তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০৩

0
717

#তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০৩
লেখনী: #তাসমিয়াহ

সায়ান ভাইয়া আম্মুকে কী বলে গেলো জানি না। কথা বলতে চাওয়া মাত্রই হতচকিত হলেও তা প্রকাশ করতে চাইলেন না। ভাইয়াকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে বসলেন। আর আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম দরজার কাছেই। চিন্তা এটাই করছিলাম যে নিশ্চয় সায়ান ভাইয়া কথাগুলো বলে দেবার পর তিনি চলে গেলে আম্মু আমাকেও বের করে দেবেন। আবার এমনও হতে পারে যে তার সাথেই বের করে দিল!

আধঘণ্টা মত কথা বলবার পর দুজনেই বেরিয়ে এলেন। সায়ান ভাইয়া স্বাভাবিক, বরং চেহারায় লাবণ্য ঠিকঠাক রয়েছে। বরং মনে হচ্ছে কোনো শুভ শুরুয়াতের উদ্বোধন করে আসলো। আম্মু থমথমে, চুপচাপ। আমায় ইশারা করে বললেন যাতে সায়ান ভাইয়াকে এগিয়ে দিয়ে আসি। খানিক বিরক্ত হলাম আমি। এত বড় ছেলেকে এগিয়ে দিয়ে আসবার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি? তাও আবার তাকে এগিয়ে দিতে হবে, যার জন্য এখন নিজেরই বেরিয়ে যেতে হবে। এর চেয়ে বরং আম্মু সরাসরি বললেই পারতো যে ওর সাথে বা পিছুপিছু বেরিয়ে যাও। যদিও সাথে তো নিয়ে যাবে না। আরেকটু তামাশা হবে, এটুকুই।

সব ভাবনা মনে মনে চাপিয়ে রেখে সায়ান ভাইয়ার পিছুপিছু বের হলাম। মেইন গেট পার হয়ে যেতেই ভাইয়া ইশারায় বুঝাল যে আর যেতে হবে না সাথে। রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তাচ্ছিল্য সূচক হাসি পেলো আমার। একটু পর আম্মু বের করে দিলে কোথায় আশ্রয় হবে তা ঠিক নেই, আবার অন্ধকারের পরোয়া! হাসলাম না তবুও। ভাইয়া এবার আমার দিকে ফিরে বললেন –

“নিজের কাজ আর জীবনের দিকে মনোযোগ দাও মিহির। এসব আবেগী চিন্তায় ভেসে যাবার কোনো মানে হয় না। বয়সটা আবেগের হলেও একটু কন্ট্রোল আনা বিরাট কঠিন কাজ নয়। আমি তোমার থেকে বেশ সিনিয়র। এক কথায় আমার সাপেক্ষে তুমি বাচ্চা সম। আর আমার ব্যক্তিগত পছন্দ আছে। কোনো একজনের প্রতি আমার অনুভূতিগুলো জমা করে রাখছি। তাই তোমার আবেগকে কিঞ্চিৎ সময়ের জন্যও প্রশ্রয় দেয়া সম্ভব না।”

সায়ান ভাইয়ার কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিলাম। কখন যে কেঁদে ফেলেছি বুঝতেই পারিনি। কিন্তু অন্ধকারটা ঘোর লাগানো বলে আমার জানা মতে সে বুঝতে পারেনি। অবশ্য আলোতেও পারবার কথা ছিল না। কারণ কারো দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করতে হলে নিজের মন আর অনুভূতির কিছু অংশ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু যেহেতু ওনার মনে অনুভূতিগুলো ডিপোজিট করছেন অন্য কোনো একজনের নামে, তাই আমার প্রতি তার করুণা আসা সম্ভব নয়। অবশ্য সাময়িক করুণা নিতে পারতাম না। এর চেয়ে সরাসরি প্রত্যাখ্যানও ভালো হয়েছে। এবার আমার যাইহোক, তাতে তার যোগসাজশ আর রবে না। মুক্ত করে দিব মন থেকে এবার!

“ধন্যবাদ আপনাকে সায়ান ভাইয়া। সরাসরি যদি আগেই বলে দিতেন, তবে আমি আপনাকে বিরক্ত করতাম না। আর যেহেতু আগে থেকেই সব ঠিকঠাক, আম্মুকে না জানিয়ে আমায় বুঝিয়ে বললেই হত। অবশ্য ভাববেন না যে আম্মু আমাকে বের করে দিলে আমি আবার আপনার দ্বারস্থ হতে যাব। তা কখনো হচ্ছে না আর। একটুও জালাতন করব না আপনাকে। আপনার সামনেও পড়বো না, এমনকি আমার ছায়া আপনাকে মাড়াতে হবে না হবে না। আসছি।”

সায়ানের কথা শেষ হবার আগেই মিহির পেছনে ফিরে গেল। সায়ানও আর আটকালো না মিহিরকে। শুধু তাকিয়ে দেখলো যে নিঃশব্দে বাসায় ঢুকে গেলো। তবে অবাক হল ওর কথাবার্তা আর ততক্ষণাৎ পরিবর্তন দেখে। ভেতরকার চাপা অভিমানটা লুকাতে চাইলেও ততটা পটুত্ব সহকারে লুকোনো সম্ভব হয়নি। বয়সের পরিপক্বতার পরিমাপ তো এতেই প্রকাশ পায়। তাই এটাকে আবেগের ভিতে আঘাত লাগবার সাময়িক যন্ত্রণা ধরে নিয়ে মাথা ঘামালো না। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে নিজেও বাসায় ফিরে যায়।

মিহির বাসায় ঢুকে নিজের ঘরে চলে যায়। সাজ ধুয়ে মুছে সাফ হয়। সাধারণ সাজপোশাকে নিজে গড়িয়ে নেয়। কান্নার ছাপ চেহারা থেকে সম্পূর্ণ ধুয়ে যায়নি। নাক, গাল লাল হয়ে রয়েছে এখনো। তবুও নিঃশব্দে চেয়ার টেনে পড়ার টেবিলের সামনে বসে পড়লো। পড়ায় মন বসতে না চাইলেও লক্ষ্যহীন বইপত্র নাড়াচাড়া করতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই মা ঘরে আসলেন। বেশ কিছুক্ষণ তুমুল বকাবকি করলেন মিহিরকে। মিহির নির্বিকার। কোনো প্রতিক্রিয়া সে দেখাচ্ছে না। চুপচাপ সব কথা শুনে যাচ্ছে। অথচ মিহির এমন ফ্যাচফ্যাচে কাঁদুনি একটা মেয়ে যে সামান্য জোরে কথাও নিতে চাইতো না। বাবাকে বলে দিতো। শত দুষ্টুমি দুরন্তপনাও মাফ চেয়ে পার পেয়ে যেতো। আজ তার শান্তভাব অপরিচিত লাগছে মিসেস মনারও। শুধু এটুকু বুঝতে সমস্যা হচ্ছে যে মা কোন দিকে রাশ টেনে বকা দিচ্ছে। স্পষ্টতা না পেলেও জানবার আগ্রহ হয়নি আর। শুধু মায়ের শেষ আদেশ স্কুল ছাড়া বাসার বাইরে আর বেরোন হবে না, কারো সাথে বিশেষ যোগাযোগ রাখা যাবে না এটুকুতে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয় মিহির। মা চলে গেলে দরজা চাপিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মাথাটা ধরেছে খুব। ঘুম না হলে আর রক্ষে হবে না। বিশেষ কোনো ভাবনা কাছে ভিড়তে দেয় না। তার আগেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় মিহির।

সেদিনের ওর থেকে মিহির পুরোপুরি শান্ত হয়ে যায়। আর কোনো দুরন্তপনা, দুষ্টুমি, সাজগোজ, শত বায়না ওকে গ্রাস করতে পারে না। স্কুল থেকে বাসা আর বাসা থেকে স্কুল, এর বাইরে আর কোনো গণ্ডি মাড়ায় না সে। পূর্বে কোচিং-এর বায়না রেখেছিল ঠিকই, তবে এখন আর বন্দোবস্ত করেও পাঠানো গেলো না ওকে। তাই বাধ্য হয়ে বাবা বাসায়ই টিউটর এনে দিলেন। তবে মেয়ের আচরণে খুশি হবার পাশাপাশি চিন্তিতও হলেন। তবে স্ত্রীর সাথে আলোচনা করে তেমন সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। সে এটুকু জানলেন যে যা হয়েছে তা মিহিরের উন্নতির জন্য। তাই কথা বাড়ালেন না আর।

মিহির আর কখনো ছাদে যেতো না নিজ থেকে। গেলেও সর্বোচ্চ কিছু সময়ের মাঝেই কাজ সেরে ফিরে আসতো। মাস তিন চারেক পর শুনা গেলো সায়ানরা শিফট হয়ে চলে গিয়েছে অন্য এলাকায়। তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না মিহির। যেন এটাই হবে বলে নিশ্চিত ছিল সে। যাবার পূর্বে আর সায়ানের দেখা না পাওয়ায় স্বস্তি পেলো মিহির। খামোখা আবেগে ডুবতে মানা করেই গিয়েছে সায়ান। তাই দেখা পাওয়াটা ডুবে যাওয়ারই নামান্তর হত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here