#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা ?(প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব সংখ্যা-৬)
——————–
চোখ মেলে নিঝুম নিজেকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় আবিষ্কার করে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে সকলে তাকে ঘিরে বসে আছে। নিঝুম তড়িঘড়ি করে উঠে বসতে নেয় তখনই অনিলা খান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন,
“আরে আরেহ করছ কী। তোমার শরীর ঠিক নেই রেস্ট নাও। সারাদিনের ধকলে হয়তো এমনটা হয়েছে।”
নিঝুম উঠতে গিয়েও ওঠে না। সত্যিই শরীরটা ঠিক নেই। হঠাৎ ওর মনে পড়ে যায় কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। সে হন্তদন্ত হয়ে আশেপাশে চোখ ঘোরায়। নাহ কোথাও তো কিচ্ছু নেই গেল কই সেগুলো। এবারে ও এক লাফে উঠে বসে পড়ে। অস্থির হয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে বক্সটি খুঁজতে থাকে। ওকে এমন উত্তেজিত দেখে সকলেই একটু ঘাবড়ে যায়। অনিলা খান বলেন,
“কী হয়েছে মা তুমি এমন করছো কেন?”
ইরা এসে নিঝুমকে জাপটে ধরে বলে,
“ভাবি শান্ত হও এমন করছ কেন?”
তখন নিঝুমের চিৎকারে ইশানও এখানে উপস্থিত হয়। সে খুব চিন্তিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। মনে হচ্ছে কোনো গভীর চিন্তায় মগ্ন। ইহান স্থীর হয়ে দাড়িয়ে আছে। সেও কিছু চিন্তা করছে। দু ভাইয়ের কীসের এতো চিন্তা?
এদিকে নিঝুম কিছুতেই থাকছে না। সে বারংবার বলছে,
“ওখানে কিছু ছিলো। সেগুলো কোথায় গেল? আমি স্পষ্ট দেখেছি। ও-ই দিয়েছে ওগুলো। আমি নিশ্চিত ও-ই দিয়েছে। এজন্যই ওভাবে দেখছিলো আমায়।”
নিঝুমকে থামানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অনিলা খান নিঝুমকে পাল্টা প্রশ্ন করে,
“কী দেখেছ তুমি মা? আর কার কথা বলছো? কে কী দিয়েছে?”
নিঝুম পাগলের মতো প্রলাপ বলতে থাকে,
“ও দিয়েছে। ও দিয়েছে। কেন দিয়েছে। কে ও। কেন দিলো। কী করেছি আমি। কী বোঝাতে চাইছে ও… ”
নিঝুমের পাগলামো দেখে ইহান আর স্থীর থাকতে পারে না। তার প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে এসব৷ সে নিঝুমের সম্মুখে এসে তার এক হাতের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরে। চোয়াল শক্ত করে অগ্নিদৃষ্টি প্রয়োগে বলে,
“একদম চুপ। আর একটুও পাগলামো নয়। তুমি ভুল দেখেছ। কেউ কিচ্ছু দেয় নি। কোনো কিচ্ছু নেই এখানে। সব তোমার মনের ভুল। সারাদিনে বেশি স্ট্রেস নিয়ে ফেলেছ তাই এমন হয়েছে। এখন রেস্ট করো। সব ঠিক হয়ে যাবে। বাজে চিন্তা একদম নয়।”
নিঝুমের কানে কথা গুলো গেল কিনা কে জানে সে তো ইহানের মধ্যে ডুবে গেছে। ইহানের বলা কথা গুলো হয়তো তার কর্ণ ছুতে অক্ষম। ইহানের হাতের স্পর্শে তার মনে পড়ে যায় তখনকার কথা। চোখ বন্ধ করতে করতে সে এক পলক দেখেছিলো ইহান তাকে নিজ বক্ষে জায়গা দিয়েছে। তখনকার কথা মনে পড়তেই লজ্জায় মিয়িয়ে গেল সে। সকলের সামনে এমন সিচুয়েশন ছি! ছি! মুহূর্তেই ভুলে গেল সেই ভ’য়া’ব’হ স্মৃতি। ইহান ফার্স্ট এইড বক্স থেকে একটি ঔষধ নিয়ে নিঝুমকে খাইয়ে দিল৷ এটা অল্প পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ। ডক্টরের পারমিশন আছে ডিপ্রেশনে এটা সাময়িক ভাবে খাওয়া যায়। নিঝুমের এখন ঘুমের প্রয়োজন তাই ইহান ওটা ওকে খাইয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিঝুম ঘুমিয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করার আগে আরেকবার ইহানকে দেখে নিল।
নিঝুম ঘুমতেই যেন সকলে স্বস্তি ফিরে পেল। অনিলা খান প্রশান্তির নিশ্বাস ফেললেন। ইরাও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু তখন ইশান এগিয়ে এসে বলল,
“কেবল তো শুরু কতদিন সামলাতে পারবে?”
অনিলা খান বললেন,
“যত দিন পারা যায় ততদিন। চেষ্টা করতে দোষের কী। আমার বিশ্বাস আমি পারব।”
“পারলেই ভালো।”
ইশান চলে যায়। অনিলা খান ইরাকেও চলে যেতে বলে। ইরা চলে যায়। অতঃপর তিনি ইহানের কাছে গিয়ে বলে,
“খেয়াল রাখিস ওর দিকে। ইনশাল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ইহান ছোট্ট করে মাথা নাড়ায়। অনিলা খান নিজের ঘরে চলে যায়। ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ইহান মনে মনে ভাবে,
“কিচ্ছু ঠিক হবে না। কেবল তো শুরু হলো। ধীরে ধীরে অনেক কিছু হবে। সামলাতে পারব তো?”
ইহান এক পলক নিঝুমের দিকে তাকায়। ঘুমন্ত মুখখানা দেখতে কী নিষ্পাপ লাগছে। ইহান ফের মনে মনে ভাবে,
“শুধু শুধু তোমায় ইউজ করতে হলো। কী করতাম বলো আমি তো নিরুপায়। সব দোষ তোমার বাবার।”
———————–
আরও একটি মিষ্টি ভোরের উপস্থিতি নিঝুমের জীবনে। তড়িঘড়ি করে উঠে ফ্রেশ হয়ে নামাজ আদায় করে নেয় সে। আজকে আর কুরআন তেলওয়াত করে না। মাথা টা কেমন জানি ধরে আছে গরম চা হলে মন্দ হতো না কিন্তু এতো ভোরে কিচেনে কেউ নেই হয়তো তাই মনের ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রেখে বেলকনিতে চলে গেল সে। ইহান আজও বেলকনির ডিভানে কোনো রকমে কাত হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। পড়নে গেঞ্জি, ট্রাউজার, চুলগুলো এলোমেলো। নিঝুম খুব মন দিয়ে পর্যবেক্ষণ করল তাকে। দেখতে তো মাশাল্লাহ কিন্তু ব্যবহার টা একদম করলা। আনমনেই ভেংচি কাটল নিঝুম। পরক্ষণেই মনে হলো ইহানের শুতে হয়তো অসুবিধা হচ্ছে। নিজের প্রতি অসম্ভব রাগ হলো তার। তার জন্যই তো ইহানের এমন কষ্ট করতে হচ্ছে। সে শুধু শুধুই উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। নিঝুমের ইচ্ছে করছে ইহানকে ডেকে তুলে বিছানায় পাঠিয়ে দিতে কিন্তু কোথাও একটা সংকোচ থেকেই যায়। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক পর্যায়ে নিঝুম ইহানকে ডেকেই ফেলল। কী বলবে! কী বলবে! ভেবে, ভেবে অবশেষে মি.খান নামেই সম্বোধন করল ইহানকে। বলল,
“এই যে শুনছেন। আপনার তো কষ্ট হচ্ছে। ভেতরে গিয়ে শুবেন চলুন। শুনতে পাচ্ছেন৷ মি.খান শুনতে পাচ্ছেন।”
ইহানের ঘুম খুব পাতলা। নিঝুমের মৃদু আওয়াজেই তার ঘুম ছুটে গেল। চোখ মেলে নিঝুমকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। অতঃপর নিঝুমের তাকে ডাকার কারণটা মস্তিষ্কে নাড়া দিতেই তার কাছেও মন হলো, আসলেই বিছানায় গিয়ে শোয়া টা ভীষণ জরুরি। এভাবে শোয়াটা ভীষণ কষ্টকর। ইহান কিছু না বলে হাই তুলতে তুলতে উঠে বিছানায় গিয়ে উবুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। নিঝুম আর কিছু বলল না। সে তার মতো বেলকনি থেকে বাগান দেখায় মনোযোগী হলো।
বেলকনি থেকে বাগানের এক সাইট স্পষ্ট দেখা যায়। বেশিরভাগ গন্ধরাজ আর লাল গোলাপ। পুরো বাগানটায় ফুলের সমারোহ। সাদার মধ্যে থেকে থেকে লাল রঙা ফুল গুলো যে কারো নজর কাড়তে সক্ষম। যে কখনো ফুল তেমন পছন্দ করে না সেও হয়তো একবার দেখলে দ্বিতীয় বার ফের তাকাবে। নিঝুমও মনোযোগ সহকারে সেগুলো দেখছিল। ফুলের টকটকা লাল রঙ দেখে তার হঠাৎ মনে হলো গতকাল রাতের কথা। বুকটা ধপ করে উঠল নিমেষেই। মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। মনে মনে ভাবল, ‘সত্যিই কী আমি ভুল দেখেছিলাম। নাকি অন্য কোনো সত্যি লুকিয়ে আছে এর পেছনে?’
নিঝুম ফের ভাবে সেই বক্সটির কথা। মনে করার চেষ্টা করে কী কী ছিলো সেখানে। সেখানে ছিলো,’একটি রক্তাক্ত পাঞ্জাবি,একটি আগুনে পোরানো আধপোড়া শাড়ি, বড় ছোঁ’ড়া ছোঁ’ড়া’র গায়ে তাজা রক্তের ছাপ, কিছু শুকনো ছেঁড়া বকুল মালা, ভাঙা রেশমি চুড়ি। আর বক্সটির ওপর পাশে রক্ত দিয়ে লেখা ছিলো,” ছাড়ব না”।
সেগুলো মনে করতেই আঁতকে ওঠে নিঝুম। আবার রাতের মতো সিচুয়েশন হতে থাকে তার। নিজের মধ্যে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে সে। শরীরে অদ্ভুত কম্পন শুরু হয়েছে। চোখ জোড়া বড় বড় হয়ে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে সেভাবেই দাড়িয়ে থাকে সে। মুখে কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। ছোট থেকেই সে ভীষণ ভীতু প্রকৃতির তার ওপর আবার রক্তে তার ফোবিয়া আছে। রক্ত দেখা বা সেই মুহূর্ত মনে পড়লেই সে সে’ন্স’লে’স হয়ে পড়ে। আজও সে সময় আগত। ধীরে ধীরে চে’ত’না হারায় সে। সারা শরীর নিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে।
ধপ করে কিছু পড়ার শব্দে চমকে ওঠে ইহান।
——————–
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি