ছে। অতি সহজভাবে পেয়ে যাওয়া ইলহানকে সে অতি সহজভাবেই হারিয়ে ফেলছে! অরিনের কপালের সুখ বেশিদিন সইল না। অরিনের ইচ্ছে হলো আরেকবার ইলহানকে অনুরোধ করে। আরেকবার ক্ষমা চায়। তাকে বুঝিয়ে বলে। কিন্তু আত্মসম্মান ভুলে বার-বার মিনতি করাও তার পক্ষে সম্ভব হলো না। যে যেতেই চাইছে তাকে জোর করে আটকে রাখবেই বা কয়দিন?
হালিমা ডাকছিলেন লাঞ্চ করার জন্য। দুই সেকেন্ডেই তিনি প্রবেশ করলেন অরিনের ঘরে। ইলহানকে হাসিমুখে বললেন,” এসো বাবা, হাত-মুখ ধুঁয়ে কিছু খেয়ে নাও। কথা বলার অনেক সময় পাওয়া যাবে।”
তারপর অরিনের দিকে চেয়ে বললেন,” আর তুই এমন পুতুলের মতো বসে না থেকে ওঠ। জামাইকে খাবার বেড়ে দে।”
অরিন বিস্ময় নিয়ে মায়ের দিকে তাকালো। যে মা এই কয়দিনে সকাল-বিকাল ইলহানকে গালাগাল করেছে সে হঠাৎ করে এতো আদর-আপ্যায়ন শুরু করল কেন এখন? হালিমা আবার তাগাদা দিলেন,” জলদি আয়।”
অরিন আর কাউকেই কিছু বলল না। নিরুপায় হয়ে চুপচাপ মায়ের সাথেই গেল। ইলহানকে ভাত বেড়ে খাওয়ালো। হালিমা ইলহানের পাশে বসে নানান গল্প জুড়লেন। তার মুখ থেকে হাসি সরছেই না। ইলহানও কত স্বাভাবিক। এদিকে অরিন তপ্ত আগুনে জ্বলে-পুড়ে ছাড়খাড় হচ্ছে। সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপমাত্র নেই। এসব দেখে আরও বেশি কষ্টে মুষড়ে যাচ্ছে হচ্ছে অরিনের মন। সে কি আসলেই এতো বড় অপরাধ করে ফেলেছে যে তাকে এতো নিদারুণ শাস্তি পেতে হবে? অরিনের মন চাইল চিৎকার করে বলতে,” থামো তোমরা, আমার দিকে তাকাও৷ আমার কথা শোনো। আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। বিরহের দাবদাহে ঝলসে যাচ্ছে আমার মন। আমার দিকে তাকাও কেউ।”
হালিমা ধমক দিয়ে বললেন,” কিরে, তোকে কি এখানে স্ট্যাচু অফ লিবার্টি সেজে দাঁড়িয়ে থাকতে এনেছি? জামাইয়ের পাতে মাংস দে।”
অরিন থতমত খেয়ে ইলহানের প্লেটে মাংস তুলে দিল। ইলহান স্বাভাবিক চোখে অরিনের দিকে তাকালো একবার। তারপর খাওয়ায় মনোযোগ দিল। যেন খাওয়াই দুনিয়ার সব! যাকে ডিভোর্স দিতে এসেছে তার বাড়িতে বসেই এমন কবজি ডুবিয়ে খেতে লজ্জা করছে না? আর মা-ও কেমন জামাই আদর দেখাচ্ছে মানুষটাকে। অরিনের মা-ই বোধহয় ইতিহাসের প্রথম মা যে মেয়ের সংসার ভাঙা নিয়ে এতো খুশি! কি আশ্চর্য! সবাইকে খুব অচেনা লাগছে অরিনের। নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে পৃথিবীটাকে।
খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ হলে অরিনকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তৈরী হতে হলো ইলহানের বাড়ি যাওয়ার জন্য। অরিন একবার মুখ ভার করে বলল,” আমার লাগবে না কোনো জিনিস৷ ওগুলো আপনার কাছেই রেখে দিন।”
ইলহান তখন রুক্ষ গলায় জবাব দিল,” তোমার জিনিস আমারও লাগবে না। তাছাড়া ওইসব থাকলে পুরনো স্মৃতি বেশি বেশি মনে পড়বে। আমি চাই না পুরনো কথা আর মনে রাখতে। এখন আমার নতুন জীবন নিয়ে ভাবার সময়।”
অরিন বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। এটাই কি তার সেই ইলহান? যে হঠাৎ সুখবর্ষণের মতো জীবনে এসেছিল? সে এখন অরিনের জীবনটাকে দুঃখের সমুদ্র বানিয়ে চলে যেতে চাইছে! খুব অভিমান হলো। যদি এভাবেই ছেড়ে যাবে তাহলে সেদিন কেন এসেছিল? যেই হাত একদিন ছেড়েই দিবে সেই হাত কেন ধরেছিল? কেন পোড়াকপালে ঠাঁয় দিয়েছিল সুখের সুভাষ! অরিন বোকা, আসলেই বোকা। সে বুঝতে পারেনি ইলহানকে৷ মানুষটা ঋতুর মতো বদলে গেল। অরিনের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ মাঝরাস্তায় সিগন্যাল পড়ায় অরিন দেখল হাসাদ ভাইয়ের মোটরসাইকেল। তার সামনে একজন, পেছনে আরেকজন। মাঝখানে স্যান্ডউইচের কিমার মতো বসে আছেন তিনি৷ হাত-পায়ে ব্যন্ডেজ। চেহারা প্রায় বদলেই গেছে। মোটরসাইকেল আর শার্টের কালার ঠিক না থাকলে অরিন চিনতেই পারতো না। মায়ের কাছে শুনেছিল মানুষটা নাকি হসপিটালে ভর্তি। আজ বুঝি তাকে রিলিজ দিয়েছে? অরিনের দিকে চোখ পড়তেই ঝটিতে মুখ ফিরিয়ে নিল হাসাদ। যেন দিনের বেলায় ভূত দেখে ফেলেছে। অরিন বুঝল না, হাসাদ ভাই তাকে এতো ভয় পাচ্ছে কেন? ইলহান নির্ণিমেষ অরিনকে জানালায় চেয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করল,” কি দেখছো?”
অরিন আঙুল তুলে বলল,” হাসাদ ভাই।”
” ও।”
” উনার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”
” আমি কিভাবে জানবো?”
” মা বললেন, কেউ একজন উনাকে নিষ্ঠুরের মতো পিটিয়ে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে গেছে৷ তখন আমি মায়ের কথা বিশ্বাস করিনি। কিন্তু এখন দেখছি সত্যিই! ইশ, বেচারা।”
” তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে? দরজা খুলে দিবো নাকি? চলে যাবে তার কাছে?”
ইলহানের খোচা বুঝতে পেরে অরিন ফ্যাকাশে কণ্ঠে বলল,” তুমি আমার সাথে এমন করছো কেন?”
ইলহান সামনের দিকে চেয়ে দায়সারাভাবে বলল, ” তাহলে কেমন করা উচিৎ? ”
অরিন আর কোনো জবাব দিল না। আর কাঁদলও না। বুকের ভেতর শুধু তীক্ষ্ণ চিনচিনে একটি ব্যথা অনুভব করল। গাড়ি থামল ইলহানদের বাড়ির পার্কিংলটে। অরিন আড়ষ্ট হয়ে বলল,” শোনো, আমি উপরে যাবো না। মা আমাকে দেখলে সিন ক্রিয়েট করতে পারে৷ তুমি জরীকে দিয়ে আমার জিনিসগুলো নিচে পাঠিয়ে দাও।”
ইলহান উত্তপ্ত দৃষ্টিতে বলল,” কেউ সিন ক্রিয়েট করবে না।চলো।”
অরিনকে যেতে হলো। দরজা খুলল জরী। অরিনকে দেখে হাসিমুখে বলল,” ভাবী আসছেন? কেমন আছেন ভাবী?”
অরিন নিশব্দে হাসল। মাথা নেড়ে জবাব দিল। বৈঠকঘরেই বসে টিভি দেখছিলেন শায়িখ সাহেব। অরিন আর ইলহানকে ঢুকতে দেখে স্মিত হাসলেন। অরিনকে জিজ্ঞেস করলেন,” কি অবস্থা মা? তোমার বাড়ির সবাই ভালো আছে?”
অরিন শ্বশুরের হাসি-খুশি মুখ দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ল। তিনিও কি ছেলের দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মত? নাহলে এভাবে হাসবেন কেন? ডাইনিংরুমেই দেখা হলো মিসেস ইলোরার সাথে। তিনি টেবিলে বসে কিছু খাচ্ছিলেন। অরিনকে দেখেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করলেন না। বোঝাই যাচ্ছে যে ইলহান পুরো পরিস্থিতি সামলে রেখেছে। ইলমি ঝট করে এসে অরিনকে খপ করে জড়িয়ে ধরল। আনন্দিত কণ্ঠে বলল,” কেমন আছিস?”
