সুখহীন নিশিদিন
পর্ব 9
নিষনের ভীষণ কান্না পাচ্ছে I কেন ওর সাথে সব সময় এরকম হয় ? কেন সব কষ্ট সবসময় ওকেই পেতে হবে ? এটা সত্যি যে ও দীপার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছে Iকিন্তু সেটা তো এমনি এমনি নয় I নিষণ চায়নি দীপার জীবনটা ওর মায়ের মতন হোক I দীপার ছোট ছোট যত্নগুলো খুব ভালো লাগতো I ইচ্ছা করেই ওর ব্যাগ থেকে খাবার নিয়ে যেত , তার পর ক্যান্টিন থেকে খাবার পাঠিয়ে দিত I হঠাৎ হঠাৎ মজার মজার ধাঁধা শোনাতো I কত চেষ্টা করত নিষণ কে একটু খুশী করার Iআর বিনিময়ে নিষণ কি দিয়েছে ওকে ? শুধু অবহেলা আর অপমান I সে যাই হোকI তাই বলে দীপা ওকে এভাবে কষ্ট দেবে ? এত ছোট করবে এটা কোনদিন ভাবেনি নিষণ I দীপা আসলে প্রতিশোধ নিয়েছে I কখনো সপ্তর্ষি কখনো দীপা সেজে ওকে নিয়ে মজা করেছে I
একটু আগে টেক্সট পাঠিয়েছে দীপা I সকাল সাড়ে নয়টায় দেখা করতে বলেছে রাইফেলস স্কয়ার এর সামনে I নিষণ ঘড়ি দেখল I রাত সাড়ে তিনটা বাজে I কিছুতেই ঘুম আসছে না I মাথার ভেতর প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে I কালকে দীপার গানটা অসম্ভব সুন্দর ছিল I শেষবারের মতো আর একবার গানটা শুনবে নিষণ I এরপর আর এই জীবনে কোনদিন ও গান শুনবে না I এই গানটা গাইবার কি দরকার ছিল ? নিষণ গানটা অন করল I সপ্তদীপার কিন্নর কণ্ঠ রাতের নিস্তব্ধতা খান খান করে দিতে লাগলো
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
অন্তরে আজ দেখব, যখন আলোক নাহি রে
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
ধরায় যখন দাও না ধরা
হৃদয় তখন তোমায় ভরা
এখন তোমার আপন আলোয় তোমায় চাহি রে
চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে
দীপা মিথ্যাচার করেছে ওর সঙ্গে I অন্তরে বাহিরে নিষণ কোথাও ছিল না ওর I পুরোটাই ভুল ছিল I নিষণ ঠিক করে রেখেছে কালকের পর আর কোনদিনও দীপার মুখোমুখি হবে না I কোনদিনও না I
নিষণ রাইফেলস স্কয়ার এর উল্টোদিকে রিক্সা থেকে নামল I রাস্তা পার হয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে একবার চারপাশটা দেখে নিল I মার্কেটে এখনো খোলেনি I তাই ভেতরে এতটা ভিড় নেই I নিষণ সামনে তাকিয়ে দীপাকে দেখে প্রথমে চিনতে পারলো না I দীপা আজ শাড়ি পড়ে এসেছে I সবুজ শাড়ি কাল পার I শুধু গারো করে কাজল দিয়েছে চোখে আর কোন প্রসাধনী নেই I ঢেউ খেলানো চুলগুলো পিঠের উপর ছড়ানো I দীপার এতো বড় আর এতো সুন্দর চুল আগে কখনও লক্ষ্য করা হয়নি তো I নিষণ কয়েক সেকেন্ড মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল I তারপরও নিজেই একটু লজ্জা পেয়ে চোখ সরিয়ে নিল I চোখে মুখে গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে ,কাছে এসে দাঁড়ালো I দীপা তখন একটা ছোট মেয়ের কাছ থেকে গোলাপ ফুল কিনছিল I মেয়েটার বালতিতে যতগুলো ফুল ছিল দীপা সবগুলোই নিয়ে নিয়েছে I তারপর হেসে হেসে কি যেন বলছে I ফুল দেখে নিষণ এর একটু মেজাজ খারাপ হল I পারফেক্ট ডেট প্লান করছে মনে হয় I এখন কি এই ফুলগুলো ওকে দেবে ?
দীপা নিষণ কে দেখে একটু হাসলো I তারপর বললো এস I নিষণ ভেবেছিলো দীপা হয়তো ওকে নিয়ে সারাদিন রিক্সা করে ঘুরবে I কোথাও গিয়ে আমন্ত্রণ বিহীন নিমন্ত্রণ খাবে I কিংবা এ ধরনের আরও কিছু পাগলামি করবে I কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে দীপা পার্কিং লটের দিকে চলে গেল I ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলতে খুলতে বলল
তোমাকে কষ্ট করে আমার সঙ্গে সামনে ই বসতে হবে I পেছনে কোন জায়গা নেই I
নিষণ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পেছনে সত্যিই কোন জায়গা নেই I পেছনের সিট গুলো পুরোটাই ছোট-বড় নানা রকমের বক্স দিয়ে ভরা I দীপা ব্যাগ থেকে একটা রাবার ব্যান্ড বের করে ফুলগুলোকে আটকে নিয়ে পেছনে রেখে দিলো I তারপর বলল
সিট বেল্ট বেঁধে নাও
তুমি ড্রাইভ করবে ?
হ্যাঁ I ভয় নেই আমি অনেকদিন ধরে ড্রাইভ করি I
নিষণ আর কিছু বলল না I বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে রইল চুপচাপ I
গাড়ি মগবাজারের একটা পুরনো দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামল I বাড়িটা বেশ পুরানো আমলের I আজকাল এমন বাড়ি দেখা যায় না I নেমপ্লেট দেখে নিষণ বেশ অবাক হলো I এইরকম একটা জায়গায় নিয়ে আসবে দীপা , সেটা আশা করে নি ও I বাড়ির নাম আকাশ নীলা অরফানেজ I দীপা হর্ন বাজাতে দারোয়ান দরজা খুলে দিল I ছোট একটা উঠোন সামনে I তারি এক পাশে গাড়ি পার্ক করে নেমে পরল I তারপর দারোয়ানের কাছে গিয়ে কি সব বলে আবার ফিরে এসে বলল
চলো ভেতরে যাই
নিষণ আর কিছু বলল না I ভেতরে ঢুকে গেল পেছন পেছন I দীপা ভেতরে ঢুকতেই কেমন একটা বদলে গেল পুরো পরিবেশটাই I সবাই হুলুস্থুল করে ছুটে এলো I দীপা হাত উঁচিয়ে বলল
আজকে আমরা সবাই অনেক মজা করব I
বাচ্চারা সব হই হই করে উঠলো I নিষণ তাকিয়ে দেখল বিভিন্ন বয়সের বাচ্চা I সবাই মিলে এসে ওকে ঘিরে ধরেছে I নিষণ অবাক হয়ে ওদের কান্ড কারখানা দেখতে লাগলো I দীপা কিছুক্ষণ চারিদিকে তাকিয়ে বলল
পারুল আপা কোথায় ?
কেউ কোনো কথা বলল না I দীপা কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে বলল
আমি বলেছি না আজকে কেউ কোন কাজ করবে না I পারুল আপা এখন নিশ্চয়ই রান্না করতে বসে গেছে I তাকে এক্ষুনি ডাকো I
নিষণ তাকিয়ে দেখল ভেতর থেকে একজন স্বাস্থ্যবতী গলদঘর্ম মহিলা বেরিয়ে এসেছে I বোঝাই যাচ্ছে রান্নাঘরে ছিল এতক্ষন I দীপা অবলীলায় তার কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল I তারপর বলল
পারুল আপা আমি বলেছি না আজকে রান্না করবে না I আমি খাবার নিয়ে এসেছি I
তুমি আসবা আর আমরা তোমারে কিছু খাওয়ামু না এইটা হয় ?
কিন্তু আমি তো তোমাদের সাথে গল্প করতে এসেছি I তোমরা কাজ করলে কিভাবে হবে ?
সব কাজ শেষ I তোমার পছন্দের পিঠা বানাইছি
দীপা আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল I তারপর নিষনের দিকে ফিরে বলল
বুঝলে নিষণ যদি পিঠা বানানোর কোন কম্পিটিসন থাকতো তাহলে পারুল আপা নিঃসন্দেহে চ্যাম্পিয়ন হত I কি পিঠা বানিয়েছো ?
