#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা?(প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব-১৩)
————–
ইরা রুমে ঢুকেই স্বজোরে দরজা লাগিয়ে দিলো। এমনটা হবে মোটেও সে আশা করে নি। কী থেকে কী হয়ে গেল। ভেজা শরীর নিয়েই ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার অন করে দিল। হাঁটু মুড়ে বসে পরল নিচে। শাওয়ারের ঠান্ডা জলের শীতল স্পর্শে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার নেত্রকোণের অবাধ্য নোনাজল। এই মুহুর্তে নিজের প্রতিই চরম বিরক্ত সে। বিরক্তি গুলো কান্না হয়ে ঝড়ে পড়ছে। নিহানের জন্যও চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। না জানি কী অবস্থায় আছে। ইহান নিশ্চয়ই তাকে ছেড়ে কথা বলবে না। যদি হাত তোলে ওর ওপর তখন কী হবে? এমনো হাজার জল্পনা কল্পনা করতে করতে ডুকরে কেঁদে ওঠে ইরা। ভাবনা গুলো কেমন অবাধ্য। মানতেই চাইছে না। ভালো কিছু ভাববার কোনো অবকাশ নেই।
———–
“তোমার সাহস কী করে হয় আমার বোনকে ডিস্টার্ব করার?”
— “ডিস্টার্ব করেছি কে বলল আমি তো শুধু কথা বলছিলাম। সে যদি ডিস্টার্ব হতো তবে কী গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে থেকে যেত?”
— ” ইরা ডিস্টার্ব হয়নি বলছো?”
— “হুম বলছি।”
— “বুঝলাম!কিন্তু এমন কথা তুমি আর কখনোই ওর সঙ্গে বলতে আসবে না। এটা তোমাদের কারোর জন্যই খুব একটা শুভকর নয়।”
— “এমন কথা তো আমাকে বলতেই হবে। অন্তত যতদিন ইরা শুনবে ততদিন।”
— “বড্ড নাছোড়বান্দা! ব্যাপার না এ বয়সে এমনটা হয়ে থাকে। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে। তবে এখনই মনটাকে সংযত করো নয়তো পরবর্তীতে অনেক বেশি আঘাত পেতে হবে।”
— “আঘাতের আরও বাকি আছে বলছেন? জীবনের সবথেকে বড় আঘাত তো আমি এই তিন বছর যাবৎ মাথায় নিয়ে ঘুরছি যেটার সুচনা করেছিলেন আপনারা আরও পাঁচ বছর আগে থেকে।”
— “সবটাই নিয়তি। সেজন্যই বলছি এসব থেকে যত দুরে থাকবে তোমার এবং ইরার জন্য ততই মঙ্গল।”
— “কীসে মঙ্গল কীসে অমঙ্গল আমি জানি না। আমি শুধু জানি জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত এই অমূল্য চাওয়া আমি চাইতে বাধ্য।”
— “তরুণ বয়স। রক্ত গরম। এখনই সাবধান করছি। ইরা চায় না তুমি তার আসেপাশে থাকো। আমি ওকে পারসোনাললি জিজ্ঞেস করেছি, সে বলেছে তোমাদের পরিবারের মতো হিংস্র পরিবারে সে যেতে চায় না। ঘৃণা করে ও তোমাদের।”
— “একটু ভুল হচ্ছে। আমাদের পরিবারের বাকি সদস্যকে ঘৃণা করলেও আমাকে ইরা কখনোই ঘৃণা করবে না। আমি যে তার হৃদয়। হৃদয়কে কখনো নিজের থেকে আলাদা করা যায় না। মুখে বললেও আমি জানি ইরা আমাকে এখনো চায়। শুধু আপনাকে কষ্ট দিতে পারবে না বলে আমাকে দুরে ঠেলে দেয় বারংবার। আমি ইরার চোখে এখনো আমার জন্য ভালবাসার অথৈ সাগর দেখেছি।”
— “বেশ প্রমাণ করো তবে। তুমি যদি ইরার মুখ থেকে স্বীকার করাতে পারো তবে কথা দিলাম আমি নিজে দাড়িয়ে থেকে তোমাদের বিয়ে দেবো। আর যদি না পারো তবে কোনোদিন এ মুখ নিয়ে আমার এবং আমার বোনের সামনে আসবে না। মনে রেখো সময় মাত্র এক মাস।”
— “মনে থাকবে।”
— “এখন আসতে পারো।”
নিহান চলে যেতে নেয় ফের পেছন ঘুরে কী মনে করে ইহানের একদম মুখোমুখি এসে দাড়ায়। ইহান প্রশ্ন বোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। নিহান সেদিকে তোয়াক্কা না করে হুট করে ইহানের পায়ে হাত রেখে সালাম করে বসে। ইহান হতবাক হয়ে যায়। নিহান সালাম করে উঠে বলে,
— “দোয়া করবেন ভাইয়া। আমি জানি আপনি খুব ভালো মানুষ। সেই সঙ্গে আমার পরিবার কতটা জঘন্য তাও আমি জানি। কিন্তু সবকিছুর উর্ধ্বে আমি ইরাকে ভালবাসি। আপনি হয়তো আমার কষ্ট টা বুঝবেন। আপনিও তো আমার মতোই…..।”
নিহান কথা শেষ করল না উল্টো পথে হাঁটা ধরল। বেশ কয়েক কদমে এগিয়ে গেল বহুদূর। ইহান সেখানেই দাড়িয়ে রইল। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে মনে মনে ভাবল,
