#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ),(পর্ব-৩)
————
“হেই বেইবি,, ইউ নো দ্যাট ইউ আর লুকিং সো প্রীটি?”
ইশানের কথা শুনে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল তুশী। এতো ভারি কথার মিনিং সে কিছুই বুঝল না। ইশান ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আলতো হাতে তুশীর গাল টেনে দিল। সোনালীর দিকে ইশারা করে বলল,
“ইওর মাম্মা ইজ গুড টু”
তুশী এবার হয়তো কিছু একটা বুঝল। সে ফুলো ফুলো গাল দুটো প্রসারিত করে বলল,
“ওটা আমার মাম্মা নয় আমার ফুপ্পিয়া”
ইশান যেন এটা শোনারই অপেক্ষায় ছিল। মেয়েটিকে দেখে আগেই সে বুঝতে পেরেছিল বেবিটা তার নয়। বিবাহিতা -অবিবাহিতার পার্থক্য উপর থেকে দেখেও অনেকটা বোঝা যায়। তবুও শিওর হওয়ার জন্য তুশীকে ওভাবে বলেছে সে। ইশান তুশীর সঙ্গে আরও টুকটাক কথা বলছে। ততক্ষণে সোনালীর স্ন্যাক্স কেনা শেষ। পাশ ফিরে তুশীকে অপরিচিত যুবকের সঙ্গে কথা বলতে দেখে কিঞ্চিৎ রাগ হলো তার। দ্রুত পায়ে ওদের দিকে হেঁটে এসে চিলের মতো ছো মে’রে তুশীকে নিজের দিকে টেনে নিল। ঘটনাচক্রে ইশান, তুশী দুজনেই হতভম্ব। ইশান কিছু বলার পূর্বেই সোনালী কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“এই যে মিস্টার,, কী এতো কথা বলছিলেন ওর সঙ্গে? জানেন না অপরিচিত লোক হয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি কথা বলতে নেই?”
“নাহহহ জানতাম না তবে এখন জেনে নিলাম।”
ইশানের কথায় যেন গা জ্বলে উঠল সোনালীর। সে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালো ওর দিকে। অতঃপর তুশীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল। তুশী সোনালীর হস্ত বন্ধনে থাকা অবস্থায়ও পেছন ফিরে বার কয়েক ইশানকে দেখে নিল। ততক্ষণে সোনালী তাকেও শাসাচ্ছে,
“বাড়ি গিয়ে তোমার হচ্ছে দাড়াও। তুমি কেনো দূরে গেলে?কেন কথা বললে ওই ছেলেটির সঙ্গে?”
এদিকে ওরা চলে যেতেই ইশান আনমনেই হেসে ফেলে। সিগারেট কিনতে এসেই সোনালীর ওপর চোখ পড়ে তার। তুশী থেকে নামটাও জেনে নিয়েছে। কিন্তু এড্রেস বলতে পারে নি তুশী। সোনালীর মায়াবী মুখশ্রীটা অদ্ভুত ভাবে তাকে ভীষণ রকম আর্কষণীত করেছে। মেয়েদের সঙ্গে ফ্লার্ট করা তার পূর্বকার অভ্যেস হলেও সোনালীকে দেখে কেমন জানি একটা মায়া বিরাজ করছে তার মনে। সেখানে ছলনার কোনো জায়গা নেই। কথায় আছে না,” লাভ এ্যাট ফার্স্ট সাইড” অনেক টা সে রকম। কিন্তু ইশান এসব মন থেকে মানতে চাইছে না তবুও মনের সঙ্গে যুদ্ধে পেরেও উঠছে না।
—————–
“আরে ইহান যে এসো এসো।”
“জ্বী স্যার।”
“তো বলো কেমন আছো এখন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। স্যার একটা কথা! আসলে আমি কাল থেকে ডিউটিতে ব্যাক করতে চাইছি। ছুটির ডেট এখনো শেষ হয়নি তবুও আমি চাইছি কাল থেকে জয়েন করতে। আমার মনে হয় আমি এখন টোটাল ফিট আছি।”
“ওকে ওকে ওকে মাই সন! তুমি তাহলে কাল থেকেই জয়েন হয়ে যাও। আর কাল তবে তোমাকে একজনের সঙ্গে ইন্ট্রডিউস করিও দিবো কেমন।”
“কে সে?”
“খুব বিশেষ কেউ। কালকেই না হয় বলি।”
“ওকে স্যার তবে আমি এখন উঠি।”
“ওহ! শিওর।”
————
বেশ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে থানার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ল নিঝুম। মনটা আজ কেমন কেমন জানি করছে। মনে হচ্ছে বড় কিছু হতে চলেছে। অস্থিরতা দমাতে না পেরে সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি হয়ে হাজির থানায়। নিঝুম সিনিয়র অফিসার খোরশেদের সঙ্গে কেসের বিষয়ে কথা বলতে ব্যস্ত ঠিক তখনই দরজার কড়া নাড়ে কেউ। অফিসার খোরশেদ সেদিকে মনোযোগ দিয়ে বলেন,
“কাম ইন”
ততক্ষণাৎ ভেতরে প্রবেশ করে ইহান। ইহানকে দেখে খোরশেদ আনন্দিত কন্ঠে বলেন,
“এসো এসো ইয়াং ম্যান। গতকাল বলেছিলাম না তোমার সঙ্গে একজনকে ইন্ট্রডিউস করিয়ে দিবো। এই দেখো সে এসে গেছে।”
“জ্বি স্যার আমি অতি আগ্রহী।”
ইহানের মন্তব্যে চমকে ওঠে নিঝুম। সে এতক্ষণ ইহানের উল্টো দিকে ঘুরে ছিল। এখনো সেভাবেই আছে। যার ফলস্বরূপ এখনো কেউ কারো মুখ দেখে নি। নিঝুম বুঝতে পারছে না এখন তার কী করা উচিত। পেছনের মানুষটি যে
ইহান এ বিষয়ে সে শতাধিক নিশ্চিত। কিন্তু কথা হলো ইহান তাকে দেখার পর ঠিক কীভাবে রিয়েক্ট করবে এটাই। ততক্ষণে অফিসার খোরশেদ ইহানকে চেয়ারে সিট নিতে বলল। ইহান বসে গেল নিঝুমের পাশের চেয়ারটি টেনে। নিঝুম এবার জড়সড় হয়ে বামপাশ ফিরে বসল। ইহান একটু অবাক হলো। এমন ব্যবহার সে আশা করছে না। পরপরই অফিসার খোরশেদ নিঝুমকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“মিসেস নিঝুম এই হলো মিস্টার ইহান। এনার কথাই বলেছিলাম আপনাকে। আপনি তো ইহানের বাবার মৃত্যু রহস্যের তদন্তেই আছেন বর্তমানে।”
নিঝুম নামটি শোনা মাত্র জ্বলে উঠল ইহানের অন্তর। এতক্ষণ খোরশেদের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি দেওয়া চক্ষুযুগল এখন অতি উদাসীনতায় চেয়ে আছে কিছুটা দুরত্ব বসে থাকা চেনার মতো অপরিচিতার দিকে। ইহান অতি আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। কিন্তু নিঝুম! সে তো ফিরতে চেয়েও পারছে না। এতগুলো বছর পর এই মানুষটির মুখোমুখি হওয়া ওপরে ওপরে সহজ হলেও অন্তস্থল থেকে বিরাট কঠিন। নিঝুমকে ফিরতে না দেখে অফিসার খোরশেদ বললেন,
“মিসেস নিঝুম এনিথিং রং? আপনি এমন করছেন কেন?”
নিঝুম ভেতর থেকে জোর নিশ্বাস টেনে নেয়। অতঃপর নিজেকে স্বাভাবিক করে সটান হয়ে দাড়িয়ে ইহানের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।
“হ্যালো মিস্টার ইহান আ’ম নিঝুম আহসান।”
ইহানের যেন হাত এগোচ্ছে না। কন্ঠনালী কাঁপছে ভীষণ। কিছু বলতে নিয়েও পারছে না। লেডিস শার্ট, লেডিস প্যান্ট, চোখে চশমা, হাতে ঘড়ি, চুলগুলো কার্লিং করে উঁচুতে উঠিয়ে ঝুটি করা, সামনের কিছু চুলে কালার করা। এ কোন নিঝুম। সবথেকে বড় কথা হলো এতটা স্ট্রং পারসোনালিটি কোথায় পেল সে। কীভাবে স্ট্রিক্ট হয়ে কথা বলছে ইহানের সঙ্গে। কই ইহান তো পারছে না। তবে সে কী করে পারছে। আচ্ছা সে নিজেকে আহসান কেন বলছে? ইহানের সঙ্গে তো তার ডিভোর্স হয়নি তবে তার তো নিঝুম খান হওয়ার কথা তাহলে আহসান কেন? এতগুলো বছর কোথায় ছিল সে? কীভাবে এতকিছু হলো?
