#কাঁচের_গায়ে_বৃষ্টি_ফোঁটা? (দ্বিতীয় পরিচ্ছদ),(পর্ব-৬)
————–
ইরার চোখে মুখে আজ প্রবল খুশির ঝিলিক। মেয়েটাকে আজ একটু বেশিই প্রাণবন্ত লাগছে। অহেতুক মিটিমিটি হাসছে। গুনগুনিয়ে গাইছে। ইহান মনে মনে খুশি হয়। সে জানে ইরার এই খুশির কারণ। নিহান ইরার কাছে যাওয়ার আগে ইহানের সঙ্গে মিট করে গেছে। ইহানই নিহানকে ইরার অবস্থান বলে দিয়েছিল। নিহান যাবে বলে ইহান আর গাড়ি পাঠায়নি। নয়তো তার আদরের বোনের জন্য কখন গাড়ি পাঠিয়ে দিতো। ইহান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যাক, অবশেষে একজন অন্তত সুখের মুখ দেখতে চলেছে!!
বরাবরের মতো অনিলা খানের ঘর থেকে ফোনে কথা বলার আওয়াজ ভেসে আসছে।সেই আওয়াজে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে সারাবাড়ি পায়চারী করা ইরার পা অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যায়। এটা নতুন নয় নিঝুম চলে যাওয়ার পর থেকেই সে এমনটা প্রায়শই লক্ষ করেছে। তার মা ঘরবন্দী হয়ে লুকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলে। সে এ বিষয়ে বারকয়েক জিজ্ঞাসাবাদ করেও লাভ হয়নি। অনিলা খান খুব সন্তপর্ণে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। ইরা ভাবছে আর নয় আজকে সে আড়ি পাতবে মায়ের ঘরে। যদিও তা অন্যায় তবুও এভাবে আর কতদিন?তাদেরও তো অধিকার আছে তার মায়ের ব্যাপারে সবটা জানার।
খুব সন্তপর্ণে দরজায় কান লাগিয়ে দাড়িয়ে পরল ইরা। ঘরের মধ্যে থেকে ভেসে আসা অস্পষ্ট শব্দ গুলো এবার পুরোপুরি স্পষ্ট ভাবে ভেসে আসছে তার কর্ণে। কিন্তু ভেতর থেকে যা শোনা গেল তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। তার মা বারংবার “নিঝুম” নামটি ধরে সম্মোধন করছে। কথা গুলো এমন, ‘এই নিঝুম কী হলো থেমে গেলি কেন, এই নিঝুম জানিস ইহানটা না বড্ড বদলে গেছে, এই তুই এবার একেবারের জন্য আমার কাছে ফিরে আয় না মা।’
আরও অনেক অনেক কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে। ইরার পক্ষে সেখানে দাড়ানো আর এক মুহূর্ত সম্ভব হলো না। সে ছুট্টে ইহানের রুমে চলে গেল। ইহান তখন সবেই বাহিরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। ইরা ইহানের সামনে এসে হাঁপিয়ে চলেছে অবিরত। ইহান সেদিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী হয়েছে এভাবে হাঁপাচ্ছিস কেন?”
ইরা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে বলল,
“তো কী করবো। খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তোমার সঙ্গে।”
“হ্যাঁ তো বলে ফেল। আমি একটু বেড়বো।”
“ভাইয়া বউমনি সত্যিই বেঁচে আছে। আমি মাকে বউমনির সঙ্গে ফোনে কথা বলতে শুনেছি।”
ইহান প্রথম কথাটা স্বাভাবিক নিলেও পরবর্তী কথাটি শুনে একটু থমকায়। তার মা সব জানে কিন্তু কীভাবে? এজন্যই ইহান প্রথম যেদিন নিঝুমের কথাটি তাকে বলে সে কোনো প্রতিক্রিয়া করে না।
“আরেহ ভাইয়া কী ভাবতে বসলে?”
“আচ্ছা কী কথা বলছিলো মা?”
অতঃপর ইরা সবকিছু খুলে বলল ইহানকে।
“আচ্ছা তুই যা এটা নিয়ে আমি পরে কথা বলবো মায়ের সঙ্গে।”
ইহান ইরাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে দ্রুত পায়ে বেড়িয়ে যায়। আর ইরা ভাবতে থাকে, এতো তরতাজা খবর পেয়েও ইহান কীভাবে এতটা স্বাভাবিক? ইহান বাড়িতে ফিরলে অবশ্যই এ বিষয়ে তাকে চেপে ধরবে ইরা।
——————
পার্কের বেঞ্চিতে হাস্যজ্জল মুখে বসে আছে সোনালি। তার থেকে কিছু টা দুরত্বে তুশী বাচ্চাদের সঙ্গে খেলায় মেতে আছে। সোনালী সেদিকে তাকিয়েই হাসছে। তুশীকে অন্যান্য বাচ্চাদের সঙ্গে এতটা খুশি দেখে তারও খুব ভালো লাগছে। অকস্মাৎ এক পুরুষালি কন্ঠস্বরে ঘোর কাটে তার।
“এই যে মিস হাসলে কিন্তু আপনাকে দারুণ লাগে।”
সোনালী ভীষণ রেগে গেলো। এটা তো সেদিনের সেই ছেলেটা। তেজস্বী কন্ঠে উত্তর দেয় সে,
“কী চাই?”
“আপনাকে”
“ফ্লার্ট করছেন?”
“উহুম সত্য বলছি।”
“জানেন আমি কে?”
“না বললে কী করে জানবো।”
“আমার ভাইয়া সমর্পণ চৌধুরী একজন সিনিয়র আর্মি অফিসার। আর আমি তারই একমাত্র বোন সোনালী চৌধুরী। সো বুঝতেই পারছেন আমার সঙ্গে ফ্লার্ট করার শা’স্তি কতটা ভ’য়ংক’র হতে পারে।”
“এতকিছু ভাবার মতো সময় হয়নি ম্যাডাম। আর ভাবতেও চাই না।”
“না ভাবতে চাইলেও ভাবুন নয়তো পরবর্তীতে আমাকে বিরক্ত করলে একদম গারদে ভরে দেবো।”
সোনালী ধপ করে উঠে যায়। এক পলক ইশানের দিকে তাকিয়ে হনহনিয়ে তুশীর কাছে যায়। তুশীর হাত ধরে টানতে টানতে চলে যায় পার্ক থেকে। তার এতো সুন্দর মুড টার ফালুদা বানিয়ে দিল ওই অসভ্য ছেলেটা। চারপাশটা এখন একদম অসহ্য লাগছে।
এদিকে ইশান! সে তো নিজের ধ্যানে মত্ত। “সোনালী” নামটি আপনমনে বারংবার আওড়িয়ে চলেছে। আশেপাশের কিছুতেই যেন ধ্যান নেই।
———————
তীব্র চিৎকারের শব্দে অসহ্য লাগছে নিহানের। মারিয়া এসেছে তার ফ্ল্যাটে। আদরের ছোট ভাই বাড়ি ছেড়ে অনত্র থাকবে এটা মেনে নিতে পারছে না সে। তবে এই সহজ কথাটি যেখানে শান্তশিষ্ট, সুশৃঙ্খল ভাবে উপস্থাপন করা যেত সেখানে সে তৈরি করছে বিশৃঙ্খলা। এটাই তাদের কালচার। চিৎকার, চেঁচামেচিতেই অভ্যস্ত তারা। এদিকে নিহান একপ্রকার বাধ্য হয়ে বোনের এমন ব্যবহার গলাধঃকরণ করে চলেছে। নেহাৎই বড় বোন তার ওপর নিহানকে অনেক স্নেহ করে তাই নয়তো এর উচিত জবাব সে অনেক আগেই মারিয়াকে দিয়ে দিত। পরিশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে নিহান মুখ খুলে,
“আপু তুমি এমন কেন করছ? তোমাদের ওই নরক পুরীতে থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই সো এসব নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি না করে ভদ্র ভাবে বসো।”
মারিয়া ভাইয়ের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। অবিশ্বাস কন্ঠে বলল,
“তুই, তুই বলছিস আমাকে এসব কথা? তুই আমার নিহান তো? নাকি বিদেশে গিয়ে পাখনা গজিয়ে গেছে তাই আপুকে যা তা বলছিস?”
