অনুভবে পর্ব-৩২,৩৩

0
1090

অনুভবে
পর্ব-৩২,৩৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
৩২

সভ্য ইনারার এমন লজ্জামাখা মুখ দেখে ফিক করে হেসে দিলো, “তোমার নাক মুখ দেখি লজ্জায় লাল হয়ে গেছে। গতরাতের সব কথা ভুলে গেলে না’কি?”
ইনারা চমকে মুখ তুলে তাকায়। তার হঠাৎ করে পার্টিতে ব্যালকনি দৃশ্যটা মনে পড়ে। সে সভ্যের গালে একখানা চুমু দিয়ে তার কাছে চুমুর আবদার করছিলো। মনে পড়তেই চোখদুটো ছানাবড়া হয়ে যায় তার। লজ্জায় গলা দিয়ে কোনো শব্দও বের হচ্ছিল না তার। আর চোখ মিলিয়ে রাখতে পারে না সে সভ্যের সাথে। সে মুখ নামিয়ে নেয়।

সভ্য বাঁকা হাসে। তার কেন যেন ইনারার এমন লজ্জামাখা ভাবটা অসম্ভব ভালো লাগে। তার ব্যক্তিত্ত্বের প্রতিটি রূপই ভিন্ন। আর তার প্রতিটি রূপেরই প্রেমে পড়তে ইচ্ছে করে। তার লজ্জা আরেকটু বাড়ানোর ইচ্ছে হলো সভ্যের। গতকাল মেয়েটা অনেক জ্বালিয়েছে। আজ একটু মজা নিতে দোষ কীসের?

সভ্য ইনারার দিকে ঝুঁকে দুষ্টুমি করে বলল, “তো গতকাল কীসের এত আবদার করেছিলে ভুলে গেছ? আবদারটা পূরণ করব?”
ইনারা চক্ষু দুটো কপালে তুলে তাকায় সভ্যের দিকে। সাথে সাথে পিছিয়ে যেতে নিলেই তার গাউনে পা লেগে পড়ে যেতে নেয়। সভ্য আবারও তাকে ধরে নেয়। কোমরে হাত রেখে তাকে নিচে পরে যাওয়া থেকে বাঁচায়। আবার এক টানে তাকে কাছে টেনে নেয়। দৃষ্টিমিলন ঘটে।

সভ্য ইনারার কপালে আসা চুলগুলো আলতো আঙুলে সরিয়ে নেয়। চুলগুলো যে তার এত সুন্দর দৃশ্যের মাঝে আসছিলো। এই অপরূপ দৃশ্যটি হলো ইনারার লজ্জামাখা মুখ। তার ভিজে যাওয়া কপাল, চোখের পলক, গাল, ঠোঁট সবটা। ঝর্ণার পানি যখন গড়িয়ে পরছিলো ইনারার মুখে তার ইচ্ছা হচ্ছিল এই জল হয়ে একবার ছুঁয়ে দিতে তাকে। কিন্তু গতরাত কেটে গেছে। ইনারাও আর নেশায় মাতাল নেই, যে গতকালের মতো বাচ্চামো গুলো করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে সে ইনারার এই লজ্জামাখা মুখ দেখে মাতোয়ারা হয়ে যাচ্ছে। আকর্ষিত অনুভব করছে সে। এর উপর তার স্বর্ণোজ্জ্বল কেশের উপর আলাদা এক দুর্বলতা আছে তার। ঝর্ণার জলে ভিজে সে কেশগুলোর সৌন্দর্য আরও বেড়ে গেছে।

সে ইনারার লম্বা কেশ নিয়ে খেলা করছিলো। কেমন অদ্ভুত ব্যাপার! যে দুটো মানুষ সারাক্ষণ ঝগড়া করে কাটায়। এই মুহূর্তে দুইজন একে অপরের চোখে ডুবে আছে। দুইজনের মুখে কোনো কথা নেই। চারপাশে কেবল ঝর্ণার জলের শব্দ।

