#বর্ষায়_ভেজা_অভ্র
#পর্ব_০৩
#শারমিন_আক্তার_বর্ষা
______________
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রান্না শুরু করে মিসেস রিসার্ভ। মেহমান আসার পূর্বেই তার রান্না সম্পূর্ণ হয়। সকালের নাস্তা করে বাকিরা গল্প করতে বসে। অন্য দিকে দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে ব্যস্ত সে রান্না ঘরে। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণ করে রুমে চলে আসে। রিসার্ভ আজ অফিসেই লাঞ্চ করেছে অনেক কাজের চাপ থাকায় বাড়ি আসতে পারেনি। তবে সে কল দিয়ে তার বউয়ের খোঁজ নিয়েছে। দুপুরে খাওয়ার পর ঘুম হয় ভালো বলে ঘুমানোর জন্য রুমে চলে যায়। রুমে এসে দেখে আগে থেকেই শায়েলা তার খালা শাশুড়ী রুমে বসে আছে। সম্পর্কে খালা শাশুড়ী হলেও বয়স দু’জনের সেম।
শায়েলা বলল,’ আসো দু’জনে মিলে গল্প করি৷ সেদিনের পর কি হলো তা তো আর বলাও হয়নি আর শোনাও হয়নি।’
ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,’আজকে আমি অনেক ক্লান্ত কালকে শুনবো!’
শায়েলা বলল,’ চলো দু’জনে শুয়ে পরি তারপর রিলাক্সে শোনা যাবে।’
শায়েলা নাছোরবান্দা সে জানে তার নিস্তার নেই আজ তাই রাজি হলো। শায়েলা তার কলেজের নিত্যদিনের গল্প বলতে শুরু করল।
______________________
‘ভোর দুপুরে কোই যাইতাছোস তুই সাইজা গুইজা তাও আবার শুক্রবারের দিনে?’ বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে বের হতে যাবে বর্ষা, সেই সময়ে পেছন থেকে শানিতকন্ঠে বলে উঠল তার বড় আম্মু!
পেছনে ঘুরে বর্ষা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে বলল,‘ কোই সাজছি বড় আম্মু তুমি একটু বেশিই দেখতাছো। তা ছাড়া আমি আমার বান্ধবী তমার বাড়ি যাচ্ছি ওর থেকে নোটস নিতে। গত চারদিন আগের বৃষ্টিতে ভিজার পর থেকে তো আর কলেজে যাওয়া হয়নি। এখন মোটামুটি সুস্থ ভাবছি আগামীকাল থেকে কলেজ যাবো তাই আজ নোটস নিতে যাচ্ছি।’
ভ্রু কুঁচকে তিনি বললেন,‘ আচ্ছা যা। তারাতাড়ি বাড়ি ফিরে আসিস। ’
বর্ষা ছোট্ট করে জবাবে বলল, ‘ আচ্ছা! ‘
বলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। সালমা বেগম কাজের তাগিদে চলে গেলেন রান্নাঘরে।
মিনিট দশেক পর হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে প্রবেশ করল অভ্র, সে হম্বিতম্বি কন্ঠে সকলের উদ্দেশ্য বলল,‘আজকে কোনো ভাবেই বর্ষাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিও না, আর খেয়াল রেখো ও জেনো ফোনে কারো সাথে কনটাক্ট না করতে পারে। ’
বলে উল্টো দিকে পা বাড়ালো অভ্র। পেছন থেকে তার মা সালমা বলে উঠল, ‘বর্ষা তো বাড়িতে নেই। ও তো কিছুক্ষণ আগেই ওর বান্ধবীর বাড়িতে গেছে কিসের নোটস আনতে!’
সরু চোখে অভ্র তার মা’র দিকে তাকিয়ে সুক্ষ্ম কণ্ঠে বলল,‘ কার বাড়িতে গেছে? না মানে কোন বান্ধবীর বাড়ি? ’
এক বাক্যে সালমা বললেন,‘ ওই যে কি নাম? ও হ্যাঁ মনে পরেছে মেয়েটার নাম তমা। ওর বাড়িতেই গেছে চিন্তা করিস না তারাতাড়ি চলে আসবে। ‘
অভ্র এক হাত মুঠি বন্ধ করল, অন্য হাতের তালুতে পাঞ্চ মেরে রাগী গলায় বলল,‘ এটা একদমই ঠিক হয়নি তোমার ওকে যেতে দেওয়া মোটেও উচিত ছিল না আম্মু। এখন কি ভাবে সামলাবো ওকে?’
