সুখহীন নিশিদিন
পর্ব 10
আকাশ নীলা থেকে বেরুতে বেরুতে ওদের বিকেল হয়ে গেল I অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও কেউ ওদেরকে ছাড়তে রাজি হলো না I অগত্যাই দুপুরের খাবার খেয়ে তবে বেরোতে হলো I আজ খাবার, টেবিলে পরিবেশন করা হয় নি I সবাই মেঝেতে বসে খাচ্ছে I পারুল আপা একটা বড় গামলায় সব বিরিয়ানি ঢেলে মাঝখানে রাখেছে I তারপর সবাইকে প্লেটে তুলে দিয়েছে I কাচ্চি বিরিয়ানি সঙ্গে স্যালাড I সামনের বড় ঘর টাতে সবাই গোল হয়ে বসেছে I দীপার এক পাশে রুনু আর অন্য পাশে বসেছে মিলি I মিলি এখানকার বাচ্চাদের মধ্যে সবচাইতে বড় I ওর বয়স এবার 15 হবে I নিষণ বসেছে ওদের উল্টোদিকে I বাচ্চারা ওকে নানান রকমের প্রশ্ন করে অতিষ্ঠ করে তুলছে I মজার ব্যাপার হলো ও একটুও বিরক্ত হচ্ছে না I ধৈর্যের সঙ্গে সবার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে I এই যেমন চাঁদের রং হলুদ কেন ? কিছুদিন পরপর চাঁদ টা কোথায় চলে যায় ? এক দুই তিন তিনটাই মৌলিক সংখ্যা কি করে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি I দীপার খুব মজা লাগছে I ও ভেবেছিলো নিষণ হয়তো বাচ্চাদের পছন্দ করে না I কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে নিষণ কে বুঝতে ওর আরো অনেক বাকি আছে I মিলি পাশ থেকে কানে কানে বলল
ও দীপা দিদি ওই সুন্দর ছেলেটা কে গো ? তোমার বর ?
দীপা একটু লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিল I তারপর আস্তে আস্তে বলল
না I আমার বন্ধু
বিশেষ বন্ধু ?
তুই খুব পেকেছিস মিলিI চুপচাপ খা
রুনু এই পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য I ওর বয়স 4 বছর I দীপা আর মিলির গল্প শুনে ও হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল
আমি এখানে বসবো না I আমি দীপা দিদির বরের হাতে ভাত খাব I
তারপর দৌড়ে গিয়ে নিষনের কোলে বসে পড়ল I আশেপাশের ছেলেদের প্রশ্নের তোরে নিষণ কিছু শুনতে পায়নি I ভাগ্যিস ! দীপা ভয় পেয়ে ওকে আনতে গেলে নিষণ হাত তুলে বললো
না ঠিক আছে I ও বসুক এখানে I আমি ওকে খাইয়ে দিচ্ছি
দীপা হতভম্ব হয়ে গেল I এত রাগী , খটমটে স্বভাবের ছেলেটা কিনা এখন রুনুর মতন দুষ্টু একটা বাচ্চাকে খাইয়ে দেবে ?
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেরুতে বেরুতে বিকাল হয়ে গেল I যাবার আগে সবাই খুব করে অনুরোধ করল আবার যেন ওরা দুজন আসে I দীপাকে অবাক করে দিয়ে নিষণ বলল
অবশ্যই আসবো I
যতক্ষণে ওরা বেরুলো ততক্ষনে বিকাল হয়ে গেছে I দীপা গাড়িতে উঠে ঘড়ি দেখল I 3:30 বাজে I এইদিক কার রাস্তায় বেশ জ্যাম I এর পরের গন্তব্য উত্তরা I কি জানি কতক্ষণে পৌঁছাতে পারবে I দীপার একটু একটু মন খারাপ করা শুরু হয়েছে I আজকের দিনটা অনেক ছোট মনে হচ্ছে I কি হতো আজকের দিন টা আর একটু বড় হলে I দীপা ভালো করে জানে নিষণ অসম্ভব জেদি আর একগুঁয়ে রকমের ছেলে I আজকের পরে ও আর কিছুতেই দীপার সঙ্গে দেখা করবে না I নিষণ একবারের জন্য ও জিজ্ঞেস করেনি যে ওরা কোথায় যাচ্ছে I কোনমতে আজকের দিনটা পার করে দিচ্ছে ?দীপার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে I ও একটা হাত তুলে চোখটা মোছার চেষ্টা করল, যেন ড্রাইভ করতে সমস্যা না হয় I
কি হয়েছে দীপা ? মাথা ব্যথা করছে ? কষ্ট হচ্ছে ড্রাইভ করতে ?
দীপা খুব অবাক হয়ে তাকালো I এর আগে কখনো নিষণ এত নরম গলায় কথা বলেনি I কি জানি হয়ত আজকে শেষ দিন বলে I দীপা জবাব দিল না I কোনমতে একটু হাসলো I নিষণ বলল
সামনে একটা চায়ের দোকান আছে I গাড়িটা একটু পাশে রাখ I চলো চা খাই I
রাস্তার পাশে ছোট একটা টং দোকান I সামনে কাঠের বেঞ্চি পাতা I অনেক গুলো লোক গাদাগাদি করে বসে খাচ্ছে I দীপার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল I নিষণ সেটা বুঝতে পেরে বলল
তুমি বের হয়ে ফ্রেশ এয়ার এ দাঁড়াও আমি চা নিয়ে আসছি
দীপা গাড়ি থেকে নেমে হেলান দিয়ে দাড়াল I চট করে চুলটা হাত খোঁপা করে নিল I গাড়ি থেকে বোতল বের করে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল I কি যে হয়েছে চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে I
নিষণ চা নিয়ে ফিরে এসে দেখল দীপা মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে I পানি ফেলে শাড়ি ভিজিয়ে ফেলেছে I নিষণ ওকে দেখে অবাক হয়ে গেল I কাজল লেপ্টে গেছে , টিপ সরে গেছে কপাল থেকে I তবু কি অদ্ভুত স্নিগ্ধ লাগছে ওকে দেখতে I
নিষণ কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে দীপার মনে হল ওকে নিশ্চয়ই ভূতের মতন লাগছে I দীপা কিছু বলার আগেই নিষণ ওর হাত থেকে পানির বোতলটা নিয়ে গাড়িতে রেখে দিল I তারপর চায়ের কাপ দুটো ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুমাল দিয়ে যত্ন করে ওর মুখটা মুছে দিল I সরে যাওয়া টিপ ঠিক করে দিল I তারপর বলল
– এখানে অনেক ধুলোবালি চলো গাড়িতে বসে চা খাই
দীপা আর কিছু বলল না I চা শেষ করে আবার রওনা দিল I এবারের গন্তব্য উত্তরা 9 নম্বর সেক্টর I এবারেও গাড়ি থেকে নেমে নিষণ চমকালো I জায়গাটার নাম বাংলাদেশ এ বি এ সেন্টার I নিষণ প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো I দীপা বলল
এটা একটা প্রাইভেট অর্গানাইজেশন I এখানে অটিস্টিক বাচ্চাদের থেরাপি দেয়া হয় I আমি মাসে একবার এখানে আসি I এই বাচ্চাগুলোর কাছাকাছি থাকতে আমার খুব ভালো লাগে I ওদের মধ্যে এক ধরনের সারল্য আছে I তুমি গেলেই বুঝতে পারবে I তবে এখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারব না I শুধু উপহার গুলো দিয়ে চলে যাব I
ওরা দুজনে মিলে উপহার এর বাক্স ভেতরে নিয়ে গেল I দীপা বিভাগীয় প্রধানের সঙ্গে দেখা করে ফুলগুলো তার হাতে দিয়ে বলল
আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা I বাবা বলছিল আজকে এই প্রতিষ্ঠান এর জন্মবার্ষিকী
ভদ্রমহিলা একটু হাসলেন I তারপর বললেন
হ্যাঁ তোমার বাবা ঠিকই বলেছেন I কেমন আছেন উনি ?
