কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ),(পর্ব – ৪)

0
965

#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ),(পর্ব – ৪)

————–
অফিসার খোরশেদের কথা শুনে নিঝুম বেশ বিরক্ত হলো। “এই কেসে ইহানের সঙ্গে তাকে কাজ করতে হবে,”এটা কেমন কথা? সে যখন একাই এই দ্বায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে সেখানে আবার অন্য কাউকে নিতে হবে কেন? এদিকে ইহান তো মহা খুশি। সে তো মনে মনে এটাই চাইছিল। টুকটাক ডিসকাশন শেষ করে নিঝুম বেড়িয়ে যায় থানা থেকে। ইহানও পিছু নেয় নিঝুমের।
————–

” ঝুম….. ”

তীব্র আর্তনাদ মাখা কন্ঠে থমকে দাড়ায় নিঝুম। পায়ের নিশ্চল গতি। পিছু ফেরে না। ফেরার প্রয়োজন মনে করছে না। তীব্র অগ্রাহ্য করতে চাইছে। কিন্তু ওই যে ওই আর্তনাদ তো পুরোপুরি উপেক্ষা করার নয়। “ঝুম” এ নামে কেবল অদিতি তাকে ডাকত। আর আজ ইহান ডাকছে। এই দুজন ব্যক্তিকেই সে চরম ঘৃণা করে। দুজনেই স্বার্থপর। তাকে চরম ভাবে ঠকিয়েছে। অদিতি এবং ইহান দুজনেই নিজের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করেছে। ইহানের জন্যই তার জীবন মা’রা’ত্ম’ক ঝুঁ’কির মধ্যে ফেঁসে গিয়েছিল। ম’র’তে ম’র’তে বেঁচেছে। সেদিন যদি সমর্পন না থাকত? তাহলে নিজের পরিণতি ভেবেই আঁতকে উঠে নিঝুম। চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে। ঝাপসা লাগে চতুর্দিক। গলায় পেঁচানো জরজেট ওড়নার কোণ দিয়ে খুব সন্তর্পণে চোখের পানি মুছে নেয় সে। নিজের দুর্বলতা আর কারো সামনে প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক সে। অতীতের পাতা ঘাটলে মনটা বি’ষি’য়ে ওঠে। মূহুর্তেই নিজেকে শক্ত আবরণে আবৃত করে নেয়। কঠিন ভঙ্গিতে পেছন ফিরে তাকায়। কাঠ কাঠ গলায় উত্তর দেয়,

“ফার্স্ট অফ অল, আ’ম নিঝুম, নট ঝুম। এন্ড ইউ হ্যাভ নো রাইট টু কল মি লাইক দ্যাট।”

ইহান থতমত খেয়ে যায়। করুন সুরে কিছু বলতে নিবে তার আগেই নিঝুম হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,

“প্লিজ স্টপ ইউর ড্রামা। আই ওয়ান্ট টু গো নাও।”

নিঝুম চলে যেতে পা বাড়াতেই ইহান হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে গিয়ে নিঝুমের সম্মুখে দাড়ায়। হাত জোর করে অনেক আকুতি মিনতি করে কিছু কথা বলার জন্য কিন্তু নিঝুম শুনতে নারাজ। সেই মুহূর্তে প্রকৃতিও ওদের সঙ্গে মেতে উঠে মান-অভিমানের খেলায়। নিঝুমের মান ভাঙাতে যেমন ইহান ব্যাকুল তেমনই তীব্র তাপ সম্পন্ন সূর্য যখন অভিমানে নিজেকে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে নেয় তখন সেই মান ভাঙাতে ব্যস্ত থাকে অজস্র মেঘরাশি। তাদের সেই মান অভিমানের খেলা প্রকৃতির বুকে ঝড়ে পড়ে বৃষ্টি হয়ে। আজও ঠিক তাই হচ্ছে। পশ্চিমাকাশে আগে থেকেই তীব্র মেঘের আনাগোনা। হঠাৎ করে গগনের বক্ষ চিঁড়ে প্রবল বারিধারা সিক্ত করে তুলছে ধরনী। সেই বর্ষণে সিক্ত হয়ে উঠছে দুজন নর-নারীর অন্তরীক্ষ। বৃষ্টির পানির সঙ্গে চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে মিলন খেলায় লিপ্ত হয়েছে।

“পথ ছাড়ুন।”

“যদি না ছাড়ি?”