তীক্ষ্ণকন্ঠে বলে অভ্র বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেলো। পেছন থেকে সালমা বার কয়েক ডাক দিয়ে বললেন, ‘কি হইছে বাবু? আমাকে বল!’
কিন্তু অভ্র আর এক মূহুর্ত ও সেখানে দাঁড়ালো না। সে তার মতো ছুটতে লাগল।
বান্ধবীর কাছ থেকে নোটস নিতে এসে এমন পরিস্থিতি ফেস করতে হবে। যা কল্পনাও করেনি বর্ষা। স্তব্ধ নির্বাক দাঁড়িয়ে রয়। কি হচ্ছে এইসব? চিৎকার দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে।
এখানের কোনো কিছুই বর্ষার বর্তমানে বোধগম্য হচ্ছে না। সব কিছুই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।
কোনো মতে পা টিপে টিপে ভেতরে গেলো বর্ষা। চোখে ছানি পড়ার মতো কিছু পরল। ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে গেলো৷ অপলক দৃষ্টিতে বর্ষা সামনে তাকিয়ে রইল। পরক্ষণে, ‘তমা’ বলে একটা চিৎকার দিলো। সকলের কানে বর্ষার চিৎকারের আওয়াজ পৌঁছাতেই তারা বর্ষার দিকে দৃষ্টিপাত করে।
বাসার মধ্যখান টায় পরে আছে তমার নিস্তেজ দেহ। তার চারপাশ ঘিরে আত্মীয় স্বজন বসে আছে। মেয়ের মৃত দেহের পাশে বসে কাঁদছে মাইমুনা। (তমার মা’র নাম)
বর্ষা হাঁটতে হাঁটতে তমার পাশে গিয়ে বসল। একগাল ছুঁয়ে দিয়ে বলল,‘ এটা কি করলি তুই তমু? কিসের জন্য করলি এমন?’
সকলে বলাবলি করছে, কি সুন্দর মাইয়া আত্মহত্যা করছে। মনে হয় কারো লগে প্রেম পিরিতি ছিল। বাড়ি থেকা মাইনা নেয় নাই তাই এমন করছে।
পেছন থেকে তাজুওয়াত খান ধমকের গলায় বলল,‘ চুপ করো তোমরা। আমার মেয়ের এই অবস্থা আর তোমরা এই সব বলে কানাকানি করছো?’
তাজওয়াতের কথায় তারা অপমান বোধ করেন আর সেখান থেকে প্রস্থান করে। একটা ছেলে সম্ভবত তমার কাজিন হাতে একটা কাগজ নিয়ে ছুটে আসছে মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বার কয়েক ‘কাকা’ বলে চিৎকার দিয়ে উঠেছে। কান্ত হয়ে দুই হাঁটু তে ভোড় দিয়ে দাঁড়ায় তারপর হাতের কাগজ টা তাজওয়াতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,‘ কাকা এই কাগজটা তমার ঘরে পাইছি।’
কাগজটা হাতে নিলেন তাজওয়াত! এটা কোনো সাধারণ কাগজ নয়। একটা সুইসাইড নোট যা লিখেছে তমা। তিনি শুকনো ঢোক গিলে পড়তে লাগল,
❝তমা’র লিখে যাওয়া শেষ কিছু কথাঃ-
তুমি আমাকে এটা করতে বাধ্য করেছো আব্বা। আমি ম’রতে চাই নাই কিন্তু তোমার জেদের কাছে আমার ভালোবাসার কোনো মূল্য ছিল না। কয়েক দিন থেকে ডিপ্রেশনে ভুগতেছি। কোনো কিছুই ভালো লাগছিল না শুধু একটা কথাই মাথায় ঘুরছিল, আমি রাফিকে ভালোবাসি তার জায়গা আমি অন্য কাউকে দিতে পারবো না। এটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মন প্রাণ উজাড় করে শুধু রাফিকেই ভালোবাসি। কিন্তু তুমি যা বিন্দুমাত্র বুঝতে চাওনি আব্বা। তোমার মেয়ের সুখের চাইতে তোমার প্রিয় ছিল টাকাওয়ালা জামাই। জানো তো আব্বা টাকা দিয়ে না সব সময় সুখ কেনা যায় না।
আমি সত্যি আর পারতেছিলাম না। বাসায় তোমাদের জানালাম বললাম একটা বার দেখা করো কিন্তু তুমি শুনলে না। টাকা পয়সা আমাকে মানসিক শান্তিটা দিতে পারবে না আব্বা। আমি যে একজনের ভালোবাসায় আসক্ত আব্বা।
আমার শেষ ইচ্ছাগুলো পারলে তোমরা পূরণ করিও-
১! আব্বা তুমি আমার খা/টিয়া ধরবা না, মাটিও না দিবা না। আমার মরা মুখটাও দেখবা না।
২! ছোট চাচী, কাকুমনি, বড় চাচী, আমার বন্ধুমহল প্রিয় ভাইবোন সবাই আমাকে মাফ করে দিও।
৩!আমি মরতে চাইনি বাঁচতে চেয়েছিলাম! রাফির সাথে সংসার করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু আব্বা আমাকে বাঁচতে দিলো না। ❞
শব্দ করেই কাগজ টা পড়লেন তাজওয়াত। পড়া শেষে কাগজ হাতে মেঝেতে বসে পরলেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে কান্না শুরু করলেন। একমাত্র মেয়েকে বুকের সাথে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে আজ মেয়ে হারা হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ি ভর্তি মানুষ জন উপেক্ষা করে পুলিশ আসলো। অনেক রিকুয়েষ্ট করেও তমার দেহ রাখতে পারেনি তাজওয়াত। পোস্টমর্টেমের জন্য পুলিশ জোর করেই নিয়ে যায় তমার মৃত দেহটা। হাউমাউ করে কাঁদছে সকলে যার যাওয়ার সে তো চলেই গেছে এখন আর মরা কান্না করে কি হবে। গাড়ি ছুটে চলেছে বর্ষার সাথে কেউ নেই। সে মাটিতে বসে চিৎকার দিয়ে উঠে। পেছন থেকে দু’টি হাত বর্ষার দুই বাহু চেপে ধরলো।
বর্ষা পেছনে ফিরে তাকায়ে দেখল অভ্র, বর্ষা কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল,’তম তমা!’
আর কিছু বলার আগে সেন্সলেস হয়ে যায় বর্ষা। অভ্র দুই হাতে বর্ষাকে ধরে পাঁজাকোলে তুলে নেয়। গাড়িতে উঠে বসে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়।
বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে গাড়ির সিটের সাথে চিপকে চুপচাপ বসে আছে অভ্র। চোখে মুখে শান্ত ভাব। কপালের সামনে থাকা ছোট ছোট চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক সেদিক। মৃদু বাতাস বইছে গাড়ির জানালা খোলা থাকায় সেই বাতাসে উড়ছে বর্ষাভ্র’র চুল। যদিও অভ্রর দৃষ্টি এখন বর্ষার মুখের উপর স্থির। অভ্রর বুকের মধ্যিখান টায় মাথা গুঁজে মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে একদম বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগছে তাকে দেখছে। কে বলবে এই মেয়েটাই কিছুক্ষণ আগে মাটিতে গড়াগড়ি করে কাঁদছিল।
আনমনেই অভ্র নিজের ঠোঁট জোড়া দিয়ে স্পর্শ করলো বর্ষার কপালে। কান্না করা অশ্রুকণা গুলো শুকিয়ে শুষ্ক হয়ে গালের সাথে ল্যাপ্টে আছে বর্ষার। জেগে থাকলে এই বলতো,‘আমার গালটা টনটন করছে।’
ভাবতেই অভ্রর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। বর্ষা কান্না করতে করতে কয়েক ঘন্টা আগে জ্ঞান হারিয়েছে এখনো জ্ঞান ফিরেনি।
