#সুখ_নীড়
#পর্ব_২৫,২৬
২৫
জয়ীতার রিপোর্ট হাতে হসপিটালের এ মাথা ও মাথা দৌড়াচ্ছে তুহিন। জয়ীতার এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়ি তার সিজার করতে হবে। না হলে বড়ো কোনো বিপদ ঘটে যেতে পারে। জয়ীতার বেশ ব্লিডিংও হয়েছে। তাই ব্লাড ডোনারও রেডি করতে হবে।
আজ ভোরবেলা জয়ীতার চিৎকারে কাকলির ঘুম ভেঙে যায়। সে তার ছোট মাথায় যতটুকু বুদ্ধি কুলোয় ততটুকু দিয়ে জয়ীতাকে নানাভাবে সুস্থ করার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ওই অস্পষ্ট আলোতেই দৌড়ে যায় বাড়িওয়ালার বাসায়। সামনে কয়েকটা ফাঁকা প্লট রেখেই বাড়িওয়ালার বিল্ডিং। সেখানে দোতলায় থাকেন বাড়িওয়ালা। তিনি মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক। পল্লব তাকে খুব সম্মান করে। জয়ীতার এমন বিপদের কথা শুনে সে ছুটে চলে আসে। দ্রুত সে জয়ীতাকে এই হাসপাতালে নিয়ে আসে।
বেলা দশটার দিকে তুহিন অফিসের জরুরী একটা ব্যাপারে কথা বলার জন্য বারবার পল্লবের নাম্বারে কল করে না পেয়ে বাধ্য হয়ে জয়ীকে কল দেয়। জয়ীর ফোন রিসিভ করে কাকলি। এতক্ষণ সে ফোনের লক খুলতে না পারায় জয়ীতার মায়ের কাছেও কল দিতে পারেনি। জয়ীর ফোনে কল আসতেই সে তুহিনকে জয়ীতার কোনো আত্মীয় মনে করে কাঁদোকাঁদো হয়ে সবকিছু বলতে থাকে।
তুহিন কাকলির সাথে কথা বলে কোনোকিছু ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে কাছে বড়ো কেউ থাকলে তাকে ফোন দিতে বলে। কাকলি বাড়িওয়ালার কাছে ফোন ধরিয়ে দিলে সে সবকিছু খুলে বলে জয়ীতার ব্যাপারে। তুহিন সবকিছু জেনে খুব ঘাবড়ে যায়। দ্রুত ছুটে যায় সাভারে। সেখানে পৌঁছাতে তার ঘণ্টা দুই লেগে যায়। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের কাছে তুহিন পল্লবের খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে। কিন্তু উনি নিজেই জানে না সেখানে সে তুহিনকে কী করে জানাবে পল্লবের খোঁজ। উল্টো এতক্ষণের জয়ীতার কোনো আত্মীয় দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
জয়ীতার যে অবস্থা তাতে সে নিজেই ভীষণভাবে ভয় পেয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় কী সিদ্ধান্ত নেবেন উনি নিজেও বুঝতে পারছিলেন না। তাছাড়া পল্লবকে ফোন দিয়ে পাওয়া যাচ্ছে না। আর জয়ীর আর কোনো আত্মীয় স্বজনের নাম্বারও তার কাছে বা কাকলির কাছে, কারো কাছেই নেই। তুহিনকে পেয়ে সব দায়িত্ব তুহিনের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে হাজার সেখান থেকে চলে আসেন।
তুহিনইবা এই মুহূর্তে কী করবে? সে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। এমন একটা বিপদের মুহূর্তে পল্লবের নিখোঁজ হওয়ার কোনো অর্থই সে উদ্ধার করতে পারছে না। কতটা কেয়ারলেস হলে এই অবস্থায় স্ত্রীকে রেখে নিজে গায়েব হয়। এই মুহূর্তে সে কার কাছে সাহায্য চাইবে কিছুই বুঝতে পারছে না। এক ফাঁকে কাকলিকে নিয়ে বাসায় যেয়ে জয়ীর মেডিকেল চেকআপের সব কাগজপত্র নিয়ে এলো।
জয়ীর ব্লাড গ্রুপ জানতে পেরে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার আর জয়ীতার ব্লাড গ্রুপ একই। ডাক্তার যখন এসে বলল জয়ীতাকে এমার্জেন্সি সিজার রুমে নিতে হবে তখন তুহিন কী সিদ্ধান্ত নেবে কিছুই বুঝতে পারছে না। একদিকে প্রিম্যাচিউর বেবি তার উপর জয়ীতার অবস্থাও ভাল না। বারবার পল্লবকে ফোন দিয়ে না পেয়ে শেষে সিদ্ধান্ত নিলো পল্লবের মা মানে তার খালা সাজেদা চৌধুরীকে ফোন দিবে। আবার পরক্ষনেই নিজের মত বদলাল। সে জানে সাজেদা চৌধুরী কতটা নির্দয় স্বভাবের মানুষ। কে জানে শেষে হিতে-বিপরীত না হয়ে যায়। জয়ী এবং জয়ীর বাচ্চার সাথে যদি খারাপ কিছু করে বসে তখন সে কী জবাব দেবে পল্লবের কাছে?
তারপর ভাবল তার ভাই শাহীনকে ফোন দিবে কিন্তু সেটাও সে করল না কারণ কিছুদিন ধরে শাহীন ভীষণ ক্ষ্যাপা পল্লবের উপরে। গার্মেন্টসের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে পল্লবের সাথে আর তার সাথে বেশ ঝামেলা হচ্ছিল এটা তুহিন নিজেও জানে। শেষে দেখা যাবে তার ভাই সাহায্য করার পরিবর্তে তাকেই বকাবকি শুরু করবে এসব ঝামেলা ঘাড়ে নেওয়ার জন্য।
পরে সিদ্ধান্ত নিলো যা করার তাকে নিজেকেই করতে হবে। কাউকে জানাতে যাবে না। যা আছে ভাগ্যে। দেখা যাক! ভাগ্যই তাকে এখানে ঠেলে নিয়ে এসেছে। না হলে সকালে সে জয়ীতাকে ফোন করতেই বা যাবে কেন আর এখানে আসবেই বা কেন?