তোমার পছন্দের ভাপা আর চিতই সঙ্গে চাটনি
আমি পেস্ট্রি আর স্যান্ডউইচ এনেছি তোমরা তাহলে বিকেলে খেও I আর সবার জন্য কাচ্চি বিরিয়ানি I খলিল ভাই কে বল গাড়ি থেকে নামাতে I আর খেলনাগুলো ও নামাতে বল I
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের পরিবেশ একেবারে বদলে গেল I দীপা বাচ্চাদের জন্য বেলুন বাঁশি আর টমটম গাড়ি নিয়ে এসেছে I বিলুপ্তপ্রায় এই খেলনাটা স্পেশালি অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে ও I বাচ্চাদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল I পুরো বাড়িটা টমটম গাড়ির শব্দ মুখরিত হয়ে উঠলো I বাচ্চারা যখন খেলায় ব্যস্ত তখন দীপা আস্তে আস্তে নিষনের কাছে এসে বলল
চলো তোমাকে বাগানটা দেখিয়ে আমি I বাচ্চারা ছাদ বাগান করেছে
আকাশ নীলর ছাদটা বেশ বড় I একপাশে ফল আর সবজি বাজার I অন্যদিকে ফুল I ফুল বাগানের মাঝখানে একটা দোলনা রাখা I দীপা নিষণ কে সেখানে
নিয়ে বলল
বস
তারপর নিজেও বসল কিছুটা দূরত্ব রেখে I নিষনের মাথায় অনেকক্ষণ থেকেই একটা প্রশ্ন ঘুরঘুর করছিল I আর কৌতুহল দমন না করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল
এই জায়গাটার নাম আকাশ নীলা কেন ?
এই নামটা আগে থেকেই ছিল I এটা একটা প্রাইভেট অরফানেজ I ফান্ডিং এর অভাবে ওরা বিক্রি করে দিয়েছে I এই জায়গাটা নিয়ে একটা মজার গল্প আছে I
কি ?
আমার জন্মের পর মা খুব চেয়েছিল তার একটা ছেলে হোক I সেটা আর হলো না I আমার জন্মের কিছুদিন পর মায়ের ইউটেরাসে টিউমার ধরা পড়ে I ইউটেরাস ফেলে দিতে হয় I এরপর মা খুব ভেঙে পড়েছিল I তখন আমার বাবা মাকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন I বাবা বলেছিলেন
এই যে দেখো এই ছেলেমেয়েগুলোর বাবা মা নেই I কোন দিন হবেও না I তোমার একটা মেয়ে আছে I আল্লাহ তোমাকে কত কিছু দিয়েছে দেখো I তুমি যদি তোমার ভালোবাসার একটু এদেরকে দাও তাহলে দেখবে বিনিময় অনেক কিছু ফিরে পাবে I
এরপর থেকে মা সবসময় এখানে আসতে I আমি একটু বড় হওয়ার পর থেকে আমাকে ও নিয়ে আসত I তারপর যখন ফান্ডিং এর অভাবে এই জায়গাটা বন্ধ হয়ে যেতে নিল তখন আমরা এটা কিনে নিলাম I এই বাচ্চা গুলো বড় হবার পর পড়াশোনা শেষ করলে আমরা ওদের চাকরির ব্যবস্থা করে দেই I ছেলেরা অনেক সময় চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যায় I মেয়েদের সাধারণত আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করে দেই I বিয়ের দিন কি যে মজা হয় এখানে I তুমি না আসলে বুঝতেই পারবে না I এরপর কারো বিয়ে হলে আমি তোমাকে নিয়ে আসব I
কথাটা বলে হঠাৎই কেমন যেন নিভে গেল দীপা I ততক্ষণে খাবার চলে এসেছে I বিভিন্ন ধরনের পিঠা ভরা থালাটা ওদের মাঝখানে রেখে পারুল আপা চলে গেল I দিপা বলল
– খাও I চা খাবে তো ? নাকি কফি দিতে বলব ?
– চা ই খাব I কফি করতে হবে না
নিষন প্লেট থেকে পিঠা তুলে নিল I হঠাৎই ওর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল I খুব ছোট থাকতে নানা বাড়িতে গেলে এ রকম পিঠা খেত I কতবছর কেউ এরকম যত্ন করে খাবার দেয় না I এখানে এসে খুব অদ্ভুত লাগছে ওর I এভাবে কখনও ভেবে দেখা হয়নি, যে নিজের কষ্ট দূর করার জন্য দুঃখী মানুষকে আনন্দ দিতে হয় I এতগুলো বছর ধরে নিজের দুঃখকে জিইয়ে রেখেছে ও I কখনো কারো জন্য কিছু করার চেষ্টা করে নি I আজ দীপাকে দেখে খুব অবাক হয়েছে নিষণ I এই দীপাকে তো আগে কখনো দেখেনি ও I ওর বরাবরই মনে হতো দীপা একজন হালকা ছটফটে ধরনের মেয়ে যার মধ্যে কোন গভীরতা নেই I তবে কি সত্যিই কাউকে বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না ,যে সে আসলে কেমন ? তবে কি দীপা সত্যি ওকে খুব গভীরভাবে চেয়েছিল ওই বুঝতে পারেনি ? এই প্রশ্নটাও কাকে করবে ও ?
চলবে ……..