আনমনা ইহানকে ফের বাজিয়ে দেয় নিঝুম,
“কী এতো ভাবছেন মিস্টার। আমি কিন্তু এবার অপমান বোধ করছি। বাই দি ওয়ে, আপনি কোনো ভাবে আমার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে অনিচ্ছুক নয়তো? ওকে ডান! আমি উইথড্র করছি আমার হ্যান্ডশেক।”
ততক্ষণাৎ নিঝুম হাত নামিয়ে নিতে গেলে ইহান তড়িঘড়ি করে নিঝুমের হাতে হাত মেলায়। অনুতপ্ত হয়ে বলে,
“সরি, সরি! আমি আসলে একটু অন্য মনস্ক ছিলাম। এগেইন সরি।”
“ইট’স ওকে।”
অফিসার খোরশেদ এদের কর্মকাণ্ডে হেসে কুটিকুটি। তিনি আবার অধিক রসায়ন সত্তার মানব। এদিকে হ্যান্ডশেক শেষে নিঝুম অফিসার খোরশেদকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“স্যার আমাকে এখন উঠতে হবে। আমি এই সাবজেক্টটা নিয়ে আগামীকাল কথা বলে নিবো। এখন আপাততঃ ক্যাম্পে যেতে হবে। ওখানে জরুরি কাজ আছে।”
খোরশেদ খুব সাচ্ছন্দ্যে নিঝুমকে বিদায়ের পারমিশন দিয়ে দিলেন। ইহান বেশ বুঝতে পারছে নিঝুম তাকে ইন্ডাইরেক্টলি অপমান করতে চাইছে। কিন্তু এখন তার হাতে কিছুই নেই। তবে সেও আবরার খান ইহান। সব রহস্য বের করে তবেই ছাড়বে।
—————-
একমাত্র অনিলা খান ছাড়া আর কাউকেই আজকের ঘটনা জানায় না ইহান। কিন্তু অনিলা খান হু হা ছাড়া তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। ইহান বেশ বিরক্তি নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করে। এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে তার মা কী করে এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারে। লাইক সিরিয়াসলি!!
ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয় ইহান। মনটা অনেক দিন পর কিছুটা শান্ত হয়েছে। তা শুধুমাত্র নিঝুমের দর্শনে। আবার অস্থিরতাও বেড়েছে অনেক। নানারকম প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু উত্তর জানতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে নিশ্চয়ই। নিঝুমের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে হবে খান বাড়িতে। এত কঠিন কাজ তো আর এতো সহজে সাধন হবে না।
—————–
বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে ইশান। মনটা তার আজ ভীষণ চঞ্চল। সবকিছু কেমন অস্থিরতায় পরিপূর্ণ লাগছে। ছুট্টে গিয়ে তার নাগাল পেতে মন চাইছে। এ কেমন অনূভুতি? অথচ যার জন্য তার এতো উচাটন সে এসবের কিচ্ছুই জানে না। সে তো দিব্বি তার মতো ভালো আছে। ইশানের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়ে সে আছে মহা সুখে।
বেলকনির সিঙ্গেল দোলনাটায় বসে থেকে আনমনে আকাশপানে চেয়ে আছে ইরা। বিষন্ন মনে রোজের চলাচল এই তীব্র যন্ত্রণার। চার বছর আগে হারিয়ে যাওয়া যুবকরুপী প্রেমিক পুরুষের সন্ধান সে আজও পায়নি। পায়নি সেদিন ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা। কোথায় চলে গেল সে? কেন গেল? আর কী তবে কোনো দিন ফিরবে না? নাহ!ভাবা যাচ্ছে না এসব। তীব্র কষ্ট হানা দেয় হৃদয়ে। বুক চিড়ে ফালিফালি হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়ে।
—————
চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি