সুখ_নীড় #পর্ব_২৭

0
421

#সুখ_নীড়
#পর্ব_২৭

হুট করে এভাবে নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজতে এসে তার মৃত্যু সংবাদ শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। জয়ীতা কী আশাতে সে এসেছিল আর কী শুনছে! জয়ীতার হাত পা বরফ শীতল হয়ে আসছে। তুহিনের বারবার নিষেধ সত্ত্বেও তার বড়ো ভাই শাহীন জয়ীতাকে সত্যটা বলে দিয়েছে। পল্লববিহীন পৃথিবীতে কী করে সে বেঁচে থাকবে! পল্লব এই পৃথিবীতে নেই এটা শুনে জয়ীর মনে হচ্ছে সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। একটু বাদেই ঘুম ভেঙে যাবে। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখবে এসব মিথ্যে কথা! তার পল্লবের কিছু হয়নি। তার মনে হচ্ছে আসলে এই ক’দিন ধরে পল্লবকে নিয়ে আজেবাজে ভেবেছে তাই হয়ত সে ঘুমের ঘোরে এসব দেখছে।

একদম পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে জয়ীতা । মাথার উপর ফ্যানটা আজ যেন অন্যদিনের থেকে দ্রুতই ঘুরছে। সেদিকে তাকিয়ে তার মনে হচ্ছে ফ্যান নয় পুরো পৃথিবীটাই ঘুরছে তার মাথার উপর। চোখে একফোঁটা পানি নেই, মুখে কোনো শব্দ নেই। অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে জয়ী। যেন কোনো স্ট্যাচু।।

তুহিন ভয় পেয়ে গেল। জয়ীতার শারীরিক, মানসিক কোনো অবস্থাই যে স্বাভাবিক নয় এটা সে জানে। জয়ীকে নিয়ে তার ভয় হচ্ছে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে যায়। তাহলে ওর বাচ্চাটা যে জীবন মরণের সীমানায় দাঁড়িয়ে, সে সুস্থ হয়ে পৃথিবীতে ফেরার আগেই অনাথ হয়ে যাবে। এসব কথা তুহিন তার ভাইকে বলতেও পারছে না। কারণ পল্লবের যে বাচ্চা হয়েছে এটা একমাত্র সেই জানে। এখন পর্যন্ত কাউকেই জানায়নি। তার ভাই শাহীন জানে জয়ীতার একটা মেজর অপারেশন হয়েছে তাই এতদিন হাসপাতালে ছিল। জয়ীতাও চায় না কারো সামনে তার সন্তানের কথা তুলতে।

অনেকবার তুহিন তার ভাই শাহীনের কাছে রিকোয়েস্ট করেছে এই মুহূর্তে জয়ীকে কিছু না জানাতে কিন্তু শাহীন তার কথা শুনেনি। সে চায় না জয়ীকে এভাবে অন্ধকারে রাখতে। অযথা কোনো হাঙ্গামার মাঝেও যেতে চায় না আর। রোজ রোজ এসে জয়ী তাদের কাছে পল্লবের খোঁজ জানতে চাইবে আর তাকে মিথ্যা বলতে হবে এসব ঝামেলায়ও সে যেতে চায় না।

তাই তুহিনকে ধমক দিয়ে সে বলল, আজ হোক কাল হোক সে তো জানবেই। তাছাড়া সে পল্লবের স্ত্রী। তার এ কথা সবার আগে জানা উচিত।

এমনিতেই পল্লবের মা তাদের দুই ভাইকে পল্লবের খুনী ভেবে মামলা করতে যাচ্ছে। তাই নতুন করে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চায় না।

জয়ীকে এভাবে দেখে তুহিনের বড়ো ভাবী এগিয়ে এসে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিতে দিতে জয়ীকে ধরে সোফায় বসাল। জয়ী এখনো উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। মুখে কোনো শব্দ নেই। যেন বোবা হয়ে গেছে, কাঁদতে ভুলে গেছে। তার মাথা কাজ করা বন্ধ করা দিয়েছে। কীসব আজগুবী গল্প শুনিয়েছে তাকে শাহীন সাহেব! এতটা নির্দয় গল্প কী করে হয়!

