তুমি_এবং_তুমি,পর্ব : ০৫

0
781

#তুমি_এবং_তুমি,পর্ব : ০৫
লেখনী : #তাসমিয়াহ

পার্টী মোমেন্টে লোডশেডিং যেন দুধের মাঝে এক ফোঁটা লেবুর রস। উপস্থিত সবার মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। আইপিএস কানেক্টেড রয়েছে, আর এটা তো লোডশেডিং-এর মরশুম নয় আর সময়ও নয়। তবুও… লিয়া বারবার ইলহামের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিল। ইলহাম একটু দূরে ডেকে নিয়ে ওকে কানে কানে কিছু বলতেই বিস্মিত হয় ও। কিছুক্ষণ বাদে খুশি মনে এসে সবার সাথে যোগ দিল। ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আড্ডাটা একটু ম্যানেজ করবার বুদ্ধি দীপ্ততাটুকু করে দিল ইলহাম। এতে পুনরায় লিয়া ওর প্রেমে পড়ে গেল। সত্যি সবার ভাগ্যে ইলহাম লেখা থাকে না। তবে স্বপ্নগুলো ইলহামের মতই কাওকে ঘিরে গড়ে ওঠে। শুধু বাস্তবায়নটা এক রকম হয় না। তবে যার হয়, তার উচিত সর্বোচ্চটুকু দিয়ে তা আগলে রাখা। লিয়াও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নেয় নতুন জীবনে প্রবেশ করবার পর প্রতিটা খুশির মুহূর্ত ইলহামকে ঘিরে রাঙিয়ে তুলবে আর এভাবেই জীবনটা সুন্দর করে বইয়ে নিবে।

মিহির বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে। মাত্র দু তিন মিনিট মুখ চেপে ধরে রাখা হয়েছিল তার। কিন্তু আর বোধ হয় দু তিন সেকেন্ড পেরোলে দম আটকেই যেতো ওর। আগন্তুক যে খুব চতুরতা সহকারে ওর সাথে এমনটা করেছে তা বুঝতে পারছে ও। কিন্তু আগন্তুকের পরিচয়টা খোলাসা হচ্ছে না নিজের কাছে। পার্টির প্রায় সবাই পরিচিতই বলা চলে। উপস্থিতির বিরাট একটা অংশ তো সব ওর আর লিয়ার ফ্রেন্ডস। ইভেন সিনহাও ছিল সেখানে। আসলে সায়ানের সাথের সেদিনের ঘটনার পর মিহির আর কক্ষনো সিনহার সাথে স্বাভাবিক হতে পারেনি। কথা বলায় তো বারবার এড়িয়ে চলেছে। আর আলাদা হবার পর কোনো যোগাযোগই রাখেনি ও। সিনহা প্রথম প্রথম কারণ বুঝতে না পারলেও ওর ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে ফাঁকেই ছিল। কিন্তু আজ পার্টীতে বহু দিন পর ঠিকই কথা হয়েছে দুই বান্ধবীর মধ্যে। মিহিরের পূর্বে একটু অভিমান, রাগ ছিল সিনহার ওপর। ওর মনে হত যে সিনহার জন্যই সায়ান খুব দ্রুত সবটা জেনে গিয়ে ওকে এভাবে ছোট করে দেখেছে। তবে আবেগ দিয়ে ভাবনার দিনগুলো শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন যা রয়েছে তা হল ব্যক্তিত্ব, বিবেক। আর সেগুলোর সাপেক্ষে সিনহার কোনো দোষ নেই। তাই আজ যখন সিনহাকে আগের মতই স্বাভাবিক হাসি খুশি দেখা গেল, মিহির নিজ থেকেই ওর সাথে মিশে গিয়েছে। ওকে মানিয়ে ফেলেছে। এত বছর পরে সিনহাও আর পুরোনো কিছু মনে ধরে রাখেনি। তাই পুনরায় স্থাপিত হল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব।

এরা বাদে বাকি সবাই ইলহামের বন্ধুবান্ধব, কাজিন। কাওকে অপরিচিত মনে হল না। আর নাই-ই নিচু মানসিকতার। তবে এভাবে কে চোখ বেধে, মুখ চেপে ধরে ছাদে ধরে আনলো তা বুঝতে পারছে না মিহির। একটু পর কী হতে চলেছে তা ভাবনায় ধরছে না ওর। কে জানে লিয়া টের পাবে কি না ওর অনুপস্থিতি। কারণ ওর চোখ বাঁধা বলে সব অন্ধকার তো লাগছেই। কিন্তু তার ওপর একটু আগেই লোডশেডিং হয়েছে। তাই কাওকে স্বর্গে পাঠিয়ে দেয়া হলেও ইলেক্ট্রিসিটি না আসা অব্ধি পাশের কাকপক্ষীও টের পাবে না।

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে মিহিরের ভয় হয়েও খুব একটা হচ্ছে না। আগে যে মেয়ে আরশোলা দেখলে চেঁচিয়ে কেঁদে আশপাশের পরিবেশ মাথায় তুলতো, আজ সে তো কি’ড’ন্যা’প হয়েও ততটা অশান্ত হচ্ছে না যা হওয়া উচিত। নিজের শান্তভাব নিজেকে ভাবাচ্ছে ভীষণ। খারাপ কিছু হয়ে গেলেও পরোয়া নেই নিজের জন্য তেমন। তবে না জানিয়ে আসায় বাবা মা-র হয়তবা ওকে খুঁজে পেতে একটু কষ্ট হবে। তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ ওভাবেই।

কাছাকাছি কোনো পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে মিহির। এগিয়ে আসছে ওর দিকেই। কিছুক্ষণ পর আশপাশে কারো অস্তিত্ব স্পষ্ট বোধ করছে মিহির। এবার একটা কণ্ঠ কানে এসে বেজে যায়।

“ভয় পেয়েছ মিহির?”

নিঃসঙ্কোচ কৌতূহলী প্রশ্ন। কণ্ঠটা পরিচিত লাগলেও সঠিক নির্ণয়ন করতে পারছে না মিহির। এর মাঝে চোখ থেকে বাঁধন সরিয়ে ফেলা হয়। সব কালোচিত লাগলেও কিছুক্ষণ বাদে ধীরে ধীরে আলোর সাথে মানিয়ে চারপাশে তাকায় মিহির। আন্দাজ খুব একটা ভুল করেনি ও। শূন্য ভাসছিল মনে হলেও উর্ধ্বগামী পদচালনে ধরেই নিয়েছিল যে ছাদের দিকে আনা হচ্ছে ওকে। হয়েছেও তাই। ও ছাদে রয়েছে এখন। তবে বাইরে তুলে না নিয়ে গিয়ে ছাদে কেনো আনা হল তা নিয়ে খটকা লাগছে ওর। আর কে আনলো? কেনো ওকেই আনলো? কী চায়?

পেছনে তাকিয়ে দৃষ্টি যেন সপ্তম আকাশ ছুঁয়ে ফেললো মিহিরের। ধারণা কেনো, কল্পনারও বাইরে ছিল এই মানুষটার এমন আচরণ। কী করে সম্ভব হল তার দ্বারা? আর কীসের জন্যই বা ওকেই…

“সায়ান ভাইয়া!”

হ্যাঁ। ভাবনার দোর পেরিয়ে অনুপ্রবেশটা অন্য আর কেউ নয়, সায়ান করেছে। কিন্তু কেনো করেছে তা বুঝতে পারছে না মিহির। তবে এহেন কাজে সায়ানের জন্য তিলে তিলে গড়া অভিমানের পাহাড় আরেকটু উচ্চতা লাভ করে নেয় সুযোগ লুফে নিয়ে। সায়ান হয়তবা বুঝতে পেরেছে মিহিরের মুখশ্রীতে মনের কোন আবছায়া পড়েছে। তাই আলতো হেসে বললো –

“রাগ, অভিমান আজ থেকে বরং জমানো ছেড়ে দাও মিহির। এখন থেকে একটু একটু করে ভালোবাসা জমাতে শেখো। এগুলি আমায় ফেরত দিয়ে দাও।”

সায়ানের কথায় মিহির বোধ করল ও রসিকতা করছে। তাই রেগে জবাব দিলো –

“এসবের মানে কি সায়ান ভাইয়া? আমি এখানে কেন এনেছেন, তাও এমন জঘন্য পরিস্থিতি দাঁড় করিয়ে? আমাকে কী দরকার আপনার, বলুন?”

মিহিরের রাগের প্রখরতা সায়ানের হৃদয় ছুঁয়ে ফেলে। এবার থেকে আর তো কোনো কিছু বাস্তবতার ছাঁকুনিতে পরিবর্তন করে গ্রহণ করবার দায় নেই। সবটা তো স্বাধীন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাই উপভোগ করতে মন্দ লাগছে না। বরং শুরুটা তেতোতে হলে ফল পরবর্তীতে খুব মিষ্টি পাবার আশা রাখে সায়ান।

“ফার্স্ট অফ অল, সরি এমন করে ভয়ার্ত পরিস্থিতি দাঁড় করিয়ে তোমায় এখানে আনা। সাফার সবাইকেই করতে হবে কিছুক্ষণ এর জন্য। তবে আমার দিক থেকে ভাবলে এর চেয়ে আর কোনো বেটার উপায় পাইনি এত কম সময়ের মাঝে। এমনি বলা হলে কখনোই তুমি আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এখানে আসতে না তো!”

সায়ানের শেষ কথায় হালকা আর্তনাদ। যা মিহিরকে ভেতর থেকে ছু্ঁতে চাইলে পাশ কাটিয়ে দেয় মিহির। সবকিছু কি এত সহজে ভুলে যাওয়া, ভুলিয়ে দেয়া, পুনরায় অস্তিত্বের বিচরণ ঘটানো – নাহ, এত সহজে আর কিচ্ছু হবে না। হতে দেবে না ও। কষ্ট পেয়েছে, সেটুকু নিজে সামলেও নিয়েছে। তাই নিজেকে আর কারো কাছে সপে দেবে না। কাওকে কাছে ভিড়ে বসতীর খোঁজ দেবে না। মন গোপনের সীমানাটা খুব নিজস্বতায় ঘেরাই সুন্দর!

“আপনি যা করলেন, তা মোটেও ঠিক করেননি সায়ান ভাইয়া! আমাকে যেতে দিন।”
“এখনো অব্ধি তো কিছুই করিনি আমি। তুমি কি এডভান্স ভাবতে শিখে গিয়েছ নাকি মিহির?”

সায়ানের চোখে মুখে চরম দুষ্টুমির রেখা ঢেউ খেলছে। এতে রাগে জ্বলে ওঠে মিহির। এটা কি এগুলি করবার সময়! এমন আচরণ এসব বয়সে মানায় না একদম। মিহির কিছু বলতে যাবে তার আগেই সায়ান বলে ওঠে –

“তোমার রাগ, দুঃখ, ঝগড়া – সব শুনে নেবো, প্রমিস। কিন্তু তার আগে আমি কিছু কথা বলতে চাই। তা বলা হয়ে গেলে তারপর জবাব দিও সবকিছুর।”

সায়ানের কথায় কিছুটা অনুনয় মেশান ছিল, যা মিহিরের হৃদয়কে পুনরায় বশীভূত করল। যাতে ও চুপ হয়ে যায়। কিন্তু এরপর সায়ান যা করে তাতে বিস্ফোরণ ঘটে মিহিরের চারপাশে…!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here