অনুভবে ২য় খন্ড,পর্ব ১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“আমি এই লোকটার সাথে বিয়ে করব? অসম্ভব!” ইনারা কঠিন গলায় বলল। তার শান্ত দৃষ্টি মুহূর্তে ক্রোধে পরিপূর্ণ হয়ে এলো। তার সামনে দাঁড়ানো তার ভালোবাসার মানুষটি। এই মুহূর্তে তার খুশিতে আত্নহারা হওয়া উচিত ছিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে তার হৃদয়ে ক্রোধ ব্যতীত কোনো অনুভূতি আসছে না। এই লোকটা কেবল তাকে ভালোবাসার আলো দেখিয়ে হারিয়েই যায় নি। তার জীবনের সবচেয়ে বাজে মুহূর্তে একবারও তার খোঁজ করার চেষ্টা পর্যন্ত করে নি। আর এই লোকটার সাথে সে বিয়ে করবে? সারাজীবন তো দূরের কথা, এই লোকটার সাথে দুটো বছর কাটানোও তার জন্য অসম্ভব। যদি সে তাকে ভালো না বাসতো তাহলে হয়তো ব্যাপারটা ভিন্ন হতো। কিন্তু সে সভ্যকে ভালোবাসে। এই ভালোবাসাটাই তার ক্রোধ, ঘৃণা হাজারোগুণ বেশি বাড়িয়ে তুলে।
রহমান বলে, “ম্যাম কিন্তু এটা বড় স্যারের আদেশ।”
“হোক আদেশ। আমি এই লোকটার সাথে বিয়ে করব না। উনাকে বলুন অন্যকিছু বলতে। আমি অন্য যেকারো সাথে বিয়েও করতে রাজি কিন্তু উনার সাথে না।”
কাঠ কাঠ গলায় বলে ইনারা।
সভ্য এতক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলো ইনারার কথা। সে বিরক্ত হয়ে বসে পড়ল আবার চেয়ারে। তার ফোনটা বের করে বলল, “রহমান, আমার কাছে এত ফালতু সময় নেই যে আমি এখানে ব্যয় করব। যে কাজ করতে এসেছি তার শেষ করা হোক, অথবা আমি চললাম।”
“না..না স্যার। বড় স্যার প্রচুর রাগ করবেন।” রহমান আবার ইনারার কাছে যেয়ে তাকে মনে করাল, “ম্যাম আপনি ওয়াদা করেছিলেন বড় স্যারের শর্ত পূরণ করবেন। এখন আপনি পিছাতে পারেন না। আপনি এখন পিছিয়ে গেল অতীতে আপনার উপর করা সব খরচ যেমন মুহূর্তেই পরিশোধ করতে হবে তেমনি ভবিষ্যতে আপনি কোনো সাহায্য পাবেন না। আর আপনার এতটুকু জানা উচিত। এত ক্ষমতাশীল ব্যক্তিদের থেকে আপনার সুরক্ষা ও তাদের শিক্ষা দিতে সাহায্য দুটোই দরকার। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। আর কেবল দুই বছরই তো। বুঝার আগেই কেটে যাবে।”
ইনারা এবার স্থির হয়ে যায়। সে এভাবে তার তিন বছরের তপস্যা নষ্ট করতে পারে না। সে প্রতি মুহূর্ত কেবল এই প্রতিশোধের আগুনে জ্বলেছে। এমন একটা লোকের পিছনে সে নিজের এত কঠিন তপস্যা নষ্ট করতে পারে না। সে মাথা নাড়ায়, “এর পূর্বে আমার কিছু প্রশ্ন আছে।”
“আপনার প্রশ্ন করার অধিকার দেওয়া হয় নি।”
ইনারা এই মুহূর্তে তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করে কেবল, “ঠিকাছে। তবে উনাকে বলে দিন, এই বিয়েটা ঠিক দুই বছর পর শেষ হয়ে যাবে।”
“ম্যাম ছোট স্যার নিজেই তো বিয়ের কথা শুনে শর্ত দিয়েছিলেন। বড় স্যার এই শর্তের ব্যাপারে জানে না। আগামী দুই বছরে কোম্পানির সম্পূর্ণ পাওয়ার ছোট স্যারের হাতে এসে পড়বে। তারপর আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি দেওয়া হবে।”