জি ভালো
আমরা ইউনিভার্সিটি তে একসঙ্গে পড়তাম I আমি যখন এই প্রতিষ্ঠান শুরু করার কথা ভাবি , সবাই আমাকে অনেক নিরুৎসাহিত করেছিল I অনেকেই অনেক ভালো ভালো , লাভ জনক বিজনেস এর আইডিয়া দিয়েছিল I সেই সময় তোমার বাবা আর আরো কয়েকজন বন্ধু আমার পাশে না থাকলে এই প্রতিষ্ঠানটা আমি চালাতে পারতাম না I তোমার বাবাকে আমার হয়ে ধন্যবাদ দিও I
নিষণ ভেতরে ঢুকে দেখল একটা বড় মাঠের মধ্যে বাচ্চাগুলো খেলছে I ঠিকই বলেছিল দীপা I বাচ্চা গুলোর মধ্যে একটা অদ্ভুত সারল্য আছে I দীপা ওদের জন্য রং তুলি আর নানান রঙের কাগজ নিয়ে এসেছে I আর সঙ্গে এনেছে খেলার জন্য বল I উপহার পেয়ে বাচ্চাগুলো কি যে খুশি হয়ে গেল Iনিষনের চোখে পানি এসে গেল I বেরোনোর সময় ভদ্রমহিলা দীপার চিবুক ছুঁয়ে বললেন
দোয়া করি অনেক বড় হও জীবনে I আর এই সুন্দর মনটা হারিয়ে যেতে দিওনা I
পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায় গাড়িটা একটু সামনে গিয়ে পার্ক করতে হয়েছে I ওরা দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো I নিষণ হঠাৎ লক্ষ্য করলো দীপা একটু পিছিয়ে গেছে I পিছনে ফিরে দেখল রাস্তার পাশের একটা বাড়ির দেয়াল জুড়ে বিশাল বাগান বিলাসের গাছ I ডাল নুইয়ে পড়েছে রাস্তার উপর I দীপা মেঝে থেকে একটা বাগানবিলাসের ডাল তুলে নিচ্ছে I তারপর অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে হেঁটে আসছে Iদীপাকে খুব বিষন্ন দেখাচ্ছে I নিষণ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও একটু লজ্জা পেয়ে বলল
চল এসে গেছি I তারপর একটু থেমে বলল
এখন রাস্তায় অফিস ফেরত মানুষের অনেক জ্যাম I একটু বসে যাই কেমন
ওরা দুজন সামনে লেকের ধারে বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো I দীপা কোন কথা বলছে না I কেন জানিনা ওর হঠাৎ খুব মন খারাপ লাগছে I অন্যদিকে নিষনের মনটা অকারণেই ভালো লাগছে I ও সামনের দিকে তাকিয়ে বলল
বাচ্চাগুলো এত কিউট I তোমাকে ওরা ভীষণ ভালবাসে তাই না ?
হু
অবশ্য তোমাকে তো সবাই ভালোবাসে I স্কুলে থাকতে দেখেছি
দীপা ম্লান একটু হাসল I তারপর নিচের দিকে তাঁকিয়েই বললো
সবাই না
নিষণ কথাটার মানে প্রথমে ঠিক ধরতে পারল না I যতক্ষণ বুঝল ততক্ষণে দীপা অন্য কথা শুরু করে দিয়েছে
ভেবেছিলাম তোমাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটকে রাখবো I আরো কয়েকটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল I কিন্তু আর বিরক্ত করতে ইচ্ছা করছে না I শুধু শেষবারের মতো তোমাকে একটা গান শোনাবো I এরপর আর কোন দিন তোমাকে আমার মুখ দেখাবো না I
নিষণ হতভম্ব হয়ে গেল I দীপা এসব কি বলছে ? ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো I দীপা কোথাও যেও না I এই পৃথিবীতে আমার প্রিয় জন যারা ছিল সবাই তো আমাকে ছেড়ে চলে গেছে I তোমাকে কেন যেতে হবে ? কিন্তু কিছুই বলতে পারলনা I তারা আগেই দীপা গান শুরু করে দিয়েছে
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে
আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি
লহো লহো করুণ করে
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে
যখন যাব চলে, ওরা ফুটবে তোমার কোলে
যখন যাব চলে, ওরা ফুটবে তোমার কোলে
তোমার মালা গাঁথার আঙুলগুলি মধুর বেদনভরে
যেন আমায় স্মরণ করে
এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে
দীপা গান শেষ করতে পারলো না I ওর গলা ধরে এল I দীপা নিষনের কাছ থেকে বিদায় নিল না I একটা কথাও বলল না Iউঠে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করলো I একবার ও পিছন ফিরে তাকালো না I ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে I চারিদিকের নেমে পড়া বিবর্ণ সন্ধ্যা ওদের মনকে আরো বিষন্ন করে দিচ্ছে I দীপা ওর আচলটা তুলে চোখ মুছলো I কি জানি এই জীবনে আর কোনদিন দেখা হবে কিনা I
চলবে………..