কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব-১৭ শেষ)

0
1269

কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা (প্রথম পরিচ্ছদ),(পর্ব-১৭ শেষ)

————–
রক্তাক্ত শরীরে বাড়িতে প্রবেশ করে ইহান। তার কোলে অবস্থান করছে নিঝুমের অচেতন দেহ। ড্রয়িংরুমের স্তব্ধ পরিবেশ দেখে ইহানের আর বুঝতে বাকি নেই যে এখানে কিছু একটা হয়েছে। ইহানকে দেখে ইরা,ইশান দৌড়ে আসে। অনিলা খান আঁচলে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠেন। এই ছেলেটিকে নিয়ে সে সবসময়ই চিন্তায় থাকে! অস্থির চিন্তা।

– ভাইয়া ঠিক আছো? এ কী হাল হয়েছে?

ইরা কথা বলতে পারছে না। ডুকরে কেঁদে উঠছে। ইহান ওদের আস্বস্ত করার উদ্দেশ্যে বলল,

– আ’ম অলরাইট। কিচ্ছু হয়নি আমার কিন্তু নিঝুম ঠিক নেই। ইমিডিয়েটলি ডক্টর সাখাওয়াতকে কল করে আসতে বল।

ইশান দ্রুত মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। ইহান নিঝুমকে সোফায় শুয়িয়ে দিয়ে ওর মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। অনিলা খান যেন আজ স্তব্ধ। ছেলে – ছেলের বউয়ের এমন পরিণতি খুব গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করছে তার অন্তরীক্ষে।

————–
গভীর ঘুমে আছন্ন নিঝুম। ইহান হাফ ছেড়ে বাঁচল যেন। ডক্টর সাখাওয়াত ওকে দেখে গেছে।
বলেছেন, ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। প্রতিবারের মতো নর্মালি ভয় পেয়ে সেন্স হারিয়েছে।ইহানের হাতের মারাত্মক জখমও ট্রিটমেন্ট করে দিয়ে গেছেন তিনি।

ইহান ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়ে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে। এতক্ষণে সময় করে উঠতে পারে নি। মায়ের মনের অবস্থা নিশ্চয়ই শোচনীয়। ইহানের এই মুহুর্তে তাকে সঙ্গ দেওয়াটা ভীষণ প্রয়োজনীয়। মাঝপথে ইরাকে ডেকে বলে গেছে নিঝুমের কাছে গিয়ে বসতে।
ইরা দেড়ি না করে তখনই চলে গেছে।

– লা’শটা দেখেছিস?

– এখনো না

-যা দেখে আয় চিনতে পারিস কিনা। আমার মনে হচ্ছে তুই চিনতে পারবি।

ইহান দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলে,
– হুম যাচ্ছি, মা

– হুম

ইহান বেড়িয়ে গেল।হুইলচেয়ার টেনে টেনে অনিলা খানও ছেলের পেছন পেছন গেলো।

লা’শের সামনে দাড়িয়ে ইহান,ইশান আর অনিলা খান। লা’শটির চেহারা বোঝা না গেলেও পোশাক দেখে ইহান ঠিকই চিনতে পারল। এই লোকটাই ওকে আঘাত করেছে। ধারালো ছু’রি দ্বারা হাতে জখম করেছে। ইহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ঝটপট একটি নম্বরে কল করে লা’শটি নিয়ে যেতে বলে। কথা শেষ করে পেছন ফিরতেই ইরা হন্তদন্ত হয়ে সেখানে ছুটে আসে। সকলে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে মুহূর্তেই। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ইরা হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

– ভাইয়া ভাইয়া তাড়াতাড়ি চলো। বউমনি কেমন জানি করছে। অদ্ভুত পাগলামি। আমি সামলাতে পারছি না।

ইহান, ইশান দৌড়ে চলে যায় সেদিকে। ইরা অনিলা খানের হুইলচেয়ার ঠেলে তাকেও নিয়ে যায়।

—————
-মারিয়া শান্ত হ বোন। এমন পাগলামি করিস না। আরেহ সামান্য হাতে লেগেছে মাত্র তেমন ডে’ঞ্জা’রা’স কিছু না।

– নাহহহহহহহহহহহহ!আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমার ইহানের গায়ে হাত? সবকিছু শেষ করে ফেলব আমি সবকিছু……

