কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব-৩)

0
1069

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব-৩)

————-
ধীরে ধীরে বিছানার সন্নিকটে এগিয়ে আসছে ইহান। তার দৃষ্টি নিঝুমের মুখে নিবদ্ধ। নিঝুমের দৃষ্টি চঞ্চল। সে শুধু এদিক-ওদিক চোখ ঘোরাচ্ছে। ইহান যখন একদম বিছানার নিকটে চলে আসে হতবিহ্বল নিঝুম ঠিক তখনই ইহানের চোখে দৃষ্টি মেলায়। ইহান নিঝুমের দিকে ঝুঁকতে থাকে। নিঝুমের আ’ত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ইহান এক হাত বাড়িয়ে দিতেই নিঝুম চোখ-মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। উত্তেজিত কন্ঠে বলে,

“প্লিজ এখনই না। আমি প্রস্তুত নই এসবের জন্য। আমার সময় চাই। দয়া করুন।”

কথা শেষ করে নিঝুম কয়েকটি ঘন নিশ্বাস ফেলে। অতঃপর ধীরে ধীরে শান্ত হয়। কিয়ৎক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর নিঝুম যখন দেখল ইহানের কোনো সাড়া শব্দ নেই তখন সে মনে কিঞ্চিৎ সাহস সঞ্চার করে ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো। এতটুকুতেই ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছে সে যার প্রমাণ বহন করছে তার ঘামার্থ মুখশ্রী, কম্পিত দেহ। কিন্তু এর থেকেও বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ল যখন সে চোখ মেলে দেখল ইহান তার একদম সম্মুখে ক্রোধান্বিত রুপে বসে আছে। ইহানের চোখের দৃষ্টি এই মুহুর্তে ভীষণ ভ’য়ং’ক’র। মনে হচ্ছে চোখজোড়া নিঝুমকে ভস্ম করে ফেলতে সক্ষম হবে হয়তো। নিঝুমের শরীরের কম্পন কমে অন্তরে ঝড়ের সৃষ্টি হচ্ছে। মনে হচ্ছে অন্তরিক্ষের গহবরে কোনো মহা ট’র্নে’ডোর আগমন ঘটতে চলেছে। নিঝুমের সেই আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে দিয়ে ইহান ওর কাঁধ বরাবর হাত বাড়িয়ে দিল। মুহুর্তেই নিঝুম ফের দুচোখ বন্ধ করে নিল। ইহান ওর কাঁধের ওপর থেকে হাত দিয়ে একটি বালিশ সংগ্রহ করে আবার সটান হয়ে বসে পড়ল। তার রাগ যেন কিছুতে কমছেই না। অতঃপর সে নিঝুমের এক হাত শক্ত করে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

“আবরার খান ইহান অতটাও ক্যারেক্টর লেস নয় যে যেখানে সেখানে তাকে ঢলে পড়তে হবে। তুমি ভাবলে কী করে তোমার মতো একটা ঠ’ক’বা’জ মেয়েকে আমি স্পর্শ করব। এমন কথা ভুলেও কখনো মস্তিষ্কে স্থান দিও না নয়তো পরিণাম অনেক ভ’য়া’ব’হ হবে। তোমাকে আমি বিয়েটা করেছি শুধু মাত্র আমার সম্মান রক্ষা করতে যেটা তুমি আর তোমার ওই সো কল্ড বান্ধবী মিলে বিকিয়ে দিতে চেয়েছিলে। তোমার বান্ধবী তো চলে গিয়ে বেঁচে গেছে কিন্তু এখন সারাজীবন এরজন্য সাফার করতে হবে তোমাকে।”

কথা শেষ করে ইহান নিঝুমের হাতটা সর্বশক্তি দিয়ে ঝটকা মে’রে ফেলে চলে যায়। নিঝুম এতক্ষণে নিজের বন্ধ চোখ খুলার সাহস করে। অহেতুক তার চোখ জোড়া ভিজে ওঠে নোনাজলে। সব কথাকে ছাপিয়ে তার কানে শুধু একটি কথাই বাজছে, “সে নাকি ঠকবাজ।”

ইহান বালিশ নিয়ে হনহনিয়ে বেলকনিতে চলে যায়। নিঝুম সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তার কী দোষ ছিল? সে কী ভীষণ অপরাধ করে ফেলেছে? নিঝুমের জায়গায় অদিতি থাকলে ইহান নিশ্চয়ই এমন করত না? ভালবেসে আপন করে নিতো কী?