— “তুমি যে ছেলে খারাপ নও তা আমি খুব ভালো ভাবেই জানি নিহান। কিন্তু তোমার ওই ভয়ংকর পরিবারে বোনকে পাঠাতে কিঞ্চিৎ হলেও আমার আপত্তি আছে। তবে ইরা নিজ মুখে কখনো তোমাকে চাইলে আমি না করবো না কখনোই। কারণ দিনশেষে তুমি ছেলে ভালো। আমার বোনকে সুখীই করবে। কিন্তু সেটা ইরা বুঝলে তবেই।”
———-
ছাদের রেলিংয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে নিঝুম। দৃষ্টি গহীন আসমানে। অপলক চেয়ে আছে যেন পলক ফেলতে প্রবল নিষেধ। দুপুর থেকেই তার মনটা খারাপ। একবার দেখেছে ইরা এসেছে বাড়িতে। একবার চেয়েছিল যাবে আবার কেন জানি যেতে ইচ্ছে করল না। ইহানের প্রতি চাপা অভিমান গুলো সকলের ওপর ঝাড়ার প্রবল প্রচেষ্টা মাত্র। তার অভিযোগের ভাষা গুলো বড্ড দুর্বল। নয়তো কী আর শুরুর দিন থেকেই এমন অবহেলা পেতে হয় নিজ স্বামীর কাছ থেকে। অভিমান যখন গাঢ় হয় অভিযোগের পাল্লা গুলো তখন আরও ভারী হয়ে ওঠে। অভিমান, অভিযোগের খেলায় হেরে যায় ভালবাসা।
— “এতো রাতে এভাবে বসে আছো কেনো?”
নিঝুম হকচকিয়ে ওঠে। অন্য সময় হলে হয়তো ভয়ে এক চিৎকার দিতো কিন্তু আজ মনটা যে ভীষণ বিষন্ন। সবকিছুতেই তার বিরোধিতা চলছে। নিঝুম ঘেটি কাত করে দেখল ইহান দাড়িয়ে। হাতে কফির মগ। নিঝুমের দিকেই চেয়ে আছে। মাঝে মধ্যে কফিতে একেকটা চুমুক দিচ্ছে। ইহান গম্ভীর কণ্ঠে আবারও সুধায়,
— “কী হলো কথা বলছ না কেনো?”
নিঝুম উঠে দাড়ায়। মাথা নত করে ছোট্ট করে বলে,
— “এমনিতেই”
অতঃপর নিঝুম ইহানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। ততক্ষণাৎ ইহান বলে ওঠে,
— “আমি কী যেতে বলেছি?”
নিঝুমের চলন থেমে যায়। থমকে দাড়ায় সেভাবেই। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা চলে। প্রথম বাক্য ইহান বলে,
— “সরি দুপুরের ব্যবহারের জন্য। আসলে আমার মাথার ঠিক ছিল না। ইরাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা হচ্ছিল।”
নিঝুম চটজলদি মুখ খুলে,
— “ইট’স ওকে আমি আগেই বুঝতে পেরেছিলাম।”
— “হুমহ! আচ্ছা এদিকে এসো।”
নিঝুম কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। ইহান হাতের ইশারায় তাকে পুনরায় আগের জায়গায় বসতে বলে। নিঝুম বিনাবাক্যে বসে পড়ে। আজ কেন জানি তার কথা বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। ওই যে অভিমান গুলো যে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চাইছে। নিঝুম বসতেই ইহানও ধপ করে ওর পাশে বসে পড়ে। নিঝুম আড়চোখে একবার পরখ করে নেয় ইহানকে। সাদা গেঞ্জির সঙ্গে ডার্ক ব্লু ট্রাউজার। চাঁদের আবছা আলোয় অদ্ভুত সৌন্দর্য বিচরণ করছে সারা মুখশ্রীতে। থেকে থেকে কফিতে চুমুক বসাচ্ছে। চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো। বেশ লাগছে দেখতে। নিঝুম চোখ সরিয়ে নিল। বেশিক্ষণ ওদিকে দৃষ্টি অব্যাহত রাখা সম্ভবপর নয়। নচেৎ যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এমন মুগ্ধ নয়নে সাধারণত প্রেমিক পুরুষ তার প্রেয়সীকে পর্যবেক্ষণ করে কিন্তু এখানে ঘটনা টা হয়েছে কী সম্পূর্ণ ভিন্ন ধর্মী। এখানে প্রেয়সী তার প্রিয়কে দেখতে ব্যস্ত কিন্তু প্রিয় তার একবারের জন্যও তা বুঝতে পারছে না। বুঝতে পারছে না নিঝুমের ছোট্ট হৃদয়ের ব্যাকুলতা। বুঝতে পারছে না কিছু নাম না জানা অনুভূতির আর্তনাদ। সে তো তার নিত্য সঙ্গী গাম্ভীর্য অটুট রাখতেই ব্যস্ত৷
— “গান জানো?”
নিঝুম চমকে উঠে। কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে ইহানের দিকে। ইহান আচমকা নিঝুমের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। চোখাচোখি হয়ে যায় চারটি চোখ। কিছু নিরব অনূভুতি রচনা করে দৃষ্টির অন্ত-গহ্বরে। নিরবতা ভেঙে ইহান ফের বলে,
— “পারো যদি তবে গেয়ে শোনাও।”
—————–
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি