তুমি_এবং_তুমিই,পর্ব : ০৭ (শেষ)
লেখনী : #তাসমিয়াহ
সায়ানের কথাগুলো শুনার পর মিহির অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। ফিরে যাচ্ছে বারবার সাত বছর আগের সেই দিনটিতে।
~~~~~ফ্ল্যাশব্যাক~~~~~
“সায়ান, কী ব্যাপারে কথা ছিল তোমার বাবা? মিহির কি কোনো ভুলে করেছে বা বেয়াদবি করেছে তোমার সাথে?”
মিসেস মনা বেশ চিন্তিত ও শঙ্কিত কণ্ঠে কথাটা বললেন সায়ানের দিকে তাকিয়ে। সায়ান বরাবরই তার কাছে স্নেহের পাত্র। প্রতিবেশী হওয়ায় চেনা জানা রয়েছে বেশ। সত্যি ভালো ছেলে ও। পড়াশুনা ও যাবতীয় আচার আচরণে সায়ান প্রশংসনীয়। আর মিহিরের চেয়ে বেশ সিনিয়র। তাই এভাবে হুট করেই কথা বলতে চাওয়ায় একটু দ্বিধায় পড়ে গেলেন যে মিহির কোনো সমস্যা করে এলো কি না। কিন্তু পরবর্তীতে সায়ানের কথা শুনে কিছুটা রাগান্বিত না হয়ে পারলেন না।
“আন্টি, আপনার আমার সম্পর্কে মতামত বা ধারণা কেমন?”
“ধারণা বলতে..? তোমাকে চিনি আমি যেহেতু একইসাথে থাকি কাছাকাছি বাসায়। বয়সে আমার সন্তান তুল্য তুমি। যথেষ্ট সুনাম ও প্রশংসা বাকিদের মত আমিও মন থেকে মানি। তুমি যথার্থ বুদ্ধিমানও!”
“তবে আমি যদি মিহিরকে আপনার কাছ থেকে চেয়ে নিতে চাই, আপনি কি রাজি হবেন?”
মিসেস মনা বিস্ফোরিত নজরে সায়ানের মুখ পানে তাকান। এমন কথা যেন দূর কল্পনায়ও শ্রবণীয় তা ভাবতে পারেননি। বেশ তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“কী বলছো এসব সায়ান? মজা করছো?”
“আন্টি আপনার সাথে আমার সম্পর্ক টা মজা করবার নত নয়। আর নাই-ই এই পরিস্থিতি টা মজা করবার মত। আপনি আমার গুরুজন। আপনার সামনে পর্যাপ্ত শিষ্টাচার আমার ভূষণ। আমি যা বলছি সবটা ঠাণ্ডা মাথায়, স্বজ্ঞানে, স্ব ইচ্ছায় বলছি। এটা সঠিক সময় নয় তা আমি জানি। শুধু আপনার কাছ থেকে প্রতিজ্ঞা আর অপেক্ষা চাচ্ছি। আমায় সময় দেয়া হলে কথা দিচ্ছি যোগ্য হয়ে তবেই ফিরবো আপনার কাছে মিহিরকে চাইতে। নাহলে আর কখনোই সামনে এসে দাবি জানাবো না মিহিরের জন্য।”
“মিহির এখন উপযুক্ত না হলেও ওর মতামতের যথার্থ গুরুত্ব আমার কাছে রয়েছে। আমি তো ওকে জোর করতে পারি না। যথেষ্ট ভাবে বিবেচনা প্রয়োজন এতে।”
গম্ভীরবেদী স্বরে বললেন মিহিরের মা।
“জি নিশ্চয়। আমি জানি আমাদের বয়সের পার্থক্যটা বেশ দীর্ঘ। তবে সম্পর্ক টিকে থাকে মনের বন্ধনে। আর সেটা স্থাপন হলে বয়স কোনো দুর্বলচেতা প্রভব রাখতে পারে না।”
“এখন এই মুহূর্তে ওর মাঝে এ ধরণের চিন্তা প্রবেশ করলে ওর পরিণতি কী হতে পারে তা কি তোমার আন্দাজ রয়েছে সায়ান?” – (চাপা কিন্তু শক্ত গলায় কথাটা বললেন মিসেস মনা)
“এরকম কোনো চিন্তা ভাবনা ওর মাঝে ফুটিয়ে তুলতে চাইলে আপনার কাছে আবেদন নিয়ে আসবার প্রয়োজন হত না আন্টি। শুধুমাত্র একটু ওর আবেগকে প্রশ্রয় দিলেই সবটা সম্ভব হত। কিন্তু এটা করতে চাইনি আমি। তাই বেমানান মনে হলেও আমি গুরুত্ব পূর্ণ মনে করেই আপনার সামনে দাবি প্রকাশ করেছি।”
“মিহিরের আবেগ? কী বলছো সায়ান? ও কি কিছু বলেছে তোমায়?”
বেশ শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞাস করলেন ওর মা।
“আন্টি, কৈশোরের একটা স্পর্শকাতর সময় সবার সামনে হাজির হয়। একটু দোলাচলে ভাসিয়ে দিতেই চায়। সবাই ভেসে যায় না, হাবু ডুবু খায় না। তবে ছোঁয়াগুলো যে আঁচড় দিয়ে যায় না এমনটা নয়। মিহিরও এমন কিছুর সাক্ষাত পেয়েছে। যার দরুন কিছু আবেগময় আকাঙ্ক্ষা ওকে দোটানায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।”
সায়ান বেশ রাশভারী ভাব টেনে কথাগুলো বললো।
“পরিষ্কার করে সবটা না বললে বুঝতে বেগ পেতে হচ্ছে সায়ান!”
“আমি বলবো সবটা খুলে। তবে শর্তসাপেক্ষে বলবো। আপনি আমায় কথা দেবেন যে এর কোনো প্রভব মিহিরের ওপর জানান দেবেন না!”
না চাইতেও মুখ ভার করেই সায়ানের শর্তটা মেনে নেয় মিসেস মনা। সায়ান এবার বলতে শুরু করে যে মিহির ওর কাছে কী করে কৈশোরের প্রথম প্রেম নিবেদন করেছে। সবটা শুনে মিসেস মনা বেশ রাগান্বিত হন আবার একইসাথে কষ্টও পান। সায়ান ওনার অনুভূতি টের পেয়ে বলেন,
“আন্টি, দয়া করে কিছু মনে করবেন না যে এসব বলে আপনার সামনে মিহির কে বা সরাসরি আপনাকে ছোট করছি। আমার এমন কোনো উদ্দেশ্য নেই ঘুণাক্ষরেও। মিহিরের প্রতি আমার টান কাজ করলেও প্রকাশ করিনি তা আমি। তবে ওর প্রকাশ মাত্রই ওর মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে আমি আপনার কাছে এসেছি ওকে চাইতে। শুধু একটু সময় আর অপেক্ষা চাইছি। আশা করছি আমি আমার প্রতিজ্ঞার বিনিময়ে আপনার কাছে কাঙ্ক্ষিত দাবিপূরণ হবে।”
“মিহির এখন একটা সংকটময় অবস্থায় রয়েছে, যা বুঝতে পারছো তুমি। ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা কীসে বলো!”
“যদি সময়ের সাথে ওর মতামত পরিবর্তন হয়, সবটা আবেগী মোহ হিসেবে ফুরিয়ে যায়, তবুও আমি কোনো জোর দাবি নিয়ে উপস্থিত হব না কখনো। তবে এখনো ওকে কিছুই বুঝতে দেইনি আমি। শুধু আপনার কাছে আমার এটুকুই আবেদন, আমার বলা কথাগুলো ওর কানে পৌঁছবেন না কখনো আমি না বলা পর্যন্ত। ওকে শুধু একটু আগলে রাখবেন যাতে এমন সময় কেও ওর মানসিকতার সুযোগ নিতে না পারে।”
মিসেস মনা এক দৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছেন সায়ানের দিকে। বড্ড অবাক হবার পাশাপাশি একটু স্বস্তিও পাচ্ছেন এটা ভেবে যে ছেলেটা সত্যিই ভালোবাসে তার মেয়েকে। প্রকৃত মায়া আর যত্ন রয়েছে ওর আচরণে। নাহলে এমন করে ভাবতে পারতো না। বরং মিহিরের কাজের সুযোগ নিতে পারতো। যেহেতু তা করেনি, তার মানে ভরসাযোগ্য যথাযথ। শুধু সময়ের অপেক্ষায় পরিণতির পথ চেয়ে এগোতে হবে।
“আমি আসি এবার আন্টি!”
সায়ান এবার একটু লাজুক ভাব এনে কথা বলছে। এতক্ষণ যাবত দায়িত্ববোধ সহকারে কথা বললেও গুরুজনের সামনে এতটা বাগ্মী, স্পষ্ট হতেও সহ্য করতে হয়েছে আদবের বহিঃসীমা।
“এসো।”
“কিন্তু, আন্টি…”
ইতস্তত করতে থাকে সায়ান। মিসেস মনা যেন সায়ানের আড়ষ্টতা টের পান। তাই কিছুটা মুচকি হেসে বলেন –
“তোমার প্রতিজ্ঞা পালন করে ফিরে এসে দেখো আমি আমার টুকু রাখতে পারি কি না!”
সায়ান আর কিছু বলে না। সম্মানে মাথা নিচু করে বেরিয়ে চলে আসে ওনার রুম থেকে।
~~~~~বর্তমান~~~~~
“আপনি তো আমাকে জানালেনই না কিছু। আবার আম্মুও সবটা জেনে..! ধুর ভাল্লাগেনা!”
“সব ভালো লাগতে হয় না বুঝলে!”
সায়ানের চেহারায় দুষ্টু হাসির রেখাপাত দেখা যায়। মিহির তা বুঝতে পেরে মুখ ভার করে ফেলে। সায়ান তা দেখে মুচকি হাসি দিয়ে কাছে এগিয়ে আসে। তারপর ওর বাম হাত দিয়ে মিহিরের ডান হাতটা আলতো করে স্পর্শ করে। তারপর ওর হাতে থাকা একটা রিঙ মিহিরের অনামিকায় পরিয়ে দেয়। প্রথম বারের মত এমন কোনো স্পর্শ আর ঘটনার সম্মুখীন হওয়ায় কেঁপে ওঠে মিহির। একটা মিষ্টি হাওয়া যেন চারপাশ ঘিরে ধরে ফেলে ওকে। শিহরণ জাগিয়ে তোলে ওর হৃদয়ে। সবটা স্বপ্ন মনে হতে থাকে। হয়তবা সেদিনের সায়ানের ওকে ফিরিয়ে দেয়াতে আজ ওর জন্য এত স্বপ্নিল, সুন্দর মুহূর্ত উপস্থিত করেছে। নাহলে হয়তবা এত দূর অব্ধি আসা হত না। একটা অনিশ্চিত সম্পর্ক সাময়িক সময়ে জীবনভরের বিষাদগম্ভীর সীমানা টা টেনে দিত। সত্যিই এই বোধহয় ওদের দুজনের মাঝে বয়সের পার্থক্য, ম্যাচিউরিটির ভিন্ন ছাপ! সায়ান এবার মিহিরকে কিছুটা নিজের দিকে কাছে টেনে আনে। প্রথমে কিছুটা না বললেও খানিক বাদে মিহির দূরে সরে পড়ে। এতে সায়ান কিছুটা বেজার হয়ে যায়।
“এখনো কি আর কোনো ধোঁয়াশা রয়েছে মিহির?”
“আপনার না রিলেশন ছিল! সেটা তো খোলাসা করলেন না। মনে জমা করছিলেন কত কী। এত সব কার জন্য ছিল তখন?”
“তোমার জন্য।” – (সায়ানের কাটকাট জবাব)
“হুহ,বাজে বকবেন না!”
“বাজে বকবো কেন, সত্যি বলছি।”
“এখনো ত একটা গার্লফ্রেন্ড আছে বলে শুনেছি। সেটা কে?”
“তুমি।”
“সায়ান! ভালো হচ্ছে না কিন্তু! সবেতেই শুধুমাত্র মশকরা করে উড়িয়ে দিচ্ছেন আমায়।”
“নাহ। মশকরা করে উড়িয়ে দেবো কেন। আমার অনুভূতির শুরু থেকে শেষ, সবটা জুড়ে শুধুমাত্র তুমি এবং তুমিই ছিলে, রয়েছ আর থাকবে। এটাই পরম সত্য করে নিয়েছি। আর এবার থেকে তা ক্ষণে ক্ষণে জানান দেবো!”
“লিয়া তো বললো..”
“ওরা জানে টুকটাক। আমার এত দিনের অপেক্ষা পূর্ণতা পাবে! আনন্দিত ত সবাইই।”
“কিন্তু..”
“কিন্তুুর অবকাশ নেই। নিচে যাওয়া উচিত। এতক্ষণে নিশ্চয় সবার কষ্ট হয়েছে অন্ধকারে থাকতে। এবার আলো নিয়ে ফিরে আলোকিত করে দিব একদম। আর আমাদেরও এংগেজমেন্টের বাকি অর্ধেক টা সেরে ফেলব।”
“অর্ধেক মানে?”
“আমি আপনাকে রিঙ পরিয়ে ছেড়ে দেবো, আপনার থেকে নেবো না, এটা কি হয়?”
“কিন্তু সায়ান…”
“চলো, আন্টি অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। প্রতিজ্ঞা পূরণে বিলম্ব অহেতুক!”
মিহির আর কিছু বলতে পারে না। অপলক তাকিয়ে দেখছে সায়ানের হাসির মাঝে জড়িয়ে থাকা মুগ্ধতা। কানে বাজছে একটাই কথা, “আমার অনুভূতির শুরু থেকে শেষ, সবটা জুড়ে শুধুমাত্র তুমি এবং তুমিই ছিলে, রয়েছ আর থাকবে।”
সমাপ্ত