হঠাৎ হাতের স্পর্শ পেতে মৃদু নড়েচড়ে উঠে বর্ষা। সাথে সাথে ভ্রুযুগল কুঁচকে বর্ষার মুখের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকালো অভ্র। এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবে হয়তো বর্ষা উঠে পরেছে কিন্তু না ‘ও’ উঠেনি। হাল্কা নড়ে আবারও অভ্রর বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে ফেলে। হয়তো বা ঘুমের মধ্যে কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখেছিল তাই নড়েচড়ে উঠেছে।
কৃতপূর্বের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ঘাবড়ে যায় অভ্র। দুইহাতে বর্ষাকে আরও শক্ত করে ধরে নিজের আষ্টেপৃষ্টের সাথে জড়িয়ে দীর্ঘ শ্বাস নেয়।
কানের কাছে ফিসফিসে আওয়াজে বলল,“সর্বদা সকল পরিস্থিতিতে আমি তোমার থাকবো।”
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগল অভ্র।
অশ্রবণ চোখে স্ষ্ট ভেসে উঠছে আজ থেকে এক মাস আগের স্মৃতি গুলো- বর্ষা হঠাৎ তখন কল দিয়ে আবদার করেছিল,‘এই তুমি আর একটু জোরে কথা বলতে পারো না? তোমার এই আসতে আসতে বলা কথা আমি বুঝি না!’ ফোনের অপরপ্রান্তের মানুষটিকে উদ্দেশ্য করে বলল বর্ষা।
ফোনের ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল অভ্র, ‘আমি তোর মতো জংলী নই! যে সারাদিন চেঁচিয়ে যাবো।’
ঠোঁট জোড়া উল্টিয়ে রাগে কটমট করছে বর্ষা। ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে শানিত কন্ঠে অভ্র বলল, ‘আমি কাজ করছি, জরুরি কিছু বলার থাকলে বলে কল কাট। আর নয়তো বাড়িতে আসার পর ঠাসস করে একখানা চড় খাবি। ’
কোনো কিছু না বলে বর্ষা ফুঁসতে লাগে, ফোনের ওপাশ থেকে অভ্র আবারও বলল, ‘ ফুঁসাফুঁসি বাদ দিয়ে এখন বল কিছু লাগবে? ‘
বর্ষা আমতা আমতা করে বলে উঠল, ‘ আইসক্রিম খাবো! ’
অভ্র জানতে চেয়ে বলল, ‘ কি আইসক্রিম? ’
বর্ষা এক নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল, ‘ কোন, কাপ, বাটি, চকবার আর … ’
বর্ষার আরও কিছু বলার আগে অভ্র বর্ষাকে থামিয়ে দিয়ে কর্কশকন্ঠে বলল, ‘ থাপ্পড় চিনিস, আইসক্রিম খাবি নাকি আইসক্রিমের গোডাউন দিবি? ’
ভারী দীর্ঘ শ্বাস ফেলল বর্ষা পরক্ষণে শানিত কন্ঠে বলল, ‘ তাহলে ডাব নিয়ে এসো তিন থেকে চারটা! ‘
অভ্র তিরতির করে বলল, ‘ টাকা পাঠা ৩০০/৪০০ আসতে সময় নিয়ে আসবো! ’
বর্ষা রাগে চেঁচিয়ে বলল, ‘ ফাজিল টাকা পাঠানোর হলে তো আমিই বাজারে গিয়ে কিনে আনতে পারি। ’
‘ তাহলে আমার অপেক্ষা করছিস কেন গিয়ে নিয়ে আয়! ’ বলল অভ্র।
বর্ষা রাগী গলায় বলল, ‘ আমার ঘাট হয়েছে! ’
বলেই কল কেটে দিল, সামনেই বসে ছিলো বর্ষার চাচি আম্মু ও ফুপু। বর্ষাকে রাগান্বিত দেখে বর্ষার চাঁচি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ কিরে এত রেগে রেগে কার সাথে কথা বলছিস? ’
বর্ষা রক্ত চক্ষে তার চাঁচি আম্মুর দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলতে লাগল, ‘ বড় আম্মু তোমার ছেলেটা জন্মের বেয়াদব ও ফাজিল। আমি একটা আইসক্রিম আর নয়তো একটা ডাব আনতে বলছি সে উল্টো আমাকে বলে তাকে টাকা পাঠানোর জন্য আমি তাকে টাকা পাঠালে তৈ নাকি সে কিনে আনবে, হার কিপ্টে বজ্জাত একটা। ’
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে বর্ষা তাদের সামনে থেকে চলে যায়।
চলবে?