সভ্য হঠাৎ বলল, “আই এম সরি। গতকাল না বুঝে তোমাকে সে কথাটা বলা উচিত হয় নি।”
ইনারা খানিকটা অবাক হয়, “কোন কথা?”
“যে তোমাকে আঘাত করেছে সে তোমাকে ভালোবাসে না একথা।”
ইনারার সে কথা মনে পড়ে। সাথে সাথে সে সভ্যের থেকে দূরে সরে ঝর্ণাটা বন্ধ করে দেয় এবং বলে, “আমি এ ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।”
বলে সে যেতে নেয়। কিন্তু সভ্য তাকে যেতে দেয় না। সে তার হাত ধরে নেয় এবং বলে, “কিন্তু আমি বলতে চাই। আমার একটা বাজে অভ্যাস আছে। মাঝেমধ্যে না ভেবেই কথা বলে ফেলি। সে কথাটা সামনেরজন কিভাবে নিবে তাও ভাবি না। মাথাতেই আসে নি তোমার কথাটা খারাপ লাগতে পারে। হতে পারে যে তোমাকে আঘাত করেছে সে তা খেয়ালই করে নি। এ কথা পরে মাথায় এলো। আমি মন থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি কিন্তু সহজে কাওকে সরি বলি না। যেহেতু তোমাকে বলছি সেহেতু আমি তা মিন করেই বলছি। এখন তুমি রাগ ছাড়বে না’কি গতকাল রাতের কথাগুলো আবার মনে করাব?”
“না না, কোনো দরকার নেই। একদম গতরাতের কথা তুলবেন না।”
ফিক করে হেসে দিলো সভ্য। শব্দ করে।
ইনারা বিরক্তির সুরে জিজ্ঞেস করে, “এত হাসির কি বলেছি?”
“গতরাতের কথাগুলো মনে পড়ছে।”
“দেখুন একদম হাসবেন না।”
ইনারা মুখে কথাটা বললেও সভ্যের হাসি দেখে ইনারা চোখ ফেরাতে পারে না। কী সুন্দর হাসি! তাকে এভাবে আর কখনো হাসতে দেখে নি ইনারা। বাস্তব জীবনে তো না-ই, টিভিতেও কখনো বিশেষ হাসে না সভ্য। হাসাও উচিত না। এত সুন্দর হাসিটা সবার দেখা উচিত না। এই হাসির সাক্ষী কেবল সে থাকলেই হবে। সব রাগ, অভিমান ভুলে যায় ইনারা। সভ্যের হাসি দেখে তার ঠোঁটেও হাসি এঁকে উঠে।

সভ্য হাসতে হাসতে চোখ পড়ে ইনারার ঠোঁটের মিষ্টি হাসির উপর। তার হাসির শব্দটা কমে আসে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায় সে ইনারার দিকে। তার মনে পড়ে গতকালের ইনারার কান্না। সাথে সাথে তার বুকের ভেতর চিনচিন ব্যাথা উঠে। সে মুগ্ধ গলায় ইনারাকে বলে, “জানো তোমাকে হাসলে খুব সুন্দর দেখায়। সবসময় হাসতে থাকবে।”
সে ইনারাকে গতরাতের কান্নার কথা জানায় না। হয়তো ইনারা সেসব কথা কাওকে জানাতে চায় না। তাকে নেশায় বলে ফেলেছে। জানলে হয়তো সে লজ্জিত হবে, অস্বস্তিবোধ করবে। তাই কথাগুলো তার মধ্যেই থাক। কেবল তার মনের খাঁচায় বন্দী থাক গতরাতের সুন্দর স্মৃতির পাখিগুলো। সে মনে মনে বলল, “আমি তোমার ঠোঁটের হাসির জন্য সব সহ্য করতে পারি, কিন্তু তোমার কান্নাটা কেন যেন আমার সহ্য হয় না।”

“আপনি হঠাৎ এ কথা বললেন কেন?” প্রশ্ন করে ইনারা। সভ্যের ভাবনার পরিসমাপ্তি ঘটে। সে বলে, “এমনিতেই। আমি তোমার জন্য কাপড় দিচ্ছি। চেঞ্জ করে নেও। নাহলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
ইনারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

সভ্য বের হয়ে আলমারি থেকে তার কিছু জামা বের করে দেয়। তারপর সে-ও অন্যরুমে যেয়ে চেঞ্জ করে নেয়। চেঞ্জ করা শেষে রান্নাঘরে যেয়ে ইনারার জন্য লেবুপানি বানায় এবং তার জন্য নাস্তা তৈরি করতে শুরু করে। এর মাঝে হঠাৎ করে তার আবারও মনে পড়ে ইনারার বলা গতরাতের কথাগুলো। কথাগুলো কিছুতেই তার মাথা থেকে যাচ্ছে না। তাই সে নিজের ফোন বের করে কাওকে কল দিলো। এবং খুবই গম্ভীর গলায় বলল, “হ্যালো আমি সভ্য। আমি তোমাকে একটি মেয়ের নাম দিচ্ছি। আমার কোম্পানিতে কাজ করে। তার এবং তার পরিবারের সব তথ্য আমি আজই চাই। আর এ কথা দাদুভাই বা অভ্র ভাইয়া না জানে। কিছুতেই না। আমি তার নাম এবং কোম্পানিতে যে ডিটেইলস আছে তা দুইঘন্টার মধ্যে পাঠাচ্ছি।”
.
.
ইনারা গাউন চেঞ্জ করে সভ্যের গেঞ্জি এবং টাউজার পরেছে। দুটোই তার জন্য অনেক বড়। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে দেখছে নিজেকে। সে তো সবসময়ই এমন গেঞ্জি এবং টাউজার পরে। তাহলে আজ নিজের কাছে নিজেকে আলাদা লাগছে কেন তার? সভ্যের পরা গেঞ্জি পরায়? সে কী লজ্জা পাচ্ছে? সে নিজেই আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, “ইনুর বাচ্চা নিজেকে সামলা তো লজ্জায় যেন গাল দুইটা টমেটোর মতো লাল হয়ে গেছে। কী অবস্থা!”