অরিন কোনো জবাব দিল না। এই মুহূর্তে একেও সহ্য হচ্ছে না। তার ভাই অরিনকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করে নিচ্ছে। আর এদিকে সবাই কাটা ঘাঁয়ে নূনের ছিটা দেওয়ার মতো একই প্রশ্ন বার-বার করে যাচ্ছে। ” কেমন আছিস, কেমন আছিস?” অরিনের কেমন থাকার কথা? ইলহান হাত ধরে বলল,” ঘরে চলো।”
ইশ, এমনভাবে ঘরে ডাকা হচ্ছে যেন রোম্যান্স করবে। অথচ একটু পরেই তো তাকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হবে। অরিন মাথা নিচু করে ইলহানের সাথে ঘরে ঢুকল। সাজানো-গোছানো রুমটি মাত্র কয়েকদিনেই খুব বেশি আপন হয়ে গেছিল অরিনের। এখন সব ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবেই কান্না পাচ্ছে। ছোট্ট শিশুর মতো মেঝেতে আছড়ে পড়ে বলতে মন চাইছে,” আমি যাবো না। কোথাও যাবো না।”
অরিন কান্নার দমক সামলাতে নিজের মুখ চেপে ধরল। ঠিক তখনি এক ঝটকায় অরিনের কোমর টেনে তাকে কাছে নিয়ে এলো ইলহান। জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। অকস্মাৎ এই আক্রমণে অরিন হতভম্ব। নিজেকে ছাড়াতে চাইলে ইলহান ধমক দিল। তার হাতের স্পর্শ আরও শক্ত করল। উষ্ণ ঠোঁট দিয়ে স্পর্শ এঁকে দিল অরিনের কপাল। নাক ডুবিয়ে পিপাসার্তের মতো চুলের গন্ধ নিল বুক ভরে। অরিনের নরম শরীর বন্দী হলো ইলহানের বলিষ্ঠ পেশিতে। নড়াচড়া করার জো রইল না। ইলহান চু’মু দিল অরিনের ঠোঁটে। দীর্ঘ, গাঢ়, তৃষ্ণার্তের মতো ছিল সেই চুম্বন। অরিন চোখ বন্ধ করল। নোনাজল প্রবাহিত হচ্ছিল চোখের কার্নিশ দিয়ে। সেই জল আলতো হাতে মুছে দিল ইলহান। নরম ও সিক্ত কণ্ঠে বলল,” আমাকে অবিশ্বাস করার জন্য আরও কিছুদিন কষ্টে রাখতে চেয়েছিলাম তোমাকে। কিন্তু পারলাম না। তোমাকে কষ্ট দেওয়া মানে নিজেকেই শাস্তি দেওয়া।”
অরিন অশ্রুরুদ্ধ হয়ে বলল,” তুমি এতো ভালো কেন?”
ইলহানের থেকে জবাব এলো সকৌতুকে,” তুমি অনেক বোকা তো, তাই।”
অরিন হাত দিয়ে চাপড় মারল ইলহানের কাঁধে। চোখ মুছতে মুছতে বলল,” তাহলে ডিভোর্স পেপার কেন আনলে?”
ইলহান আবার হাতে নিল রিপোর্টটি। অরিনের দিকে বাড়িয়ে বলল,” পড়ে দেখো।”
অরিন কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটি নিল। কভার পেইজ দেখেই বুঝতে পারল মেডিকেল রিপোর্ট। কিছুদিন আগে সে আর ইলহান ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল চেকাপের জন্য। সেই রিপোর্ট হাতে এসেছে আজ। অরিন প্রেগন্যান্ট! মুহূর্তেই খুশিতে ঝলমলিয়ে উঠল অরিনের চেহারা। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” এটা কি সত্যি?”
ইলহান হাত সরিয়ে নিল। ভ্রু কুচকে বলল,” এবার চিমটি নিজের হাতে কাটো। আমাকে না। ”
অরিন হেসে ফেলল। কান্না মুছে গিয়ে চোখে জমল খুশির অশ্রু। জীবনটাকে এক মুহূর্তের জন্য স্বপ্নময় বোধ হলো। তারপর এক পর্যায় ইলহান হতাশ কণ্ঠে বলল,”কেন এতো ভয় পাও অরিন? আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে আরেকজনকে বিয়ে করবো এই কথা বিশ্বাস করতে পারলে তুমি?”
অরিন কানে হাত দিয়ে বলল,” তোমার উপর বিশ্বাস আছে। কিন্তু নিজের ভাগ্যের উপর একটুও বিশ্বাস নেই। তাই ভয় হয়। স্যরি, এক্সট্রিমলি স্যরি।”
ইলহান দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অরিনকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিয়ে বলল,” আর কখনও অবিশ্বাস করবে না তো?”
অরিন দুইহাতে ইলহানের পিঠ জাপটে ধরল। দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” কক্ষনও না।”
মা এর অদ্ভুত ব্যবহার নিয়ে অরিন সন্দিগ্ধ থাকলেও এখন মানেটা ধরতে বেশি বেগ পেতে হলো না। তিনিও সবার মতো নাটক করেছেন। পুরো ঘটনা জেনেও চুপ থেকেছেন। অরিনকে কষ্টে রেখেছেন। এতে অবশ্য একটা দিক ভালোই হয়েছে। অরিন জীবনে কখনও আর ইলহানের কাছে কিছু গোপন করবে না৷ তিনদিন একটানা কাঁদতে কাঁদতে ঢের শিক্ষা হয়ে গেছে তার। অরিন অভিমানী কণ্ঠে বলল,” মাও সব জানতো তাই না?”
” সবাই সব জানতো।”
” খুব খারাপ তুমি।”
” বেশি কষ্ট পেয়েছো?”
” মুখ দেখে বোঝা যায় না? পুরো তিনদিন একটুও ঘুমাতে পারিনি।”
” কিন্তু আমি বাড়িতে গিয়ে তো দেখলাম তুমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো!”
” ওইটা ঘুম ছিল না। তন্দ্রা ছিল। সারারাত কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে একটু চোখ বুজে রেখেছিলাম।”
” ও তাই?”
” হুম।”
ইলহান অরিনকে পাজাকোলায় তুলে বলল,” ঠিকাছে, তাহলে এখন চলো ঘুমাবে।”
” এখন তো আমার ঘুম আসছে না।”
” আমি ঘুম এনে দিবো তো।”
বালিশে শুয়েই অরিন দুইহাতে মুখ ঢাকল। লাজুক কণ্ঠে বলল,” ছাড়ো আমার ঘুম আসছে।”
” মাত্র না বললে ঘুম আসছে না?”
” কিন্তু এখন আসছে।”
” এদিকে তাকাও না, বাবুর আম্মু!”
অরিন মুখ থেকে হাত সরালো। চোখ বড় করে বলল,” বাবুর আম্মু?”
” হুম। এইতো আমাদের বাবুটা। ওর এখনি একটা নাম ঠিক করে ফেললে কেমন হয়?”
” ভালো। কি নাম রাখবে?”
” উম, নাম হবে বৃষ্টির নামে। যেহেতু তোমার-আমার দু’জনেরই বৃষ্টি পছন্দ। ”
” বৃষ্টির নামে কি নাম?”
” ছেলে হলে বর্ষণ আর মেয়ে হলে বৃষ্টি। নাম হবে বর্ষণ অথবা বৃষ্টি। কিন্তু আমরা তাদের ডাকবো সুখবর্ষণ অথবা সুখবৃষ্টি বলে।”
অরিনের খুব মনে ধরল ব্যাপারটা। চোখ বুজে আদুরে কণ্ঠে বলল,” বাহ, খুব সুন্দর।”
ইলহান অরিনের চোখেমুখে আদুরে পরশ দিতে দিতে বলল,” আমার জীবনে সুখবৃষ্টি এনে দেওয়ার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ অরিন।”
” বৃষ্টি কেন বলছো? বর্ষণও তো হতে পারে।”
” উহুম বৃষ্টিই হবে। আমি জানি।”
“জ্বী না, বর্ষণ হবে। আমার তো এটাই মনে হচ্ছে।”
ইলহান অরিনের মুখ চেপে ধরল। তেজ নিয়ে বলল,” আমি বললাম না বৃষ্টি?”
অরিন মুখ থেকে হাত সরিয়ে দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলল,” আমি বললাম না বর্ষণ?”
” বৃষ্টি।”
” বর্ষণ।”
” না, বৃষ্টি।”
” না, বর্ষণ।”
” বৃষ্টি,বৃষ্টি,বৃষ্টি।”
অরিন আর কিছু বলার আগেই ইলহান তার ঠোঁট আটকে দিল। অরিন চোখ বন্ধ করতেই অনুভব করল স্নিগ্ধ ভালোবাসার জোয়ার। সুখের বর্ষণ অথবা বৃষ্টি হয়ে এভাবেই ভালোবাসা নামুক সর্বহৃদয়ে। বিশ্বাস ও ভালোবাসার জোর অটুট থাকুক।
_____
সমাপ্ত
লিখা- Sidratul Muntaz