#সুখ_নীড়
#পর্ব_১৫,১৬
১৫
পুলিশ এসে তাদের মতো করে জয়ীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল সবার কাছে। সাজেদা চৌধুরীর তো মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে আছে। পল্লবকে নিষেধ সত্ত্বেও সে পুলিশ ডেকেছে। তার রেপুটেশনের ওপর যতভাবে দাগ লাগানো যায় কোনোদিকই বাদ রাখছে না এই ছেলে। পুলিশ সবার কাছে জিজ্ঞাসাবাদ করে সমস্যার কোনো সুরাহা করতে না পেরে পল্লবকে জিজ্ঞেস করল, আপনার কি কাউকে সন্দেহ হয়?
এ প্রশ্নের সাথে সাথে পল্লবের মায়ের চোখদু’টি বেশ বড় হয়ে গেল। পল্লব কী বলে সেটা নিয়েই এবার তার প্রখর আগ্রহ! কারণ পল্লব যদি কোনোক্রমে একবার তার নাম বলে ফেলে তবে তার ওপর মিডিয়ার লোকজন নির্দ্বিধায় আংগুল তুলবে। প্রচণ্ড ভয় পায় সে এই মুহূর্তে এই হলুদ সাংবাদিকদেরকে। সামনে তার নমিনেশানের কথাবার্তা চলছে। এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলায় সে পড়তে চায় না। আর জয়ীতাকে নিয়ে আগেই নানানভাবে বিতর্কিত সে। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই আর নতুন কোনো বিতর্কে জড়ানো সম্ভব না। আর গুম কেসে তো একদমই না।
পুলিশের এই প্রশ্নে সে নিজেও কিছুটা আবেগপ্রবণ হবার অভিনয় করে ছেলেকে নিজেই বলে, হ্যা, বাবা। বলো। কাউকে তোমার সন্দেহ হয়! আমার শত্রুর অভাব নেই বুঝলেন! খুব ভয় হচ্ছে। জানেনই তো এবার ইলেকশান করছি। এখন নতুন নতুন শত্রুদের ডানা পাখনা গজিয়েছে। কেউ হয়ত আমাদেরকে বিপদে ফেলতে এই কাজটা করেছে। কিন্তু যেই করুক তার কাছে আমার প্রশ্ন শত্রুতা আমার সাথে হতে পারে তাই বলে আমার পরিবারের কারো সাথে কিসের শত্রুতা? আপনারা প্লিজ, একটু ভালো করে ইনভেস্টিগেট করুন!
পল্লব তার মায়ের এমন পরিবর্তনের ব্যাপারটা ঠিকই বুঝতে পারল। সে তার মায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে পুলিশকে বলল, না এখনো পর্যন্ত তেমন কাউকে সন্দেহ করিনি। তবে কিছু জেনে থাকলে অবশ্যই আপনাকে সর্বপ্রথমে জানাব। আপনারা প্লিজ একটু সিসি ক্যামেরার ব্যাপারটা দেখেন। আর কীভাবে ইনভেস্টিগেট করলে সঠিক ভাবে আগানো যাবে সেটা একটু দেখেন।
পুলিশ ইন্সপেক্টর আহসান আলী তাকে বলল, বাহাত্তর ঘণ্টার আগে আমরা কোনো মিসিং কেস নেই না। কিন্তু আপনি কল করেছেন তাই চলে এসেছি। সিসি ফুটেজ এর ব্যাপারটা আমাদের ইনভেস্টিগেট টিমকে দেখাব। ওনারা ভালো বুঝবেন। তবে আপনি যদি কাউকে সন্দেহ করেন আমাদের জানালে আমাদের জন্য তদন্ত শুরু করা সহজ হবে।
– আমি নিজেই আপনাকে জানাব কাউকে যদি আমার সন্দেহ হয়। আপনি প্লিজ, দ্রুত সিসি ফুটেজ উদ্ধারের চেষ্টা করুন। এখান থেকে হয়ত কোনো ক্লু পাওয়া যাবে।
আহসান আলী পল্লবকে আশ্বাস দিয়ে চলে গেল।
আহসান আলী যাবার পরে পল্লব তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, সতিই তুমি কিছু জানো না, আম্মি?
– পল্লব, তোমার সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি। কোন সাহসে তুমি এ বাড়ীতে পুলিশ ডেকেছ? একবারও জিজ্ঞেস করেছ আমাকে?