“ভুল করছেন।”

“তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমার ক্যারেক্টর। নম্রভাবে কথা বলছি বলে অতিরিক্ত করছ।”

“আর আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আমার পরিচয়। আমিও কিন্তু আর আগের ক্যারেক্টর বহন করছি না।”

“তুমি যেমনটাই হতে চেষ্টা করো না কেন আমার কাছে তুমি সেই আগের নিঝুমই থাকবে। কারণ আমি তোমাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, খুব করে চিনি, খুব করে জানি। তুমি শুধু আমার নিঝুম। একান্তই আমার ব্যক্তিগত।”

নিঝুম তাচ্ছিল্য হাসে। তুচ্ছ কন্ঠে বলে,

“তাই বুঝি? তা কোথায় ছিল চার বছর আগে আপনার এই সো কোল্ড অনুভূতি? যখন আমি স্ত্রী রুপে আপনার পেছন পেছন তৃষ্ণার্থ প্রেয়সীর মতো ঘুরে বেড়াতাম। দিনরাত ভালবাসি, ভালবাসি বলতাম। আপনার যাবতীয় টেক কেয়ার করতাম। পাগলের মতো আপনাকে চাইতাম। কিন্তু আপনি তো শুধু আমাকে ইউজ করে গেছেন। দিনকে দিন পায়ে পিষেছেন আমার ভালবাসাকে। আপনার জন্য আমি ম’র’তে ম’র’তে বেঁচেছি। আর কী চাই আপনার? ধোঁকা দিয়েছেন আমায়। দিনরাত ঠকিয়ে গেছেন। এখন আবার নতুন করে কী স’র্ব’না’শ করতে এসেছেন আমার?”

“হুম সবকিছুই মেনে নিলাম। বাট সবকিছুর পরে শুধু একটি কথাই বলবো ঝুম ” ভালবাসি, ভালবাসি, ভালবাসি।”

“তাই তা কী করে উদয় হলো এ-ই ভালবাসা?”

” এভাবে বলো না ঝুম। তুমি হয়তো সেদিন একটু খেয়াল করলেই সবটা ধরতে পারতে। তোমার ছোট্ট ছোট্ট পাগলামি গুলোতে দিনকে দিন আমি অভস্ত্য হয়ে গিয়েছিলাম। সেই অভ্যেস ধীরে ধীরে ভালবাসায় রুপান্তরিত হতে বেশি সময় নেয় নিয়ে। আমি তোমাকে অনেক বার একসেপ্ট করতে চেয়েছি কিন্তু ওই যে অপরাধ বোধটা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে বারংবার। যততবার তোমাকে কাছে টানতে চেয়েছি মনে হয়েছে আমি কোনো পাপ করছি। তোমাকে আমার অতীত না জানিয়ে বেশি দুর এগোনো ঠিক হবে না। অবশেষে তুমি সবটা শুনেই নিলে আমার থেকে। জানো সেদিন রাতে কতটা কী প্ল্যানিং করেছিলাম। ভেবেছিলাম পরদিন খুব আয়োজন করে তোমাকে প্রপোজ করবো।তারপর দুজনে মিলে সুখের পৃথিবী তৈরী করবো।এসব দেখে তুমি কতটা খুশি হবে ভেবে নিজেই আনন্দিত হচ্ছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক ছিল কিন্তু তুমি ঠিক ছিলে না। পরদিন সকালটা সুন্দর হওয়ার বদলে ডুবে গেল ঘন কালো অন্ধকারে। তোমাকে হারিয়ে ফেললাম আমি। তারপর থেকে পাগলপ্রায় আমার দশা। সবকিছু থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলাম। ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম অনেক টা। অপরাধ বোধ, পেয়ে হারানোর কষ্টে নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছিলাম। কাজ থেকে নিয়েছিলাম লম্বা বিরতি। অবশেষে হঠাৎ সেদিন তোমার আবছা অবয়ব দেখতে পাই হাই রোডে। তারপর থেকে নিজেকে গুছিয়ে নেয়। ফিরে যাই কর্মক্ষেত্রে। ভাগ্যের পরিহাসে দেখা মেলে তোমার সঙ্গে। দু’জনে ফের মুখোমুখি। কিন্তু ভিন্নতা আকাশচুম্বী।”

বৃষ্টির বেগ আরও তীব্র রুপ নিয়েছে। নিঝুম সমানে চোখের জলে ফেলছে। খুব করে ইচ্ছে করছে ইরানের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে কিন্তু পারছে না। কোনো এক অদৃশ্য দেয়াল রোধ করছে তার অন্তর রাস্তা। ইহানও কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। নতমস্তকে দাড়িয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। নিঝুম বৃষ্টির মধ্যেই ছুট লাগায়। এক মুহূর্ত দাড়ায় না। চোখ দিয়ে অজস্র জলরাশি উপচে পরছে তো পরছেই। থামার কোনো নাম নেই। ইহান হতাশ হয়। নিঝুম কিছু না বলেই চলে যাবে ভাবতে পারে নিয়ে। পেছন থেকে অনেক করুণ কন্ঠে আরেক বারের মতো ডেকে বসে,

“ঝুমমমম……….”

নিঝুম থমকে দাঁড়ায়। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে থমথমে কন্ঠে আবৃতি করে,

“কাঁচের গায়ে বৃষ্টি ফোঁটা
জলছবি আর আঁকবে না
জমানো অনেক মনের কথা
থাক তুমি তার বুঝবে না

অনেক দিয়েছ যন্ত্রণা মনে
এবার না হয় কিছু গ্রহণ করো সাদরে
পারো যদি করতে প্রমাণ
খুলবে তবে মনের দুয়ার
দেখাও দেখি কেমন পারো
মনের প্রাচীর তবে ভাঙো”

—————
এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে নিহান। তবে চার বছর আগে যে বাড়ি থেকে বেড়িয়েছিল আজ সেখানে যযাচ্ছে না। আজ যাচ্ছে তার নিজের সৎ পথে উপার্জিত অর্থে তৈরি ভবনে। যেটাকে কেন্দ্র করে সে বিগত চার বছর ধরে নানারকম স্বপ্নের জাল বুনেছে ভিনদেশে থেকে। আর সেই স্বপ্নের প্রতিটি ধাপ শুরু হয়েছে ইরাকে জড়িয়ে। হ্যাঁ এ-ই চার বছর নিহান বিদেশে ছিল নিজের ক্যারিয়ার গড়তে। চার বছর আগে ইরানের বলা কথা গুলো সে তলিয়ে দেখেছে। অতঃপর তার ইরাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য একটু স্যাকরিফাইস করেছে মাত্র। এ কথা কেউ না জানলেও ইহান জানত। নিহান যযাওয়ার আগে ইহাকে সবটা বলে গিয়েছিল। আজ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে। ইরাকে সে নিজের করে নেবে। নেবেই!!

—————-
“নিঝুম আগামীকাল আমাদের একটি ইম্পর্টেন্ট ইনভাইটেশন আছে। তুমি তৈরি থেকো। এই ইনভাইটেশনে আমাদের অনেক জরুরি ক্লু পেতে পারি।”

সমর্পণের কথায় নিঝুম খাবার মুখে তুলতে তুলতে প্রশ্ন করে,

“ওহ তাই। তো কোথায় শুনি?”

“আহসান মঞ্জিলে।”

নিঝুমের হাত থেকে কাটা চামচটি পড়ে যায়। চেহারায় বিষন্নতা স্পষ্ট। সমর্পণের খাওয়া শেষ। সে উঠে গিয়ে নিঝুম কাঁধে হাত রাখে। কনফিডেন্সলি বলে,

“বি স্ট্রং এন্ড টেক কেয়ার অফ ইওর সেল্ফ। উইল সি সামথিং বেটার ইন দ্যা ফিউচার।

—————–

চলবে,
সাদিয়া আফরিন নিশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here