গল্পের_অন্তরালের_অপূর্ণতা,(পর্ব-২)

0
1141

গল্প:#গল্পের_অন্তরালের_অপূর্ণতা,(পর্ব-২)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম

কার্পেটের নিচ থেকে চাবি বের করে, চাবি দিয়ে দরজা খুলতে গিয়ে সে দেখল দরজা ভেতর থেকে আটকানো। রামিশার বুক কেঁপে উঠলো। ঘরের ভিতরে কে আছে?
দরোজায় আলতো ধাক্কা দিয়ে সে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে বিস্মিত হয়ে গেল… এ কাকে দেখছে সে!!
এও কি সম্ভব???
পূর্ণতা পড়ার টেবিলের চেয়ার এর উপর গুটিসুটি মেরে বসে আছে।
রামিশার মুখ থেকে আর্তচিৎকার বের হতে যাচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণেই রামিশা দুই হাত মুখে দিয়ে চিৎকার আটকে ফেলল।
– পূর্ণতা তুই!!এখানে কখন এলি? কোথায় ছিলি এতদিন? তোর ফোন বন্ধ কেন? তুই কোথায় গিয়েছিলি? তোর এই অবস্থা কেন?
পূর্ণতা চোখ বুজে বসে ছিল;সে চোখ খুলল, পূর্ণতা রামিশার দিকে তাকিয়ে বলল, একসাথে এত প্রশ্ন করলে উত্তর দিব কিভাবে? একটা একটা করে কর।

বেশ কিছুক্ষণ পর রামিশা বিস্ফোরিত চোখে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে, তার চাহনিতে অবিশ্বাসের দৃষ্টি।পূর্ণতা রামিশার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই কি আমার কথা বিশ্বাস করছিস না?
– না অবিশ্বাসের কি আছে? তবে একজন লোক তোকে ধরে নিয়ে গেল আবার সে তোকে ছেড়ে দিল?
– তোর কি মনে হচ্ছে যে সেই লোক আমাকে ছেড়ে দিয়েছে? আমি পালিয়ে এসেছি।
-বুঝতে পারলাম‌। কিন্তু তোকে কেন ধরবে ?তোর উপর তার কি শত্রুতা?
-সেটা তো আমারও প্রশ্ন। আমিতো কারো কোন ক্ষতি করিনি।

পূর্ণতা প্রায় এক সপ্তাহ পর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার সময় বেশ ভয়ে ভয়ে বাসা থেকে বের হলো। রামিশার তার সাথেই আসার কথা ছিল। কিন্তু রামিশা বেশ অসুস্থ। সেজন্য তাকে রেখেই পূর্ণতাকে বের হতে হল । এই কয়েকদিনে তার প্রচুর অ্যাটেনডেন্স মিস হয়েছে। ল্যাব ওয়ার্ক গুলো বাকি রয়ে গেছে। অনেকদিন পর ক্লাসে প্রবেশ করে পূর্ণতার বেশ অস্বস্তি লাগছে। মনে হচ্ছে যেন সবাই তার দিকেই তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা কে বসে থাকতে দেখে তারই ক্লাসমেট রিফাত তার দিকে এগিয়ে আসলো।বললো,
আরে পূর্ণতা এতদিন পর? অসুস্থ ছিলে নাকি?
-না মানে আমি বাড়িতে গিয়েছিলাম এই আর কি।
-তাই নাকি? কবীর তো বললো তুমি নাকি অনেক অসুস্থ ছিলে হসপিটালে ভর্তি।
পূর্ণতা বেশ বিব্রত বোধ করল তার অনুপস্থিতিতে কে তার নামে কি বলেছো সে তো জানে না এখন কাকে কিভাবে উত্তর দিতে হবে সেটাও বুঝতে পারছ না।
পূর্ণতা রিফাতের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, আমাকে এখন ল্যাবে যেতে হবে এখনো দুইটা এসাইনমেন্ট সাবমিট করিনি , ও গুলো কমপ্লিট করব আজকে। একথা বলেই পূর্ণতা ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

সকাল থেকে টানা চারটা ক্লাস , ল্যাব ওয়ার্ক,ভার্সিটির শেষে কোচিং সেন্টারের দুইটা ক্লাস নিয়ে; একটা টিউশনি করে বাসায় এসে পূর্ণতা বিছানায় এলিয়ে পড়ল। বিকেল ছয়টা বাজে গেছে এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। পূর্ণতা জীবনটা ভীষণ যান্ত্রিক। একটার পর একটা ক্লাস, টিউশনি করে মাস শেষে বাড়িতে টাকা পয়সা পাঠাতে বেশি বেশ হিমশিম খেতে হয়।তার মা বলে এত টাকা পয়সায় পাঠানোর প্রয়োজন নেই , কিন্তু সে জানে তার বাবার একার পক্ষে সব ভাইবোনদের পড়াশোনা চালানো সম্ভব নয়। সেই জন্য পূর্ণতা যতটা পারে ভাইবোনদের জন্য সাহায্য করার চেষ্টা করে।
বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো; পূর্ণতা বিছানা ওঠে থেকে বসে দরজার দিকে তাকালো। বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে দেখল , রামিশা দাঁড়িয়ে আছে।রামিশা মনে হয় দুপুরে বাইরে গিয়েছিল।
– কিরে কোথায় গিয়েছিলি?
– আরে আমার একটা কাজ ছিল।
-কি?
– আমার ছোট ভাবির বোনের গায়ে হলুদ সেজন্য কিছু কেনাকাটা করতে গিয়েছিলাম।
পূর্ণতা রামিশার হাতের দিকে তাকিয়ে দেখল রামিশার হাতভর্তি শপিং ব্যাগ।
-কি কি কিনলি?
– চল তোকে দেখাই।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে পূর্ণতা‌ রামিশাকে ডেকে বলল, এই রামিশা শুননা!
– কি বলবি বল‌…
– আমার না বুঝেছিস মোবাইলটা হারিয়ে গেছে সেদিন; যেদিন আমাকে কিডন্যাপ হয়েছিল,ওই দিন।
– বলিস কি! তুই এত কয়দিন মোবাইল ছাড়া কাটিয়ে দিয়েছিস? পারিস কিভাবে?
– কি করব বল,এখন হাতের অবস্থা তেমন ভালো না। টাকা পয়সা নেই, এখন নতুন মোবাইল কিনাও সম্ভব না। আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?
– আরে এত চাপ নিচ্ছিস কেন? টাকা ধার দেয়া লাগবে কেন! তুই আমার মোবাইলটা নিয়ে নে। আমি একটা নতুন সেট কিনবো।
– বলিস কি? তুই তো দুই মাস আগেই না নতুন মোবাইল কিনলি!! এখন আবার নতুন কিনবি?
– হ্যাঁ। এখন আর এটা ভালো লাগছেনা।

রামিশা তার ফোন থেকে সিম কার্ড , মেমোরি কার্ড খুলে রেখে পূর্ণতার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল। নিজে পরদিন কিনে নেবে বলে। পূর্ণতার রামিশার এই স্বভাবটি জানে। সে কিছুদিন পরপরই ফোন চেঞ্জ করবে কিংবা নতুন ড্রেস কিনবে। রামিশা বেশ সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছে। তাছাড়া সে অনলাইনে কিসব বিজনেস করে। পূর্ণতা সে ব্যাপারে তেমন কিছুই জানেনা।
রাতে পূর্ণতার ঘুম আসছিল না তাই সে রামিশার দেওয়া ফোনটা নিয়ে ঘাটতে থাকল। তার মোবাইলে কিছুই নেই। তবে সে ভাঙ্গাচোরা একটা ফোন ব্যবহার করত, সেজন্য তার কাছে এটা খুব সুন্দর একটা মোবাইল লাগছে। সে ফোনটা ঘাটতে ঘাটতে ফোনের নোটপ্যাড এ গিয়ে বেশ কিছু লেখা সেভ করা দেখলো। সে দেখে বেশ মজা পেল। লেখাগুলো পড়ার চেষ্টা করল। সেখানে লেখা আছে রামিশা কি কি ড্রেস কিনেছে? কি কি কালারের ড্রেস কিনবে? কেনাকাটা করে তার কত টাকা খরচ হল, এসব কিছুতেই তার নোটপ্যাড ভর্তি হয়ে আছে। তবে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস তার চোখে পড়ল , ইংলিশে বেশ কিছু লেখা আছে, সম্ভবত কোনো কিছুর রুলস মনে হচ্ছে। রামিশা মনে হয় কোন জায়গা থেকে কপি পেষ্ট করে রেখেছে।
সে সবগুলো রুলস পড়ল ।তবে তার মনে হচ্ছে বেশ অদ্ভুত কিছু আজগুবি রুলস। সম্ভবত কোনো গেমের রুলস হতে পারে এগুলো। গেমটার নাম লিখা “Save me”এরকম অদ্ভুত একটা গেমের নাম দেখে তার বেশ হাসি পেল।

পরের এক সপ্তাহ পূর্ণতা জীবনের বেশ ব্যস্তময় সময় গেল। ক্লাস টেস্ট, ল্যাবটেষ্ট ,ল্যাবওর্য়াক সবকিছু মিলিয়ে নিশ্বাস ফেলার সময় মেলেনি। তবে এর মধ্যে তাঁর দুঃসহ অতীত তার কাছ থেকে বেশ দূরে চলে গিয়েছে। কিন্তু আজ ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় পূর্ণতার মনে হচ্ছিল তাকে কেউ ফলো করছে। বেশ অস্বস্তিকর একটি অনুভূতি। তাই সে খুবই অনিরাপদ বোধ করছিল। পূর্ণতা তার অস্বস্তিকর অনুভূতিটি নিয়ে ই কোচিং সেন্টারে প্রবেশ করলো ক্লাস নেয়ার উদ্দেশ্যে, বিকাল পাঁচটার দিকে তার একটি কেমিস্ট্রি ক্লাস থাকে । যা সে ইন্টারমিডিয়েটের স্টুডেন্টদের সাথে থাকে।
যথারীতি আজকেও সে ফার্স্ট ইয়ারের ক্লাস। কিন্তু সে লক্ষ্য করলো ক্লাসের একেবারে শেষ প্রান্তে বসে একটি ছেলে মোবাইল টিপছে। পূর্ণতার মাথা গরম হয়ে গেল। সারাদিন এমনিতেও এত ক্লান্ত থাকার পর ক্লাসে এসে এ ধরনের জিনিস দেখলে তার মাথা ঠিক থাকেনা। পূর্ণতা ছেলেটির কাছে গিয়ে তার মোবাইলটা টেনে নিয়ে নিল, ছেলেটি চমকে উঠলো, চমকে পিছিয়ে গেল।
সে কাতর স্বরে বলল – ম্যাম, প্লিজ ফোন টা দিয়ে দিন।
পূর্ণতা ছেলেটির অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ফোনটি তার কাছে জমা রেখে দিল। ফোনটি রেখে দেওয়ার সময় ফোনের স্ক্রিনে সে দেখতে পেলো ছেলেটা একটি গেম খেলছিল ফোনের স্কিন এবং মাঝখানে লেখা “Save me ” Level 4।
একই নামের গেমের রুলস তো সে রামিশার দেওয়া মোবাইলেও দেখেছিল। সে বেশি কিছু চিন্তা না করে মোবাইলটা রেখে দিয়ে ক্লাস নিতে থাকলো।
ক্লাস শেষ করে পূর্ণতা ছেলেটির কাছে গিয়ে তার ফোনটি দেওয়ার সময় বলল, ক্লাসে পড়ানোর সময় আর কখনো ফোন যাতে তোমাকে ফোন বের না করতে দেখি।
ছেলেটি মাথা নিচু করে বললো ,স্যরি ম্যাম।এরকম আর হবে না।
পূর্ণতা ছেলেটিকে প্রশ্ন করল, আচ্ছা তুমি কি গেম খেলছিলে? এটা কি নতুন গেম নাকি? তোমাদের জেনারেশন তো এখন পাবজি আর ফ্রী ফায়ার ছাড়া কিছুই চেনে না।
পূর্ণতার এহেন কথা শুনে ছেলেটি বেশ চমকে উঠলো এবং কোন প্রকার উত্তর না দিয়ে তাড়াহুড়া করে চলে গেল। পূর্ণতা ছেলেটির এরূপ প্রস্থান দেখে সে বেশ সন্ধিহান বোধ করল এবং গতরাতে রামিশার দেওয়া ফোনটা ব্যাগ থেকে বের করে সেই একই গেমের রুলস গুলো দেখতে থাকলো; রলস গুলো ভালো করে লক্ষ্য করে সে হতভম্ব হয়ে গেল।

বিশেষ দ্রষ্টব্য: প্রিয় পাঠক সমাজ,
(পড়ে কেমন লাগলো অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন। যদি কোন ভুল ত্রুটি হয় তবে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।ধন্যবাদ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here