———————-

ভোরের আলো চোখে পড়তেই মুখ ছুটে যায় নিঝুমের। পিট পিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক জানান দেই নতুন জায়গায় তার উপস্থিতি। সে ধরফরিয়ে উঠে বসে। আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কোথায় আছে। অতঃপর ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক জাগ্রত হয়, মন শান্ত হয়, মনে পড়ে যায় গতকালের সকল ঘটনা। দেওয়াল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ভোর ছয়টা বাজে। নামাজের সময় হয়েছে। নিঝুমকে গতকাল রাতে তার ননদ ইরা একটি লাগেজ দিয়ে গেয়েছিল। এগুলোতে মেবি নতুন বউয়ের জন্য আনা জিনিস-পত্র ছিল। ইরা বলেছিল ওখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিতে কিন্তু রাতে ইহানের উপস্থিতি এবং তার পরবর্তী ঘটনা তার মনে গভীর ভাবে রেখাপাত ঘটায় যার ফল স্বরুপ সে কিছু না করেই ওভাবেই কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ে। ইরা তাকে তার নিজস্ব ফোনটাও দিয়ে গিয়েছিল যেটা সে বিয়ে বাড়িতেই ফেলে এসেছিল। ফোনের কথা মনে হতেই নিঝুম বালিশের নিচ থেকে ফোনটি সংগ্রহ করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না তাতে বিন্দু মাত্র চার্জ অবশিষ্ট নেই। হতাশ হয়ে নিঝুম ফোনটি আবার যথা স্থানে রেখে দেয়। ইরার কাছ থেকে চার্জারের ব্যবস্থা করে ফোনটা চার্জ দিতে হবে তারপর বাড়িতে যোগাযোগ করতে হবে। ওখানকার কী অবস্থা কে জানে? তার আগে তাকে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে নিতে হবে। বাড়িতে থাকতেও নিঝুম দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি নামাজ আদায় করা এবং কুরআন তেলওয়াত করার কথা কখনোই ভুলত না। এটি তার অন্যতম প্রিয় কাজ। এই সময়টায় সে গভীর ভাবে নিজেকে উপলব্ধি করতে পারে।

ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে নিয়ে কিছু সময় কুরআন তেলওয়াত করল সে। কুরআন শরীফ খুব নিকটেই ছিল তাই ভাবল সময় আছে যখন তখন পড়ে নেওয়া যাক। এসব মানসিক পিড়া থেকে একমাত্র মুক্তি লাভের উপায় এই কুরআন।

কুরআন তেলওয়াত মিষ্টি ধ্বনি কর্ণপাতের মাধ্যমে ঘুম ভাঙে ইহানের। বেলকনির ডিভানে বসে ল্যাপটপে কাজ করতে করতে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। বালিশটি এনেছিল হেলান দিয়ে বসার উদ্দেশ্যে কিন্তু শেষমেশ দেখা যায় ওটা তার শয়ন যোগ্য হয়ে উঠেছে।