ডাক্তার এসে বলল, প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। রোগীর অবস্থা ভীষণ ক্রিটিকাল। মা এবং বাচ্চা দু’জনের জীবন সংকটাপন্ন! তাই যা করার দ্রুত করতে হবে। তুহিন চারদিকে অন্ধকার দেখছে। কী করবে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কাকে খবর দিবে আর কাকে দিবে না! এই মুহূর্তে জয়ীতার আপনজন দরকার। কারণ বন্ড পেপারে সাইন করতে হবে। তাছাড়া কাউন্টারেও টাকা জমা দিয়ে আসতে হবে।
তুহিন আগে পিছে কিছু আর চিন্তা না করে ডাক্তারকে বলল, যা করার তাই করতে। সে টাকা জমা দিয়ে আসছে এখনই।
হঠাৎ একজন নার্স এসে বলল, আপনিই তো পেশেন্টের হাজব্যান্ড? এখানে একটা সাইন করতে হবে। আপনার জন্যই এত অপেক্ষা। এত কেয়ারলেস কী করে হন বুঝি না। পেশেন্টের সিচুয়েশন খুব বেশি ভালো না। দ্রুত সিগনেচার করেন। সময় নেই আমাদের হাতে।
তুহিন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কোনো সমস্যা হবে ভেবে নার্সের কাছে আর সত্যমিথ্যা কিছু বলতে না যেয়ে মাথা ঝুলিয়ে হ্যা সম্মতি দিলো।
নার্স ফাইল এগিয়ে দিতে দিতে বলল, যে লোকটা এই পেশেন্টকে নিয়ে এসেছেন উনি সেই সময়ে অনুমতি যদি দিতেন তাহলে রোগীর অবস্থা এত ক্রিটিকাল হতো না। প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। আপনি আসতে দেরি করার কারণেই পেশেন্টের এই অবস্থা। দ্রুত এখানে সিগ্নেচার করুন। আর ব্লাড দেয়ার জন্য দোতলায় ২০৫ নাম্বার রুমে চলে যান। কুইক।
নার্স চলে যাচ্ছিল তখন তুহিন বলল, সিস্টার! জয়ীতা আর বাচ্চা বাঁচবে তো?
– কিছুই বলতে পারছি না। আল্লাহকে ডাকুন। ঘাবড়াবেন না। আল্লাহ ভরসা।
সাজেদা চৌধুরী আজ নিজে চৈতীকে নিয়ে ডাক্তার নুরুন্নাহারের ক্লিনিকে এসেছেন। ডাক্তার নুরুন্নাহার শহরের একজন সেরা গাইনি ডাক্তার। চৈতী ইনার রেগুলার পেশেন্ট।
বছরের পর বছর পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ চৈতী দ্বিতীয়বার মা হতে পারছে না। কয়েকবার ইণ্ডিয়ায় যাবার প্লান করলেও কল্লোলের ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয় নি।
সাজেদা চৌধুরীর একজন নাতী চাই। একটা ছেলে চাই যে তার বংশকে সামনে নিয়ে যাবে, তার সম্পত্তির ওয়ারিশ হবে। কল্লোলের মেয়েটাই এখন তার একমাত্র ভরসা। কিন্তু সে তো ক’দিন বাদে অন্যের ঘরে চলে যাবে। তাই তার একটা ছেলে যে করেই হোক চাই।
আজ নিজে চৈতীকে নিয়ে এসেছে। চৈতীর ভীষণ ভয় হচ্ছে। তার শাশুড়িকে তার একফোঁটাও বিশ্বাস নেই। সে আবার মা হতে না পারলে যদি নাতী পাওয়ার জন্য তার ছেলেকে আবার বিয়ে করায়! কথায় কথায় এমন সে প্রায়ই বলে। আসার পথেও গাড়িতে বসে বলেছে যে করে হোক তার বংশরক্ষার জন্য একটা ছেলে চাই। চৈতীর পক্ষে সম্ভব না হলে সে কল্লোলকে আবার বিয়ে করাবে। চৈতী মনে মনে হাজারটা গালি দিয়ে শাপ শাপান্ত করলেও মুখে কিছু বলার ক্ষমতা নেই। এমনিতেই তার শাশুড়ি এখন আহত বাঘের মতো। পল্লব চলে যাবার পর থেকে উনি কেমন যেন অস্বাভাবিক আচরণ করে সবার সাথে। আসলে জয়ীর কাছে হেরে যাওয়াটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
ডাক্তার নুরুন্নাহার অনেক অভিজ্ঞ ডাক্তার। হাত যশ খুব ভালো। পল্লব আর কল্লোলের জন্মও উনার হাতেই। বয়সে সাজেদা চৌধুরীর থেকে কিছু বেশিই হবেন ।
চৈতীর রেগুলার চেকআপ শেষে ওষুধ পত্র বুঝিয়ে দিলে সাজেদা চৌধুরী তাকে ইশারায় বাইরে অপেক্ষা করতে বলেন। ভয়ে ভয়ে চৈতী বাইরে চলে যায়।
ডাক্তারকে সে বলল, এবার বলুন, আসলে কাহিনী কী? আমার ছেলের বৌ কি তার মা হবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে? যদি এমন হয় আল্লাহর কসম! আমি কল্লোলকে আবার বিয়ে করাব। আমার বংশ তো রক্ষা করতে হবে! আমার একটা নাতী চাই যেকোনো মূল্যে।
– দেখুন, সবকিছু চাইলেই এ জগতে মেলে না। আপনি শান্ত হউন। আমি আপনাকে সবকিছু খুলে বলি। তারপর সিদ্ধান্ত নিবেন কী করবেন। আমি এতদিন ধরে ব্যাপারটা চাপিয়ে এসেছি আপনার বউয়ের কাছে।
সাজেদা চৌধুরীর চোখ লাল হয়ে ওঠে এ কথা শুনে। মনে মনে ভাবলেন তার ধারণাই সত্যি। তার বউ মা হবার যোগ্যতা হারিয়েছে।
– কী হয়েছে? কী লুকিয়েছেন আপনি? আমার কাছে সবকিছু ক্লিয়ার করুন।
– আসলে সমস্যা চৈতীর চাইতে আপনার ছেলে কল্লোলেরই বেশী। সে তো মেডিসিনও নিতে চায় না। এখানে আসেও না রেগুলার চেকআপের জন্য। সেদিনও কিছু টেস্ট দিয়ে বললাম নেক্সট ভিজিটে রিপোর্টসহ আসতে। অথচ দেখেন কোনো খোঁজখবর নেই। তার একটাই কথা তার কোনো সমস্যা নেই। আমি চৈতীকে এসব ব্যাপারে কিছুই জানাইনি যাতে সে এটা নিয়ে কল্লোলকে কোনোভাবে খোঁচা দিতে না পারে। কয়দিন আগেই এমন একটা কেইসে আমার এক পেশেন্টের হাসবেন্ড সুইসাইড করেছে। আসলে পুরুষত্ব নিয়ে কথা বললে সেই পুরুষ নিজেকে কতটা ইনসিকিউরড ফিল কতে সেটা অবশ্যই আপনি বুঝবেন। উনি বউয়ের কাছে প্রতিনিয়ত খোঁচা খেতে খেতে এবং আশেপাশের আপনজনের কথাগুলোতে খুব কষ্ট পেয়ে সহ্য করতে না পেরে সুইসাইডের রাস্তা বাছে নিয়েছে।
জানেন, চোখের সামনে আজও ছেলেটার চেহারা ভাসে। কিছুদিন ধরে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। চোখ বন্ধ করলেই ওকে দেখতাম যেন। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় সেই থেকে। তাই কল্লোলের ব্যাপারটা আমি চৈতীকে জানানোর ব্যাপারটাও আমি ভালো মনে করিনি। আপনি এসে ভালোই হলো। আপনার কাছে সত্যিটা আমি বলতে পেরে নিজেকে হালকা বোধ করছি কিছুটা ।
ডাক্তার নুরুন্নাহারের কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেননি সাজেদা চৌধুরী। সাজেদা চৌধুরীর কাছে এসব অবাস্তব গল্প মনে হচ্ছে।
ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ডাক্তারকে বলল,
এসব মনগড়া কাহিনী বানাতে লজ্জা লাগে না । চৈতীকে বাঁচানোর জন্য এসব কথা বলছেন, না?
ডাক্তার নুরুন্নাহারও এবার ক্ষেপে গেলেন।
– আপনি কি আমাকে খুব সস্তা ভাবছেন? আমি কেন কোনো মনগড়া কাহিনী আপনাকে বলতে যাব? আমার কী ঠেকা পড়েছে? আপনার সাথে আমার অনেক দিনের পরিচয় তাই আমি ব্যাপারটা আপনাকে ভালো করে বলেছি! আপনার মন চাইলে বিশ্বাস করবেন না চাইলে নাই। অন্য ডাক্তার দেখিয়ে কনফার্ম করতে পারেন।আমার কাছে আর আসবেন না, প্লিজ। আমার পেশেন্ট বসে আছে। এবার আসতে পারেন। বলে বাইরের দিকের দরজার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন উনি।
ডাক্তার নুরুন্নাহারের এমন একগুঁয়েমি দেখে সাজেদা চৌধুরী বুঝলেন যে এটা হয়ত আসলেই সত্যি। তাছাড়া ডাক্তার নুরুন্নাহার বিক্রি হয়ে যাবার মতো কোনো মহিলাও নয়।
– স্যরি। আচ্ছা, বুঝলাম আমার ছেলের সমস্যা আছে তাহলে এর আগে ওর মেয়ে হলো কি করে? এটা বলুন।
– এটাই একটা ভ্রান্ত ধারণা। একটা ছেলে বা একটা মেয়ে হলেই আমার মনে করি তার নেক্সট টাইম বাচ্চা হতে আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আসলে সেটা না। সমস্যা আছে, প্রথম সন্তান হওয়ার পরেও অনেক সময় দ্বিতীয় সন্তান হওয়া নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়। যেটা হচ্ছে কল্লোল এবং চৈতীর ক্ষেত্রেও। দু’জনেরই ফার্টেলিটি পাওয়ার খুবই কম। আমি অনেকভাবে পরীক্ষা করেছি, ট্রিটমেন্ট দিচ্ছি। কিন্তু কল্লোলের ফার্টেইলিটি কমছেই দিন দিন। চৈতী মোটামুটি ওকে। কল্লোলেরই বেইসকলি মেজর প্রবলেম। তাকে মানসিকভাবে, শারিরীকভাবে রিলাক্সে থাকতে হবে। প্রেসার একদমই নেওয়া যাবে না। ড্রিংকসের নেশা থাকলে সেটাকে ছাড়তে হবে। আমার জানামতে কল্লোল ড্রিংকস করে প্রচুর। তাছাড়া প্রপার টাইমে মেডিসিনটা পর্যন্ত খায় না। যাই হোক এসব বলে আর কী লাভ! আপনি যদি বংশরক্ষা করতে চান সেক্ষেত্রে চৈতীর না কল্লোলকেই ট্রিটমেন্ট করান।
