অনুভবে
পর্ব-২৮,২৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
২৮
“আমি জিজ্ঞেস করছি কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে?”
উচ্চ স্বরে বলায় কিছুটা ঘাবড়ে উঠে ইনারা। ভয়ও পেয়ে যায় সে সভ্যের এমন রাগ দেখে। সভ্যের রাগ সে আগে দেখেছে কিন্তু এমন রাগান্বিত মুখ আগে সে দেখে নি।
ইনারা এখন সত্যিটা তো বলতে পারে না। কিন্তু সভ্যের রাগ দেখে কথা ঘুরানোর সাহসও তার হয় না। তাই সে মিথ্যাটাই বলে, “ওই আ…আমার ভুলেই হয়েছে?”
“তোমার ভুলে? আর তা কীভাবে?”
“আহা হয়ে গেছে। হঠাৎ করে দেখি ব্রেসলেটটা ভেঙে গেল।”
সভ্য গম্ভীরমুখে এগিয়ে এসে ইনারার চোখে চোখ মিলিয়েই বলল, “কেবলমাত্র আমার পরিবারের পরিচয় অজানা থাকায় মেয়েরা আমাকে মিসট্রিরিয়াস প্রিন্স বলে অভিহিত করে। বাট গেস হোয়াট? তোমার মতো রহস্যের খনি আমি আগে দেখি নি। তুমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তবুও ডিজাইনার গাউন পরেছ ! আচ্ছা তোমার কাছে এত দামী পাথর লাগানো ব্রেসলেট কীভাবে এলো? চাপ না দিলে হঠাৎ করেই ব্রেসলেট ভেঙে তোমার হাতে ঢুকে যায়? অবুঝ পেয়েছ আমাকে? তুমি জানো আমি মিথ্যা বচন অপছন্দ করি কিন্তু তুমি মিথ্যা ছাড়া কিছুই বলো না।”
বলে থামলো সভ্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রাগটা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। তারপর পকেট থেকে তার রুমাল বের করে ইনারার হাতে বাঁধতে বাঁধতে শান্ত গলায় বলে, “তুমি কি লুকাচ্ছ আমি জানি না। তবে জানো আমি চাইলে পাঁচ মিনিটে তোমার বংশের ইতিহাস বের করতে পারি। কিন্তু তা আমি করব না। তোমার জীবন নিয়ে আমার হস্তক্ষেপ করাটা অনুচিত হবে। যেদিন তোমার মনে হবে আমি তোমার সত্যিটা জানার যোগ্য, সেদিন আমাকে বলো। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকবো।”
ইনারার কপালে শঙ্কার রেখা আঁকে। সে জিজ্ঞেস করে, “একটু বাড়িয়ে বললেন না? পাঁচ মিনিটে আমার বংশের পরিচয় বের করতে পারবেন? ব্যাপারটা যে কারও জন্যই অসাধ্য।”
সভ্য বাঁকা হাসে,”এ ব্যাপারে তোমার না ভাবলেও চলবে। আমি তোমার ব্যক্তিগত জীবনে কখনোই ঘাটাঘাটি করব না।”
“আপনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কী?”
সভ্য এবার চোখ তুলে তাকায় ইনারার দিকে, “কেন? তোমার হঠাৎ আমার সম্পর্কে এত জানার ইচ্ছা জাগলো কেন? আমার বউ হবার শখ জেগেছে না’কি?”
সভ্যের কথায় থতমত খেয়ে যায় ইনারা, “না এ-কি বলছেন? আপনার কথা শুনে আগ্রহ জাগে। তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“তাই? আচ্ছা যাও তোমার কথাই মেনে নিলাম। আর উওর সঠিক সময় হলে আপনা-আপনি পেয়ে যাবে। বেশি ব্যাথা করছে? ডাক্তারের কাছে যাবে?”
“ইশশ এতও লাগে নি। আপনি অকারণে চিন্তা করছেন।”
“তুমি অকারণে বিপদ ডেকে আনো তাহলে আমি অকারণে চিন্তা করবো না।”
“এহ আসছে, কে বলল আপনাকে আমার চিন্তা করতে?”
সভ্য তার পকেটে হাত দিয়ে ইনারার দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায় এবং বলে, “তো কে করবে শুনি?”
সভ্যের হঠাৎ এত কাছে আসাটা ইনারাকে অপ্রস্তুত করে দেয়। সভ্যকে এতটা কাছে দেখে তার আকর্ষণ থেকে রেহাই পায় না সে। নীল স্যুটে তার আকর্ষণীয়তা আরও বেড়ে গেছে। তার আকর্ষণীয়তা ইনারার কিশোরী মনের ভেতর উথাল-পাথাল করে দেয়। সে নিজ অজান্তেই সভ্যকে বলে ফেলে, “স্যুটে আপনার হ্যান্ডসামনেস হাজারোগুণ বেশি বেড়ে যায়।”
বলে নিজেই জিহ্বায় কামড় দেয়। এ কি বলে ফেলল সে? পাগল হয়ে গেল না’কি!
সভ্যেরও চোখ দুটো বড় বড় হয়ে পড়ে। আজ প্রথম ইনারা সরাসরি তার প্রশংসা করল। তাকে এই প্রথমবার হ্যান্ডসাম বলল। তার নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। সে অবিশ্বাস্য সুরে জিজ্ঞেস করে, “কি বললে তুমি? আমি মনে হয় ভুল শুনেছি। আবার বলো তো।”
“ওখানে তো পার্টি চলছে। ওদিকে যাওয়া উচিত এইবার। সকলে হয়তো অপেক্ষা করছে আমাদের। না পেয়ে খুঁজতেও পারে।”
ইনারা সামনে যেতে নিলেই সভ্য তার বাহু ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে এবং বলে, “আমার উওর দেওয়া ছাড়া কোথাও যাচ্ছ না তুমি। তুমি কি মাত্র আমাকে হ্যান্ডসাম বলেছ? তোমার কাছে আমাকে হ্যান্ডসাম লাগে?”
“এই সামান্য কথাটা এত বড় করার কি আছে? সকলেই তো আপনাকে হ্যান্ডসাম বলে।”
“কিন্তু তুমি তো আলাদা।”
মৃদু স্বরে বলে সভ্য। ইনারা অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। পরক্ষণেই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়।
সভ্য ইনারার হাত ধরে বলে, “তবে একটা কথা বলি?”
“হঁ”
“তোমাকে যে আঘাত দিয়েছে সে তোমাকে ভালোবাসে না। আমাদের ভালোবাসার মানুষকে কখনো আমরা এভাবে আঘাত দিয়ে ছেড়ে যেতে পারি না।”
কথাটায় ইনারার হৃদয়েও আঘাত লাগে। সভ্য এমনটা বলতে পারে কিভাবে? ঠিকাছে তার বাবা নারাজ হতে পারে কিন্তু তাকে ভালোবাসে না এমনটা হতেই পারে না। সকল মা বাবাই তো তাদের ভালোবাসে। নারাজ হলে মানুষ ভুল কতকিছুই তো করে ফেলে বা বলে থাকে তাই বলে কি তার বাবা তাকে ভালোবাসে না? কথাটা ভাবতে তার যত রাগ উঠে তার থেকে বেশি কষ্ট হয়।
ইনারার রাগ ও কষ্ট তার মুখে স্পষ্ট ভেসে উঠে। সে সভ্যের বুকে হাত রেখে তাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলে, “আপনি ডিসাইড করার কে? কে আমাকে ভালোবাসে আর কে না তা আমার বিষয়, আপনার না।
ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে সেখান থেকে চলে যায়। সভ্য বিব্রত হয়ে যায়। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। সে কি ভুল কিছু বলে ফেলেছে? সে ছুটে গেল ইনারার পিছনে।
ইনারা পার্টিতে ফিরে এসে রাগে হেঁটে যাচ্ছিল। এমন সময় কেউ এসে তার হাত ধরে নেয়। ইনারা ভাবে মানুষটা হয়তো সভ্য। তাই সে গলায় বলে, “বলেছি আপনার সাথে আমি কথা বলব না। যান তো।”
“আমি কী করেছি তোমার সাথে?”
কন্ঠটা শুনে ইনারা অবাক হয়। পিছনে ফিরে দেখে জোহান দাঁড়ানো। সে খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে আশা করেছিল সভ্যকে। সে বলে, “আপনি?”
“কেন অন্য কারো আশায় ছিলে না’কি?”
“না তো। আমি অন্য কার আশা থাকব!”
“আচ্ছা এসব কথা বাদ দেও। আমার সাথে আসো।”
“কোথায়?”
“আহা আসো না। স্যারপ্রাইজ আছে তোমার জন্য।”
জোহান ইনারার হাত ধরে তার সাথে নিয়ে যায়। ইনারা বিরক্ত হয় ভীষণ। এভাবে তাকে কোথাও নেওয়ার মানে হয় না। সে জিজ্ঞেস করে, “কোথায় নিচ্ছেন তা তো বলবেন।”
“দেখলেই বুঝতে পারবে।”
জোহান ইনারাকে দরজার বাহিরে নিয়ে গেল। ইনারা বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করে, “এবার বলবেন কি কারণে এখানে এনেছেন আপনি?”
“কেউ তোমার সাথে দেখা করার জন্য খুব ব্যাকুল। তার সাথে দেখা করানোর জন্য এনেছি।”
“কে?”
জোহান ইনারার কাঁধ ঘুরিয়ে তাকে পিছনে ফেরায়। ইনারা দেখে সৌমিতা আন্টি সেখানে দাঁড়ানো। তাকে দেখে ইনারা কিছু মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। তার চোখে জল ভেসে উঠে। সে দৌঁড়ে যেয়ে জড়িয়ে ধরে সৌমিতা আন্টিকে। কান্না করে উঠে। কেন যেন সৌমিতা আন্টির মাঝে তার মা’য়ের ছোঁয়া পায় ইনারা। তাই আবেগি হয়ে উঠে। অঝোরে কান্না করতে শুরু করে।
সৌমিতা আন্টিও ইনারাকে দেখে অবিশ্বাস্য ভাব নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তাকে কাছে পেয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “ইনু মামনি কেমন আছিস তুই? কতদিন পর দেখলাম তোকে। এতদিন বুঝি আন্টির কথা একটিবার মনে পড়ে নি?”
ইনারাও কাঁদোকাঁদো গলায় উওর দেয়, “আন্টি আপনিই বলেছিলেন আমাকে কল দিবেন। আর দিলেন না।”
“বলছ কি? আমি কতবার কল দিয়েছি তোমার বাসায়। তোমার ফুপি বলল তুমি আমার সাথে কোনো কথা বলতে চাও না।”
চমকে উঠে ইনারা। সে সৌমিতা আন্টিকে ছেড়ে দিয়ে তার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়।
“ফুপি বলেছে?” বিস্মিত সুরে বলে ইনারা, “কিন্তু উনি মিথ্যা কেন বলবে? আমি তো আরও শ্রীমঙ্গল থেকে আসার পর অনেকবার ঘরের সকলকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কল করেছিলেন কি-না! প্রতিবার উওর না এ পেয়েছি।”
ইনারা এবং সৌমিতা আন্টি দুইজনকেই বিব্রত দেখাল।
চলবে…
অনুভবে
পর্ব-২৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারা এবং সৌমিতা আন্টি দুইজনকেই বিব্রত দেখাল। এর মাঝে জোহান এসে তার মা’য়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, “আরে মা এসব ছাড়। এসব সুখের সময় চোখের পানি নষ্ট করো না-তো। এটা তো মিষ্টি মুহূর্ত এমন কাঁদলে চলে? তাই না ইনারা?”
ইনারা মিষ্টি হাসে। সৌমিতা আন্টির প্রতি জোহানের ব্যবহার দেখে সে স্বস্তি পায়। নয়তো ক’দিন আগে যখন জোহান ফোনে সৌমিতা আন্টির সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলো তখন সে জোহানের প্রতি অনেকটা সম্মান হারিয়ে ফেলেছিলো এবং সৌমিতা আন্টির জন্য চিন্তিত হয়েছিলো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তার মনের ভুল। অনেকেই তো রাগের বশে আপনদের সাথে বাজে ব্যবহার করে ফেলে।
ইনারার হাসিটা দেখে জোহান তাকিয়ে রইলো। চাঁদের মৃদু রশ্মিতে তাকে কেমন হুর-পরী দেখাচ্ছি। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখনই আকাশ থেকে নেমে এসেছে। ইশশ এত সুন্দর কেউ হয়?
“একদম।” ইনারা সৌমিতা আন্টির হাত ধরে বলে, “আন্টি এসব কথা পরে হবে আজ আমরা অনেক গল্প করব। অনেক।”
বলে ইনারা আবার জড়িয়ে ধরে সৌমিতা আন্টিকে। আর জোহানের দিকে তাকিয়ে ভেজা চোখ নিয়ে একগাল হেসে বলে, “থ্যাঙ্কিউ। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
জোহান যেন চাঁদ নিজের হাতে পেয়ে গেল। এতদিন নিজের বোকামির কারণে ইনারাকে নিজের থেকে অনেক দূর করে দিয়েছিল। ইনারার পোশাক দেখে সে ভাবতেও পারি নি এই মেয়েটা এত সুন্দরও হতে পারে। কিন্তু এবার সে একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একদম ঠিক ধারণা করেছিলো সে। মা’য়ের প্রতি কিছুটা দুর্বল ইনারা। তাই মা’কে এখানে এনে তার সাথে সব ঠিক করাটা সহজ হবে।
তিনজনে ভেতরে যায়। সৌমিতা এসব দেখে বড্ড অবাক হয়। আজ পর্যন্ত সে কোম্পানির কোনো পার্টিতে আসে নি। তাকে খুব খুশিও দেখায়। ঐশি দূর থেকে তার মা’কে দেখে ছুটে আসে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “মা তুমি এখানে?”
“জোহান ড্রাইভার পাঠিয়েছিলো আমাকে আনতে।”
ঐশি উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকাল জোহানের দিকে। তার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করছে। সে জোহানকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অনেক অনেক থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া। আমি জানতাম তুমি একসময় পর আবার আগের মতো আমার বেস্ট ব্রো হয়ে যাবে।”
সে আবার ছুটে যেয়ে তার মা’য়ের হাত ধরে বলে, “আসো মা তোমাকে সবার সাথে দেখা করাই।”
“এভাবে যাব? তোমাদের সবাইকে কত সুন্দর লাগছে আর আমাকে…”
ইনারা সৌমিতার আন্টির কথা কেটে বলে, “আপনাকে একদম নায়িকা লাগছে আন্টি। আপনার সামনে তো আমরা পানিভাত। তাই না ঐশি আপু?”
“একদম। আম্মু তুমি তো এমনিতেই সুন্দর। আসো তো।”
ঐশি তার মা’কে নিয়ে যাবার পর আকস্মিকভাবে জোহান জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি এখনো দীপার কথা নিয়ে আমার সাথে নারাজ?”
“না তো। উনার ব্যাপার নিয়ে আমি আপনার সাথে নারাজ হতে যাব কোন দুঃখে?”
“না মানে তুমি আর আগের মতো আমার সাথে কথা বলো না তাই।”
ইনারার মনে পড়ে সেদিন দীপা যাবার পর জোহান তার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলো। এমন কিছু কথা বলেছিলো যা শুনে সে আসলেই জোহানের প্রতি তার মনে থাকা সম্মানটা কমে গিয়েছে।
জোহান আবার বলে, “আসলে আমি দীপাকে অনেক বুঝিয়েছি। ও তখন আমার গার্লফ্রেন্ড ছিলো। ওর সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় আমি ওকে সকলের সামনে ছোট করতে পারি না। কিন্তু ও কিছুতেই বুঝতে রাজি নয়। তাই অবশেষে না পেরে ব্রেকাপ করে নিয়েছি। কি হলো ইনারা? তুমি কিছু বলছ না কেন?”
“কী বলব? আপনার ইচ্ছা হয়েছে করেছেন। কিন্তু আমি অনেক খুশি যে আপনি সৌমিতা আন্টির সাথে আমার দেখা করালেন। আন্টিকে দেখলেই আমার মা’য়ের কথা মনে হয়। মা সবসময় সৌমিতা আন্টি এবং তার ছবি দেখাতেন এবং গল্প শুনাতেন।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনারা। মৃদু হেসে তাকায় জোহানের দিকে, “থ্যাঙ্কিউ।”
সে মিষ্টি হাসিটা দেখে জোহান খানিকটা ঘোরে হারিয়ে গেল। আজ মেয়েটার এত ছোট ছোট জিনিসও তাকে এমন মোহে বেঁধে দিচ্ছে কেন?
“তুমি এখানে?” সভ্যের কন্ঠ শুনা যায়। ইনারা তার দিকে তাকিয়ে দেখে সে হাঁপাচ্ছে। সভ্য বলে, “এভাবে কেউ কথোপকথন শেষ না করে বেরিয়ে আসে? এতক্ষণ ধরে খুঁজছি তোমাকে। কোথায় ছিলে?”
“আপনাকে কেন বলতে হবে আমার?”
“উফফ তোমার হঠাৎ করে কি হয় বুঝি না। এক মুহূর্তে তোমার রাগ উঠে যায়। আমি ভুল কি বলেছি তা তো বলবে।”
“এখন এটাও আমার বলতে হবে? আপনি বুঝতে পারছেন না আপনি কী ভুল বলেছেন?”
“না বুঝতে পারছি না। তারপরও সরি বলছি। এবার খুশি? এখন আমার সাথে আসো। তোমার হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে আনি।”
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।”
“আর বললেই আমি তোমার কথা মানবো? আসো।”
ইনারার হাত ধরার জন্য সভ্য হাত বাড়াতেই জোহান তাকে আটকায়। কপাল কুঁচকে বলে, “শুনতে পারিস নি ও কি বলেছে? ও তোর সাথে যেতে চায় না। এতোটুকু কথা ও কি বুঝতে পারছিস না?”
“এটা সম্পূর্ণ ওর এবং আমার ব্যাপার। তোকে মাঝখানে আসতে বলা হয় নি।”
“আর আমি মাঝখানে আসলে তুই কি করবি?”
সভ্য বাঁকা হেসে তার পকেটে হাত গুঁজে এক পা এগোয় জোহানের দিকে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, “আজ হঠাৎ করে ইনারার প্রতি তোর ধ্যানটা একটু বেশিই যাচ্ছে না?”
জোহান কথাটা শুনে একটু ঘাবড়ে যায়। আড়চোখে একবার ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “এ-এমন কিছু না। আর হলেই তোর কি আসে যায় শুনি?”
“আমার অনেক কিছু আসে যায়। আমি….”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই সভ্য সৌমিতা আন্টির কথা শুনতে পায়, “আরে সভ্য না?”
সভ্য সৌমিতা আন্টিকে দেখে অবাক হয়। সাথে খুশিও। সৌমিতা আন্টি এসে সভ্যের দুই গাল ধরে মায়াভরা চোখে তাকে দেখল কিছুক্ষণ ভরে। তার চোখে পানি চলে এলো। সে সভ্যের কপালে একখানা চুমু খেয়ে বললেন, “আগে সবসময় জোহান ও ঐশির সাথে আমার আগে পিছে “মিষ্টি মামনী” বলে বলে ঘুরে বেড়াতে। আজকাল বুঝি একবারও মনে পড়ে না আমার কথা?”
সভ্যের চোখে মুখে বিষাদ ছড়িয়ে গেল। সে একনজর তাকাল জোহানের দিকে। সেই দুঃখময় দৃষ্টি নিয়ে। তার বুক চিরে বেরিয়ে আসে বিষাদের নিশ্বাস। তারপর সে সৌমিতা আন্টির দিকে তাকিয়ে তার হাত নিজের হাতে নিয়ে মৃদু হেসে বলে,”প্রতিদিন আপনার কথা মনে পড়ে মাননী। ঐশিকে প্রতিদিন আপনার কথা জিজ্ঞেস করি। আপনার কথা খুব মনে পড়ে। বিশেষ করে আপনার হাতের বাঙালি খাবারগুলো।”
“যখন খেতে মন চাইবে চলে আসবে।”
“এখন তো আর সবকিছু আগের মতো নেই আন্টি যে ইচ্ছে হলেই ছুটে আসতে পারব।”
কথাটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠে সভ্যের। ইনারা অবাক হয়। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে একবার জোহানের দিকে তাকায়, আবার সভ্যের দিকে। প্রথমে সে দুইজনের মাঝের ঝগড়াটা মজা হিসেবে নিলেও এখন মনে হচ্ছে আসলেই গম্ভীর কোনো কিছু হয়েছে তাদের মাঝে।
সামি এসে ইনারার কাঁধে হাত রেখে বলে, “হাই পার্টনার তোমাকে তো আজ একদম হিরোইন লাগছে।”
“দেখতে হবে না পার্টনার কার? তোমাকে ড্যাশিং লাগছে।”
সামি নিজের কোর্টের কলার ঠিক করে বলল, “তাই না? আমারও তাই ফিল হচ্ছে। পার্টিতে সবচেয়ে হ্যান্ডসাম আমাকে লাগছে না?”
ইনারা এর উওর দেবার পূর্বে একটু বিরতি নিল। আড়চোখে একবার সভ্যের দিকে তাকিয়ে লজ্জা পেল। চোখ নামিয়ে নিলো। মৃদুস্বরে বলল, “একদম।”
“কথাটা কনভেনসিং লাগছে না তো পার্টনার। মনে অন্যকারও নাম রেখে কি মুখে আমার প্রশংসা করছ না’কি?”
দুষ্টুমি করে বলল সামি। ইনারার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে গেল তার কথা শুনে। কেন যেন সে ঘাবড়ে যায়। যেন তার বড় কোনো চুরি ধরা পড়েছে। সে কি উওর দিবে বুঝতে পারছে না। কিন্তু বেঁচে গেল সে। তার উওর দেবার প্রয়োজন পরলো না। এর পূর্বেই ঐশি বলল, “বান্দররাও স্যুট পরে আসলে তোর থেকে বেশি সুন্দর লাগবে ওদের।”
কথাটা শুনে সবাই হেসে ফেলে। তারপর কিছুক্ষণ কথা বলে সকলে। কিন্তু জোহান এর ব্যাপারটা ভীষণ বিরক্তকর লাগে। সে ইনারার সাথে একা কিছু সময় কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু সকলে দল বেঁধে বসে আছে। কারও যাবার নামই নেই। না পেরে সে ইনারাকে বলল, “ইনারা তোমার হাতে ব্যথা পেয়েছিলে? আমার সাথে আসো, আমি ব্যান্ডেজ করে আনছি।”
“না, প্রয়োজন নেই। তেমন ব্যথা পাইনি।”
সৌমিতা আন্টি ঘাবড়ে যেয়ে বললেন, “সে কি ইনুমণি তুমি ব্যাথা পেয়েছ?”
“না আন্টি চিন্তা করার মতো কিছু নেই। এত ব্যথা পাইনি।”
“তবুও কিছু হবার আগে ব্যান্ডেজটা করে নিলে তো ভালো।” জোহান বলল। সৌমিতা আন্টি তার কথার সাথে একমত হয়ে বলল, “একদম। যাও, জোহানের সাথে যাও।”
ইনারা সৌমিতা আন্টিকে মানা করতে পারে না। তাই জোহানের সাথে যায়। যাবার সময় একবার সে সভ্যের দিকে তাকায়। তার চোখে হতাশা স্পষ্ট। কিন্তু এই হতাশা কারণটা ইনারা ধরতে পারল না।
জোহানের সাথে যাবার সময় মাঝরাস্তায় তাদের দেখা হয় দীপার সাথে। দীপা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। কিন্তু তাকে কিছু বলে না। সে জোহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
ইনারা বলে, “আপনারা কথা বলেন। আমি আসছি তাহলে।”
কিন্তু জোহান তাকে যেতে দেয় না। তার হাত ধরে নিয়ে দীপাকে উওর দেয়,
“কিন্তু তোমার সাথে আমার কোনো কথা নেই। আর আমার মনে হয় না আমাদের কোনো কথা বলার প্রয়োজন আছে।”
জোহান আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ইনারাকে নিয়ে যায়।
রাগে, অপমানে দীপার শরীর জ্বলে ওঠে। রক্ত মাথায় চড়ে যায়। এই সামান্য এক মেয়ের জন্য তার মতো এত বড় অভিনেত্রীকে এভাবে অপমান করল জোহান। তার জন্য এক মুহূর্তে না ভেবে এভাবে ছেড়ে দিলো তাকে? সে কোন দিক থেকে সৌন্দর্যে কম? দেশ-বিদেশের কত পুরুষ তার সৌন্দর্যের পাগল! আর জোহান এই তুচ্ছ মেয়ের জন্য তাকে ছেড়ে দিলো? মাথা ঠিক রইলো না আর দীপার। সে একটা ওয়েটারকে ডাক দিয়ে তাকে কিছু টাকা দিয়ে বলল ইনারার কোক-এ এলকাহোল মিশিয়ে পান করাতে। আজ সে এই মহলে তার তামাশা হতে দেখবে এবং শান্তি পাবে।