ততক্ষণাৎ সপাটে চড় পড়ল মারিয়ার গালে। মায়ান তীব্র হুংকার ছেড়ে বলল,

– ইহান, ইহান, ইহান! পাগল হয়ে গেছিস তুই? ওই ছেলের জন্য পাঁচটা বছর ধরে কম পাগলামি তো করছিস না কিন্তু ও তো দিব্বি বউ নিয়ে সংসার করছে। ভুলে যা ওকে। নিজেও ভালো থাক আমাকেও ভালো থাকতে দে।

মারিয়া হাতে থাকা আধভাঙ্গা গ্লাসটা স্বজোরে ছুড়ে মা’র’ল কিছুটা দুরত্বে থাকা টেলিভিশনের ওপর। মুহূর্তেই ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল টেলিভিশনটি। দিগুণ তেজস্বী কন্ঠে বলল,

– আমার শুধু ওকেই চাই।

মায়ান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে চলে গেল।

—————–
– নিঝুম প্লিজ কথা শোনো। এমন পাগলামি করো না। প্লিজ কথা শোনো। আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবো। প্লিজ শোনো শান্ত হও। হাত থেকে ছু’রিটা ফেলে দাও। ফেলে দাও বলছি।

– নাহ কিছুতেই ফেলব না। আমি আগে আমার প্রশ্নের জবাব চাই। এটা আমার জীবন ম’র’ণে’র প্রশ্ন। আমাকে সত্যিটা জানতে হবে এবং সেটা এই মুহুর্তেই।

নিঝুম ছু’রি হাত থেকে ফেলতে নারাজ। তার আগে উত্তর চাই। ঘুমের ঔষধে তেমন ইফেক্ট পড়ে নি ওর ওপরে। খুব দ্রুতই জেগে গেছে। তারপর থেকেই শুরু করে দিয়েছে অদ্ভুত পাগলামি। টি-টেবিলের ওপর থেকে ফল কাটা ছু’রি নিয়ে শুরু করেছে আ’ত্ম’হ’ত্যা’র প্রচেষ্টা।
ব্ল্যাকমেইল করে সত্যি জানতে চাইছে।

সকলেই উত্তেজিত নিঝুমের কান্ডে। কিন্তু কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। ইহান ইশারায় সবাইকে চলে যেতে বলল। ইশান ইরা অনিলা খানকে নিয়ে বাহিরে চলে গেল। ওরা দরজার বাহিরেই থেকে গেল। ইহান নিঝুমের দিকে করুন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

– শান্ত হয়ে বসো। ওটা ফেলে দাও। আমি সব সত্যি খুলে বলছি তোমায়। ট্রাস্ট মি সব বলব। তবে আগে শান্ত হও।

নিঝুম চুপ করে সোফায় বসে। ইহানও নিঝুমের পাশে বসে। নিঝুমের হাত থেকে খুব সন্তর্পণে ছু’রি টা নিয়ে নেয়। নিঝুম কিছু বলে না। ইহানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ইহান একটা সিগারেট জ্বালায়। কয়েকটা টান মে’রে বেশ আঁটসাঁট বেঁধে বসে। অতঃপর বলতে শুরু করে…….