ইহান চোখ মেলে দেখে ল্যাপটপটি এখনও তার কোলের উপরে পড়ে আছে। সিস্টেম গুলো এখনো চালু করা। সযত্নে সিস্টেমগুলো অফ করে ওটাকে কোল থেকে নামিয়ে রেখে উঠে দাড়ায় সে। তারপর উঠে দাড়িয়ে বেলকনি দিয়ে বাহিরে দৃষ্টিপাত করে। বাহিরের মৃদু আলো দেখে বুঝতে পারে বেশি বেলা হয়নি। এত ভোরে কুরআন তেলওয়াত করছে কে এর আগে তো কখনো এমন মধুর ধ্বনি এত সকাল সকাল শোনার সৌভাগ্য তার হয়নি। অনিলা খান কুরআন তেলওয়াত করেন তবে তা সন্ধ্যা বেলা ভোরে নয়। ইহান হাই তুলতে তুলতে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। অতঃপর সে স্তব্ধ। সুন্দর, পরিপাটি সাজে এক রমনী মন দিয়ে কুরআন তেলওয়াত করছে। কী অপরুপ সেই দৃশ্য। আশেপাশের পরিবেশটাও কেমন জানি স্নিগ্ধতায় পরিপূর্ণ। ইহান বিরক্ত করে না নিঝুমকে। কাবার্ড থেকে প্রয়োজনীয় জামাকাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। আজ একটু বেশিই তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছে ঘুম থেকে। সবই এই মেয়েটির কারিশমা।

বদ্ধ ঘর হওয়ায় কুরআনের ধ্বনি বাহিরে প্রবেশ করতে অক্ষম। আর নিঝুমও খুব মার্জিত ভাবে তিলাওয়াত করেছে যাতে করে বেশি উচ্চ শব্দের সৃষ্টি না হয়। মিডিয়াম আওয়াজে পড়াই অতি উত্তম।

———————-

ইহান ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে নিঝুমকে ঘরে পায় না। অযথাই তার চোখ এদিক ওদিক নজর বুলায়।ফের নিজেই নিজের মনকে শান্ত করে বেলকনিতে চলে যায়। বেলকনি থেকে ল্যাপটপটি নিয়ে এসে বিছানায় আরাম করে বসে। গতরাতে ঘুমাতে ভীষণ কষ্ট হয়েছে। একবার ভেবেছে ঘুমবে না কাজ করেই রাত কভার করে দেবে কিন্তু শরীর তার ঘোর বি’রো’ধি’তা করেছে। ফলস্বরূপ কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও জানা নেই। এখন একটু শান্তিতে কাজ করতে চায়।

রুম থেকে বেড়িয়েও নিঝুম পড়েছে মহা বিপদে। কোথাও কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে আছে। ইরার ঘর কোনটা তাও সে জানে না। ফোনটা চার্জে দেওয়া ভীষণ জরুরি হয়ে পড়েছে বাড়িতে যে করেই হোক দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। অবশেষে একজন মধ্য বয়স্ক লোক এসে তাকে ইরার ঘরের সন্ধান বলে দেয় সেই সঙ্গে ইরাকে ডেকেও দেয়। এই লোকটি হয়তো এই বাড়ির মেড সার্ভেন্ট। তার পোশাকআশাক, চালচলনে এই পরিচয়ই বহন করে।

ইরা নিঝুমকে দেখে ভীষণ খুশি হয়। নিঝুম ইরাকে তার সমস্যার কথাটা জানায়। ইরা ততক্ষণাৎ নিঝুমের ফোনটি তার ফোনের চার্জার দিয়ে চার্জে লাগিয়ে দেয়। অতঃপর দু’জনে নানাপ্রকার গল্প করতে থাকে। ইরা মেয়েটা বেশ মিশুক, প্রানোচ্ছল প্রকৃতির। এই অল্পক্ষণেই নিঝুমের বেশ মনে ধরে তাকে।

তারা গল্প করতে করতে নয়টা বেজে যায়। হঠাৎই নিচ থেকে অনেক শোরগোল ভেসে আসে। ইরা কৌতুহল নিয়ে এগিয়ে যায় কী হয়েছে দেখতে। কিন্তু নিঝুম নড়াচড়া করতে ভুলে যায়। সে পাথরের ন্যায় শক্ত রুপ ধারণ করে। তার কানে ভেসে আসছে সেই পরিচিত কন্ঠস্বর, পরিচিত হুংকার, পরিচিত দাম্ভিকতা। এখানে দাড়িয়েই সে উপলব্ধি করতে পারছে আসন্ন বি’প’দে’র সংকেত।

———————

চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here