তুহিনের ইশারায় শাহীনের স্ত্রী নার্গিস জয়ীতাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
চোখের পানি ঝরতে দাও, বোন! মনটা শান্ত হবে। এভাবে কঠিন হয়ে থেকো না। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। সবাইকেই চলে যেতে হবে। কেউ আগে কেউ পরে। আমাদের পল্লব উপরওয়ালার খুব প্রিয় তাই হয়ত আগেভাগেই নিয়ে গেছেন। ওর জন্য আমরা এখন দোয়া করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারব না। সে এখন আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার জন্য দোয়া ছাড়া আর করারই বা কি আছে! তুমি হাসপাতালে ছিলে তাই তোমাকে কিছুই জানানো হয়নি। ওর পরিবারের তত্ত্বাবধানে দাফনকাজ সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়া ওরা কেমন সেটাও তো জানো। ওদের সামনে তোমার যাওয়াটাও কম বিপদ না।

বলতে বলতে সে জয়ীতাকে ধরে একটা ঝাকুনি দিলো। জয়ীতা এবার আর নিজেকে সংবরণ করতে পারল না, সে হাউমাউ করে চিৎকার করে বলতে শুরু করল,

আমি বিশ্বাস করি না। আপনারা আমাকে মিথ্যে কথা বলছেন। আমার পল্লবের কিছু হয়নি । পল্লবের সাথে আমার এমন কোনো কথাই হয়নি। পল্লবের এই মুহূর্তে আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা নয়, একদমই নয়। আল্লাহ এত নির্দয় কী করে হলেন আমার সাথে? পল্লব আর আমি একসাথে থাকব, আজীবন থাকব। আমাদের একটা সুখের সংসার হবে। সেখানে আমাদের সন্তান থাকবে। আমাদের সন্তানকে নিয়ে আমরা স্বপ্ন সাজাব।
আপনারা এত রুড কেন? কী করে এসব বলতে পারছেন? একজন মানুষকে নিয়ে এসব মিথ্যে দুর্ঘটনার নাটক সাজিয়ে তাকে মেরেই ফেললেন?

শরীরের সমস্ত জোর খাটিয়ে কথাগুলি বলতে বলতে জয়ীতা জ্ঞান হারিয়ে নার্গিসের কোলের উপরেই ঢলে পড়ল।

তুহিন প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেল। এমনটাই সে ভয় পাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি পালস চেক করল জয়ীর। পালস চলছে দেখে সে কিছুটা স্বস্তি পায়। দ্রুত নাকেমুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে জ্ঞান ফেরাতে ব্যর্থ হয়ে দ্রুত তাকে নিয়ে তারা হসপিটালের উদ্দ্যেশ্যে বের হলো।

আধাঘণ্টা কেটে যাবার পরেও জয়ীর জ্ঞান না ফেরায় হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারী করতে করতে শাহীন তুহিনকে বলল, ডিসগাস্টিং! একটা ঝামেলা শেষ হতে পারে না আরেকটা এসে মাথায় উঠে বসে। এখনই দেখা যাবে পঙ্গপালের মত আবারও সাংবাদিকেরা ঘিরে রেখেছে। পল্লবের ঝামেলা ছাড়াতে পারছিনা তার মধ্যে আবার পল্লবের বউ শুরু করেছে। উহ! তুহিন এক কাজ কর! এখনই খালামণিকে বা কল্লোলকে ফোন দে। যাদের ঝামেলা তাদের ঘাড়ে বুঝিয়ে দিয়ে যাই। যাদেরটা তারা সামলাক। অযথা এসব ঝামেলায় জড়িয়ে নিজেদের সময় নষ্ট, মান সম্মান নষ্ট। মিডিয়ার কানে এসব কথা যাওয়ার আগেই আমি এখান থেকে বের হতে চাই। উনাদের খবর জানিয়ে এখান থেকে বের হয়ে আয়। আমি গাড়িতে অপেক্ষা করছি।

কথাগুলি বলে তুহিনের উত্তরের অপেক্ষা না করেই শাহীন বেরিয়ে গেল।

তুহিন পড়েছে দোটানায়। কী করবে সে বুঝতে পারছে না। যে মানুষের ভয়ে জয়ীকে পল্লব এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছে তাকে সেই যমদূতের হাতে ফেলে রেখে সে কী করে যাবে! এখনতো পল্লবও নেই যে সে এসে জয়ীকে উদ্ধার করবে!

কিছুই ভেবে পাচ্ছে না তুহিন । এই অবস্থায় তাদের না বলেই বা উপায় কী! এই মুহূর্তে তারা ছাড়া জয়ীর পাশে দাঁড়াবার মত আর আছেই বা কে! একবার ভাবল তাদেরকে কিছুই জানাবে না। শুধু জয়ীর মাকে ফোন দিয়ে আসতে বলবে। কিন্তু পরে আবার মনে হলো সে যদি সাজেদা চৌধুরীর কাছে জয়ীর খবর এখন না পৌঁছায় তাহলে পরে তাদেরকেই এ নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হবে। তাছাড়া সে কিছু না বললেও তার বড় ভাই যে চুপ থাকবে না এটা সে নিশ্চিত। অনেক ভেবেচিন্তে পরে সে সরাসরি সাজেদা চৌধুরীকে ফোন না দিয়ে পল্লবের বড়ো ভাই কল্লোলকে ফোন দেয়।

পরপর দু’বার রিং দেবার পর কল্লোল তুহিনের ফোন রিসিভ করে জয়ীতার খবরটা শুনতেই সাথে সাথে বলল, হ্যারে তুহিন, তোরা তো দেখছি আমাদের জন্য দেবদূত হয়ে গেছিস! আমার ভাইয়ের লাশের খবরও তোর কাছ থেকে পেতে হলো আবার তার বৌ, যাকে আমরা নিখোঁজের লিস্টে রেখে বসে আছি তার খবরও তোর কাছ থেকে পেতে হচ্ছে। আসলে এসবের রহস্য কী বলতো! সবকিছু এক সুতোয় গাঁথা না তো?

কল্লোলের কাছ থেকে সে এমন খোচা মারা কথাই আশা করেছিল। তাই কথাগুলোতে তেমন কোনো আমল না দিয়ে সে শুধু বলল, জয়ীতা ভাবী শাহীন ভাইয়ার কাছে এসেছিল পল্লব ভাইয়ের খোঁজে। সে ভাবেই তার সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। পল্লব ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটা সে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। আমরা প্রাথমিকভাবে চেষ্টা করে জ্ঞান ফেরাতে না পেরে হসপিটালে নিয়ে এসেছি। ভাবলাম তোমাদেরকে খবরটা জানাই। এখন এখানে আসা না আসা তোমাদের ব্যাপার। আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি বাকিটা তোমাদের উপর ।

কল্লোলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে ফোনটা কেটে দিলো।

গাড়িতে উঠতেই শাহীন বলল, আজ কয়েকটা জরুরী কাজ সারতে হবে। আমার সাথে তুইও যাচ্ছিস ফ্যাক্টরিতে। গাড়িতে উঠে তারা মাত্র বসেছে তখনই ফোনটা বেজে উঠল তুহিনের। পল্লবের বাচ্চা যে হসপিটালে ভর্তি আছে সেখান থেকে কল এসেছে। তুহিনকে ইমার্জেন্সি সেখানে ডাকা হয়েছে।

শাহীন তালুকদার কিছু একটা বলতে যাবে তখন তুহিন বলল, ভাইয়া আমাকে একটু ইমার্জেন্সি সাভার যেতে হবে। তুমি চলে যাও।

শাহিন খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলল এমনকি জরুরী কাজ যে আমার কথা উপেক্ষা করে ব্যবসা-বাণিজ্য সব ফেলে আবার দৌড়াতে হবে?

ভাইয়া! তেমন কিছু না, আবার অনেক কিছু। আমার এক ফ্রেন্ডের খুব দরকার আমাকে.। এজন্য এই মুহূর্তেই আমাকে যেতে হবে।

ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই তুহিন গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। তুহিনের এমন আচরণে শাহিনের মেজাজ কিছুটা বিগড়ে গেল। ইদানীং কীসের এত ব্যস্ততা তুহিনের সে বোঝে না।

জয়ীতার জ্ঞান ফিরতেই চারপাশে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে পড়ে। তার সামনে বসা স্বয়ং যমদূত তার শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরী। এই মানুষটাকে সে বাঘের মতো ভয় পায়। ইনি এখানে কী করে এলেন কিছুই মাথায় আসছে না তার। ধীরে ধীরে বোঝার চেষ্টা করছে সে কোথায় আছে। এর মাঝে আবার মনে পড়লো পল্লবের খবরটা। ছল ছল নয়নে উঠে বসে। নিজেকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা যেন মুহূর্তে গায়েব হয়ে যায় তার। সাজেদা চৌধুরী কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জয়ীতা হঠাৎ করে তার হাত দুটো চেপে ধরে বলল,

আম্মি, পল্লব কোথায়? পল্লব ভালো আছে তো?

দ্রুত হাতটা ছাড়িয়ে নেন সাজেদা চৌধুরী।

– এই মেয়ে একদম নাটক করবি না। এসব নাটক আমি বুঝি। আমার ছেলেকে তুই মেরে ফেলেছিস। কবরে আমার ছেলের লাশ হয়তো মাটিতে মিশে গেছে আর এখন এতদিন পরে এসে ভাব নিচ্ছিস তুই কিছুই জানিস না।

জয়ীতা এবার পুরোটাই পরিষ্কার যে পল্লব আর পৃথিবীতে নেই। কোনো মা সন্তানের মৃত্যু নিয়ে ঠাট্টা উপহাস করবে না।

সে হাউমাউ করে এবার কেঁদে উঠল। কষ্টের প্রচণ্ড ঘূর্ণিপাকে বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যাচ্ছে তার। চারপাশটাকে বড় বিরক্ত লাগছে, অপ্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। শুধু পল্লবের সাথে তার শেষ দেখা আর শেষ কথাগুলোই চোখে ভাসছে, কানে বাজছে।

কান্না বড় সংক্রমিত জিনিস। জয়ীর কান্না দেখে সাজেদা চৌধুরীও নিজেকে যেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এই ক’দিনে বেশ সামলে নিতে চেষ্টা করেছিলেন অথচ আজ আবার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালেন। জয়ীতার কষ্ট তার বুকে সুইয়ের মতো বিঁধছে। কিন্তু তারপরেও জয়ীতার উপর দরদ দেখাতে খুব কার্পণ্য তার।

উলটো জয়ীতাকে বারবার পল্লবের মৃত্যুর জন্য দোষারোপ করেই যাচ্ছেন। এতদিন কোথায় লুকিয়েছিল, পল্লবকে কাকে দিয়ে মেরেছে, কেন মেরেছে আরো নানান কথা! এমন সময় ডাক্তার এসে রুমে ঢুকতেই সবাই একটু নড়েচড়ে বসে।

ডাক্তারের কাছে জয়ীতার ব্যাপারে কোনো কিছুই জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে নেই সাজেদার। সে মরুক না বাঁচুক তা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু ডাক্তার নিজে আগ বাড়িয়ে বললেন,

“ভয়ের কিছু নেই। উনার রিসেন্ট সি সেকশন হয়েছে এজন্য শরীরটা কিছুটা দুর্বল তাই হয়তো এভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়েছেন। ওনার খাবার দাবারের দিকে খেয়াল রাখবেন। আর এখানে কিছু মেডিসিন দেওয়া আছে। তাছাড়া ওনার ডক্ ওনাকে যেভাবে প্রেসক্রাইব করেছেন সেভাবে চলাফেরা করলে সমস্যা হবে না আশা করছি। যেহেতু তেমন কোনো প্রবলেম নেই উনাকে আপনারা আজকেই নিয়ে যেতে পারেন।

ডাক্তার সাহেব কথাগুলো বলে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে না যেতেই সাজেদার চোখ যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইল। ডাক্তার এটা কী বলল! জয়ীতার c-section! তারমানে?
ও মাই গড! সাজেদা চৌধুরী এবার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না । এবার বুঝলেন এতদিন এই মেয়ে কেন গায়েব ছিল!

ডাক্তারের কথাশুনে জয়ীতার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। এই সত্যটাকে সে চাপিয়ে রাখতে চেয়েছিল এই বর্বর মানুষগুলোর কাছ থেকে। পল্লব যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে এটা তো সে নিশ্চিত। এই কষ্টটুকু সামলাতে না সামলাতেই তার ছেলেটাও কি এবার তার কোল ছাড়া হয়ে যাবে? হাত পা হিম হয়ে আসছে। এই মানুষগুলোকে তার মোটেই বিশ্বাস নেই। এমন না যে তার ছেলে হয়েছে শুনে খুশিতে পুতুপুতু করে তার বাচ্চাসহ তাকে ঘরে তুলবে! এটুকু সে খুব ভালো করেই নিশ্চিত যে ও বাড়িতে তার কোনদিনই যাওয়া হবে না। পল্লব বেঁচে থাকতেই হয়নি আর তো সেখানে আজ পল্লব নেই। ও বাড়িতে সে নিজেও আর যেতে চায় না. দুমড়েমুচড়ে পৃথিবী অন্ধকার হয়ে আসছে তার কাছে। কী হতে যাচ্ছে তার সাথে? একের পর এক নাটকীয় ঘটনা তার জীবনকে নিয়ে এভাবে আর টানা হেচরা করবে?

বিধাতার কাছে কি তার খুব বেশি কিছু চাওয়া ছিল? কখনো সে চায়নি পল্লবের মত কোনো ধনীর দুলাল তার জীবনে আসুক। তাকে ভালবেসে তার জীবনকে রাঙ্গিয়ে তুলুক। কেনই বা এলো কেনই বা এভাবে তাকে ছেড়ে চলে গেল?

সে শুধু এতটুকুই ভাবত কেউ তার জীবনে আসবে যে তাকে খুব চাইবে, আদরে সোহাগে জীবনকে রঙিন করে তুলবে। সেখানে আদর থাকবে, সোহাগ থাকবে, ভালোবাসা থাকবে, ঝগড়া থাকবে, মান থাকবে অভিমান থাকবে। আর দশটা মানুষ যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই একটা সুখ নীড় বাঁধতে চেয়েছিল সে।
এটুকুই খুব বেশি কিছু? উপরওয়ালার কাছে তার এই অভিযোগ যেন জমতে জমতে আজ পাহাড়ে পরিণত হয়েছে।

কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পল্লবকে হারিয়ে ফেলা, পল্লব এবং তার ভালোবাসার শেষ চিহ্নটুকুকে আদরে বুকে জড়িয়ে নেবার আগেই হারিয়ে ফেলার প্রচন্ড ভয় সবকিছু তাকে একদম ওলট-পালট করে দিচ্ছে।
যদিও তার কাছে সবকিছু এখনো যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে এখনই সে দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠবে। উঠেই দেখতে পাবে পল্লব তার পাশেই বসা, তার আদরের সন্তান তার চোখের সামনে হাত-পা নাড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। পল্লব আর সে দুজনে মিলে দোলনাটা মৃদু ধাক্কা দিচ্ছে আর কিভাবে তাদের সন্তানকে নিয়ে ভবিষ্যৎ সাজাবে সেই স্বপ্ন দেখছে।
উহ, এই পৃথিবী এত নিষ্ঠুরতার পরিচয় কী করে দিচ্ছে!

হঠাৎ করে সাজেদা চৌধুরীর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো ভাবনায় মগ্ন, জয়ীতা। সেই বিস্ফোরিত নয়নে যেন শীতলতার মিষ্টি স্রোত বইছে। হঠাৎ করে এমন মৌসুম পরিবর্তন নিশ্চয়ই যে ভালো কোনো লক্ষণ না এটুকু বুঝ জয়ীতার আছে। অজানা শঙ্কায় বুকের ভেতরটা আরো একবার কেঁপে উঠল।

সাজেদা চৌধুরীর মতো রুমে দাঁড়িয়ে থাকা কল্লোলও এবার অবাক। একেতো ডাক্তারের বলে যাওয়া কথাগুলি সে হজম করতে পারছে না তার উপরে তার মায়ের এমন পরিবর্তন।

যে কারো জন্যই ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ মোটেই কাম্য নয, মোটেই সুখকর নয়।
ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদ তাকে যতটুকু না কষ্ট দিয়েছে তার থেকেও বেশি কষ্ট পাচ্ছে ভাইয়ের ওয়ারিশ রেখে গিয়েছে সেটা শুনে।

কষ্টের ঝড় বইছে বুকের আনাচে কানাচে। ফুপিয়ে কেঁদেই চলছে জয়ীতা। এই মুহূর্তে তার কাছে পৃথিবীর সবকিছুকে খুব স্বার্থপর লাগছে। আজ এতটা দিন ধরে পল্লব এই পৃথিবীতে নেই অথচ সে জানতেও পারেনি। তাকে শেষবারের মতো দেখবার তৌফিকটুকুও তার হয়নি। সবকিছু মিলিয়ে কিছুই যেন এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না।
তার মনে হচ্ছে পল্লব এখনই চলে আসবে। এখনই এসে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরবে। তাদের সন্তানের কপালে চুমু খেয়ে আদর করে কোলে তুলে নিবে।
এসব কী হয়ে গেল তার জীবনে!..

সাজেদা চৌধুরী জয়ীতার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কাঁদিস না আর মা। যে যাবার সে তো আমাদের অথৈজলে ভাসিয়ে রেখে চলে গেছেই। কেঁদে যদি ফেরাতে পারতাম! আমি তোর কষ্ট বুঝি।৷ আমি যেমন আমার সন্তানকে হারিয়েছি তেমনি তুই তোর স্বামীকে হারিয়েছিস। দুজনেরই প্রিয় মানুষ হারিয়েছি। আমি তোর উপর অনেক অন্যায় করেছি মা
। হয়ত এটা তার প্রায়শ্চিত্ত । উপরওয়ালা আমাকে কেন নিলো না? আমার সন্তানের উপর কেন এত নির্দয় হলেন? কতদিন ছেলেটাকে আদর করিনি এই হাতে। শেষ বিদায় দেওয়ার জন্যই হয়ত আমার হাতদু’টো প্রস্তুতি নিচ্ছিল তাই এভাবে মায়াকাটাতে এই দুই হাতে ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলাম। কেমন পাষণ্ড আমি!

চোখ মুছতে মুছতে আবার বললেন, কী হয়েছিল সেদিন বলবি আমাকে! আমার ছেলে কি সত্যিই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছে? আমার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না। ও এত ভালো ড্রাইভিং করে! যে যাই বলুক আমার মন বলছে কেউ আমার আদরের ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে। ওরা কেউ আমাকে সাহায্য করছে না। প্রশাসন আমার কথার দামই দিচ্ছে না। তাদের কাছে এটা শুধুই দুর্ঘটনা। আমি তো জানি আমার কী হারিয়েছে ! আমার সন্তানকে হারানোর কষ্ট আমি এত দ্রুত ভুলে যাব?
তুই কি কিছু জানিস, মা?

সাজেদা চৌধুরীর মুখে মা ডাক শুনে৷ মুহূর্তেই সব ভুলে আবেগ আপ্লূত হয়ে পড়ল জয়ীতা। সে এবার যেন কষ্টটুকু নিংড়ে বের করার একটা জায়গা পেল! সে তার শাশুড়ি সাজেদা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে চিৎকার কপ্রে উঠল। দু’জন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে মনের আনাচে কানাচে ছড়ানো সবটুকু কষ্ট যেন নোনাপানিতে ঝড়াতে শুরু করল।

জয়ীতা কোনো রকম নিজেকে সামলে ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল, পল্লবকে কেউ মেরে ফেলেছে, আম্মি। পল্লবের কোনো দুর্ঘটনাই হয়নি। ওকে মার্ডার করা হয়েছে।

সাজেদা চৌধুরী এবার নড়েচড়ে বসলেন। জয়ীতার কথার তীব্রতা তাকে এবার নিশ্চিত করল সে ভুল পথে এগুচ্ছে না।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here