সাজেদা চৌধুরীর মাথা কিছু সময়ের জন্য কাজ করা যেন বন্ধ করে দিয়েছে। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে।
– আমাদের সমাজে এক ভ্রান্ত ধারণা রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে যে বাচ্চা না হলেই সমস্যা মায়ের। বাবারও যে কোনো ভূমিকা রয়েছে এখানে সেটা কারো মাথায়ই আসে না। মনে-মনে ধরেই নেয় মায়েরই যত সমস্যা। তাহলে বংশ রক্ষার জন্য কি করা যায়? সহজ উপায়, ছেলেকে আবার বিয়ে করাও আর এরপর বিয়ের পর বিয়ে করতেই থাকে। কিন্তু নাতী নাতনীর মুখও আর দেখা হয় না। যত্রতত্র এমন হাজারো উদাহরণ রয়েছে আমাদের সমাজের চারপাশে। কিন্তু আপনার কাছে আমি এটা আশা করিনি। আপনি একজন এডুকেটেড পারসন , আপনি কিছু না জেনে না বুঝে চৈতীর উপরে রাগ দেখাচ্ছেন।
যাই হোক আমার আর কিছু বলার নেই। আমি আমার মতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। যেহেতু আমার এখানে রেজাল্ট ভালো হয়নি আপনি বাংলাদেশে আরও অনেক ডাক্তার আছেন তাদেরকে দেখাতে পারেন। অথচ সবচাইতে বেস্ট হয় যে চাইলে দেশের বাইরে ট্রিটমেন্ট করাতে পারেন। হয়ত খুব দ্রুতই ভালো কোনো রেজাল্ট পেয়ে যাবেন।
ক্লিনিক থেকে বের হবার পরে সাজেদা চৌধুরীর মুখ যেন থুবরে পড়েছে। চৈতী ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছে না। কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই সাহসও নেই।
সারা রাস্তা গাড়িতে শাশুড়ি-বউয়ের একটা কথাও হলো না।
জয়ীতার একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। সে নিজেও কিছুটা বিপদমুক্ত। এখনো পুরোপুরিভাবে সেন্স ফেরেনি।
তবে তার বাচ্চা প্রিম্যাচিউর হবার কারণে বেশ সমস্যা হচ্ছে। বাচ্চার ওজন আড়াই কেজির চেয়ে কম ।
ছোট্ট ফুসফুস দু’টো বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেন গ্রহণ করার মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। দেহে নিজস্ব তাপ উৎপাদন প্রক্রিয়াও তৈরি হচ্ছে না। তাই তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে।
তুহিন একা একা হাসপাতালের করিডোর ধরে পায়চারি করছে। এতবড় একটা ধকল গেল অথচ এখনো এই পল্লবের ফেরার নামগন্ধ নেই। এই লোকটা এত কেয়ারলেস হবার কথা না। সে খানিকটা অবাক হলো। যার স্ত্রী এ রকম অবস্থায় তার তো এভাবে গায়েব হয়ে যাবার কথা না। তাছাড়া আজকে সে অফিসেও যায়নি। গতকাল রাত বারোটার দিকে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজ খবর নেই। কোনো বিপদ হলো না তো!
এদিকে তার ভাই শাহীন কয়েকবার কল দিয়েছে অফিসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনার জন্য।
তুহিন তার এক বন্ধু গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি এটা বলে কোনো রকম করে আজ কাটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু পল্লবের ব্যাপারটা নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল।
এখান থেকে যাবে সেই উপায় পর্যন্ত নেই। জয়ীতা এবং তার বাচ্চাকে কার দায়িত্বে রেখে যাবে সেটাই মাথায় আসছে না।
ওয়েটিং রুমে যেয়ে কর্ণারের দিকে একটা খালি চেয়ার পেয়ে সেখানে বসল। বসে বসে ভাবছে পল্লবকে তার মা ধরে নিয়ে যায় নি তো! বা পল্লব নিজে থেকে মায়ের কাছে গেছে এমন কিছু হতে পারে।
এসব ভাবনায় মগ্ন অবস্থায় চোখ পড়ল নিউজ চ্যানেলে।
ব্রেকিং শিরোনামঃ তুরাগ নদীতে গাড়িসহ একটি অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার।
এটা পড়ে হঠাৎ বুকের মধ্যে ধক করে উঠে তুহিনের। পল্লবের আবার কিছু হয়নি তো!
সে দ্রুত বিস্তারিত খবর জানতে ফোন হাতে নিলো।
চলবে….
#সুখ_নীড়
#পর্ব_২৬
মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদছেন সাজেদা চৌধুরী। এমন দৃশ্য তাকে দেখতে হবে এটা স্বপ্নেও ভাবেনি সে। তার প্রিয় সন্তানের রক্তাক্ত নিথর শরীরটাকে সে চোখ থেকে সরাতেই পারছে না। তাকে বারবার ব্যর্থ স্বান্তনা দিয়েই যাচ্ছে তুহিন। সে নিজেও ভীষন ভেঙে পড়েছে। তার মাথায় এখন শুধু একটাই চিন্তা পল্লবের মৃত্যুর খবর সে কি করে জানাবে জয়ীতাকে। জয়ীতার মাত্র সিজার হয়েছে। একদিকে শারীরিক অবস্থা ভালো না অন্যদিকে তার বাচ্চাটা ইনকিউবেটরে। বাচ্চার বেশ কিছু সমস্যা আছে। ডাক্তাররা তাদের মত চেষ্টা করে যাচ্ছে বাকিটা আল্লাহর হাতে। তাছাড়া বাচ্চাটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। তুহিন বুঝতে পারছে না কি করবে! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো বাচ্চাটিকে সে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখবে। সে তার সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করবে বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা। যদিও তুহিনের কাছে টাকার অভাব নেই। কিন্তু অন্যের বাচ্চার জন্য টাকা খরচ করার মানসিকতারও প্রয়োজন। তাও একটা দুইটা হাজার টাকার তো ব্যাপার না।
গাড়িসহ পল্লবের লাশ মিলেছে তুরাগ নদীতে। ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে একদম। টেলিভিশনে দেখে সন্দেহ হওয়াতে মর্গে পৌঁছে সে যখন নিশ্চিত হয়েছে যে এটা পল্লবেরই লাশ, তখনই সে তার খালা সাজেদা চৌধুরীকে ফোন দেয়। তাকে সে প্রথমে সরাসরি মৃত্যু সংবাদ না দিয়ে বলেছে পল্লব অ্যাক্সিডেন্ট করে হসপিটালে ভর্তি হয়েছে।
ছেলের নিথর দেহটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না সাজেদা চৌধুরী। বুক চাপড়ে আহাজারী করেই যাচ্ছেন। তার কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। নিজেই নিজেকে দোষারোপ করছেন কেন আদরের ছেলেকে অভিমান করে দূরে সরিয়ে রেখেছে তাই। একে একে তাদের আত্মীয়-স্বজন সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে। তুহিনের বড়ো ভাই শাহীন, শাহীনের বউ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে তাদের এমন বিপদের কথা শুনে। তাছাড়া পল্লব তার এমপ্লয়ি ছিল। গতকাল রাতেও কত কথা হয়েছিল ব্যবসায় সংক্রান্ত। অথচ এটা কী করে কী হলো সে বুঝতে পারছে না শাহীন নিজেও। আসলে মানুষের কার কখন মৃত্যু হবে কে জানে।
কল্লোল কিছুতেই মানতে পারছে না তার ভাই বেঁচে নেই। সেও তার মায়ের মতো ভেঙে পড়েছে। হান্নান সাহেব কোথা থেকে যেন খবর শুনে চলে এসেছেন। হান্নান সাহেবও নিজেকে ঠিক রাখতে পারছেন না পল্লবের নিথর দেহটা দেখার পর থেকে। কে কাকে স্বান্তনা দিবে? এমন তরতাজা মানুষটাকে ওভাবে আসলে কেউই মেনে নিতে পারছে না। সাজেদা চৌধুরী কল্লোলকে জড়িয়ে ধরে রোনাজারি করেই যাচ্ছে। এতকিছুর মাঝে তাদের এখনো হুঁশ হয়নি যে জয়ীতা কোথায়!
আসলে ছেলে হারিয়ে এমন পরিস্থিতিতে সে দিগ্বিদিক হারিয়ে ফেলেছে।
মর্গের সামনের ভীড় কমাতে হিমশিম খাচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তার উপর যোগ হয়েছে পুলিশ আর মিডিয়ার লোক। একেতো অস্বাভাবিক মৃত্যু তার উপর সাজেদা চৌধুরীর ছেলে। সবমিলিয়ে হুলস্থুল অবস্থা।
সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। প্রাথমিকভাবে এটা গাড়ি দুর্ঘটনা বলে পুলিশ ধারণা দিলেও সাজেদা চৌধুরী এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। তার একটাই কথা তার ছেলে পল্লব ড্রাইভিং এ খুব এক্সপার্ট! খুবই রাফ ড্রাইভিং করতে অভ্যস্ত সে। কখনো কোনো ছোটো এক্সিডেন্টও করেছে তার মনে পড়ছে না। এটা প্ল্যান্ড মার্ডার। তার ছেলেকে কেউ জেনে-বুঝেই মেরে ফেলেছে। পুলিশ সাসপেক্টেড কারো নাম জানতে চাইলে সাজেদা চৌধুরী সতর্ক হলেন। তার সন্দেহের প্রথম তীর শাহীনের দিকে। এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বড়ো শত্রু সে। তার ছেলেটাকে নানাভাবে ভড়কেছে এই অমানুষটাই।
রাত অনেক হয়েছে। সাজেদা চৌধুরীর খাওয়া দাওয়া কিছুই হয়নি। ছেলের লাশ নেওয়ার জন্য নিজেই মর্গের সামনে বসে আছেন। পোস্টমর্টেম করা শেষ হলেই ছেলেকে নিয়ে তবেই ফিরবেন। চোখের পানি কান্না করতে করতে শুকিয়ে গেছে তার। শুষ্ক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে নিথর দেহটাকে আরো একবার বুকে জড়িয়ে নেবার আশায়। চৈতী তাকে নানাভাবে স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। সে নিজেও বিমর্ষ।
শাহীন নিজেই তার ক্ষমতার প্রয়োগ করে খুব তাড়াতাড়ি যাতে পল্লবকে এখান থেকে নিয়ে যাওয়া যায় সেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। কল্লোলও কম দৌড়ঝাঁপ করছে না। শাহীনের এত আন্তরিকতা দেখে সাজেদা চৌধুরী মনে মনে অঙ্কের পর অংক কষেই যাচ্ছে।
একপর্যায়ে সাজেদা চৌধুরীর মনে পড়ল এতকিছু হয়ে যাচ্ছে, তার ছেলে বৌ জয়ীতা কোথায়? চৈতী বারকয়েক বলতে যেয়েও ভয়ে বলেনি। এই মুহূর্তে তার শাশুড়ি এটা নিয়ে আবার না উল্টাপাল্টা কোনো রিয়্যাক্ট করে বসে তার উপর। সাজেদা চৌধুরী ভাবছেন, ওই ডাইনিটা এখানে কেন নেই? ওর কারণেই তার ছেলে তার থেকে দূরে সরে গিয়েছে। সে তার ছেলেকে পর করে দিয়েছে। পাষাণের মতো নিজের রক্তকে অস্বীকার করেছে।
সাজেদা চৌধুরীর চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েই ড্রাইভারকে বলল, গাড়ি বের করতে। এই মুহূর্তে সে থানায় যাবে।
জয়ীতার পুরোপুরি হুঁশ ফিরেছে। তাকে কেবিনে রাখার পরিবর্তে ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। তুহিন ইচ্ছে করেই তাকে ওয়ার্ডে রাখতে বলেছে। কারন কেবিনে থাকলে তাকে দেখাশোনার কেউ থাকবে না। ওয়ার্ডে সারাক্ষণ কেউ না কেউ থাকে। সে ভেবেছিল বিকেলের দিকে এসে জয়ীতার বাসার মেয়েটাকে এনে রেখে যাবে। তাছাড়া এই সময়ের মাঝে পল্লব হয়তো আসবে সে এসে কোনো না কোনো ব্যবস্থা করবে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হয়নি।
সে নিজেও আসতে পারেনি আর পল্লবের তো আসার রাস্তা চিরদিনের জন্য বন্ধ।
একজন নার্স এসে জয়ীতাকে জানিয়ে গিয়েছে তার বাচ্চা প্রিম্যাচিউর হবার কারণে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। তার হাজবেন্ডই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছেন। পল্লব এসেছে জেনে জয়ীতা ভীষণ খুশি হলো।
চারপাশে তাকিয়ে জয়ীতা শুধু পল্লবকে খুঁজছে। ধীরে ধীরে তার গতরাতের কথা সবকিছু মনে পড়ছে। পল্লবকে নিয়ে কীসব আজেবাজে ভেবে নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়ে এখন পল্লবকেই উল্টো বিপদে ফেলে দিলো সে। তার উচিত ছিল নিজেকে শক্ত রাখা। তার ভুলের খেসারত দিচ্ছে তার বাচ্চা আর পল্লব। বাচ্চার চিন্তায় মাথাটা প্রচণ্ড ঘুরে উঠে। মনে মনে পল্লবকে খুঁজে ফিরছে সে।
ডাক্তার রাউন্ডে এসে জয়ীতার বিপি প্রচুর হাই দেখে মেডিসিনের ডোজ বাড়িয়ে দিলেন। নার্স শিউলিকে বললেন, পেশেন্টের দিকে খেয়াল রাখতে। এই সময়টা ভীষণ ক্রিটিকাল তার জন্য। জয়ীতা নার্সকে জিজ্ঞেস করল, তার হাজবেন্ড বাইরে আছে কি না? সে কথা বলতে চায়।
শিউলি বাইরে দেখে এসে বলল, না। উনি বাইরে নেই। দুপুরে বেরিয়েছে এখনো আসেনি। তবে ওয়ার্ডের ল্যান্ডফোনে যোগাযোগ করে একবার খোঁজ নিয়েছিল।
জয়ীতার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে। পল্লবকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার। ভালোভাবে কথা বলতে পারছে না। খুব কষ্ট করে আস্তে-ধীরে সে নার্সকে বলল, আমি একটু উনার সাথে কথা বলতে চাই। আমার কাছে তো ফোন নেই। আপনার ফোন থেকে কথা বলা যাবে?
নার্স শিউলির জয়ীতার প্রতি এমনিতেই খুব সহানুভূতি কাজ করছে। প্রত্যেক পেশেন্ট এর পাশে আত্মীয় স্বজনের ভীড় লেগে আছে। অথচ এই পেশেন্ট এর অবস্থা এত ক্রিটিকাল হওয়া স্বত্ত্বেও কেউ পাশে নেই। এমনকি হাজবেন্ড পর্যন্ত নেই। লোকটা সেই কখন গিয়েছে এখনো কোনো খোঁজ নেই। সকাল শিফটের একজন নার্সের কাছে টাকা দিয়ে গেছে কিছু লাগলে যাতে নিয়ে আসতে পারে।
এই সময়ের মাঝে মাত্র একবার কল দিয়ে খবর নিয়েছে। আর বলে দিয়েছে আজ আর তার আসার সময় হবে না। তাই তারা যেন একটু খেয়াল রাখে জয়ীর দিকে। এ কথা শুনে ভীষণ রাগ হলো নার্স শিউলির। এই সময়েও এত কীসের ব্যস্ততা?
জয়ীতার অনুরোধে সে জয়ীতার কাছে তার মোবাইলটা দিলো। জয়ীতা কোনোরকম করে পল্লবের নাম্বারটা তুলে ডায়াল করল। কিন্তু পল্লবের ফোন বন্ধ। নার্স নিজেও কয়েকবার কল করে বন্ধই পেল। আসলে পল্লবের ফোন বাসাতেই চার্জ শেষ হয়ে নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে আছে।
জয়ীতার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে নার্স শিউলি বলল, উনি হয়তো ভীষণ ব্যস্ত। না হলে উনি কিছুতেই এখানে না এসে পারতেন না। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমান।
জয়ীতার বুকের মাঝে কেমন যেন চিনচিন করে উঠল। পল্লবের কীসের এত ব্যস্ততা? একটা বারের জন্য তার সাথে কথা বলতে সময় হয় না!…