“আপু তুমি ভুল বুঝছ তেমন কিছুই নয়। আমি শুধু বোঝাতে চাইছি যে, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তোমরা। আমি নিজের মতো করে বাঁচতে চাই। হালাল পথে রোজগার করে জীবনযাপন করতে চাই। কোনো অসৎ পথের অর্থ আমার চাই না।”
“ওহ তাই বুঝি। সারাজীবন খেয়ে, পড়ে, বড় হয়ে এখন তোর মনে হচ্ছে এসব অসৎ উপার্জন? তবে আরও আগে কেন বেড়িয়ে আসিস নি? নাকি এখন নিজের ভবিষ্যৎ গড়ে নিয়ে সরে যেতে চাইছিস?”
“আপু প্লিজ! স্টপ টকিং ইউর ননসেন্স।”
“তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো আমি কেন এমনটা চাইছি।আই নিড হার।”
“ওহ আই সি! এজন্যই তুই এমনটা করছিস। ওই মেয়েটার জন্য। ওই ফালতু মেয়েটার জন্য। তুই কী করে পারছিস ভাই?”
নিহান এতক্ষণ খুব করে ধৈর্য ধরে ছিলো কিন্তু আর পারল না। খুব করে তর্কাতর্কি চলল দু ভাই – বোনের মধ্যে। এক পর্যায়ে মারিয়া নিহানের গালে স্বজোরে চড় বসিয়ে দিয়ে রেগেমেগে বেরিয়ে গেল। নিহান কিছু বলল না শুধু দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তার খুব মায়ানকে দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু উপায় নেই। বড় ভাই তার ওপর আরও তিনগুণ বেশি রেগে আছে। সামনে পেলে খু’ন করে দেবে।
——————–
মারিয়া বর্তমানে কেমন অনুভূতি শূন্য। দিকবিদিকশুন্য। চতুর্দিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে সেসব তার মাথায় নেই। তার আদরের ভাইটি তার কথা অমান্য করেছে, তার সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হয়েছে, বেয়াদবি করেছে এটাই চরম ভাবে তার মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। উত্তেজনায় গাড়ি টানছে হাই লেভেলে। অতর্কিতে ঘটে গেল এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা। অসাবধানতায় তার গাড়ি গিয়ে পড়ল অন্য একটি গাড়ির সম্মুখভাগে। কোনো রকমে এক্সিডেন্ট হতে হতে বেঁচে যায়। অবশ্য এক্সিডেন্ট না হওয়ার সম্পূর্ণ ক্রেডিটই বিপক্ষীয় গাড়িটির। মাথা চেপে ধরে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসে মারিয়া। প্রচুন্ড মাথা জ্বালা করছে তার। ইদানীং বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে এমনটা হয়। অকস্মাৎ চোখ তুলে ওপরে তাকাতেই সামনে ভেসে ওঠে দুটি সুপরিচিত মুখ। মুহূর্তেই ভ্রু কুঁচকে ফেলে সে। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যায় তাদের সম্মুখে। ইহান বুকে হাত গুজে দাড়ায়। মারিয়া কোনো রকম ভঙ্গিমা ছাড়াই বলে,
“এখনো বেঁচে আছে দেখছি।”
ইহান কিছু বলার আগেই নিঝুম কথা টেনে নিয়ে বলে,
“কৈ মাছের জান এত সহজে হজম হবে না।”
মারিয়া দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। ক্রোধিত কন্ঠে বলে,
“হবে হবে সময় হলে সব হবে।”
নিঝুম তাচ্ছিল্য হাসে। বলে,
“অপেক্ষায় থাকলাম।”
ইহান এদের মধ্যে নিরব দর্শনের ন্যায় পরিদর্শন করছে। মারিয়া রেগেমেগে চলে গেছে। যাওয়ার আগে নিঝুম তাকে সতর্ক বার্তা সরূপ বলে দিয়েছে সাবধানে গাড়ি চালাতে। এটা শুনে সে যেন দ্বিগুণ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছে। ফলস্বরূপ আরও হাই স্পিডে গাড়ী টেনে চলে গেছে। এত কিছুর মধ্যে দিয়ে ইহান এতটুকু খুব ভালো ভাবেই বুঝেছে যে, তার ঝুম আর আগের মতো দুর্বল নেই। নিজের প্রটেক্ট এখন সে নিজেই করতে পারে। সত্যিই জীবন মানুষকে অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। ভেঙেচুরে নতুন করে গড়তে শেখায়।
———————
চলবে,
লেখনিতে – সাদিয়া আফরিন নিশি