জোহান ইনারার হাত ব্যান্ডেজ করিয়ে আনার পরই সে অন্যদিকে চলে যায়। তার বন্ধু সুরভি ও প্রিয়’র কাছে। তাদের সময় দেয়। কিন্তু তা বেশিক্ষণের জন্য নয়। সুরভীর রাত দশটার আগে বাসায় যেতে হবে। তাই প্রিয় তাকে নিয়ে গেল। অন্যদিকে ইনারা তো এত ধরনের খাবার দেখে আর লোভ সামলাতে পারে না। খাদক মেয়ে সে। এর উপর কেক তার অত্যাধিক পছন্দ। এখানে কয়েক ধরের পেস্ট্রি আছে। সবগুলো ট্রাই করতে শুরু করে সে। গলা ভেজাতে ওয়েটারের কাছে কোল্ড ড্রিংক চাইলো। কিন্তু ড্রিংকটা পান করার পর তার অন্যরকম লাগল। ভালো লাগে নি কিন্তু আবার পান করার তীব্র ইচ্ছা জাগে। তাই সে আবারও আনায়। এমন করেদুই তিন গ্লাস পান করে সে। হঠাৎ তার মাথা ঘুরাতে শুরু করে। চোখের সামনে সব ঝাপসা দেখতে শুরু করে সে।
সভ্য সারা সভা খুঁজে ইনারাকে পায় সুইট খাবারের স্টলের সামনে। সে সেখানে যেয়ে কোনো কথা না বলেই ইনারার হাত ধরে তাকে টান দিয়ে নিয়ে যায় ব্যালকনিতে। যেন ইনারা তাকে মানা করতে না পারে। সেখানে নেবার পর সে ইনারার হাত ছেড়ে তাকে শান্ত ও চিন্তিত বলে, “দেখো ইনারা আমি জানি না তুমি আমার কোন কথায় কষ্ট পেয়েছো কিন্তু আই এম সরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। তুমি এভাবে আমার কাছ থেকে পালাতে পারো না।”
ইনারা হাসে। কেমন অদ্ভুত ভাবে! আচমকায় সে তার পা’য়ের পাতায় ভর করে উঁচু হয়ে দাঁড়ায় আর সভ্যের গালে একটা চুমু খায়।
সভ্য তো হতবাক। তার চোখদুটো বড় বড় হয়ে যায়। সবে কি হলো সে বুঝতে পারছে না। ইনারা হঠাৎ এমন কিছু করবে সে কল্পনাও করে নি। সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে। মেয়েটা ঠিক আগের মতোই অদ্ভুতভাবে হাসে। আর সভ্যের দুই গাল টেনে বলে,
“কীভাবে ব্যাঙের মতো তাকিয়ে আছেন? আলে আমার হ্যান্ডসাম ব্যাঙটা কত কিউট! আপনি এত হ্যান্ডসাম কেন বলুন তো?”
পরের মুহূর্তে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে সভ্যের বুকেতে। আবার সে মুখ ফুলিয়ে আদুরে গলায় বলে, “সব মেয়েরা কীভাবে আপনার দিকে তাকায়। আমার একদম ভালো লাগে না।”
সভ্যের বুকের বা’পাশে হাত রাখে সে, “আপনার বুকের স্পন্দন এত দ্রুত দৌড়াচ্ছে কেন বলুন তো?”
সভ্যের গলা দিয়ে একটা শব্দও বের হলো না। তার হৃদয়ের স্পন্দন গতি এই মুহূর্তে দিশেহারা। মনের ভেতর কেমন যেন করছে। যেন পৃথিবীর সকল শান্তি ইনারার সাথে তার বুকে এসে ঝাপিয়ে পড়েছে। কি এই অনুভূতি? কেমন? বর্ণনা করার সাধ্য তার নেই। এটা তো অনুভূতি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর অনুভূতি। ভালোলাগার অনুভূতি। ভালোবাসার অনুভূতি। এই অনুভূতি বর্ণনা করার সাধ্য কারও আছে কী? এই অনুভূতি তো রয়ে যায় কেবল অনুভবে….
চলবে…..