নার্সকে আবার জিজ্ঞেস করল, তার বাচ্চা ভালো আছে কিনা! নার্স জানাল, বাচ্চা ভালো আছে। আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে তখন শিউলি বলল,” ডাক্তার আপনাকে বেশী কথা বলতে নিষেধ করেছে। বিপি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘুমাতে হবে। আপনার হাজবেন্ড আসলেই আপনাকে জানানো হবে।”
পল্লবের আর বেবির চিন্তায় জয়ীর ঘুম কী আর আসে! জয়ীতা কিছুতেই দু’চোখের পাতা এক করতে পারছে না। তার বাচ্চাটা বাঁচবে তো! আগেও সে বাচ্চা হারিয়েছে। এবারও যদি কোনো অঘটন ঘটে তবে সে কী করে বাঁচবে? আর পল্লবের কী এমন ব্যস্ততা যে তার সাথে কথা বলার মতো সময়ও হয় না? তার এমন সময়ে সে কী করে দূরে থাকছে? নাকি বড়ো কোনো ঝামেলায় ফেঁসে গেছে? বুকের মাঝে ধড়পড় বেড়েই চলছে! টেনশনে তার মাকে ফোন দেবার কথাও মনে নেই জয়ীর।
সাজেদা চৌধুরীর সন্দেহের তীর সোজা শাহীনের দিকে। পুলিশ কর্মকর্তার দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে সে অর্ডারের স্বরেই বলল, আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না আমার ছেলেকে মার্ডার করা হয়েছে। আর এর পেছনে হাত ওই বাস্টার্ড শাহীনেরই। আমার ছেলেকে আমার বিরুদ্ধে ইউজ করে ও ইলেকশানে উইন করেছে। আমার থেকে আমার ছেলেকে দূরে সরানোর জন্য তাকে তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা বলে কান ভরেছে সারাক্ষণ । আমার ছেলেকে দিয়ে ওদের স্বার্থোদ্ধার শেষ তাই ছুড়ে ফেলে দিয়েছে।
ভেবেছে আমি কিছুই বুঝি না। আমার পল্লবের মৃত্যু সংবাদটা ওরাই প্রথমে আমাকে জানিয়েছে। ওরা দুই ভাই মিলেই আমার কলিজাটাকে ছিড়ে ছিন্নভিন্ন করেছে। আমি ওদেরকে ধ্বংস করে দিব। ওদের আমি কিছুতেই ছাড়ব না। এখন নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য আমাকে সহানুভূতি জানানোর মিথ্যে নাটক করে যাচ্ছে। আপনি এখনই মামলা লিখুন।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেইস লিখতে গড়িমসি করছেন। তিনি বললেন, দেখুন, ম্যাডাম! আপনার মাথা ঠান্ডা করুন। আপনার মানসিক অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আপনাকে স্বান্তনার বাণী শোনানোর মতো দুঃসাহস আমি দেখাতে চাই না।
কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে আপনি যার বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইছেন উনি এখন একজন সংসদ সদস্য। কোনো প্রমাণ ছাড়া চাইলেই আমরা এভাবে হুট করে মামলা নিতে পারি না। আমাদের হাতে আগে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পৌঁছাক পরে সিদ্ধান্ত নিবো কী করা যায়!
– “মানে কী? কত টাকা খেয়েছেন ওই খুনীদের থেকে? আই ডোন্ট কেয়ার হু ইজ হি! সে এমপি হোক না মন্ত্রী! আমি আমার ছেলের বিচার চাই। আপনি কেস লিখবেন কিনা সেটা বলেন? আমার ছেলেকে দাফন করার আগে আমি এর একটা বিহিত করতে চাই। আর একটা কথা! এই সবকিছুর সাথে আমি আরো একজনকে সন্দেহ করছি। সন্দেহ নয় অবশ্য, এটাই সত্যি। আর সে হচ্ছে জোর করে পল্লবের ঘাড়ে ওঠা বউ, জয়ীতা। ওই হারামজাদিই শাহীন আর তুহিনের সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে। ওই ডাইনিটাই এসব কিছুর মূল ইন্ধনকারী। আমার ছেলেকে আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েও শান্তি হয়নি ওর৷ লোভী মহিলা যখন দেখেছে আমার ছেলেটার থেকে তো আর পয়সা কড়ি কিছু বেরুবে না তখন নতুন নাগর ধরার জন্য আমার ছেলেটাকে রাস্তা থেকেই সরিয়ে দিয়েছে। আল্লাহ, তুমি বিচার কোরো! আমার ছেলের খুনীর বিচার না করে আমাকে পৃথিবী থেকে নিও না।”
অনেক ঝামেলা করে কোনোভাবে তখন মামলা করা থেকে ফেরানো গেল সাজেদা চৌধুরীকে।
হান্নান সাহেব সাজেদাকে স্বান্তনা দেবার জন্য পাশে যেতেই সাজেদা চৌধুরী ফোস করে উঠলেন। যেন এখনই হান্নানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। হান্নান সাহেবের এতে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায়। সে তার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “ছেলেটা তোমার একার ছিল না। তোমার যেমন পুড়ছে আমারও তার থেকে মোটেও কম পুড়ছে না। তোমার এই স্বভাব বদলাও। না হলে কপালে আরো খারাবি আছে বলে রাখলাম। ”
সাজেদা চৌধুরী কিছু বলতে যাবেন তখনই হান্নান সাহেব সেখান থেকে সরে আসলেন। সেও ভীষণ ভেঙে পড়েছে পল্লবের এমন পরিণতি দেখে। গত পরশুও পল্লবের সাথে তার অনেক রাত অবধি কথা হয়েছে। সে পল্লবকে বোঝাতে চেষ্টা করেছে যাতে ওই পেট্রোল পাম্প নিয়ে আর কোনো ঝামেলা না করে। কারণ তার ছেলেমেয়ে কিছুতেই এটা মেনে নিচ্ছে না। বিশেষ করে তার বড় ছেলে জামিল। হান্নান সাহেব নিজেই এর ভোগদখলে থাকলেও পেট্রোল পাম্পের দিকে তার বড় ছেলের নজর বহু আগে থেকেই। এ কথা সে নানাভাবে বোঝাতে চেয়েছে পল্লবকে, কিন্তু কিছুতেই বোঝাতে পারেনি। পল্লব উলটা ক্ষেপে যেয়ে অনেক উলটাপালটা বলেছে তাকে।