– এখানে সাহসের কী ব্যাপার দেখতে পেলে! আমি আমার ওয়াইফকে খুঁজে পাচ্ছি না। তোমরা আমাকে কেউ হেল্প করছ না। তাহলে কারো না কারো হেল্প তো আমার নিতেই হবে। আমি সেটাই নিয়েছি।
– তুমি জানো তোমার এই ছোট ভুলের মাশুল আমাকে কী করে দিতে হবে? একের পর এক ভুল তুমি করেই যাচ্ছ আর আমি মাশুল দিয়েই যাচ্ছি। আমিও তো মানুষ নাকি! এই বয়সে এসে এত প্যারা আর ভালো লাগে না। ভেবেছি শেষ বয়সটা বিজনেস সব তোমাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে আমি আমার বাবার দেখানো পথে রাজনীতির মাঠে বাকী জীবনটা কাটাব। কিন্তু তুমি তো আমার সবখানেই কাঁটা বিছিয়ে রাখতে পিছ পা হচ্ছ না।
– আম্মি, আমি এখনো কিছুই করিনি। এ তো সবেমাত্র শুরু। এই খবর মিডিয়ার কানে গেলে কী হবে ভালো করেই জানো। আমি আহসান আলীকে রিকোয়েস্ট করেছি যেনো মিডিয়ার কোনো কাকপক্ষীও টের না পায়। কিন্তু জয়ীকে খুঁজতে তোমরা কো অপারেট না করলে এটা খুব বেশিক্ষণ চাপা থাকবে না। তাই আমি বাড়ির সবার কাছে রিকোয়েস্ট করব জয়ীর খোঁজ যেই জানুক না কেন আমাকে জানাতে। আমি জাস্ট জয়ীকে চাই। ওর সাথে যে যাই করুক না কেনো আমি একবারের জন্যও টু শব্দটি করব না। কথা দিলাম। শুধু জয়ীকে পেলেই আমার চলবে!
সাজেদা বেগম ছেলের উপর এক প্রকার রাগ করেই নিজের রুমে চলে গেলেন। এদিকে পল্লব তো হন্য হয়ে পুরো বাড়িতে আবার চক্কর লাগাচ্ছে জয়ীর খোঁজে। সে বুঝতে পেরেছে কেউই তাকে জয়ীতাকে খুঁজতে সাহায্য করবে না। তাই বসে থেকে কোনো লাভ নেই। পুরানো এই তিনতলা বাড়িটার কোণা কোণা চষে বেড়াচ্ছে সে। একেকটা জায়গায় প্রয়োজনে সে বারবার খুঁজছে। তার দৃঢ় বিশ্বাস জয়ী বাড়ির ভিতরেই আছে। সে নিজেই খেয়াল করে দেখেছে জয়ীর স্যান্ডেলগুলো পর্যন্ত ঠিকঠাক আছে। জয়ী নিশ্চয়ই খালি পায়ে বাইরে বের হয়নি। তাছাড়া পরিচিতজন যে যেখানে আছে সবার কাছেই খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে ।
তার বাবা খালেক সাহেবের সাথেও খানিকক্ষণ আগে কথা বলেছে। জয়ীর কথা কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পায়নি পল্লব। তাছাড়া খালেক সাহেব যেভাবে তার কাছেই উল্টো জয়ীর শরীর কেমন আছে, সে কী করছে এসব খোঁজ-খবর জিজ্ঞেস করেছে তাতে পল্লব নিশ্চিত সেখানে এবার জয়ী যায়নি।
বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই রাত পার হয়ে যাচ্ছে পল্লবের। বুকের মাঝে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কী হয়েছে জয়ীর সাথে? তার শুধু মনে হচ্ছে তার আম্মিই কিছু করেছে। কিন্তু কী করে সত্যি বের করবে? ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখল, রাত সাড়ে তিনটা বাজে। না খেয়েই শুয়ে পড়েছে সে। জয়ী তাকে বারবার বলেছিল বাগেরহাটে থেকে যাবার কথা। সে এখানে আসতেই চায়নি। জয়ী জানত এ বাড়িতে সে নিরাপদ নয়। সব জেনেশুনেও জয়ীকে সে এখানে নিয়ে এসেছে। নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে পল্লবের। জয়ীতাকে নিরাপত্তা দেওয়া তার কর্তব্য ছিল। কিন্তু সে একদমই বুঝতে পারেনি তার ঘরে কতটা অনিরাপদ আর অনিশ্চিত জয়ীর জন্য।
পল্লবের হঠাৎ মনে হলো চিলেকোঠার পাশেই একটা স্টোর রুম আছে। সেখানে বাড়ির যত পুরানো আসবাবপত্র কাগজপত্র ফেলে রাখা হয়। সে এই একটা জায়গাই খোঁজা বাদ রেখেছে। কারণ ওই স্টোররুমে সচরাচর বাড়ির সার্ভেন্ট ছাড়া আর কেউই ঢুকে না।