এক মুহূর্তের জন্য ইনারার রাগ যেন পানি হয়ে এলো। তার বুকের ভেতর কামড়ে উঠলো। সে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা বাড়ে তার। এই ভেবে যে সভ্য কেবল তাকে ক্ষমতা পাবার জন্য বিয়ে করছে। এক ঢোক গিলে সে। বুকের ভেতর তীব্র যন্ত্রণা উঠে৷ সে যন্ত্রণাটা দাবিয়ে রেখে পা বাড়ায়। যেয়ে বসে সভ্যের পাশের চেয়ারে। তার পাশে তাকায় একপলক। তার পাশে বসা এই মানুষটাকে খুবই অচেনা লাগছে তার। যেন কখনো পরিচয়ই হয় নি। আবার মনে হচ্ছে এই গত নির্ঘুম রাতেই তার সাথে কথোপকথন হয়েছিলো তার। তার অপেক্ষায় ছিলো ইনারা। যে সভ্য আসলেই তাকে নিজের মনের কথন শুনাবে ইনারা। হায় সে ইচ্ছা, স্বপ্ন, আকাঙ্খা, ভালোবাসা! সবই আজ অতীত। আর এসব তার অতীতের স্মৃতি। তার না এখন আর স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। আর না ভালোবাসার।
কারও মুখে কোনো কথা নেই। এতক্ষণে একটিবারও একে অপরের সাথে কথা বলে নি তারা। এমনকি তাকায়ও নি। তাদের বিয়ে পরানো হয়। অবশেষে কাবিননামায় স্বাক্ষর করার সময় ইনারার হাত কাঁপছিল। তার চোখের সামনে ভাসছিলো সভ্যের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত। ভালোবাসার মানুষটার সাথে বিবাহ এত যন্ত্রণার হতে পারে তার জানা ছিলো না। তার মনে হচ্ছিলো তার হৃদয়টা কেউ চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে। এই যন্ত্রণা এক বিন্দু হয়ে অশ্রু রূপে ঝরে পড়ে ইনারার চোখ থেকে কাবিননামায়।
ঠিক সে মুহূর্তে প্রথমবার সভ্য সরাসরি তাকায় ইনারার দিকে। কিছু মুহূর্তে তাকিয়ে থাকে। ইনারা তার দিকে ফিরে তাকাতেই সে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
ইনারা সভ্যের দিকে তাকায়। দেখা হবার পরেও মানুষ একটিবার তার দিকে তাকায় নি। যেন আজ সে সভ্যের জন্য একদম অচেনা। জীবনে দেখাও হয় নি তাদের। ইনারা লুকিয়ে তার চোখের পানি মুছে দ্রুত স্বাক্ষর করে কাবিননামায়। স্বাক্ষর করেই উঠে দাঁড়ায়। রহমানকে জিজ্ঞেস করে, “আমি কী এখন যেতে পারি?”
রহমান তাকায় সভ্যের দিকে। ইশারা পেতেই সে বলে, “গাড়িতে যেয়ে বসুন ম্যাম। আগে মিষ্টিমুখ করে যান। বিয়ে শেষে মিষ্টিমুখ করতে হয়।”
“এখানে শুভ কিছু হয় নি যে মিষ্টিমুখ করতে হবে ” ইনারা বিরক্তির সুরে বলে। সে রাগে হনহনিয়ে বের হয়ে যায়। যাবার সময় তার মাথায় লাগানো অতিরিক্ত ওড়না দরজায় লেগে যাওয়ায় সে ক্রোধে তা সেখানে ফেলে যায়। সে দ্রুত যেয়ে বসে গাড়িতে। তার শরীর কাঁপছিলো। রাগে, যন্ত্রণায়, বিরক্তিতে। সে ভেবে রেখেছিলো যেদিন সভ্য তার সামনে আসবে সেদিন তার হৃদয়ে দেবে থাকা সকল প্রশ্নের উওর চাইবে সে। কিন্তু এখন তার এই ইচ্ছাটা মরে গেছে। তার সাথে এসব কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। জীবনটা যেন তার সাথে খেলা করছে। কথাটা ভাবতে না ভাবতেই তার প্রচুর কান্না পেল। কান্না আসার সঠিক কারণ সে জানে না। এই মুহূর্তে তার চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। নিজের বুকের হাহাকার সম্পূর্ণ পৃথিবীকে শুনাতে ইচ্ছা করছে তার। সে সিটে হেলান দিয়ে চোখজোড়া চেপে ধরে রাখে। না, সে কান্না করতে পারবে না। এই তিনবছর সে কান্না করার জন্য এত কষ্ট করে নি। এত তপস্যা করে নি। এখনই ভেঙে পড়ছে সামনে লড়াই কীভাবে করবে সে?
তবুও অনিচ্ছায় তার চোখের কোণে দিয়ে বয়ে পড়ে এক ধারা নোনাজল।
সভ্য বাকি ফর্মালিটি সেরে বের হতেই দেখে দরজার কাছে একটি ওড়না পড়ে আছে। ওড়নাটি ইনারার। তার লাল লেহেঙ্গার সাথে মাথায় এই সোনালী রঙের ওড়না পরেছিল। এখানেই ফেলে গেল সে ওড়নাটি।
রহমান বলে, “এটা তো ম্যামের ওড়না। ছোট স্যার দিন, আমি ম্যামকে দিয়ে দিব।”
“প্রয়োজন নেই। তুমি ওকে নিয়ে বাড়িতে যাও।”
“আপনি আসবেন না স্যার?”
“সময় হোক। তারপর আসব। ওকে নিয়ে বাড়ি যাও।”
রহমান সভ্যের আদেশ পালন করে ইনারাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছায়।
ক্লান্তিতে ইনারার চোখ লেগে এসেছিলো। এত বড় জার্নি করে এসেছে সে। চোখ খুলতেই সে দেখতে পায় তাদের যাবার পথটা কোলাহলময় নয়। এদিকে বাড়ি ঘর খুব কম। বলতে গেলে এদিকে কেবল আছে বিশাল দালান। এরইমধ্যে গাড়ি বিশাল এক গেইট দিয়ে ভেতর ঢুকে। গাড়ির দুইপাশের জানালা দিয়েই বাগান দেখা যাচ্ছে। যেখানে কেবল ফুল ও ফলের গাছ। এত বিশাল মাঠের এক কোণে ছোট একটা ঘর। ঘরটা আসলে ছোট না হলেও এই বিশাল জায়গা অনুযায়ী ছোট দেখাচ্ছে।
রহমান বলল, “ম্যাম বাড়ি এসে পড়েছে।”
ইনারা গাড়ি থেকে নামে। বিস্মিত দৃষ্টিতে দেখতে থাকে আশেপাশে। রহমান তার এমন অস্থিরতা দেখে জিজ্ঞেস করে, “কোনো সমস্যা হচ্ছে ম্যাম।”
“এটা সভ্যের বাড়ি?”
“জ্বি।”
“আমি জানি আপনার ছোট স্যার বিখ্যাত গায়ক ছিলেন। কিন্তু উনার ক্যারিয়ার কেবল পাঁচ বছরের ছিলো। তাহলে এতকিছু… ওহ আপনি তো কোনো এক কোম্পানির কথা বলেছিলেন। যার কারণে সে আমাকে বিয়ে করেছে। কী কোম্পানি যে তার এত কিছু আছে আমি জানতে পারি?”
“আপনাকে জলদিই জানানো হবে ম্যাম।”
“আর আপনি এটা বলতে পারবেন আপনার বড় স্যার কেন আপনার ছোট স্যারের সাথে আমারই বিয়ে দিলো? আই মিন তার জন্য যেকোনো মেয়ে পেয়ে যেত। আর এমন না আপনার ছোট স্যার আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। পরিষ্কারভাবে সে কেবল তার স্বার্থের জন্য জোর করে আমাকে বিয়ে করেছে। অকারণে আপনার বড় স্যার এমন করবেন না।”
ইনারার ক্রোধিত স্বর শুনে রহমান জোরপূর্বক হেসে বলে, “সরি ম্যাম, আমি সামান্য এক কর্মচারী। এতকিছু আমি কীভাবে জানব?”
ইনারা আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। ঘরের ভিতরটা জাঁকজমকহীন। তবে সুরুচিসম্মত। সম্পূর্ণ ঘর সাজানো কেবল সাদা, হাল্কা বাদামী ও সোনালী রঙের আসবাবপত্র দিয়ে। ইনারা সবকিছু দেখার পূর্বেই রহমান তাকে একটি রুমে নিয়ে যায় এবং বলে, “ম্যাম আপনার জন্য খাবার রেখে দিয়েছি। খেয়ে নিন। আর আপনার ব্যাগগুলো রুমে এসে রেখে দিচ্ছি। আপনার কিছু লাগলে বলবেন। স্যার আসা পর্যন্ত আমি বাহিরে আছি।”
“আপনার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো। আপনি বলেছিলেন বাংলাদেশে আসার পর সামনে কি করতে হবে এই নিয়ে আমরা ডিসকাশন করব। আইজা আপুর….” রহমান তাকে থামিয়ে বলে, “ম্যাম আপনি তো আজ ক্লান্ত। আগামীকাল বলি? আমি সব তথ্য গুছিয়ে রেখেছি। কাল আপনাকে এনে দিব। তারপর আপনি বলবেন কি করতে হবে।”
ইনারা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। রহমান বাহিরে যেতে নিয়েও থেমে যায়, “ম্যাম একটা কথা বলি? আপনার সাথে স্যারের কি হয়েছে আমি ঠিক জানিনা তবে এতটুকু বলতে পারি সভ্য স্যার অনেক ভালো একটা মানুষ। আপনি তাকে বুঝতে পারলে আপনাদের দুইজনের জীবন…”
সভ্যের নাম শুনতে ইনারা রেগে যায়। সে রহমানের কথা কেটে বলে, “রহমান ভাই প্লিজ। আমি আপনার স্যারের নামে কোন সুনাম শুনতে চাই না। উনি কেমন তা ভালো করে জানা আছে। আর বুঝতেও পেরে গেছি। কেবল আগে বুঝতে পারলে ভালো হতো। আমার সামনে উনাকে নিয়ে কোন প্রশংসা করতে পারবেন না আপনি। কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই। না এক মিনিট, দুর্নাম করলে করতে পারেন। আচ্ছা আপনি কত বছর ধরে আপনার স্যারের সাথে কাজ করছেন?”
“এই ধরেন বারো বছর। প্রথমে আইনুল স্যারের সাথে কাজ করতাম।”
“মানে তার পরিবারকে চিনেন। আমার মনে না অনেক বছর ধরে একটা প্রশ্ন ঘুরছে। বলেনতো কী ভেবে এই অসভ্যের নাম সভ্য রেখেছে।”
“আসলে হয়েছে কি…” রহমান উওর দিতে যেয়েও থেমে যায়। ইনারার প্রশ্ন বুঝতে পারায় চোখ দুটো বড় করে তার দিকে তাকায়। তারপর জোরপূর্বক হাসে, “ম্যাম আপনি কি বলছেন এসব? স্যার তো কত ভালো। আপনি সম্ভবত জার্নি করে ক্লান্ত হয়ে গেছেন তাই এসব উল্টাপাল্টা কথা বলছেন। আপনার কিছু লাগবে যা আপনার ক্লান্তি দূর করতে পারে?”
“আমার আপনার স্যারের প্রশংসা শুনে এই মুহূর্তে কারও মাথা ফাটাতে মন চাইছে। আপনার ফাটাবো?”
রহমান সাথে সাথে পিছিয়ে গেল। জোরপূর্বক হেসে বলল, “ম্যাম আপনি রেস্ট নিন। আমি আসি।” বলে এক দৌড় দিয়ে পালালো।
ইনারা আয়নার সামনে যেয়ে নিজেকে একনজর দেখে। তার কত বছরের স্বপ্ন ছিলো এমন লাল লেহেঙ্গা পরে একদিন সে বিয়ে করবে। চারপাশে গান বাজনা হবে, কোলাহল হবে, আকাশে হবে তারাবাজি, সে যখন তার বরের সামনে যেয়ে দাঁড়াবে তখন চারদিক থেকে ফুলের বর্ষণ হবে। তার পাশে থাকবে তার সকল আপনজন। বাতাসে সাথে বইতে থাকবে খুশি, শান্তি ও ভালোবাসা। অথচ আজ তার বিয়ে হলো কিন্তু এ বিয়েতে না কোনো খুশি আছে, না শান্তি, না তার কোনো আপনজন। আর ভালোবাসা… আচ্ছা কাওকে একতরফা কাওকে চাওয়াকে কি ভালোবাসা বলা যায়? আচ্ছা দুইবছরের কাগজি সম্পর্ককে কি বিয়ের নাম দেওয়া যায়?
ইনারার খুব ক্লান্ত লাগছে। আজকের জার্নির সহ তার আজ অনেক মানসিক অশান্তিও সহ্য করা লেগেছে। এই দেশে ফিরে আসাটাই তার জন্য অনেক বড় ব্যাপার ছিলো। সে নিজেকে শক্ত করে এসেছিলো কিন্তু সভ্যকে দেখতেই যেন তার বুকের ভেতর কেঁপে উঠলো। ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিত ছিলো। তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না ইনারা। ইনারা বিছানায় বসে কিছু মুহূর্তের জন্য। ভাবে দশ মিনিট আরাম করে উঠে পোশাক পরিবর্তন করে খাবার খাবে। কিন্তু একসময় তার চোখ লেগে আসে।
.
.
সভ্যের বাড়ি ফিরতে রাত হয়। এমনকি বাড়ি ফিরে এসে ড্রইংরুমে বসে থাকে ঘন্টা খানেকের মতো। তাকে অস্থির দেখায়। এমন সময় রহমান বলে উঠে, “স্যার একটা কথা বলি?”
সভ্য অনুমতি দেয়, “বলো।”
“ম্যাম কি আপনার উপর নারাজ?”
কথাটা শুনে কপাল কুঁচকে যায় সভ্যের, “এমন মনে হলো কেন?”
“না মানে আজকে আমি তার সামনে আপনার প্রশংসা করছিলাম। ম্যাম যে ক্ষেপা ক্ষেপলো। আমি নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। তিন বছরে কয়েকবারই ম্যামের সাথে দেখা হলো আগে বুঝি নি তার এত রাগ। বাবারে বাবা ভয়ে এখনো আমার কলিজা কাঁপছে।”
সভ্য উঠে দাঁড়ায়। পকেটে হাত ভরে বলে, “তুমি এখন যাও। রাত হয়েছে।”
“স্যার আমার মনে হয় আজকে ম্যামের সামনে না যাওয়াই ভালো। ম্যামের মেজাজ আজ ভালো না।”
“মানে তুমি বলছ ওর থেকে আমার ভয় পাওয়া লাগবে?”
“না না স্যার কি যে বলেন? আপনাকে দেখলে আমাদের সবার বুকের পানি শুকিয়ে যায়। আপনি কাওকে ভয় পাবেন কেন? কিন্তু ম্যাম তো এখন আপনার বউ। আর বউদের কাছে সবার পরাজিত হতে হয়। আমিও বিয়ের আগে বাঘ ছিলাম বিয়ের পর ভিতুর ডিম হয়ে গেছি।”
“সাট আপ এন্ড গেট লস্ট। ফাজলামো যত্তসব।”
সে রহমানের কথায় মেজাজ খারাপ করেই রুমের ভেতর প্রবেশ করেছিল। রুমে ঢুকতেই ইনারা কে দেখে সে চমকে যায়। সে রহমানকে বলেছিল ইনারাকে যেন অন্য রুমে দেয়। এই মুহূর্তে তার রহমানের উপর রাগ হাজারগুণ বেশি বেড়ে যাবার কথা। কিন্তু এমনটা হলো না। উল্টো তার ক্রোধ পানি হয়ে গেল। তার সামনেই ইনারা। লাল টুকটুকে বউ সেজে বসা। ইনারাকে তার বউরূপে দেখা স্বপ্ন সে কতবছর ধরে। অথচ আজ যখন এই দিনটি এলো তখন সে শান্তি পাচ্ছে না। উল্টো কোনো এক কারণে তোর বুকের ভিতরে ব্যথা করছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। বিছানার পাশে এসে তাকাল ইনারার দিকে। বিয়ের সাজে তাকে অপরূপা লাগছে। কিন্তু আগের মতো দেখাচ্ছে না। মেয়েটা পরিবর্তন হয়েছে। একটু বেশিই। তার স্বাস্থ্য কমেছে, মুখে আর সেই বাচ্চামো ভাবটা নেই। তার মুখের গঠন নিখুঁত হয়েছে। অনেকটা তার মা’য়ের মতো। এখন তার দৃষ্টি কঠিন থাকে। ঠোঁটের হাসি বিলুপ্ত প্রায়। শুনেছে মেয়েটা আর আগের মতো অগুছালো থাকে না। মার্জিত ভাবে থাকে। সকলের জন্য হয়তো এখন মেয়েটা অনেক বেশি সুন্দর এবং পছন্দের যোগ্য। কিন্তু তার জন্য এখন মেয়েটা অনেক অচেনা। যাকে সে কখনো ভালোবেসেছিল সে কোথাও হারিয়ে গেছে।