ঘটনার শুরুটা হয়েছিল আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। আমি তখন ন্যাশনাল কলেজের ছাত্র। চেহারা, পড়াশোনা সবকিছুতেই বেশ নামডাক তখন আমার। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রফেসর থেকে শুরু করে সকল স্টুডেন্টদের চোখে ছিলাম অনন্য। দিনগুলো ভালোই কাটছিল। হঠাৎ একদিন কলেজে পা রাখে এক নতুন ছাত্রী। মেয়ে তো নয় যেন আসমানী পরী। স্টাইলিশিংয়ে ও বেশ দক্ষ। তার কথা, চালচলন সবকিছুতেই নিপুণ সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যময়ী রমনী টি যখন কিছুদিন যেতে না যেতেই আমাকে প্রপোজ করে বসে আমি তখন কেন জানি না করতে পেরে পারি নি। এর আগেও অসংখ্য বার অসংখ্য ভাবে প্রপোজ পাওয়ার পরেও সবগুলো রিজেক্ট করেছি অনায়াসে কিন্তু তার ওই মায়াবী চোখে তাকিয়ে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি নি। একসেপ্ট করে নেই তার প্রপোজাল। পুরো কলেজ কাপিয়ে শুরু হয়ে যায় আমাদের প্রেমের কাহিনী। আবরার খান ইহান যে কাউকে একসেপ্ট করতে পারে এটা ছিল সবার ধারণার অতীত। তারপর থেকে নিয়মিত দেখা করা, রাত জেগে প্রেমালাপ, সময়-অসময়ে ঘোরাফেরা, একজন আরেকজনের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠা সবকিছুই ছিল অত্যাধিক। এই প্রণয়কে একসময় শুভ পরিণয়ে রুপান্তরিত করার উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের দু পরিবারে আমাদের সম্পর্কের কথা জানাই। শুরু থেকেই কারোই কোনো অসুবিধে ছিল না। সকলের কাছ থেকে সাময়িক মত পেয়ে আমি আমার বাবা,মা কে পাঠাই মারিয়া’র বাড়িতে। ওহ বলে রাখি তার নাম ছিল মারিয়া। বাবা, মা আর ইশান যায় সেদিন পাত্রী দেখে পাকা কথা দিতে। আমি তখন বাড়িতে প্রবল উত্তেজনা নিয়ে পায়চারি করছি। ইরা আমার অস্থিরতা দেখে খুব হাসাহাসি করছে। আমাকে খোঁচাচ্ছে। আমিও সুযোগ বুঝে ওকে দু একটা দিয়ে দিচ্ছি। দু ভাই বোন বেশ খোশমেজাজে আছি। বাবা,মা সেখান থেকে বাড়ি ফিরে প্রায় দু ঘন্টা পর। বাবা বাড়িতে এসেই আমার গালে সপাটে চড় বসিয়ে দেন। আমি হতবাক হয়ে চেয়ে আছি তার মুখপানে। তিনি আরও কয়েকটি দিবে তার আগেই মা তাকে থামায়। ইশান কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ইরা তখন এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,” কী হয়েছে তারা এমন কেন করছে?” তখন মা বলে, “মারিয়ার পরিবার একটা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত পরিবার। মারিয়ার বড় ভাই মায়ান এই শহরের কালো রাস্তার একমাত্র সম্রাট। তার আন্ডারে যাবতীয় সকল খারাপ কাজ সাধন হয়ে থাকে। আমার বাবা পুলিশ অফিসার হওয়ার সুবাদে এ ঘটনা তার অজানা নয়। এমনকি বাবা বার কয়েক মায়ানকে গ্রেফতার করা সত্ত্বেও সঠিক তথ্য প্রমাণের অভাবে ছেড়ে দিতে হয়েছে। এমন একটা পরিবারের সঙ্গে জেনে শুনে তারা কীভাবে আত্নীয়তা করবে। এসব শোনার পর আমার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। সেদিন থেকে বাবা আর আমার সঙ্গে তেমন কথা বলতেন না। ইশানের থেকে শুনেছি ও বাড়িতে নাকি অনেক ঝামেলা হয়েছে। বাবার সঙ্গে অনেক মিসবিহেভ করেছে মারিয়ার ভাই। তারপর সাত দিনের মাথায় মারিয়া আমাকে তার সঙ্গে মিট করতে বলে ৷ আমিও চলে যাই। মারিয়া খুব কান্নাকাটি করে। প্রথমে আমার মনেও অসহায়ত্ব দেখা দিলেও পরবর্তীতে মারিয়ার কথা শুনে আমি চরম অবাক হই। সে তার ভাই এবং তার পরিবারের এসব খারাপ কাজকে প্রশয় দেয়। তার মতে এসব কাজ করাটা যুক্তিযুক্ত। এসব কাজ ছাড়া নাকি অর্থের সম্রাট হওয়া সম্ভব নয়। আর অর্থ ছাড়া নাকি দুনিয়া অচল৷ তারমানে সেও তার পরিবারের মতো অর্থের পূজারি ভালবাসার নয়। আমি তখনই ওর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করি। মারিয়া আমার পায়ে পর্যন্ত পড়ে কিন্তু আমি সেদিন তার কোনো কথাই শুনি না। তারপরও ও আমাকে বেশ কয়েকমাস ধরে ডিস্টার্ব করে কিন্তু আমি আর তার ধারে কাছে নেই। কিন্তু ওই যে ভালবাসার মানুষকে কী আর সহজে মন থেকে মুছে ফেলা যায়। আর যদি হয় সেটা প্রথম প্রেম,প্রথম ভালবাসা। দিনের শুরুতে যতই অবহেলা করি না কেন দিনশেষে গহীন রাতে ঠিকই মনের মধ্যে ক্ষতগুলো জ্বলজ্যান্ত রুপ ধারণ করত। এভাবেই চলছিল সবকিছু। কিন্তু একদিন ঘটল খুবই অশুভ ঘটনা। বাবা, মা একসঙ্গে গাড়ি করে বেড়িয়েছিল। মাঝ পথে তারা দুর্ঘটনার স্বীকার হয়। বাবা স্পট ডে’ট হয়। মা বেঁচে যায় কিন্তু পায়ের শক্তি হারায়। এক্সিডেন্ট স্পট ছিল আমাদের বাড়ি থেকে কাছেই তাই খুব দ্রুতই আমরা খবর পেয়ে যাই। বাবা, মায়ের এই অবস্থা দেখে আমি তখন পাগলপারা। কী করব না করব কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। জনগণের সাহায্যে তাদের হসপিটালে এডমিট করি। বছর খানেক চিকিৎসার পর মা হুইলচেয়ারে বসতে সক্ষম হয়। প্রথম একমাস তিনি কথা পর্যন্ত বলতেন না। পাথর হয়ে থাকতেন। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়। পরে বাবার অফিসের সহকর্মীদের কাছ থেকে জানতে পারি বাবা মারিয়ার ভাইয়ের অপকর্মের প্রমাণ স্বরূপ একটি ফাইল এবং একটি পেনড্রাইভ রেডি করেছিলেন। মায়ান সেটা জানতে পেরে বাবাকে অনেক ভাবে ফোর্স করে ওগুলো দিয়ে দিতে কিন্তু শেষমেশ না নিতে পেরে বাবাকে শেষ করার জন্য এক্সিডেন্ট টা ঘটায়। মূলত এক্সিডেন্টটা ওদেরই প্ল্যানিং। এই চক্রান্তে মারিয়া নিজেও যুক্ত ছিল। ঠিক সেদিনই ওর প্রতি আমার তীব্র ঘৃ’ণা’র জন্ম নেয়। বাবার হ’ত্যা’কারীকে আর যাই হোক ভালবাসা যায় না।তবুও মনের কোণে কিছু অনুভূতি তো থেকেই যায়। কিন্তু তা বহিঃপ্রকাশ করা যায় না। আমি সরে আসলেও সরে যায়নি মারিয়া। সেই থেকে সে আমার পিছু পড়ে আছে। কাউকে আমার আশেপাশে সহ্য করতে পারে না। সবকিছুর উর্ধ্বে একটা কথা সত্য, ‘সে আমাকে ভালবাসে।’
কিন্তু আবার পরিবার, টাকা, অপরাধের পথ এসবও ছাড়তে পারে না। আমার পাশে কাউকে সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু আমার সামনাসামনি কিছু করারও ক্ষমতা নেই। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে ও নানাভাবে তোমার ক্ষতি করতে চাইছে। আমি প্রতিবারই কৌশলে তোমাকে রক্ষা করেছি। আর সেটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র আমার আইনি পেশার জন্য। হ্যাঁ! আমি একজন পুলিশ অফিসার। বাবার মৃত্যুর পর থেকে তার পোস্টে আমি জয়েন করি। বাবার সিনিয়র অফিসারের কাছে অধিক পছন্দের হওয়ায় চাকরিটা পেতে আমার তেমন অসুবিধা হয়নি। সেই থেকে আমি একটি সিক্রেট মিশনে আছি। বাবার মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের সমস্ত তথ্য-প্রমাণ, মারিয়ার পরিবারের বিরুদ্ধে সমস্ত প্রমাণ এই সবকিছু কোর্টে পেশ করার আগ পর্যন্ত আমার পেশার গোপনীয়তা বজায় থাকবে। আমার পরিবার ব্যতিত এ কথা সবার অজানা। ঠিক এই কারণেই তুমি আমাকে বারকয়েক পথে মা’রা’মা’রি করতে দেখেছ এবং পশ্চিম পাশের ঘরের রহস্য এটাই। মারিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের দু বছর পর জানতে পারি ইরা মারিয়ার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে প্রেম করছে। কিন্তু ইরা সেটা জানত না। নিহান হলো মারিয়ার সেই ভাই। তারপর থেকে ইরার জীবনেরও কষ্ট শুরু। ইরাকে আমি অনেক বুঝিয়েছি নিহান ভালো ছেলে ও ওদের মতো নয় কিন্তু ইরা বুঝতে নারাজ। তার ধারণা ও ওই পরিবারে গেলে আমি ভালো থাকব না। তাই আরকি।তারপর মায়ের কথা রাখতে বিয়েতে মত দিতে হয় আমাকে। এর মধ্যে জানতে পারি তোমার বাবা, ভাই এর সঙ্গে ওদের হাত আছে। ওরা একই সূত্রের লোক। সকলে এক হয়ে কাজ করে। তোমাকে বিয়ে করার একমাত্র উদ্দেশ্য আমার এটাই যে,’তোমার বাবাকে কব্জা করা।’ ভেবেছিলাম তোমাকে আমার খাঁচায় বন্দী করলে সে চুপ হবে কিন্তু না সে আরও বেশি ডেস্পারেট হয়ে উঠছে। তোমাকে আমি বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। মানে তোমাদের বাড়ির সকল মেমবারদের তথ্যই আমার কাছে আছে। সেদিক বিয়ে বাড়িতে তুমি ওভাবে ফল্ট করায় আমি তার-ই সুযোগ নেই। এই পর্যন্ত মারিয়া আমার কোনো ক্ষতি করে নি কিন্তু আমার আশেপাশে যারা আসে তাদেরই ও শেষ করে ফেলে। আজকে ভুল বসত ওর দলের একটা ছেলে তোমাকে মা’র’তে গিয়ে আমাকে আঘাত করে বসে যার ফলস্বরূপ তার লা’শ একটু আগে পো’স্ট’ম’র্টে’ম ঘরে পাঠানে হয়েছে।