পল্লব ছোটবেলাতে বাড়ির পুরানো সার্ভেন্ট রাবুর সাথে দুই একবার ঢুকেছিল। এরপরে কোনদিন ওই রুমে যাওয়া হয়নি। পল্লবের সিক্সথ সেন্স বারবার তাকে জানান দিয়ে যাচ্ছে যে ওই রুমে গেলেই সে জয়ীতাকে পাবে। ঘরের মধ্যেই কোথাও জয়ীকে গায়েব করা হয়েছে। বাইরে নিলে কেউ না কেউ দেখত। সবাই কি আর মিথ্যে বলবে তার কাছে! তার শুধু মনে হচ্ছে এই কাজটার পেছনে তার আম্মিরই হাত রয়েছে। পুলিশের সামনে সে মুখ খোলেনি তার আম্মির রেপুটেশনের কথা ভেবে। তার কাছে তার আম্মির বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ নেই। যদি তার সন্দেহ অমূলক হয় সে ক্ষেত্রে তার আম্মিকে শুধু শুধু ফাঁসিয়ে দেওয়াটা উচিত হবে না। এমনিতেই তার দোষের শেষ নেই।
পল্লব মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, এবার জয়ীতাকে খুঁজে পেলে এ বাড়িতে আর এক মুহূর্ত না। জয়ীকে নিয়ে সে আলাদা সংসার পাতবে! তার আম্মি যা ভাবে ভাবুক। কাউকে সে পরোয়া করে না। জয়ীকে দেওয়া প্রত্যকটি কথা সে রাখবে। অনেক হয়েছে।
স্টোর রুমের চাবি থাকে বাড়ির সবচাইতে পুরানো কর্মচারী রাবুর কাছে। পল্লব তাকে রাবু খালা নামেই ডাকে। মহিলার বয়স তার মায়ের বয়সের প্রায় কাছাকাছি। সেই ছোটবেলা তার নানা এনেছিল এ বাড়িতে। খুবই বিশ্বস্ত আর ঘরের মানুষের মতো। প্রয়োজনে ঘরের মানুষের জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে এই মহিলা। তাই তার আম্মি তাকেই এ বাড়ির বেশিরভাগ দায়-দায়িত্ব নিশ্চিন্তে সঁপে দিয়েছে। পল্লব এবং কল্লোলকে মানুষ করার দায়িত্বও এই মানুষটির হাতেই ছিল। রাবু খালাও নিজের বাচ্চার মত করে এদেরকে মানুষ করেছে। এই ভুবনে তার আর আপনজন তো কেউ নেই। এরাই তার আপন মানুষ।
একটু বেঁটে ধরনের গাট্টা গোট্টা শরীরের অধিকারী রাবু খালা। পল্লবের আম্মির একদম যথার্থ সহকারী। মেজাজ মর্জি খানিকটা সাজেদা চৌধুরীর মতোই কাঠখোট্টা ধরণের । বাড়ির সব চাকর-বাকর তাকে বেশ সমীহ করে । মালিকের প্রতি ভীষণ রকমের অনুগত সে। এজন্যই নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে। তবে সাজেদা চৌধুরীর মতো মেজাজি হলেও পাষাণ দিলের মানুষ সে না। মন-মানসিকতাও এত নোংরা না। কাজের ফাঁকে যে সময়টুকু পায় সেটুকু ধর্মকর্ম করেই কাটায়। পল্লব, কল্লোলও তার মায়ের মত করেই এই মানুষটিকে সম্মান করে।
পল্লব ছুটে গেল নিচতলাতে রাবু খালার রুমে। রাত তখন গভীর। বাড়ির সবাই মোটামোটি ঘুমিয়ে গেছে।
রাবু মাত্র তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার জন্য উঠেছে। এ বাড়িতে সেই একমাত্র সার্ভেন্ট যার একটা পার্সনাল রুম আছে। বাকিরা সবাই এক রুমে গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে থাকে। পল্লবই ছোটবেলা রাবুখালার কষ্ট দেখে তার মায়ের কাছে আবদার করেছিল তার জন্য আলাদা রুমের জন্য। তার আম্মিও ছেলের কথা ফেলতে পারেননি। রাবুকে বাকী সার্ভেন্টদের থেকে সরিয়ে আলাদা করে রুম দেওয়া হয়।
পল্লবের প্রতি রাবু খালার প্রচণ্ড রকমের টান। নিজের ছেলের মতো ভালোবাসেন।
রাবু খালার রুমের দরজা খোলাই ছিল। এত রাতে পল্লবকে দেখে সে ভীষণ অবাক হয়।
ইশারায় জিজ্ঞেস করে কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?
রাবু খালা কথা বলতে পারে না। খুব ছোটবেলা একটা এক্সিডেন্ট হয়ে তার জিহবার আগা থেকে খানিকটা কেটে পড়ে গিয়েছিল। ঠোঁটের সাহায্যে দুই চারটা শব্দ কষ্ট করে বোঝাতে সক্ষম হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার কথা কেউ বোঝে না। ইশারা ইঙ্গিতের সাহায্যেই সবার সাথে কথা বলে। বাড়ির সবাইই তার সাথে এভাবে এখন কথা বলায় অভ্যস্ত। সবাই বোঝেও। পল্লব আর কল্লোল তো সবার থেকে বেশি বোঝে।কারণ এনার কোলেই ওরা মানুষ হয়েছে।
পল্লব বলল, আমি চিলেকোঠার স্টোর রুমের চাবি চাই৷ খালা।
রাবু কিছু সময় থেমে থেকে ইশারায় আবার জানতে চাইল, কেনো? এত রাতে সেখানে যাওয়া যাবে না। সাপখোপ থাকতে পারে। ওখানে অনেকদিন হয় পরিষ্কার করা হয় না।
পল্লব বলল, সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে নিবো। আমি ওসবে ভয় পাই না।
রাবু অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেও পল্লবকে বোঝাতে অপারগ হন। পল্লবের কেনো যেনো মনে হচ্ছে জয়ী ওখানেই আছে। আর তার আম্মিই এসব করেছে। আসলে তার আম্মি জয়ী আবার ফিরে এসেছে এটা মেনে নিতে না পেরেই এ ধরণের একটা ঘৃণ্য কাজ করেছে। জয়ী ওখানে কতটা কষ্ট পাচ্ছে ভেবেই তার বুক ভার হয়ে যায় ।
রাবু খালার থেকে চাবি নিয়ে রুমে ঢুকেই লাইট অন করল। রাবু খালাও পিছু পিছু এসেছিল কিন্তু পল্লব তাকে বাধা দিলো। রাবুকে অগত্যা ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও পল্লবের কথায় রাজী হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। সাজেদা চৌধুরীর কাছে কিছু জানাবে সেটাও পারছে না। পল্লব তাকে বারবার করে নিষেধ করেছে কাউকে কিছু না জানাতে! তাছাড়া এতরাতে সাজেদা চৌধুরীর রুমে যাওয়াটাও সমীচীন মনে করলেন না।
রুমে ঢুকতেই পল্লবের মনে হলো এখানে হয়তো বহুদিন তেমন কারো আসা যাওয়া হয় না। স্টোররুম ভর্তি গাদাগাদি করে রাখা পুরানো আসবাব, স্যানিটারি জিনিসপত্র আর বাক্স পেটরায়। মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ চারপাশে। চারপাশে চোখ বুলিয়ে তার মনে হলো না ভেতরে কেউ থাকতে পারে৷ তবুও নিজের মনকে আশ্বস্ত করতে সে সবকিছুর আড়ালে আবডালে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে খোঁজ করছে। কিন্তু না কোনোকিছুই নেই।
হঠাৎ তার মনে হলো কর্ণারের দিক থেকে খুটখুট শব্দ হচ্ছে। পল্লবের কান খাড়া হলো। সে সজাগ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ খেয়াল করে পরে শব্দকে আন্দাজ করে করে সামনে আগাতে লাগল। কিন্তু না! কিছুই দেখতে পেল না। আধঘন্টা ধরে খুব ভালো করে দেখল।
পল্লব রুমটা তালাবদ্ধ করে ছাদে যেয়ে দোলনায় বসল। মাথাটা প্রচুর ব্যথা হচ্ছে তার। আজকাল কোনো টেনশান সে নিতেই পারে না। কী হলো জয়ীর সাথে ভেবেই কূল পাচ্ছে না। আসলেই কি তার আম্মিই জয়ীকে লুকিয়েছে নাকি অন্য কিছু ঘটেছে? নাকি সত্যিই জয়ী তাকে ছেড়ে চলে গেছে? কিছুই মাথায় আসছে না পল্লবের। জয়ীকে নিয়ে মাত্রই সুখের একটা ঘর বাধার স্বপ্ন দেখল অমনিই এভাবে ঝড় একেবারে এলোমেলো করে দিলো! কীভাবে কোনপথে এগুবে সেটাই তার মাথায় আসছে না। একটু যদি কোনো ক্লু পেত তবুও কিছুটা আশা করতে পারত!
মাথার উপরে অঝোরে শিশির পড়ছে। সেদিকে হুশ নেই তার। হুশ থাকবেই বা কী করে ? চোখের পানিও যে সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বয়েই যাচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না সে। ভালোবাসার মানুষ হারানোর কষ্ট কতটা ভয়াবহ সেটা একমাত্র যে হারিয়েছে সেই জানে!
চলবে…..
#সুখ_নীড়
#পর্ব_১৬
দু’দিন ধরে হাত পা বাঁধা অবস্থায় এই অন্ধকার রুমটিতে মৃতপ্রায় অবস্থা হয়েছে জয়ীর। এখান থেকে বেঁচে ফেরার আশা সে ছেড়েই দিয়েছে। এখন পর্যন্ত সে জানেই না তাকে কোথায় রাখা হয়েছে, এখান থেকে কিভাবে বের হবে? কে তার এমন অবস্থা করেছে এটা সে চোখে দেখতে না পেলেও আন্দাজ করতে ভুল হয় না।
সেদিন সে তার শ্বাশুড়ির সাথে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে তার শাশুড়ির অতীত নিয়ে কথা তোলায় চরম ক্ষেপে যায় সাজেদা চৌধুরী। জয়ীও তার শাশুড়ির উল্টাপাল্টা কথাবার্তা শুনে রাগের বশে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তার মুখে মুখে তর্ক করতে শুরু করে। জয়ীর এমন ব্যবহারে সাজেদা চৌধুরী দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলেন। একের পর এক উপর্যপুরি থাপ্পড়ে ধরাশায়ী করে ফেলেন জয়ীতাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়ীতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এরপরে কি হয়েছে কিছুই মনে নেই তার। জ্ঞান ফেরার পরে দেখে এই অন্ধকার রুমে সে বন্দি। এই দুই দিনে মাত্র একবার খাবার মিলেছে। এখানে বসে রাত না দিন বোঝার উপায় নেই। টিম টিমে একটা লাইট জ্বলে সবসময়। তাতে কোনো রকম ছায়া ছায়া দেখা যায় সবকিছু। দিনে হয়তো একবেলা তার জন্য খাবার বরাদ্দ হয়েছে তাও যৎসামান্য। সে বুঝতে পারছে না তার সাথে কী হতে যাচ্ছে, তাকে কী এভাবে না খাইয়ে মেরে ফেলা হবে নাকি অন্য কোনো উপায়ে সেটা সে না জানলেও মৃত্যু যে তার খুব নিকটে এটা সে নিশ্চিত।
নিজের বোকামির জন্য খুব অনুশোচনা হচ্ছে। রাগের বশে ওসব কথা না বললেও পারত! পল্লবকে খুব মনে পড়ছে তার। মাত্রই একটা সুখ নীড়ের স্বপ্ন দেখেছে তারা দু’জন মিলে এর মাঝেই আবার সব এভাবে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে সে কল্পনায়ও ভাবেনি। পল্লব হয়তো তাকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। চোখ দিয়ে দরদর করে পানি পড়তে থাকে জয়ীর।
এদিকে পল্লব জ্বরে আবোলতাবোল বলেই যাচ্ছে। জয়ী যে কী অবস্থায় আছে সে কথা ভুলেই বসে আছে। মাঝে পুলিশ এসেছিল একবার সিসি ফুটেজ নিয়ে কথা বলতে। কিন্তু সে এতই অসুস্থ যে জ্বর ১০২ ডিগ্রির নিচে কিছুতেই নামছে না। ঠাণ্ডার মাঝে রাতভর ছাদে বসে থাকতে থাকতে জ্বরের কবলে পড়েছে। তার উপর মনের অবস্থাও ভালো না। সাজেদা চৌধুরী বাসায় ডাক্তার ডেকে পল্লবের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন। নিজেও এসে একটু পর পর ছেলের খোঁজখবর নিচ্ছেন। কিন্তু কোনো পরিবর্তন নেই।
এদিকে শুরু হয়েছে নতুন ঝামেলা। কিভাবে যেন জয়ীতার নিখোঁজ সংবাদ সাংবাদিকদের কানে পৌঁছে গিয়েছে। সকাল থেকে শুরু হয়েছে সেই ঝামেলা। সাংবাদিকের দল একদলের পর একদল আসতেই থাকছে। অবশ্য সাজেদা চৌধুরীও ঘাবড়ে যাবার মত বান্দা নন। এদেরকে কী করে হ্যান্ডেল করতে হয় সে কথা তার জানা আছে বেশ ভালো করেই। এমন করে তাদের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করছেন যেন সে নিজেও খুব উদ্বিগ্ন ছেলের বউ নিখোঁজ দেখে। জয়ীতার টেনশনে তার ছেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছে এটাও জানাতে ভুল করছেন না তাদেরকে । সে নিজেও মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত। জয়ীতাকে নাকি সে মেয়ের মত আদর করত। তাই জয়ীতাকে সে যে-কোনো মূল্যে ফিরে পেতে চায়। পুলিশ সাংবাদিক সবার সাহায্য কামনা করছে । তার ছেলে বউকে যে অক্ষত অবস্থায় ফিরিয়ে দিবে তাকে তার চাহিদার সমান পুরস্কারও দিবেন, চোখ মুছতে মুছতে এ ঘোষণাও করে দিলেন মিডিয়ার সামনে। তার অপজিশনের কেউ হয়তো তার এ ধরনের ক্ষতি করেছে যাতে তাকে বিপদে ফেলা যায়। জয়ীতার এ বাড়িতে আসার সময়ে তার সাথের সম্পর্কটা সবারই জানা তাই জয়ীতাকে নিখোঁজ করতে পারলে সর্বপ্রথমে আঙ্গুলটা তার শ্বাশুড়ীর দিকেই যাবে এটাই চাচ্ছে তার অপজিশন প্রার্থীরা। কিন্তু তাদের রোষানলে পড়ে নিরীহ মেয়েটাকে যেন কোনোরকম কষ্ট দেওয়া না হয় এটা সে বিনীতভাবে অনুরোধ করে।
ভেজা চোখে সে সবার কাছে তার ছেলের বউয়ের নিরাপদ মুক্তি কামনা করছে। তার এমন রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে বলি যেন তার ছেলের বউ কিছুতেই না হয় এটা তার আকুল চাওয়া। প্রয়োজনে সে রাজনীতির মাঠ থেকে সরে যাবে তাও তার ছেলের বউকে সে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেতে চায়। এমন কথা শোনার পরে কী আর বলার থাকে সাংবাদিকদের।
।
তারা কথা বলতে চায় পল্লবের সাথে। পল্লবের অসুস্থতার দোহাই দিয়ে এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন সাজেদা চৌধুরী। তবে পল্লবের সুস্থতা যে তার জন্য কতটা অনিরাপদ সেটা সে এখনই টের পাচ্ছে। তাই যে করেই হোক এই মুহূর্তে পল্লবের সুস্থতার থেকে পল্লবকে অসুস্থ করে রাখাটাই এখন তার প্রধান কাজ।
তাদের পারিবারিক ডাক্তারের সাথে কথা বলে পল্লবকে হসপিটালে এডমিট করার ব্যবস্থা করা হলো। কোথায় ভর্তি করা হয়েছে এটা সে এবং তার বড় ছেলে ছেলে ছাড়া আর কারোরই জানার সুযোগ সে রাখেনি। মোটামুটি একপ্রকার বন্দি অবস্থায় রাখা হয়েছে পল্লবকে সেখানে তার চিকিৎসা চলবে আবার বন্দি করেও রাখা হবে। একের মধ্যে দুই আর কী! সে যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ মনে না করবে ততক্ষণ পর্যন্ত পল্লবকে এভাবে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে বন্দি রাখা হবে।
পরপর চার দিন কেটে গেছে। জয়ীতার নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ জাতীয় দৈনিকগুলোতেও চলে এসেছে। কিন্তু তার সন্ধান মিলছে না কোনোভাবেই। জয়ীতার বাড়ি থেকে তার আত্মীয়স্বজন মা-বোনেরা এসেছে, খালেক সাহেব পর্যন্ত চলে এসেছেন কিন্তু কারোরই জানা নেই যে জয়ীতা কোথায় আছে? বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে! সাজেদা চৌধুরী সবাইকে স্বান্তনা দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন এই বলে আশ্বস্ত করে যে সে যেকোনো মূল্যে ছেলে বউকে উদ্ধার করবেন।
এভাবে কেটে গেল আরো সাত সাতটা দিন। চব্বিশ ঘন্টায় একবার খাবার মিলে জয়ীতার তাও খুব সামান্য। কেউ একজন এসে জয়িতাকে খাইয়ে দিয়ে যায়। খাবার খেতে দেওয়ার আগ মুহূর্তে পেছন থেকে এসে জয়ীতার চোখ দুটো বেঁধে দেওয়া হয়। যাতে সে কাউকে দেখতে না পায়। জয়ীতা অনুমান করতে পারে এখানে একজন মানুষই আসে প্রতিদিন । জয়ীতা প্রতিদিনই হাউমাউ করে কেঁদে তার কাছে তার মুক্তির ফরিয়াদ জানায় কিন্তু পাথরের মন যেন গলে না। সে পল্লব এর কথা জানতে চায়। পল্লব কেমন আছে কোথায় আছে সেটাও জানতে চায়। কিন্তু কোনো উত্তর পায় না একদিনও।
এ ক’দিনে জয়িতা আন্দাজ লাগিয়ে ফেলেছে, যে এখানে কে আসে প্রতিদিন তাকে খাওয়াতে। এই মানুষটাকে সে খুব পছন্দ করে। এ বাড়িতে আসার পরে একমাত্র এই মানুষটিকেই সে খুব আপন করে ভাবত।
আজ খাওয়া যখন শেষ হয় তখন হঠাৎ করে জয়িতা বলে উঠল,
– রাবু খালা, আপনাকে তো আমি মায়ের মতো ভালোবাসি আপনি আমার সাথে এভাবে করতে পারছেন কীভাবে? আমাকে বাঁচান রাবু খালা।
রাবু খালা কেঁপে ওঠেন। জয়ীতা তাকে চিনল কী করে? সে জয়ীতার কথার কোন উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি তার কাজ শেষ করে চলে যেতে চান।
– আমি জানি আপনি কোন কথা বলবেন না কারণ আপনি তো আপনার মালিকের হুকুমের দাস। আপনি কোন কথা না বললেও আপনাকে আমি চিনতে পেরেছি ঠিক। আপনার গায়ের গন্ধ আমার কাছে অচেনা নয়। থাক, কিছু চাইবার নেই আর আপনার কাছে। একটা দীর্ঘসাস ছেড়ে বলল, জয়ীতা।
আবার একটু থেমে সে বলল, খালা শুধু একটা কথাই জানতে মন চাইছে আমাকে এভাবে আর কত দিন বাঁচিয়ে রাখবেন আমিতো মরে যাচ্ছি। একবারে মেরে ফেলুন না। হয় আমাকে মুক্তি দিন নইলে গলাটা চেপে ধরে এখনই মেরে ফেলুন। তিলেতিলে মারার প্লান করেছেন কী আপনারা? আমাকে একটু দয়া করুন। আপনি তো আমার মায়ের মতো! এই যে পরম মমতায় প্রতিদিন খাবারের লোকমা মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন সেই মমতার দোহাই! আমাকে গলা চেপে মেরে ফেলুন। আমি এভাবে আর পারছি না।
রাবু খালা খেয়াল করলেন জয়ীতার চোখের পানিতে
চোখের ওপরের কাপড়টা ভিজে যাচ্ছে। তার নিজের চোখও সিক্ত। জয়ীতা না দেখলেও যেনো বুঝতে পারছে সেটা।
আসলে রাবু খালার জর্দার ঘ্রাণটা জয়ীতার ভীষণ পছন্দের। সে নিজেও কয়েকবার তাকে এই জর্দা এনে দিয়েছে। রাবু খালা তার মালিকের খুবই আজ্ঞাবহ আর অনুগত। এটা জয়ীতা নিজেও জানে। তবে মানুষটা খুব ভালো মনের মানুষ।
রাবু জয়ীর পেছন দিক থেকে ফিরেই যাচ্ছিল চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে তখনই হঠাৎ কীসব ভেবে জয়ীর সামনে এসে দাঁড়ায়। এত কষ্টের মাঝেও জয়ীতার বুকের মাঝে আনন্দের ঢেউ খেলে যায় রাবু খালাকে দেখতে পেয়ে। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই রাবু খালা তার হাত পায়ের সব বাঁধন খুলে দিলো। সে ইশারায় জয়ীতাকে বোঝাল এখান থেকে পালিয়ে যেতে। এবং কোনোদিনই এদিকে না আসতে! কারণ তার শাশুড়ির হাতে পড়লে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত।
জয়ী রাবু খালাকে জিজ্ঞেস করল সে এখন কোথায় আছে?
আসলে চিলেকোঠার ওখানে যে স্টোর রুমটা আছে ওটা একদম বরাবর নিচতলা পর্যন্তই রয়েছে। কিন্তু সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। জয়ীর নানা শ্বশুরের সময় থেকেই এটা নানা ধরণের গোপণ কাজে ব্যবহারের জন্য তৈরি হয়েছে। তিনতলা থেকেই এখানে নামার একটা সিঁড়ি আছে। কিছু পুরানো আসবাবের পেছনে সিঁড়িটা রয়েছে। এ বাড়িতে এই গোপণ কুঠুরির কথা সাজেদা চৌধুরী আর রাবু ছাড়া আর কেউ জানে না। দোতলার অংশে রাখা হয়েছে জয়ীতাকে। এর পাশেই সাজেদা চৌধুরীর বেড রুম।
ইশারায় সব বুঝিয়ে দিলো রাবু খালা। জয়ীতা তো ভীষণ অবাক এসব শুনে। সে এই এক বছর ধরে এ বাড়িতে থাকলেও এখানে এমন কুঠুরি রয়েছে কিছুই আঁচ করতে পারেনি।
জয়ীতার কাছে সব স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না সে মুক্তি পাচ্ছে এখান থেকে। আনন্দের আতিশয্যে রাবু খালাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে শুরু করল। হঠাৎ তার মনে হল সে যদি এখান থেকে পালিয়ে যায় তাহলে এই মানুষটিকে বিপদে পড়তে হবে। যে তার প্রাণ ভিক্ষা দিলো তাকে কী করে বিপদে ফেলবে? রাবু খালাকে বলে সে তাকে বিপদে ফেলে এখান থেকে যেতে পারবে না। এমনিতেই যাবেই বা কোথায়? পল্লবের জীবনে যদি ফিরতেই না পারে তবে বেঁচে থাকা আর মরে যাবার মাঝেই বা কী তফাৎ!
রাবু খালা পাগলামি করতে নিষেধ করে ইশারায় বুঝিয়ে বলেন, এখানে থাকলে জয়ীকে হয়তো আর দু’একদিন বাদেই মেরে ফেলা হবে। চারপাশের অবস্থা একটু স্বাভাবিক হওয়ার আশায় উনি এখনো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। বেঁচে থাকলে পল্লবকে সে একদিন নিশ্চয়ই পাবে! কিন্তু মরে গেলে তো শেষবারের মতোও আর দেখা হবে না পল্লবের সাথে। তাই এই মুহূর্তে তার নিজেকে বাঁচানো উচিৎ।
রুমের এক কর্ণারে অক্সিজেন আসার জন্য উপরের দিকে একটা ছোট জানালার মতো আছে। রাবু চেক করে দেখল জানালার গ্রীলটাতে বেশ মরিচা পড়েছে। বহুবছর কোনো রিপেয়ার করা হয় না। সে দ্রুত তিনতলাতে ফিরে যেয়ে পুরানো আসবাবের ভেতর থেকে একটা ছোটো শাবল নিয়ে আসে। শাবল দিয়ে কিছু সময় প্রেসার দিতেই গ্রীল বাঁকা হয়ে গেল।
জয়ীতাও একটু হাত লাগাল। সে জয়ীতাকে বুঝিয়ে দিলো কীভাবে বের হতে হবে। নিজের পরনের শাড়িটা এ পাশের একটা পিলারের সাথে বেঁধে নেয়। একটা ড্রাম টেনে জয়ীতাকে বলে তার উপর উঠে ওই শাড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতে। জয়ীতার খুব ভয় হয়। শরীর ভীষণ দুর্বল তার। এই অবস্থায় এক পা ফেলাই তার জন্য মুশকিল সেখানে শাড়ি বেয়ে নিচে নামা তো অনেক দূরের কথা। রাবু খালা তাকে সাহস দেয়। জয়ীতা ভাবে একবার চেষ্টা করে দেখতে কী দোষ! এমনিতেই তো মরতে হবে! না হয় একটু বাঁচার চেষ্টা করে দেখুক শেষ বারের মতো। কিন্তু বেশি চিন্তা হচ্ছে এই মানুষটির জন্য। তাকে বাঁচাতে যেয়ে নিজেই না কোনো বিপদে পড়ে। তার শাশুড়ি যে পরিমাণ জল্লাদ।
জয়ীতা রাবু খালাকে জিজ্ঞেস করে, তাকে এখান থেকে বের করে দিয়ে সে নিজেকে কি করে বাঁচাবে তার শাশুড়ি হাত থেকে?
রাবু খালা তাকে তার জন্য চিন্তা করতে নিষেধ করেন। কীভাবে নিজেকে বাঁচাতে হবে সেটা তার জানা আছে। দ্রুত জয়িতাকে সেখান থেকে বের হওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন।
কোনোরকম করে ওই চিপা জায়গা থেকে নিজেকে বের করে শাড়িটা ধরে আস্তে আস্তে নিচের দিকে নামতে থাকে জয়িতা। বুকের মধ্যে দুরুদুরু করছে তার। একদিকে তো শরীরে চার আণার শক্তি নেই অন্যদিকে চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাড়ির এই পাশটায় কিছু ঝোপঝাড় থাকার কারণে মানুষের আনাগোনা ও খুব কম।
হঠাৎ জয়ীর মনে হলো তার চার পাশটা বনবন করে ঘুরছে। মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল অমনি হাত ফসকে গেল এরপর কিছু মনে নেই তার।
রাবু খালাকে দেখে সাজেদা চৌধুরীর চোখ চড়কগাছ। ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, একটা বাজে।
রাবু খালার পরণে ছেঁড়া একটা পেটিকোট আর ব্লাউজ। শাড়ি নেই। মাথা দিয়ে জবজব করে রক্ত পড়ছে।
সাজেদা চৌধুরী দাঁড়িয়ে গেলেন। দ্রুতপায়ে দরজা লক করে দিলেন।
– কী হয়েছে? তোর এ অবস্থা কেনো?
ইশারায় রাবু তাকে যা বোঝাল তাতে তার জ্ঞানশূন্য হবার উপায়।
রাগে বিড়বিড় করতে করতে রাবুর দুই গালে সজোরে দুই থাপ্পড় মারলেন সাজেদা চৌধুরী।
– এটা কীভাবে হলো? একবারও ভেবেছিস ওই মেয়ে মিডিয়ার সামনে গেলে আমার কী অবস্থা হবে? আমার পুরো জীবনের সঞ্চিত মান সম্মান এখন ওর হাতে।
আবারও মারতে উদ্যত হলে রাবু খালা তার পা জড়িয়ে ধরেন। সাজেদা চৌধুরী তাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে ওই রুমে যাবার জন্য চিলেকোঠার রুমের দিকে রওয়ানা দেন।
রুমের ভেতরে যেয়ে দেখেন ভেতরে ভীষণ খারাপ অবস্থা। রাবুর সাথে যে অনেক ধ্বস্তাধস্তি হয়েছে চারপাশে দেখলেই বোঝা যায়। রাবুর পরনের কাপড় খুলে উপরে বাঁধা হয়েছে। এই মেয়েকে দিনে যে একবেলা খাবার দেয়া হতো সেটাও বন্ধ রাখা উচিত ছিল। পানি খেয়েই বাঁচলে বাঁচত না হলে মরে যেত। রাবুর পীড়াপীড়িতেই একবেলা খাবার এলাউ করেছিল সে। এখন বুঝতে পারছে কতবড় ভুল সে করেছে।
বুকের মাঝে ঢিপঢিপ বেড়েই চলছে। জয়ীতা যদি মিডিয়ার সামনে তার এই কিডন্যাপের রহস্য বলে দেয় তাহলে কী হবে তার ভেবেই শিউরে ওঠে। তার চেয়ে বড় কথা পল্লবের জন্মের ইতিহাস এই মেয়ে জানে।
আগামীকাল তার নমিনেশন এর ব্যাপার ফাইনাল হবে। এরমাঝে এসব টেনশান আর সে নিতে পারছে না।
দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে রাবুকে সাথে নিয়ে বাড়ির পেছনে যায় । যে করে হোক এই মেয়েকে তার পেতেই হবে। টেনশনে হার্টবিট বেড়েই যাচ্ছে।
চলবে……