পাঁচ দিনের মাথায় জয়ীতাকে রিলিজ দেয়া হলো।। কিন্তু তার ছেলে তখনো হসপিটালে। আরো দিন পনেরো রাখতে হবে তাকে। এত কম ওয়েটের বাচ্চাকে না হলে বাঁচানো সম্ভব না। তাছাড়া বাচ্চার শ্বাসকষ্ট তো আছেই। প্রতিদিন গাদাগাদা টাকা খরচ হচ্ছে। সবকিছু করছে তুহিন নিজেই। তার বড় ভাই শাহীন এ ব্যাপারে কিছুই জানে না। সে প্রচন্ড বিরক্ত পল্লবের উপরে। মরে যেয়েও তাকে ঝামেলায় ফেলে রেখে গেছে। প্রাথমিকভাবে এটাকে অ্যাক্সিডেন্ট কেস বলা হলেও সাজেদা চৌধুরী এটা কিছুতেই মেনে নিচ্ছেন না। সে জোরজবরদস্তি করে হলেও তাকে মামলার আসামি বানিয়ে ছাড়বে। মিডিয়ার লোকজন এর যন্ত্রণায় তার বাইরে বের হওয়াটাই এখন মুশকিল।
আর সেই পল্লবের বউ বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতেই টাকা ঢালছে এটা জানতে পারলে সে তুহিনের বারো টা বাজিয়ে ছাড়বে।
তুহিন নিজেও ভীষণ বিরক্ত এসব নিয়ে। তার খালা সাজেদা চৌধুরী শুধু তার ভাইকেই যে হেনস্তা করছে তা নয়, তাকেও ছেড়ে কথা বলছে না।
জয়ীতাকেও হন্যে হয়ে খুঁজছে তার শাশুড়ি। ভাগ্যিস তার বাসার অ্যাড্রেসটা তাদের কারো জানা নেই। তুহিনও সত্যিটা চাপিয়ে যাচ্ছে সবার কাছে। কারণ তার খালা জয়ীতার সাথে কী করতে পারে এটা সে আন্দাজ করেই ফেলেছে মোটামুটি। এই অবস্থায় জয়ীতাকে একা ছেড়ে দিলে সে খুব মুশকিলে পড়বে। একদিকে যেমন তার আশেপাশে কোনো আপনজন নেই অন্যদিকে বাচ্চার ট্রিটমেন্ট এর এত টাকার ব্যবস্থাইবা জয়ীতা কোথা থেকে করবে?
কেন যেন জয়ীতার প্রতি তার একটা সহানুভূতি কাজ করে সব সময়ই। মেয়েটা জীবনে অনেক কিছু সহ্য করেছে তুহিন নিজেই তার প্রমাণ।
জয়ীতাকে প্রতিমুহূর্তে তুহিন মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। সে জয়ীকে বলেছে তার সিজারের পর পরই অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে পল্লব ইন্ডিয়াতে গিয়েছে। খুব বেশি প্রেশারের মধ্যে আছে তাই যোগাযোগ করতে পারছে না। দু’একদিনের মধ্যেই সে চলে আসবে।
জয়ীতা তো আর বাচ্চা মেয়ে নয় যে তাকে ছেলেভোলানো গল্প বলে বোঝানো যাবে। এটা তো সে জানে যে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাক না কেন যোগাযোগ করা এখন কোন ব্যাপারই না। পল্লবের সাথে নিশ্চয়ই কোনো না কোনো ঝামেলা হয়েছে। খুব ভয় হচ্ছে তার।সে সারাক্ষণ মনেপ্রাণে পল্লবের জন্য দোয়া করে যাচ্ছে।
তার সব সন্দেহের অবসান ঘটল যখন সে বাসায় ফিরল। আসলে তাদের বাসায় থাকা ছোট্ট মেয়ে কাকলি তুহিনের কথামতো এতদিন কোনো কিছুই জানায়নি জয়ীতাকে। আজ জয়ী যখন খুব জোর করে তাকে পল্লবের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল তখন কাকলি গরগর করে সব সত্যি কথা বলে দিলো যে পল্লব আজ অবধি হসপিটালে কখনো আসেইনি।
হাসপাতালে নার্স এবং ডাক্তাররা যাকে তার হাজবেন্ড হিসেবে মনে করেছে সে আসলে পল্লব না, তুহিন।
জয়ীতার মনের মধ্যে এবার সত্যি ভীষণ নাড়া দিয়ে উঠল। তুহিন কেন এভাবে দিনের পর দিন তাকে মিথ্যা কথা বলছে? পল্লব কোথায়? পল্লবের সাথে কোনো কিছু হয়নি তো? সেদিন রাতের ওই মেয়েটি কে? ওর কাছে পল্লবের মোবাইল ফোনই বা গেল কি করে?
আর তুহিনই বা তার জন্য এত করছে কেনো? এখানে তার স্বার্থ কি?
নিজে এখন বেশ সুস্থ হলেও একদিকে পল্লবকে নিয়ে দুশ্চিন্তা অন্যদিকে তার ছেলের চিন্তা যে প্রতি মূহুর্তে লড়াই করছে বেঁচে থাকার তাগিদে। সবকিছু মিলিয়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত সে।
এর মাঝে তার মাও এসেছে গ্রাম থেকে। সেও মেয়ের কাছে সবকিছু শুনে প্রচণ্ড হতাশ। কী ঘটতে যাচ্ছে তার মেয়ের সাথে? একটার পর একটা বিপদ। বিপদের নামগন্ধ শেষ হবার নামই যেন নেই। কায়মনোবাক্যে মেয়ের জন্য দোয়া করেই যাচ্ছেন।
জয়ীতা জানে কার কাছে গেলে সঠিক খবর বের করা যাবে? সে তখনই তড়িঘড়ি করে প্রস্তুত হলো উত্তরাতে যাবার জন্য। ওখানেই শাহীনের বাড়ী। এই শাহীনকে বা তার ভাই তুহিনকে ধরলেইই সব সত্যি বের হবে! পল্লবের হদীস না করে সে ফিরবে না। এখনো পুরোপুরি সুস্থ না সে। শরীর প্রচন্ডরকম দুর্বল। কিন্তু মনের জোরেই তাকে আগাতে হবে। এভাবে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। কেউই এসে তাকে পল্লবের খবর দিয়ে যাবে না। এই পৃথিবীতে তাকে সাহায্য করার জন্য তার নিজেকেই এগুতে হবে!
চলবে………