দীর্ঘ নিশ্বাসের সঙ্গে কথা শেষ করে ইহান। আর তখনই ভেসে আসে নিস্তেজ কন্ঠের আকুলতা,

– তারমানে আমি ছিলাম আপনার জীবনে টার্নিং পয়েন্ট। শুধু মাত্র নিজেদের স্বার্থে বলি দিলেন আমার জীবন টা। সবটা জুড়ে ছিল শুধু স্বার্থপরতা। আমি ঠকে গেলাম। কঠিন রুপে ঠকে গেলাম। নিজের পরিবার থেকে ঠকে গেলাম, যাকে নিয়ে সুখে সংসার করতে চেয়েছিলাম তার কাছ থেকেও ঠকে গেলাম। জীবন আমাকে কঠিন বেদনা উপহার দিল।

এতক্ষণে ইহানের দৃষ্টি নিঝুমের দিকে ঝুকল। নিঝুমের গাল বেয়ে টুপ টুপ করে পড়ছে বারিধারা। কেমন জানি নিস্তেজ চেহারা। ইহান কিছু বলতে নিলে নিঝুম সুযোগ দেয় না। জি’ন্দা লা’শের ন্যায় উঠে চলে যায়। ইহান সেদিকে তাকিয়ে থাকে। পিছু ডাকতে নিয়েও থেকে যায়। মনের মধ্যে থাকা কঠিন সত্তার মানুষটির বিবেকে আজ হঠাৎই টান পড়ে। সে ভুল করেছে। অন্যায় করেছে। নিজের স্বার্থে সে ব্যবহার করে গেছে এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে। নষ্ট করে দিয়েছে তার জীবন। এই প্রথম অনুশোচনা তীব্র বেগে চেপে ধরছে তাকে। এমনটা তো মারিয়া যখন তার পা জাপটে ধরে কেঁদেছিল তখনও হয়নি। অনায়াসে তাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু আজ! আজ ওই নিস্তেজ মুখশ্রী, থমথমে কন্ঠস্বর, ব্যথিত দৃষ্টির অগোচরে লুকিয়ে থাকা কতশত অভিযোগ। এগুলো কী করে উপেক্ষা করবে সে। এই প্রথম তীব্র থেকে তীব্র রক্ত ক্ষরণ শুরু হয়েছে তার অন্তরের অন্দরমহলে। মনে হচ্ছে ধারালো ছো’রা দ্বারা কেউ ক্রমাগত আঘাত হানছে। হ্যাঁ! সে ভুল করেছে । মস্ত বড় অপরাধ করেছে। অনেক কঠিন পাপ করেছে।

————–
ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাস্তায় একাকী হেঁটে চলেছে নিঝুম। আনমনের পদচারনা। মারিয়াকে ঘিরে ইহানের বলা প্রতিটি শব্দ তীরের মতো বিঁধছে তার বক্ষস্থলে। ইহান তবে এজন্যই তাকে মেনে নিতে পারছে না। সে শুধু মারিয়াকে ভালবাসে। তাকে শুধু মাত্র স্বার্থের জন্য বিয়ে করেছে। নাহ, নাহ, নাহ!!! কিছুই ভাবতে পারছে না নিঝুম মনের কষ্ট সংবরণ করতে না পেরে ভোরের আলো ফোটার আগেই নেমে পড়েছে নিস্তব্ধ রাজপথে। হঠাৎই পেছন থেকে একটি গাড়ি এসে ধাক্কা মে’রে ফেলে দেয় তাকে। নিঝুম পড়ে যায় ছিটকে কিছুটা দুরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফের তাকে টানতে টানতে গাড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। কিছু মুহুর্তের মধ্যে গাড়ি একটি নির্জন জায়গায় থামে। নিঝুমের মুখ ততক্ষণে বাঁধা শেষ। দুজন লোক তাকে ধরে একটি আঁধারে আচ্ছন্ন ঘরে ছুড়ে মা’রে। ততক্ষণাৎ ভেতর থেকে শোনা যায় কারও অট্টহাসির আওয়াজ। কি যে বিনোদন দায়ক সেই হাসির সুর। নিঝুম আন্দাজ করতে পারছে তার সঙ্গে কী হতে চলেছে। কিন্তু ছাড়া পাওয়ার বিন্দু মাত্র প্রচেষ্টা তার মধ্যে নেই। নেই কোনো ইচ্ছে। যার জীবনে শুধু ঠকে যাওয়া লেখা আছে তার জীবন বৃথা মরুভূমির সমান। থাক না সে তার মতো। নিঝুম না হয় অগোচরেই হারিয়ে যাক।

“যে তোমাতে অন্য কারো অস্তিত্ব, সেখানে আমার উপস্থিতি নেহাৎই মরিচীকা। তার থেকে বরং তুমি থেকো প্রিয় সুখে,আমি না হয় মিলিয়ে যাব আবছা কুয়াশার বুকে।”

————–
ইহান রাতে একটুও ঘুমতে পারে নি। নিঝুমের জন্য অস্থির হয়ে থেকেছে। সকাল হতে না হতেই পারি দিয়েছে নিঝুমের ঘরে। নাহ নিঝুম তো নেই। আশেপাশে, এ ঘরে ও ঘরে, পুরো বাড়িতে কোত্থাও নিঝুম নেই। ইহান হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছে নিঝুমকে।খুঁজতে খুঁজতে একদম সদর দরজায় এসে ঠেকেছে তার পা। যখনই বাহিরে পা রাখতে যাবে ঠিক তখনই ভেসে আসে কোনো রেডিও থেকে বেদনার ধ্বনি,

‘যখন পরবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে
তখন আমায় নাই বা মনে রাখলে
তারার পানে চেয়ে চেয়ে নাইবা আমায় ডাকলে..’

ইহানের পা থেমে যায় আপনাআপনি। গলা শুকিয়ে আসে। বক্ষ চিনচিন করে ওঠে। হাত-পা লাগামহীন কাঁপতে থাকে। মস্তিষ্কে জানান দিচ্ছে অজানা ভয়। কই মারিয়াকে ছাড়ার সময় তো এমন লাগে নি তবে আজ কেন এমন শূন্যতা অনূভব হচ্ছে। কেন মনে হচ্ছে অতি যত্নের কোনো কিছু হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে।

—————
দ্বিতীয় পরিচ্ছদের অংশ বিশেষঃ

ফুরফুরে বাতাসে বিষন্ন মনে আকাশ পানে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। মনটা আজ ভীষণ অস্থির হয়ে উঠেছে। পঞ্জিকার পাতা ঘাটলে দেখা যায় আজ দিনই ভীষণ স্পেশাল। একান্তই তার নিজের। তাই তো নিজের একান্ত মুহূর্ত একাকিত্বের সঙ্গে উপভোগ করতে চলে এসেছে নিজের প্রিয় জায়গা টিতে। এ বাড়ির এই বেলকনিটি তার নিজ হাতে সাজানো। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করে এখানে এলে। মনে পড়ে যায় কিছু পেয়ে হারানোর গল্প। মেয়েটির ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে দৌড়ে এসে পেছন থেকে তাকে জাপটে ধরে চার বছরের এক বাচ্চা মেয়ে। বাচ্চা মেয়েটির মুখে অমলিন হাসি। কন্ঠে সুমধুর আকুতি মেশানো বুলি, “আম্মা”

—————–

প্রথম পরিচ্ছদের সমাপ্তি,
সাদিয়া আফরিন নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here