#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা?(দ্বিতীয় পরিচ্ছদ),(পর্ব-১)
————–
-ভাবিমণি, ভাবিমণি কোথায় তুমি? দেখে যাও কী এনেছি তোমার জন্যে।
– কই কই দেখি দেখি কী এনেছ দেখি।
– ওহ গড! আইসক্রিম! মাই ফেবারিট।
– হুম এজন্যই তো এনেছি। তুমি খুশি হলেই আমি খুশি।
– ওলেহহ আমার মৌটুসী আমাকে কত্তো ভালোবাসে রে।
– হুম অনেককককককককক
– আমিও এত্তগুলো বাসি
ওদের কথার মধ্যেই বাচ্চা মেয়েটি দৌড়ে এসে অভিমানী সুরে বলে,
– আর আ আ আমাকে কেউ ভা ভালবাসে না।
বাচ্চা মেয়েটি গাল ফুলিয়ে থাকে। তখনই নিঝুম তাকে পরম স্নেহে বুকে আগলে নেয়। ফোলা ফোলা গাল দুটো আলতো টেনে দিয়ে আদুরে কন্ঠে বলে,
– কে বলেছে তোমাকে কেউ ভালবাসে না? আমার মাম্মা টাকে তো আমি অনেক অনেক অনেকককককক ভালবাসি। আই লাভ ইউ সো মাচ মাই ডিয়ার তুশীমনি।
– আই লাভ ইউ টু মাম্মা
নিঝুমের কথা শুনে তুশী অনেক আনন্দিত হয়ে যায়। ঝাপিয়ে পড়ে নিঝুমের বুকে। তখনই পাশ থেকে সোনালী মুখ খোলে। সোনালী হলো তুশীর একমাত্র ফুপ্পি। তুশী আসার আগে নিঝুম আর সোনালীর মধ্যেই কথোপকথন চলছিল।
– আমিও তো আমার তুশুরানিকে অনননননেক ভালবাসি। তুশুরানি এসো আমার কাছে।
সোনালী হাত বাড়িয়ে ডাকে তুশীকে। তুশী নিঝুমের কাছ থেকে দৌড়ে সোনালীর কাছে যায়। সোনালী ওকে দু গাল ভরে আলতো চুমু এঁকে দেয়। তখনই সিড়ি বেয়ে নেমে আসে তুশীর বাবা সমর্পণ। সমর্পণ নিজের স্বভাবসুলভ
ভঙ্গিতে ওদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,
– কী হচ্ছে এখানে? এতো আদর ভালবাসার বন্যা বয়ে চলেছে। শেষে তো দেখা যাবে আমার ভাগে কম পরছে।
তুশী ফের গাল ফোলায়। সোনালির পেটে মুখ ঘসতে ঘষতে বলে,
– ফুপ্পিয়া দেখো না বাবা আবার আমায় হিংসে করছে।
নিঝুম, সোনালী, সমর্পণ একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অতঃপর সকলে একসঙ্গে হেসে ওঠে। তুশীর অভিমান গাঢ় হয় ওদের এমন হাসতে দেখে। কোথায় মা আর ফুপ্পি বাবাকে আচ্ছা করে বকে দেবে তা না করে হাসছে? তুশী মন খারাপ করে দৌড়ে সিড়ি কাছে চলে যায়। পেছন ফিরে এক পলক তাকিয়ে বলে,
– তোমরা সব্বাই ভীষণ পঁচা।
তুশী সোজা হয়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে চলে যায়। পেছন থেকে সকলে ডাকে কিন্তু সে শোনে না। মেয়েটা এমনই ভীষণ অভিমানী। আবার একটু পর মন ভালো হয়ে গেলে নিজে থেকেই চলে আসবে। নিঝুম হতাশ হয়ে বলে,
– চিন্তা করবেন না স্যার। ও একটু পরই চলে আসবে।
– হুম
– আহ ভাবিমনি তুমি আবার ভাইয়াকে স্যার বলছ। এটা তো তোমাদের অফিস টাইম নয়।
– মৌটুসী আমি এভাবেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। হয়ে যায় আরকি৷
– প্রবলেম নেই। নিঝুম এভাবেই ডাকুক। ইনফেক্ট ওর এই অলওয়েজ স্যার, স্যার করাতে আমি ভেতর থেকে সর্বদা স্ট্রং থাকি। বাড়িতে থেকেও কাজের এনার্জি পাই।
– থাক থাক হয়েছে এবার আবার তোমরা তোমাদের কাজ নিয়ে পড়িও না। খেতে চলো সবাই।
সোনালীর কথায় সমর্পণ কিছু একটা চিন্তা করে বলে,
– ওহ হ্যাঁ ভালো কথা মনে পড়ল! নিঝুম তুমি কী আজ লেট করে বেরবে?
– নাহ স্যার নাস্তা সেরেই বেড়িয়ে যাবো।
– ওহ গুড! আমার একটা ইম্পর্টেন্ট ডিসকাশন আছে তোমার সঙ্গে। তুমি ক্যাম্পে গিয়ে একবার আমার কেবিনে মিট করে যেও।
– জ্বি স্যার অবশ্যই।
অতঃপর সকলে নাস্তা করতে যায়। খেতে খেতে নিঝুম বলে,
– মৌটুসী আমার আইসক্রিম?
– এগুলো ফ্রিজে তুলে রেখেছি। নাস্তা সেরে খেয়ে নিও।
– ওহ গুড গার্ল
সমর্পণ খাওয়া ফেলে নিঝুমের দিকে তাকায়। স্থির কন্ঠে বলে,
– মাঝে মাঝে আমি এটাই ভেবে বসি তুমি তুশীর থেকে মেইবি ছোট হবে বয়সে। এমন পাগলামি কখনো তুশীকেও করতে দেখি নি।
নিঝুম লজ্জা মাখা হাসি দেয়। তা দেখে সমর্পণ, সোনালী দুজনেই মৃদু হাসে।
দেওয়ালে টাঙানো বড় ছবিটিতে দৃষ্টি আবদ্ধ করে রেখেছে সমর্পণ। দৃষ্টি স্থির। মন অশান্ত। তবুও অশান্ত মনটাকে বেঁধে রাখতে কোনো রকম ত্রুটি সে রাখে না। শত হোক তুশী বড় হচ্ছে। ওর সামনে কখনো তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। সমর্পণের আকাশ-পাতাল চিন্তার মধ্যেই দরজায় টোকা পড়ে। সে ছবিটির কাছ থেকে সরে এসে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
– কাম ইন
সঙ্গে সঙ্গে নিঝুম হুড়মুড়িয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে। হাত ঘড়িটি সেট করতে করতে ব্যস্ত কন্ঠে বলে,
– আপনার হয়েছে লেট হচ্ছে তো। আমি কিন্তু তৈরি।
সমর্পণ নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। টেবিল থেকে কিছু ফাইল পত্র তুলতে তুলতে বলে,
– হ্যাঁ চলো।
– হুম হুম
—————–
– মে আই কাম ইন, স্যার?
– ইয়েস, কাম ইন।
– কিছু একটা ইম্পর্ট্যান্ট দরকার আছে বলেছিলেন?
– হুম বলছি আগে বসো।
নিঝুম চেয়ার টেনে বসে। সমর্পণ হাতের একটা ফাইল নিঝুমের দিকে এগিয়ে দেয়। নিঝুম ফাইলটি হাতে নেয়। সমর্পণ চেয়ার হেলান দিয়ে আরাম করে বসতে বসতে বলে,
– ওটা দেখো
নিঝুম কৌতুহল বসত ফাইলটি খোলে। পুরো ফাইলটা খুব মনোযোগ সহকারে চেকিং করে। হঠাৎই নিঝুমের বুকটা ধক করে ওঠে। পুরোনো স্মৃতি ইশারায় ডাক দিয়ে যায়। মনকে শক্ত করে সে সমর্পণের দিকে করুণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সমর্পণ সেদিকে তোয়াক্কা না করে বলে,
– এই কেসটা তোমাকে হ্যান্ডেল করতে হবে নিঝুম। দিস ইজ মাই অর্ডার।
নিঝুম ততক্ষণাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ায়। কৌতুহলী দৃষ্টি নিয়ে ভরাট কন্ঠে বলে,
– এটা আপনি কী বলছেন স্যার? সবকিছু জেনে শুনে আমার সঙ্গে এমনটা আপনি কী করে করতে পারেন?
সমর্পণ হতাশার নিশ্বাস ফেলে বলে,
– আ’ম হেল্পলেস নিঝুম। তুমি তো জানোই আমি খালামনির প্রতি ঠিক কতটা দুর্বল। সে আমার থেকে কিছু চেয়েছে আর আমি তাকে ফিরিয়ে দিবো এটা কী করে হয়?
– কিন্তু স্যার এরজন্য তো আমাকে সাফার করতে হবে। প্রতিবার সকলের প্রয়োজনে কেন আমাকে ব্যাবহার করা হয়?
– এটা তোমার ডিউটি নিঝুম। ডিউটিকে এভাবে নিজের পার্সোনাল লাইফের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না। মনে রাখবে তোমার ডিউটিতে মুল লক্ষ্য নিজেকে স্ট্রং রাখা। যেটা আমি তোমাকে এই চার বছর ধরে প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছি। এবার আমার গুরুদক্ষিণা চাই নিঝুম। তোমাকে প্রুভ করে দিতে হবে আমি ট্রেনার হিসেবে ঠিক কতটা পার্ফেক্ট। আমার ছাত্রী হিসেবে তুমি কতটা পার্ফেক্ট। কী পারবে তো নিঝুম?