ইনারার উপর তার রাগ বা অভিমান যাই হোক না কেন তা ঠিক কি কারণে সে আজও ধরতে পারে নি। জোহানকে ভালোবাসাটা, না’কি এভাবে তার প্রণয়ীকে হারিয়ে ফেলাটা। তবে এতে ইনারাকেও দোষারোপ করতে পারে না সে। মেয়েটার সাথে যা হয়েছে তা কল্পনা করাও মুশকিল। মাঝেমধ্যে সে ভাবে তার রাগ কি ইনারার উপর না তার নিজের উপরই! হয়তো সেদিন সে ইনারা থেকে দূরে না গেলে আজ মেয়েটার এত কষ্ট সহ্য করতে হতো না। আজও তার মনে আছে। চলে যাবার দুইমাস পরেই সে ফিরে এসেছিলো। একবারের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় সিফট হবার পূর্বে তাদের সাথে একবারের জন্য দেখা করবে বলে। কিন্তু সে কোম্পানিতে ঢোকার পরপরই দেখে
ইনারা বসে আছে ক্যান্টিনে। সে ইনারার দিকে এগোতে নিলেই দেখে জোহান দুইটা আইস্ক্রিম নিয়ে ইনারার পাশে বসে। ইনারা জোহানের সাথে বসে কথা বসছে আর হাসছে। খিলখিলিয়ে হাসছে। যে হাসির শব্দ তার বুকের ভেতর শান্তির গান গাইতো সে শব্দই তার বুকের ভেতর দুঃখের জোয়ার বয়ে আনলো। এমন কষ্টের অভিজ্ঞতা খুবই কম হয়েছিল তার জীবনে। সে এক পা এগোনোর সাহস করে নি। তার প্রিয় দুটো মানুষ একে অপরের সাথে সুখে ছিলো। সে কীভাবে তাদের খুশি নষ্ট করতো?
সভ্যের চোখ পড়ে ইনারার কপালে ছোট দাগটার উপর। বুক কেঁপে উঠে তার। সে ইনারার পাশে যেয়ে বসে। তার দাগগুলো এখন আর স্পষ্ট দেখা যায় না। তবে কিছু দাগ এখনো আবছা। বিশেষ করে তার মাথার দাগটা। তার আজও মনে আছে। সে তখন অস্ট্রেলিয়ায় ছিলো। হঠাৎ তাঁর কাছে ফোন আসে। সে খবর পায় জোহান ও আইজার সম্পর্কে। সে অবাক হয় না, ফিল্মের মার্কেটিং করার সময় অনেক সময় প্রধান চরিত্রের সম্পর্কে গুজব ছড়ানো হয়। কথাটাকে তেমন একটা প্রাধান্য দেয় না সে। কিন্তু পরক্ষণেই সে শুনতে পায় ইনারার সবচেয়ে কাছের বন্ধু প্রিয়র খবর। ইনারার সম্পূর্ণ পৃথিবী জুড়ে কেবল কয়েকজন মানুষ ছিলো। তার মধ্যে প্রিয় একজন। সে বুঝতে পারছিলো নিশ্চয়ই ইনারার অবস্থা ভালো হবে না। সেদিন সে নিজেকে অনেক আটকানোর চেষ্টা করল। কিছুতেই সে ইনারার জীবনে ফিরে যাবে না। জোহান আছে এর জন্য। কিন্তু সে নিজেকে আটকাতে পারল না। হতেই রওনা দিলো বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে। তার পৌঁছাতে সন্ধ্যা হলো। দেশে যেয়ে পা রাখতেই আরেকটা ধাক্কা খায় সে। রহমান তাকে ইনারার এক ভিডিও দেখাচ্ছিল। যা দেখে তার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গিয়েছিলো। ইনারার ব্যাপারে যারা যত খারাপ কথা বলছিলো অথবা যারা তাকে এসব কষ্ট দিতে চাইছিল তাদের সবাইকে খুন করতে মন চাইছিলো তার। সে জানতো ইনারা কখনো এমন কিছু করতে পারে না। রাগ থেকে বেশি সে সময় ইনারাকে চিন্তা হচ্ছিলো তার। সে সিদ্ধান্ত নিলো সে ইনারার সাথে দেখা করবে। এয়ারপোর্ট থেকে ইনারার বাসা দূরেই ছিলো। তাই সেখানে পৌঁছাতেও বেশ দেরি হয়। সে রহমানের সাথে বারবার যোগাযোগ করছিলো ইনারার ভিডিওটা ডিলিট করার জন্য। সে ফোনে কথা বলছিল এমন সময় গাড়িটা হঠাৎ থেমে যায়। সে ড্রাইভারকে রাগান্বিত জিজ্ঞেস করে, “এ’কি অবস্থা! গাড়ি হঠাৎ থামালে কেন?”
“সাহেব একটা মাইয়া গাড়ির সামনে পইড়া আসে।”
“মাঝরাস্তায়? আজ তাড়া আছে আজই সব ঝামেলা আসা লাগবে।” সভ্য রাগে গাড়ি থেকে নামে। তখন মেয়েটির চেহারা ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। সে এগিয়ে একটু সামনে যেতেই দেখতে পায় মেয়েটির চেহেরা। মেয়েটা ইনারা। তার শরীরের বিভিন্ন অংশে ক্ষত। কপাল দিয়ে রক্ত ঝরছে। সে অজ্ঞান। তাকে এই অবস্থায় দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য পাথর হয়ে গেল সে। স্তব্ধ হয়ে গেল। ইনারার এই অবস্থা দেখে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল এটা কোনো এক দুঃস্বপ্ন। তখনই আকাশে বজ্রপাত হয়। স্পষ্ট দেখা যায় ইনারার চেহারা। তীব্র বাতাস বইছে। ঝড় আসে। সভ্য ছুটে যায় ইনারার কাছে। তাকে কিছুটা উঠিয়ে গালে হাত দিয়ে অস্থির হয়ে বলে, “ইনারা…ইনারা কি হয়েছে তোমার? উঠো, উঠো প্লিজ। ইনারা….প্লিজ উঠো না।”
সভ্য বুকে জড়িয়ে নেয় তাকে। তার চোখের জলের সাথে আকাশেও বৃষ্টি ঝরে। তার তখনো মনে হচ্ছিল এই দুঃস্বপ্ন এই মুহূর্তেই ভেঙে যাবে। কিন্তু সে দুঃস্বপ্ন ভাঙলো না। সে ইনারাকে হাস্পাতালে নিয়ে যায়। সেখানেও ইনারার অবস্থা তেমন ভালো ছিলো না। দুইদিন অজ্ঞান থাকে সে। সে দুঃস্বপ্নের রাতটার কথা মনে পড়লে আজও তার বুক কেঁপে উঠে।
সভ্য ইনারার পাশে বসে। তার চোখে জল ভাসছে বুকে চিনচিন ব্যথা করছে। সে কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে ইনারার কপালের দাগটা ছুঁয়ে দেয়। সে হাত দিয়েই তার কপালে আসা চুল সরিয়ে দিয়ে দেখতে থাকে তাকে। তার হৃদয় ও চোখের তৃষ্ণা দুটোই মেটায়।
সময় কাটে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে যায় ইনারার। চোখ খুলতেই ঘুমঘুম চোখে আবছা দেখতে পায় সামনে বসা একটি পুরুষকে। সভ্যকে দেখতে পায়। এক মুহূর্তের জন্য সে চমকে উঠে। পিছাতে নিলেই পিছনের দেয়ালের সাথে মাথা লেগে ব্যাথা পায়। ব্যাথায় চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় সে।
সভ্য আতঙ্কিত স্বরে বলে, “করছটা কি তুমি?”
ইনারা চোখ খুলতেই সভ্যকে তার কাছে দেখতে পায়। সে ইনারার মাথায় হাত রেখে ডলে দিচ্ছিল। সভ্য তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়। এত বছর পর হয় দু’জনের দৃষ্টি মিলন। এই দৃষ্টিমিলন মধুর ছিলো না। ছিলো দুঃখের, যন্ত্রণার, দূরত্ব।
সভ্য জিজ্ঞেস করে, “তুমি ঠিকাছ?”
ইনারার ঘোর ভাঙে। তার মনে পড়ে যায় হঠাৎ সভ্যের ছেড়ে যাওয়াটা। সে সভ্যের বুকে হাত রেখে এক ধাক্কায় তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয় এবং উঁচু স্বরে বলে, “খবরদার আমাকে স্পর্শ করা তো দূরে কথা আমার কাছে আসারও চেষ্টা করবেন না। নাহয় অনেক খারাপ হবে।”
চলবে…