কথাটা বলেও হঠাৎ তার মাথায় কি এলো সে তার পরা গেঞ্জিটা নাকের কাছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গভীর নিশ্বাস ফেলল। সভ্যের ঘ্রাণ নেবার ব্যর্থ চেষ্টা। কিন্তু তার ঘ্রাণ না পাওয়ায় নিরাশ হয় সে। বিরক্তও হয়। আবার আয়নার দিকে নিজেকে দেখে অবাকও হয়। সে সভ্যের ঘ্রাণ না পাবায় এমন নিরাশ হচ্ছে কেন?

কথাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয় সে। ডাইনিং রুমে যেয়ে দেখে সভ্য টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে। সভ্য রান্নাঘর থেকে আরো দু প্লেট খাবার নিয়ে আসতে আসতে তার দিকে তাকাল। বলল, “তোমার ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে আমার রান্না শেষ হয়ে গেল। এত সময় লাগে!”
“উফফ আপনিও না খালাজানের মত সারাক্ষন ভুল ধরতে থাকেন।”
ইনারা এসে টেবিলে বসে। সভ্য তার সামনে একটি লেবুর শরবতের গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে, “এই নেন ম্যাম, এটা খেলে আপনার গতরাতের কোকাকোলার নেশা কেটে যাবে।”
ইনারা রাগী দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “মশকরা করছেন?”
“আমি মশকরা করব? এত সাহস আছে আমার? পরে তো রাগ করে আবার চুমুর আবদার করে বসবে। বলবে তোমার প্রথম চুমুটা ফেরত দিতে।”

কথাটা শুনে ইনারার চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। সভ্য গালে হাত দিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে একপলক সভ্যের দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো। জলদি করে খেতে শুরু করলো। তার আবারও মনে পড়লো গতরাতের ব্যালকনির কথা। কেমন বেহায়ার মতো সে সভ্যের কাছ থেকে চুমুর আবদার করছিলো। ভাবতেই তার জান চলে যাচ্ছে। এর উপর না-কি সে তার ফার্স্ট কিস দিয়ে তা ফেরতও চাচ্ছিল! ইশশ কি লজ্জাজনক ফাঁদে-ই না পড়লো সে। সে হঠাৎ করে টেবিলে ঘুষি মেরে বলল, “ওই ওয়েটারকে পাইলে কাঁটা চামচ দিয়ে খুন করব আমি। কোল্ড ড্রিংক এর নামে কি খাওয়ালো কে জানে!”
“আহা এখনো জানো না? এলকাহোল খাইয়েছিলো। যা খেয়ে তুমি তোমার ফার্স্ট কিস ফিরিয়ে দেবার আব…”

ইনারা দ্রুত উঠে এসে সভ্যের সামনে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে বলল, “দেখুন আর একবার গতরাতের কথা তুললে কিন্তু… কিন্তু আমি কাঁটা চামচ দিয়ে আপনারও খুন করব।”
ইনারার হঠাৎ মনে পড়লো তার ব্যালকনির কথাটা বাদে আর কিছুই মনে নেই। সভ্য আসলে তাকে কিস করে নি তো? চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল তার। সে সভ্যের দিকে তাকাল। কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছিল না সে। তাই বলল, “আপনি আসলে ওটা করেন নি তো?”
সভ্য উঠে দাঁড়ায়, “কোনটা?”
“ওটা…মানে আমি যা ফিরিয়ে দেবার কথা বলছিলাম।”
সভ্য এক পা এগোয়। বুঝেও অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করে, “সরাসরি বলো তো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

ইনারা রাগে বিড়বিড় করে বলে, “হনুমানের নাতি সব বুঝতে পারছো তুমি। আমাকে লজ্জা দেবার ধান্দা সব।”

“যা বলছ একটু শব্দ করেই বলো। আমিও শুনি।” সভ্য বলল।
ইনারা একটু কেশে নিয়ে বলে, “কিছু না থাক।”
বলে সে যেতে নিলেই সভ্য তার রাস্তা আটকায়। তার পিছনে টেবিল ছিলো। তার দুইপাশে হাত রেখে তার পথ আটকে সে বলে, “এবার বুঝেছি। গতকালের কিসের কথা বলছ তো? আসলে গতরাতে তেমন কিছু করি নি। আমি আবার ড্রাঙ্ক মেয়েদের ফায়েদা উঠাই না। কিন্তু তুমি যেহেতু এখন হুঁশে আছো তোমার আবদার পূরণ করতেই পারি। আমি আবার কারও ঋণ রাখি না।”
সভ্য ঝুঁকে ইনারার দিকে এগোতে নেয়। ইনারা জড়োসড়ো হয়ে যায়। সেও টেবিলে হাত রেখে ধীরে-ধীরে পিছনে ঝুঁকতে থাকে। দুইজনের দৃষ্টি একে অপরের সাথে আটকে আছে। ইনারার হৃদয়ের স্পন্দন দ্রুত হয়ে গেছে। তার নিশ্বাস গভীর। তার দৃষ্টি লজ্জাময়।

হঠাৎ করে কলিংবেল বাজে। দুইজনেই চমকে উঠে। সভ্য দরজার দিকে তাকিয়ে বলে, “নাস্তার সময় হয়েছে। তাই সম্ভবত ইরফান আর সামি এসেছে।”
“কী!” ইনারা চমকে উঠে। সজোরে ধাক্কা দেয় সভ্যকে। সে পরে যেতে নিলেই আবার কলার ধরে নিজের দিকে টান দেয়। সভ্য হাফ ছেড়ে বলে, “এখনই তো হাড্ডি ভাঙতো।”
“হাড্ডি পরে ভাঙেন। এখন লুকানোর ব্যবস্থা করেন।”
“আমার বাসায় আমি লুকাবো কেন?”
“আরে গদ্ধবের সহপাঠী আমারে লুকানোর ব্যবস্থা করেন।”
“কেন?”
“কেন মানে? কেউ যদি দেখে আমি সারারাত আপনার বাসায় ছিলাম কী ভাববে?”
“কি ভাববে?”
“আপনার এত ভাবাভাবির দরকার নেই। আমি লুকাতে গেলাম।”
“আরে তুমি কি গতকালের ড্রেস পরা আছো না’কি যে বুঝবে?”
“কিন্তু আপনার জামা পরা দেখলেই তো বুঝবে।”
“ওহ তা তো ভাবি নি।”
“ভাববেন কেন? সকাল থেকেই আমাকে জ্বালানোর পরিকল্পনাই তো মাথায় চলছে। আমি গেলাম। আপনি এদিকে সামলান।”
বলে এক দৌড়ে পালালো ইনারা।

সভ্য দরজা খুলে দেখে ইরফান এবং সামির সাথে ঐশিও আছে। সে তাদের তিনজনকে নাস্তা দিয়ে বেডরুমে এলো ইনারাকে খুঁজতে। সে বাথরুমে দেখে ইনারা সেখানে নেই। আলমারিতেও চেক করে সেখানেও পায় না।

ইনারা ছিলো বারান্দায়। সে সভ্যকে খুঁজতে দেখে সেখান থেকে বের হতে নিলেই দেখল ঐশি দরজা দিয়ে ঢুকছে। সাথে সাথে সে আবারও লুকিয়ে পরলো।

সভ্য ঐশিকে জিজ্ঞেস করল, “আরে তুই এখানে? নাস্তা কি ভালো লাগে নি? নতুন কিছু বানিয়ে দিব?”
ঐশির চোখেমুখে হঠাৎ কাঁদোকাঁদো ভাব ছড়িয়ে গেল। সে দরজা থেকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো সভ্যকে। সাথে সাথে ইনারার বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে। সে স্তব্ধ হয়ে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে তাদের দিকে। দম বন্ধ আসছিলো তার। সে সাথে সাথে সরে যায়। বারান্দার জানালা থেকে সরে তার দেয়ালে হেলান নেয়। তার গালটা হঠাৎ ভেজা ভেজা লাগছে। তার গালে হাত রেখে দেখে এক বিন্দু জল। সে কী কাঁদছে? সভ্য এবং ঐশিকে একত্রে দেখে তার এমন কষ্ট লাগছে কেন?

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-৩৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

হঠাৎ ঐশি এভাবে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরায় সভ্য ঘাবড়ে যায়। সে ঐশির মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে তোর? সব ঠিক আছে তো?”
ঐশি কাঁদোকাঁদো গলায় বলে, “ঠিক নেই। আমার কিছু ভালো লাগছে না। অশান্তি লাগছে। আমার ইচ্ছে করছে আমি সব ছেড়ে…”
এতটুকুতেই সভ্য ঐশিকে থামিয়ে দেয়। তাকে উঠিয়ে গাল মুছে দিয়ে বলে, “এখন কথাগুলো বলা লাগবে না। আমরা একটুপর কথা বলব। বাহিরে সামি ও ইরফান আছে। ওরা তোকে কাঁদতে দেখলে নানান প্রশ্ন করবে।”
ঐশিকে থামানোর কারণ হলো সে চায় না ঐশির ব্যক্তিগত জীবনের কোনো কথা তার অজ্ঞাতে কেউ জানুক। সে হোক ইনারা। যতক্ষণ পর্যন্ত ঐশি না চায় তার ব্যক্তিত্ব জীবনের কোনো কথা কেউ জানার অধিকার রাখে না। তাই তাকে থামিয়ে বুঝিয়ে রুম থেকে বের করে সভ্য।

ঐশিকে বের করে সভ্য ইনারাকে আবারও খুঁজতে থাকে। তাকে পায় বারান্দায়। ইনারাকে সেখানে দেখে জিজ্ঞেস করে, “তুমি তাহলে এখানে?”
ইনারা মুখ অন্যদিকে করেছিলো। তাই তার মলিন মুখখানা দেখা যাচ্ছিল না। সে বলল, “তুমি চিন্তা করো না আমি জলদি ওদেরকে খাইয়ে বের করছি।”
“আচ্ছা।”
ইনারার কন্ঠে অন্যরকম এক উদাসীনতা ছিলো। যা ঠিকই ধরতে পেরেছে সভ্য। সে ইনারাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে সরু চোখে তাকে ভালো করে দেখল, “তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?”
ইনারা মাথা নাড়ায়, “না।”
“তাহলে তোমার মুখ এমন মলিন লাগছিল কেন? আর তোমার কন্ঠ কাঁপানো।”
“এমনিতেই। আমি বাসায় যাব। আপনার উনাদেরকে পাঠাতে হবে না। কেবল অন্যরুমে নিয়ে যান, আমি চলে যাব।”
“একা? অসম্ভব! আমি তোমাকে দিয়ে আসবো।”
“প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারবো। তাদের হঠাৎ এভাবে বের করলে সন্দেহ করতে পারে।”
“কিন্তু…. ”
“আমি বলেছি তো আমি যেতে পারবো। জেদ করছেন কেন?” খুবই রুক্ষ গলায় বলল ইনারা। তার কন্ঠে রাগান্বিত ভাব। সভ্য তার এমন আচরণ দেখে অবাক হয়। এ সময় তার সাথে এ বিষয়ে কথা না বলাটাই উচিত মনে করে। তাই সে রাজি হয়ে যায়, “আচ্ছা ঠিকাছে। কিন্তু ড্রাইভারের সাথে যেতে হবে তোমার।”
ইনারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।

এমন সময় দরজা খোলার শব্দ আসে। সামির কন্ঠ ভেসে উঠে, “সভ্য ভাই তুই কোথায়? জরুরী কথা আছে।”

“এখানে…” সভ্য সম্পূর্ণ কথা বলে বাহির হবার পূর্বেই ইনারা তার শার্ট ধরে ভেতরের দিকে টেনে নেয়। চোখ দুটো বড় বড় করে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে, “পাগল হয়ে গেলেন না-কি? আমি এখানে লুকাচ্ছি আর আপনি তাকে আমন্ত্রণ দিয়ে আনছেন।”
সভ্য গেলে এমনিতেই সামি এদিকে আসতো না। আর না আসলে ইনারাকেও দেখত না। কিন্তু ইনারার এত কাছে আসার পর এ কথা তাকে বলতে মন চায়? তার-ই তো লাভ। সে ইচ্ছা করে ইনারার আরেকটু কাছে যায়। ইনারা জিজ্ঞেস করে, “করছেনটা কী?”
“আমাকে এখানে দেখে ফেললে তো সমস্যা। তাই লুকাচ্ছি।”
“ওহ আচ্ছা।”

ইনারা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। সভ্য তার কাঁধের একপাশে হাত রাখে তাকিয়ে ছিলো। একদৃষ্টিতে। বাহিরের মিষ্টি ফাগুন হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে ইনারার সোনালী কেশ। বিরক্ত করছে তাকে। সে অবাধ্য কেশের এমন খেলা দেখে মন ভরছিল সভ্য। মুগ্ধতায় যেন জড়িয়ে ছিলো দৃশ্যটি। এই মুহূর্তে ইনারা গতকালের মতো সেজেগুজে নেই, খুবই সাধারণ। যেমনটা সবসময় থাকে। অথচ এই মুহূর্তে তাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। কোমল সোনালী রোদের অলংকার তার সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়ে দিলো। এমন সাধারণ রূপে তাকে ভীষণ পবিত্র দেখাচ্ছে। যেন এই পৃথিবীর কোনো অপবিত্রতা তাকে স্পর্শ করে নি। তার খুব করে ইচ্ছে হলো তার চুলগুলো হাতে নিয়ে খেলা করতে। সে হাত বাড়ি তার আঁকাবাঁকা স্বর্ণোজ্জ্বল কেশ ছুঁতে নিলেই ইনারা তার দিকে তাকাল। চোখে চোখ মিলল। তার নীলাদ্রি দৃষ্টি তার বুকে আবারও আঘাত করল। সে নিজের হাত সরিয়ে নিলো। ছুঁয়ে দেখল না আর অবাধ্য কেশের গুচ্ছকে। তার ইচ্ছাটা মনেই দাবিয়ে নিলো। কিন্তু নিয়তি যেন তার ইচ্ছা পূরণ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলো। এক তীব্র হাওয়া বয়ে এলো দক্ষিণা দিক থেকে। এলোমেলো হয়ে গেল ইনারার চুলগুলো। একগুচ্ছ চুল এসে ছুঁয়ে গেল সভ্যের মুখখানা।

সভ্য চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। নিশ্বাসের সাথে মাতোয়ারা এক ঘ্রাণ পায় সে। ইনারার রেশমি চুলের ছোঁয়ায় মাতাল হয়ে উঠে।

অবশ্য তা বেশিক্ষণের জন্য নয়। ইনারা দ্রুত তার চুলগুলো হাতে নিয়ে একপাশে নিয়ে মুড়িয়ে বাঁধতে বাঁধতে বিরক্তির সুরে বলে, “উফফ এই চুল নিয়ে এক জ্বালা। ভালো লাগে না। এই জন্যই সারাক্ষণ বেঁধে রাখি। কচুর চুল।”

সভ্যের রাগ উঠলো খুব। তার এত সুন্দর এক মুহূর্তটা কীভাবে নষ্ট করে দিলো মেয়েটা! আর চুল নিয়ে এত অনিহা কেন তার? এই চুলের বাহার তার হৃদয় কতবার হরণ করে তা কীভাবে বুঝাবে? মনটাই খারাপ হয়ে গেল সভ্যের। সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

ইনারা সভ্যের চোখেমুখে ভাসা এমন রূক্ষতা দেখে মনে মনে বলে, “এই ব্যাঙের ছাতার আবার কী হলো? এইত্তো ভালো ছিলো। এখন মুখটা এমন হনুমানের নাতির মতো করে রাখল কেন? রাগ তো আমার হওয়া উচিত। একতো ওদিন ঐশির সাথে তার কিছু নেই বলে আমাকে বৃষ্টিতে গাড়ি থেকে বের করে দিলো, আর আজ তাকে জড়িয়ে ধরছিলো। সাহস কত ব্যাটার!”
সে গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করে, “আপনার হঠাৎ কি হলো?”
“কিছু না।”
“আচ্ছা একটা কথা বলেন তো, ব্যান্ডের সবার আপনার সাথেই কী এত ব্যক্তিগত কথা?”
সভ্য খানিকটা অবাক হয়ে তাকায় ইনারার দিকে, “মানে?”
“মানে এই’যে সামি এলো আপনাকে খুঁজতে। একটু আগে তো ঐশি এসে আপনাকে জড়িয়েই ধরেছিল।”
“এমনিতেই সবার কিছু জরুরী কথা থাকে। কিন্তু তুমি এত ক্ষেপে আছো কেন?”
“আমি ক্ষেপে আছি? কো-কোথায়?”
“তোমার কথায় বুঝা যাচ্ছে। ঐশি এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে এতে কি তোমার রাগ হচ্ছে?”
“আজব তো আমার রাগ হবে কেন? আমি তো কেবল জিজ্ঞেস করলাম সাধারণভাবে। কেন জিজ্ঞাসা করতে পারিনা?” ইনারা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল।

বারান্দা থেকে সামি কন্ঠ শুনতে পারছিলো। সে অবাক হয়ে মেয়ের কন্ঠ শুনে। ঐশি তো বাহিরে তাহলে এখানে কে? সে এগিয়ে যায়। যেয়ে দেখে সভ্য এবং ইনারা একসাথে। তাদের দুজনকে একত্রে দেখে উৎসুক হয়ে যায় সে। সে কিছু বলতে নেবে তখনই সভ্য তার দিকে তাকায়। হাতের ইশারায় থামতে বলে চলে যেতে বলে। সে ইশারা ঠিকই ধরতে পারে। দাঁত কেলিয়ে হেসে হাতের ইশারায় ‘চালিয়ে যেতে’ বলে নৈশব্দ চলে যায়।

অপরদিকে সভ্য ইনারাকে বলে, “আচ্ছা তোমার কি সত্যি গতকালের কোন কথা মনে নেই?”
“ঝাপসা ঝাপসা মনে পড়ছে। পরিষ্কার কিছুই না। আমি বিশেষ কিছু ভুলে যাচ্ছি না’কি?”
সভ্যের মনে পড়ে গতরাতে ইনারার তার কাছ আসা, তার গালে চুমু খাওয়াটা, বাচ্চাদের মতো তাকে চুমু দেবার আবদার করাটা, তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কান্না করাটা, এই দোলনাতেই তার কোলে বসে নিজের হৃদয়ে লুকানো হাজারো কথাগুলো মুখে আনাটা।

সভ্য দোলনাটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “তোমার মনে রাখার মতো কিছু ছিলো না।” আবার সে মনে মনে ভাবলো, “কিন্তু আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় একটি রাত ছিলো।”

ইনারা জিজ্ঞেস করে, “সামির শব্দ পাচ্ছি না। চলে গেল না’কি?”
জিজ্ঞেস করে সে নিজেই আবার উঁকি দেয় ঘরে, “হ্যাঁ চলে গিয়েছে। বলবেন না আপনি? আচ্ছা আপনি যান। সুযোগ পেলে আমাকে বের করার ব্যবস্থা করে দিবেন।”
“যা হুকুম করবেন মহারাণী।”
সভ্য চলে গেল। ইনারা কিছুটা অবাক হয়। লোকটা আজকাল বড্ড পরিবর্তন হয়েছে৷ আগে তো রুক্ষতা ছাড়া তার মুখে এক বচনও আসতো না। আর আজকাল যেন মুখে গুড় রেখে কথা বলে। ভাবতেই মৃদু হাসে ইনারা। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে ঐশির সভ্যকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য। সাথে সাথে মন উদাসীন হয়ে পরে। এই উদাসীনতায় সে নিজেই হতবাক। সভ্যকে নিয়ে তার উদাস হবার তো কোনো কারণ নেই। সভ্যের প্রতি তো তার কেবল খুনসুটি এবং কাজের সম্পর্ক। তাহলে তার এমন কেন অনুভব হচ্ছে।

কক্ষে কেউ না থাকায় ইনারা বের হয়। রুমে যেয়ে খানিকক্ষণ পায়চারি করে। হঠাৎ তার চোখে একগুচ্ছ কাগজ। যা মুড়িয়ে নিচে ফেলে রাখা হয়েছে। ইনারা সেখানে যায়। নিচে বসে একটি মুড়ানো কাগজ হাতে নিয়ে তা খুলে দেখে সেখানে লেখা,

“প্রেমের উষ্ণ হাওয়ায় মাতাল তুমি আর আমি
তোমার আঁখি নীল সমুদ্র তোমাতেই আমি;
আমি ডুবে যাব ডুবে যাব তোমার মাঝে প্রণয়ী
আমি ডুবে যাব ডুবে যাব তোমার মাঝে প্রণয়ী।

তুমিতে তুমিতে হারাই বারে বারে আমি;
তোমারেই ভালোবাসি কীভাবে বলি আমি?”

এতটুকুই লেখা সে কাগজে। সম্ভবত কোনো গানের পঙক্তি। ইনারা জলদি করে আরও কিছু কাগজ খুলে দেখে। সবজায়গায় এই গানটির পঙক্তি লেখা। কিছু এলোমেলো শব্দ। হঠাৎ ইনারার তীব্র ইচ্ছা জাগে গানটা সভ্যের কন্ঠে শুনতে। সভ্যের হাতে থাকবে একখানা গিটার। চারপাশ থাকবে প্রকৃতির বাহার। সামনে কেবল সে বসে থাকবে। একটি শাড়ি পড়ে থাকবে সে। শাড়ি! আগে কখনো সে শাড়ি পরার কথা ভাবে নি। কখনো শাড়ি পরেও নি। তাহলে হঠাৎ কেন তার সভ্যের সামনে শাড়ি পরে যাবার ইচ্ছা জাগলো?

উওর পাবার পূর্বেই ইনারার ডাক পড়লো। সভ্য দরজায় নক করে বলল, “ইনারা এখন বের হতে পারো।”
সে দ্রুত তার হাতের কাগজ পকেটে ভরে নিলো। আর বের হলো। লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে সে ড্রাইভারের সাথে যায় কিন্তু সম্পূর্ণ পথ পর্যন্ত গাড়ি নেয় না। মাঝরাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নেমে যায়।

বাড়িতে ফিরে চুপচাপ নিজের রুমে যেতে নেয়। তার ফুপি ও আইজা বসে ছিলো সোফায়। তাদের পাশ কাটিয়ে যেতে নিলেই তার ফুফী তাকে তলব করে, “ইনু দাঁড়া, কথা আছে তোর সাথে। গতরাতে কোথায় ছিলি তুই? বাসায় আসতে এত দেরি হলো কেন?”
“আজ হঠাৎ কিভাবে তোমার খেয়াল এলো যে আমি বাসায় নেই। অন্যবার যখন বাসার বাহিরে থাকি তখন তো আসে না।”
“কথা ঘুরানোর চেষ্টা করিস না। আর আইজা বলল তুইও নাকি পার্টিতে ছিলি গতকাল। তুই ওখানে কীভাবে গেলি?”
“ওহ সভ্য আমাকে পাশ দিয়েছিল। ওর সাথে আমার ডান্স পার্ফোরমেন্স ছিলো।”
“তুই সভ্যকে কীভাবে চিনিস?” ফুপি এভাবে তাকিয়ে রইলো যেন তার চোখ দুটো এখনই কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। ইনারার তার চেহারা দেখে হাসি আসলেও সে নিয়ন্ত্রণ করল।

সে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে দাঁড়ায় বলে, “তো একারণে আজ আপনার আমার কথা পড়েছে?
তাও ভালো। ফুপি আমারও আপনার থেকে একটা প্রশ্ন করার ছিলো। গতকাল না আমার সৌমিতা আন্টির সাথে দেখা হয়েছে। সে বলল উনি কল করেছিলো। কিন্তু আপনি না’কি বলেছেন আমি উনার সাথে কথাই বলতে চাই না। অথচ আমি আন্টির সাথে কথা বলার জন্য কত ব্যাকুল ছিলাম। প্রতিদিন আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম, উনি কল করেছে কি-না? আপনি কি বলতেন? না, করে নি। আপনি এভাবে মিথ্যা বলেছেন কেন ফুপি?”

ফুপির চোখ মুখ কালো হয়ে গেল। সে কি বলবে বুঝে পাচ্ছিল না। ইনারা তাকে আরও জোর করে বলল, “ফুপি আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। উওর দিন।”

আইজা সেখানেই বসে ছিলো। তার হাতে একটা ম্যাগাজিন ছিলো। কিন্তু তার ধ্যান ম্যাগাজিনে নেই। সে গতরাতের কথাই ভেবে যাচ্ছে। গতরাতে সে পার্টি থেকে যাবার পূর্বে জোহানের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েছিলো। জোহান তখন কথা বলছিলো সামির সাথে। সে যখন জোহানকে ডাক দিতে নিবে তখনই তার নাম শুনে। আর থেমে যায়। সে শুনে, “আইজার কোনো দিক ওর সাথে তুলনা হতে পারে না। কোথায় ইনারা, আর কোথায় আইজা। আর বিন্দুমাত্র সৌন্দর্যের অধিকারীও আইজা না।”
এই এক কথা গতরাত থেকে তার কানে বাজছে। এটা নতুন না। ছোট থেকেই ঘরে বাহিরে সব জায়গায় তার সাথে ইনারার তুলনা হচ্ছে। কথাগুলো তাকে আঘাত করে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেই। যতই হোক ইনারা তার ছোট বোন। কিন্তু এসব তার এখন ধৈর্যের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে যাচ্ছে। এইসব ভাবনার মাঝে ইনারার তার মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে তার ধৈর্য হার মানলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বলে উঠে, “ইনারা চুপ। এসব কোন ধরনের বেয়াদবি? তুই আম্মুর সাথে এভাবে কথা বলছিস কোন সাহসে?”

ইনারা হতভম্ব। আজ পর্যন্ত যেকোনো পরিস্থিতি হোক না কেন আইজা কখনো তার সাথে উঁচু স্বরে কথা বলে নি। আজ তার কী হলো? সে নিজের পক্ষ রেখে বলার চেষ্টা করল, “আপু তুমি জানো না ফুপি কি করে…”
“আমি জানতেও চাই না। আমি কেবল এতটুকু জানি তুই মা’য়ের সাথে এভাবে কথা বলতে পারিস না। এখন উপরে যা।”
“কিন্তু…. ”
“ইনু উপরে যেতে বলেছি।”
আইজার এমন ব্যবহারে খুব কষ্ট পেল ইনারা। সে একপলক ফুপির দিকে তাকিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করল। রুমে যেয়ে বিরক্ত হয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। আইজার কথাগুলো যেমন তাকে আঘাত করেছে তেমন তার রাগও উঠছে ফুপির উপর।

হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। নাম্বার দেখে সে চিনতে পারে না। রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করে, “কে?”
“আমি।”
“দেশের প্রধানমন্ত্রী বলছেন?”
“প্রধানমন্ত্রী বলব কেন? ”
“যেভাবে আমি বললেন মনে হলো কোনো দেশের প্রধান মন্ত্রী কন্ঠ শুনেই চিনে যাব।”
“আমার কন্ঠ শুনেই তো চেনার কথা ছিলো। এত জলদি ভুলে গেলে? জোহান বলছি।”
ইনারা একলাফে উঠে বসে। সে অবাক হয় হঠাৎ জোহান কেন তাকে কল দিবে?
“কোন বিশেষ কারণে কল দিয়েছেন বুঝে?”
“কেন এমনি দিতে পারি না?”
“না মানে…” ইনারা এক অস্বস্তিতে পরল। কী উওর দিবে?

ফোনের ওপাশ থেকে জোহানের হাসির কন্ঠ শোনা যায়, “এক বিশেষ কাজের কল দিয়েছিলাম। তোমার থেকে একটা ফেভার লাগতো।”
“আমার থেকে? কী?”
“আসলে গতকাল বাসায় একটু সমস্যা হয়েছিলো। এতে মায়ের মন অনেক খারাপ। তুমি কী একটু বাসায় আসতে পারবে? তোমাকে দেখলেই মা’য়ের মনটা ফুরফুরে হয়ে যাবে।”
থতমত খেয়ে গেল ইনারা। এমনি কিছু হলে ইনারা মানা করতে এক মুহূর্তও ভাবতো না। কিন্তু সৌমিতা আন্টির ব্যাপার। সে কি করবে বুঝতে পারছে না।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here