সমর্পণের কথা গুলো চরম গতিতে মস্তিষ্কে হানা দিতে লাগল নিঝুমের। হ্যাঁ অবশ্যই নিঝুম পারবে! তাকে পারতেই হবে। সে তো দুর্বল নয়। সময় এসেছে অন্যায়ের বদলা নেওয়ার। অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার। সে এই দেশের বুক থেকে অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করতে সদা প্রস্তুত। সে দেশের কাছে ওয়াদা বদ্ধ সব রকম পরিস্থিতিতে সে দেশের হয়ে লড়াই করবে। তাহলে এখন কেন পিছু হটবে? কখনোই না! নিজের পার্সোনাল লাইফের সঙ্গে প্রফেশন গুলিয়ে ফেলার মতো ভুল নিঝুম করবে না। সে গভীর থেকে গভীরতর একটা তপ্ত নিশ্বাসের সঙ্গে ভেতর থেকে নিজেকে তৈরি করে নিল। অতঃপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
– ইয়েস স্যার, আমি পারব। নিঝুম প্রমাণ করে দেবে আপনার শিক্ষা এবং তার মনোবল কোনটাই ঠুনকো নয়। নিঝুম ভাঙবে তবু মচকাবে না। পৃথিবীর বুক থেকে অপরাধীদের নিশ্চিহ্ন করে তবেই আমার শান্তি। এতে যদি আমার ম’র’ন ও লেখা থাকে তবে তাই সই।
– গুড গার্ল। এমন মনোবলই তোমার থেকে গ্রহণ যোগ্য। ওকে! তবে এখন নিজের কাজে ফোকাস করো। নেক্সট উইকে আমরা ঢাকা শিফট হচ্ছি।
– ওকে স্যার! নাও আই ক্যান গো।
– সিওর
নিঝুম ফাইলটার দিকে এক পলক তাকিয়ে জোর কদমে হেঁটে চলে যায়। সমর্পণ সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস টেনে মিনমিনিয়ে বলে,
– আমার হাতে কিচ্ছু নেই নিঝুম। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো খালামনির মনের ইচ্ছে পূরণ করার।এখন সময় এসেছে সবকিছুর হিসেব বুঝে নেওয়ার। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছে।
—————–
– ইহান ইহান কোথায় তুই? তুই কী আবার নিজেকে ঘরবন্দী করতে চাইছিস? আচ্ছা এভাবে আর কতদিন চলবে?
– যতদিন না আমার ম’র’ন হচ্ছে ততদিন।
অন্ধকারাচ্ছন্ন বেলকনিতে থেকে ভেসে এলো অসহায়ত্ব কন্ঠ। অনিলা খান আঁতকে উঠলেন ছেলের এরুপ বাক্যে। কোনো রকমে অশান্ত মন নিয়ে হাতড়ে হাতড়ে ঘরে প্রবেশ করলেন তিনি। হাতড়ে হাতড়ে চলে গেলেন বেলকনিতে। এখন অমাবস্যা তিথি তাই আকাশে ঘোর অন্ধকার বিরাজমান। সেই আঁধার ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বুকে। পৃথিবীর বুকে অবস্থিত ইহানের ছোট্ট বেলকনিতে। অনিলা খান ছেলেকে আবছা আলোয় উপলব্ধি করতে পারলেন। তিনি ধীর কন্ঠে বললেন,
– এমন করে বলিস না বাবু। তোর বাবার মৃত্যুর পর থেকে তো তোর মনোবলেই বেঁচে আছি আমরা। কিন্তু এই চারটে বছর ধরে এ কোন দোটানায় ভাসছি আমরা বল। তুই তো এখনো কিছু খোলাসা করে বললেই না কখনো। পুলিশের চাকরি টাও ছেড়ে দিলি। এভাবে কী আর জীবন চলে। কত দিন এমনটা চলবে বল? কতদিন?
অনিলা খান আঁচলে মুখ চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ইহান বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করল। অনিলা খান বুঝতে পারলেন ছেলে তার রেগে যাচ্ছে। তিনি সেই অবস্থায় ফের হাতড়ে হাতড়ে বেড়িয়ে গেলেন রুম থেকে। এটা নতুন নয় এই চারটি বছর ধরে এভাবেই হয়ে আসছে।
অনিলা খান চলে যেতেই ইহান ওই অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি মেলায়। বিড়বিড় করতে করতে বলে,
– ওই আকাশটার সঙ্গে আমার জীবনের ব্যাপক মিল। একজন আমাকে ঠকালো আর একজনকে আমি ঠকালাম। আমিও বিবেক বিবেচনা না করেই প্রতিশোধ নেশা এবং ডিউটির সীমারেখায় চরম ভুল করে বসলাম। হেলায় হারালাম অমূল্য কাছে থাকা রত্নটি।
আপন মনে সারারাত বিড়বিড় করতে করতেই পার করে দেয় ইহান। এভাবেই প্রায় প্রত্যেকটি রাত কাটে তার।
—————–
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি