অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ২০

0
1279

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

ইনারা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছছে। তার পরনে বিকেলের গোলাপি রঙের শাড়িটিও নেই। জিন্স টি-শার্ট পরা। তার হাতে এখনো সে বেলি ফুলের মালা। সভ্য রুমের দরজায় হেলান দিয়ে তার দিকে এক পাণে তাকিয়ে রয়েছে। মুগ্ধ দৃষ্টিতে।

ইনারা চুল মুছে তোয়ালে চেয়ারে রেখে পাশে তাকিয়ে দেখে সভ্যকে। তার চাওনি দেখে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কী দেখছেন?”
সভ্য রুমের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলে, “দেখছি না, অপেক্ষা করছি।”
“কীসের?”
“কখন তুমি বলবে,” সভ্য ইনারার মতো ঢঙ করে বলল, ‘শুনুন না, আজ তো অনেক খুশির দিন আমাকে একটু কিছু রান্না করে খাওয়াবেন?’
“আমি এভাবে মোটেও বলি না।”
“আরও আহ্লাদী করে বলেন মেডাম।”
ইনারা ভেংচি কেটে বলে, “হয়েছে একটু রান্না করে লাফাতে হবে না। রান্নবান্না সে কি বড় কাজ? আমি তো চেষ্টা করি না, নাহলে দুইদিন আপনাকে পিছু ছেড়ে দিতাম রান্নাতে।”
“তাই না? আচ্ছা আসো তোমাকে আমি রান্না শেখাই।”
“হে!” ইনারা ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল।
“হে নয় হ্যাঁ, এখন তোমাকে আমি নিজে রান্না শেখাব। তারপর দুইদিন পর তুমি আমাকে রান্না করে খাওয়াবে। আমার বউয়ের হাতের একটা জাতের খাবার খেতে কি আমার ইচ্ছা করে না? আসো।”
সভ্য ইনারার হাত ধরে তাকে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যায় এবং ইনারা উঁচু স্বরে বলে,
“এই’যে মিঃ অসভ্য আজকের দিনে আমার সাথে জোর জবরদস্তি করতে আপনার লজ্জা লাগে না।”
“গলার স্বর নিচু করো। বাহিরের মানুষ ভুল মতলব বুঝবে।”
“কেন করব? তারাও জানুক আপনি আমার উপর কত জুলুম করেন। মিঃ অসভ্য ছোড় দো মুজহে।”
সভ্য টেনে ইনারাকে রান্নাঘরে এনে হাত ছেড়ে বলে, “এই’যে মিস ড্রামা কুইন নিজের ড্রামাটা এবার বন্ধ করুন। আর চুপচাপ রান্নাঘরে চলুন। আসলে দাদাজান ফোন দিয়েছিলো। তোমার সিনেমা দেখে প্রশংসা করল।”
“সত্যি দাদাজান ছবিটা দেখেছে? আর আমি তো প্রশংসা পাবার যোগ্যই তাই সবসময়ই করে। এই’যে দেখেন হাসনা আপা প্রথম শো থিয়েটারে দেখে এসেই আমার জন্য এই ফুলের মালা গিফট আনলো।” ইনারা সভ্যকে তার হাতের ফুলের মালা দেখিয়ে বলে, ” আপনি এত বছরে এমন গিফট পেয়েছেন? আর আমি প্রথম দিনই পেয়ে গেলাম। দাদাজান আবার টেলেন্ট চিনে। এজন্যই তো আমাকে এতো আদর করে আর আপনাকে সারাক্ষণ বকতে থাকে।”
ইনারা মুখ টিপে হাসে।
সভ্য বলে, “খুব হাসি আসছে তাই না? দাদাজান এত আদর করে তোমাকে, এত ভালোবাসে।”
“আবার জিগায়।”
“জিগায় না ইট’স জিজ্ঞেস করে। জিগায় আবার কি শব্দ? ধ্যুর আমিও কোন এলিয়েনকে কারেক্ট করছি। যাই হোক, শুনো দাদাজান বলেছেন আগামী সাপ্তাহে বাড়িতে যেতে।”
“যাবেন আমি কি আপনাকে ধরে বেঁধে রেখেছি না’কি? দুইদিন আরামও পাব আমি। আহ দুইদিন ধরে আপনার চেহেরাটা আমার আর দেখতে হবে না। কী শান্তি!”
ইনারা উড়ু উড়ু মন নিয়ে কাউন্টারে উঠে বসতে নেয়। তখনই সভ্য বলে, “দাদাজান বলেছে তোমাকে নিয়ে যেতে।”
সাথে সাথে ইনারা মেঝেতে পরে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়। অবাক হয়ে বলে, “কী বললেন?”
“দাদাজান বলেছে তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে।”
“আরে আমি কি বয়রা না’কি? তা তো শুনেছি। কিন্তু কোন দুঃখে?”
“আহা দাদীর তার নাতবৌকে দেখতে হবে না। ওহ তোমাকে বলেছি আমার দাদীজান একদম দাদাজান থেকে উল্টো।”
ইনারার তো জান এমনিতেই শুকিয়ে গিয়েছিলো। সে চিকনসুরে জিজ্ঞেস করে, “উল্টো মানে?”
“মানে তোমার খারাপ দিন চালু হচ্ছে। দাদাজান আমাদের বাড়ির নারীদের প্রায়োরিটি বেশি দেয়। কিন্তু দাদীজানের জন্য তার ছেলে, মেয়ে এবং নাতি-নাতনী ছাড়া কাওকে বেশি গুরুত্ব দেয় না। আমার মা এত সুইট সেই আজ পর্যন্ত দাদীর মন গলাতে পারলো না আর তুমি তো জংলী।”
“কি বললেন আপনি, আমি কি?”
“জংলী।”
“আমি জংলী?” ইনারা সভ্যের কাছে যেয়ে তার বুকে ঘুষি মারে এবং বলে, “আপনাকে এখনই জংলীপণা দেখাচ্ছি। দাঁড়ান।”
ইনারা একের পর এক ঘুষি সভ্যের বুকে মারতে থাকে। আচমকায় সভ্য তার এক হাত ধরে নেয় এবং তার বুকের বাঁ পাশে রেখে বলে, “তোমাকে আজ বৃষ্টিবিলাসী রূপে সুন্দর দেখাচ্ছিলো। বৃষ্টি যখন তোমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা তোমার উপর অলংকার হয়ে সাজছিল। যে বৃষ্টির জল তোমার মুখে এসে জমেছিল সে জলের সৌন্দর্য তুমি বাড়িয়েছ।”

কথাগুলো শুনে ইনারা লজ্জা পায়। তার মনটায় প্রজাতিরা যেন নাচ করছে। কিন্তু সে তার খুশিটা প্রকাশ করল না। এক’পা এগিয়ে সভ্যের কাছে এসে বলল, “গায়ক সাহেব এখন এমন মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেই আমি আপনাকে ছেড়ে দিব না।”
“আমি কি বলেছি আমাকে ছেড়ে দিতে?”
সভ্য ইনারার হাত ছেড়ে তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। তার কেশগুলো আঙুল দিয়ে চুলে হাত বুলিয়ে কানের পিছনে গুঁজে আবার বলে, “আমি তো চাই তুমি আমাকে সারাজীবন ধরে রাখো।”

ইনারা একগাল হেসে তার বুকে হাত রেখে সরিয়ে দিয়ে বলে, “সুবিধাজনক দূরত্ব বজায় রাখুন। কারণ আপনি সুবিধাজনক না।”
“আমি কি করলাম?”
“আপনি এখন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছেন। তারপর কাছে আসবেন। তারপর… ”
“তারপর?” সভ্য আবার তার একটু কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “তারপর কী মেডাম?”
“তারপর অতিরিক্ত কাছে আসবেন। তাই সুবিধাজনক দূরত্ব বজায় রাখুন।”
“মানে এটা ভালো নিজে চাইলে জড়ায় ধরবা, আমি কাছে আসলে দোষ। উফফ এই ভেদাভেদ। যাই হোক, তুমি বাড়িতে গেলে অন্যকাওকে ইম্প্রেস করা না লাগলেও দাদীজানকে ইম্প্রেস করা লাগবে। কারণ ঘরে কেবল দাদীজানের চলে। দাদাজানও তার সামনে মুখ খুলতে ভয় পান। দাদীজানের মসলা চা অনেক পছন্দ। তোমাকে চা বানানো শিখতে হবে।”
“কেন?”
“ওই তুমি যেন কি শব্দ ইউস করতে? পেটানো। পেটাতে।”
ইনারা সভ্যের কথা শুনে ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর শব্দ করে হেসে উঠে, “এটা শুনলে দাদীজান আপনাকে পিটিয়ে পিটিয়ে মিউজিয়ামে ফেলে দিয়ে আসবে আর বলবে এই এন্টিক পিসকে এখানেই রাখো। পিটিয়ে না ইট’স পটানো। যা আমি অনেক ভালো মতো করতে পারি।”

ইনারাকে ভাব নিতে দেখে সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, “তোমার ভাব নেওয়া শেষ হলে এবার চা বসাও। প্রথমে পাতিলে পানি নিয়ে চুলায় বসাও।”
ইনারা তাই করল, “এটা তো সহজ।”
সভ্য আড়াআড়ি হাত ভাঁজ করে সরু দৃষ্টিতে তাকাল ইনারার দিকে, “চুলা কে জ্বালাবে?”
“চুলাও জ্বালাতে হবে?”
সভ্য বিরক্ত হয়ে নিজেই চুলা জ্বালিয়ে দিলো। তারপর তাকে মসলা এবং আদা দেখিয়ে দিতে দিতে তার পিছনে যেয়ে দাঁড়াল। তাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখে।

ইনারা বাচ্চাদের মতো উৎসুক দৃষ্টিতে চা পাতি দিয়ে তাকিয়ে পাতিলের দিকে। জিজ্ঞেস করে, “এটা আর কতক্ষণ লাগবে? মিষ্টি দিব না?”
সভ্য ইনারার চুলগুলো একপাশে নিয়ে তার কাঁধে একটা চুমু খায়। বলে, “তুমিই তো কত মিষ্টি। বেশি মিষ্টি দিলে আবার ডায়বেটিস হয়ে যাবে।”
ইনারা ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায়। পরক্ষণেই সভ্যের পেটে কণুই মেরে বলল, “আমি যেমন মিষ্টি, তেমন ঝালও।”
সভ্য তার পেটে হাত রেখে বলে, “এভাবে কেউ মারে? জংলী।”
“তাইলে তো হইলোই। আমি যেহেতু জংলী তাহলে আবার রান্না শেখানো কিসের? জলদি করে চা এবং নুডলস রান্না করে আমার দোলনায় নিয়ে আসুন। হাসনা আপাসহ সব স্টাফকে আজ ছুটি দিছি তাই আপনিই রান্না করবেন।”
“আমারুই সব কাজ করতে হলে এত টাকা দিয়ে লোক রাখলাম কেন?”
“চুপচাপ কাজ করেন তো, নাহলে দাদাজানকে ফোন দিয়ে বিচার দিব।”
“জ্বি মহারাণী। যা হুকুম দিবেন।”
ইনারা যেতেই সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “অফিসে আমি সবাইকে হুকুম করি আর এখানে আমাকে মেয়েটা হুমকি দেয়। একদিন আমার উপরই ছবি হবে ছবির নাম হবে ‘স্বামীর উপর জংলী বউয়ের অত্যাচার’।”
.
.
এক সাপ্তাহ পর,
“অভিনেত্রী ইনারার নতুন মিউজিক ভিডিও ট্রেন্ড করছে। রহস্যঘরের এত বড় সফলতা পাবার পর এখন চারদিকে তারই চর্চা হচ্ছে সকলে তার অভিনয়ে মুগ্ধ। আর এখন মিউজিক ভিডিওর পর পরিচালক আজমল নিজে তার অভিনয়ের প্রশংসা করেছেন। যা বিরল। চারবছর পূর্বে পরিচালক আজমলের সাথেই ইনারার ছবির জগতে আসার কথা ছিলো। কিন্তু তা সম্ভব হয় নি। এখন কি পরিচালক আজমলের ছবিতে দেখা যাবে তাকে?’

খবরটা পড়ে আইজা তার হাতের নিউজপেপারটা মুড়িয়ে মেঝেতে ফেলে দিলো। রাগে, জেদে, ক্ষোভে ফোঁপাচ্ছে সে। তার সামনে বসা মা এবং জোহান । সে তার মা’য়ের উপর নিজের ক্ষোভ বের করে, ” এখন খুশি তুমি? ফোন দে, ওর কথা মেনে নে, পরে তো শিক্ষা দিব ওকে। এই শিক্ষা দিয়েছি? আজ যেদিকে যাই শুধু ইনারার নাম শুনতে পাই। ছবিতে প্রধান চরিত্র ছিলো আমার ও জোহানের। অথচ কেউ আমাদের প্রশংসাও মুখে আনে নি। আমাদের এত বড় বড় ভক্তরাও না। তুমি বলেছিলে এই দুই একটা সিনে কিছু হবে না৷ ও ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করছে তাই সবাই ওকে ঘৃণা করবে। এখন দেখলে কি হয়েছে?”
তার মা অবাক হয়ে বললেন, “তুই আমার সাথে এভাবে কথা বলছিস আইজা? তুই তো জীবনে আমার সাথে এত উঁচু স্বরে কথা বলিস নি।”
জোহান তাদের সাথেই বসা ছিলো। তার হাতের কফির মগে চুমুক দিয়ে কাজ করতে করতে বলল, “আপনার মেয়ে তো আগে সত্যিই ভালো ছিলো। চরিত্রবান ছিলো। সময়ের সাথে সাথে অনেককিছু পরিবর্তন হয়, তাই না আইজা?”
“তুমি কি আমার টিমে না ওই ইনারার?”
“ওহ প্লিজ, আমি কারও টিম করি না। তোমরা জাহান্নামে গেলেও আমার কিছু আসে যায় না। যতদিন আমার স্বার্থ আছে ততদিন আমি আছি। আমার স্বার্থ শেষ হলে আমি তোমাকে চিনিও না।”
আইজা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো জোহানের দিকে, “প্রায় পাঁচ বছর ধরে আমরা একসাথে কাজ করছি। তুমি তাও এ কথা বলতে পারলে?”

কথাটা শুন জোহানের হাসতে হাসতে মুখের থেকে কফি পড়ে গেল। আইজা রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে, “আমি এখানে হাসির কিছু বলেছি?”
“তোমার মুখ থেকে কথা শুনে না হেসে পারলাম না। যাকে তুমি বোন বলে দাবি করতে, যার সাথে এক যুগের বেশি সময় কাটিয়েছ তার সাথে এত খারাপ কিছু করার পরও তোমার মনে হয় এই জীবনে সবাই তোমার পাশে থাকবে। এটা রসিকতা করলে না তুমি?”
আইজা চুপসে যায়। সে চোখ নামিয়ে নেয় লজ্জায়। জোহান বলে, “আচ্ছা তাহলে আজ উঠি। তোমরা দুইজন শোক পালন করো।”
জোহান উঠে দরজা দিয়ে বের হবার পূর্বেই তার এসিস্ট্যান্ট এসে তাকে একটা গুরুতর খবর দেয়, “স্যার আরেকটা ঝামেলা হয়েছে। ইনারা মেডাম একটি শো-তে গেছেন। সেখানে একজন মিডিয়া আপনার এবং তার ছবিটার কথা জিজ্ঞেস করছিলো। আর তিনি এইটা উওর দিলো।”

জোহানের হাতে ফোনটা দেওয়া হয়। সে দেখে ইনারা একটি কালো রঙের ড্রেস পরেছে সাদা স্টোনের কানেরদুলের সাথে। হাতে একটি কালো হ্যান্ডব্যাগ। সে তার স্বর্ণোজ্জ্বল চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে বলল, “ছবিটা আপনারা দেখেছেন? ছবিতে জোহানকে এখনের মতো লাগছে না আমাকে? অবশ্যই ছবিটা অনেক আগের। কয়েকবছর আগে জোহান এবং আমার এনগেজমেন্ট হবার কথা ছিলো কিন্তু হঠাৎ একদিন টিভিতে দেখি তার সাথে না’কি আইজার সম্পর্ক আছে। আমাকে তখন কিছুই বলা হয় নি। আমি তো আকাশ থেকে পড়েছিলাম। এখন তারা এমন কেন করল তা তো আপনাদেরই জিজ্ঞেস করতে হবে।”

কথাগুলো শুনেই আইজা উঠে দাঁড়ায়। উচ্চস্বরে বলে উঠে, “ও ইচ্ছা করে এমন স্টেটমেন্ট দিয়েছে। এমনিতেই চারদিকে ওর প্রশংসা চলছে। এখন তো আরও সহানুভূতি পাবে ও। আমরা ভিলেন হবো সবার চোখে। জোহান তুমি কিছু বলবে?”
জোহান বাঁকা হাসে। তার ভ্রুঁ নাচিয়ে বলে, “মেয়েটা দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছে কীভাবে বলতে পারো?”
“আর ইউ কিডিং মি? তুমি এই মুহূর্তে কি বলছ? ও কি বলল শুনো নি? ”
“উফফ ওর সৌন্দর্য থেকে চোখই সরাতে পারি নি। কীভাবে শুনব? যাই হোক, আমি আসি। সি ইউ লেটার সুইটহার্ট।”
বলে জোহান এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। আইজা রাগে তার সোফার কুশন মাটিতে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে উঠে আর তার মা’কে বলে, “তোমার জন্য আজ এসব হয়েছে। আমি বলেছিলাম মামাকে সবটা জানাও। তার থেকে হেল্প নেও। কিন্তু তুমি মানা করলে। এখন মামা রাগ করে আমার সাথে কথা বলছে না। নিজেকে খুব বুদ্ধিমান ভাবো তাই না? দেখলে তোমার বুদ্ধির কারবারি?”
“আইজা তুই এভাবে আমার সাথে কথা বলছিস? লজ্জা করে না তোর?”
“তুমিও তো আমার সাথে সারাজীবন এভাবে কথা বলে এসেছ। আমার এই সমস্যা, ওই সমস্যা। তো এখন আমি বলতে সমস্যা কী? আর আমার সাথে নিচু স্বরে কথা বলো। আমার টাকা দিয়েই এখন এত বিলাসিতা করো তুমি।”
“আইজা!”
“একদম চিল্লাবা না। তোমার এই বিলাসিতার জন্য আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। এখন হারিয়ে যা পেয়েছি তা হাত থেকে ছুটে যেতে দিব না আমি। এখন আর আমার নিজের অর্থ এবং খ্যাতি ছাড়া কিছু চাই না। তোমাদেরও না।”
আইজা তার মা’য়ের পাশ কেটে চলে গেল। তার মা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার মেয়ে তাকে এমন কিছু বলতে পারে এর কল্পনাও সে করে নি।
.
.
আহনাফ একটি টিভি চ্যানেলে উচ্চ পদে কাজ করে। চ্যানেলের সব শেষ সিদ্ধান্ত সেই নেয়। আজ চ্যানেলের একটি শো তে নায়িকা ইনারার ইন্টারভিউ হচ্ছে। তার প্রথম ছবি আসার পূর্বেই তার ফ্যান হয়ে যায় সে। কেন হবে না? ক’জন নায়িকা তার সাথে ভুল হওয়ার পর প্রতিবাদ করতে জানে?

শো-টা খুব ভালো ভাবেই চলছিল। যখন শো শেষ পর্যায়ে তখনই সুরভির মেসেজ আসে। সুরভি তার অফিসে এসেছে। তার না’কি কোনো জরুরী কাজ। বিপদে পড়েছে সে। এখন আহনাফ চলে গেলে ইনারার সাথে আজ আর দেখা করতে পারবে না। কারণ অফিসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ইনারার শ্যুটিং শেষ হয়ে যাবে। তবুও সে গেল। সুরভির বিপদ বলে কথা। সুরভি এ বিগত কয়মাসে তার অনেক কাছের বন্ধু হয়ে গেছে। তাই তাকে সাহায্য করাটা সবচেয়ে জরুরি।

আহনাফ সেখান থেকে নিজের কেবিনে যায়। যেয়ে দেখে সুরভি চেয়ারে বসে চিন্তায় নখ কামড়াচ্ছে। আহনাফ দৌড়ে কাছে জিজ্ঞেস করে, “কী হয়েছে সুরভি? তুমি ঠিক আছো তো?”
সুরভি চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “আমি তো ঠিক আছি। কিন্তু আপনি ঠিক থাকবেন না।”
“মানে? আমার কি হবে?”
“আসলে আমার বেস্টফ্রেন্ড আপনার সাথে আজ দেখা করতে আসবে। একঘন্টা আগেই জানাল। আমরা যেহেতু এত সময় ধরে কথা বলছি তাই বুঝেছে বিয়ে ফাইনাল। এখন ওকে এক থেকে দুই কিছু বললে আমাকে ছিল্লা ফালাবে সাথে আপনাকেও। তাই আপাতত আপনি একটু ওকে সামলে নিয়েন।”
“সুরভি তুমি আমাকে এভাবে ডাকলে? তোমার বান্ধবী তো আর আমাকে খুন করবে না। তোমার জন্য আমি আমার ফেভারিট অভিনেত্রীর সাথে দেখাও করতে পারলাম না। ধ্যুর।”
কিছু সময়ের মধ্যে দরজার বাহিরে খুব হৈ-হুল্লোড় শোনা গেল। আহনাফ অবাক হয়। দরজা খুলে বাহিরে উঁকি মেরে দেখে অভিনেত্রী ইনারা বাহিরে এবং সে তার রুমের দিকেই আসছে।

আহনাফ কতক্ষণ অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো বাহিরের দিকে। তারপর উৎসুক গলায় বলল, “সুরভি দেখো বাহিরে অভিনেত্রী ইনারা এসেছে। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না।”
“অল দ্যা বেস্ট।”
“অল দ্যা বেস্ট কেন?”
“বুঝবেন?”

ইনারা রুমের ভেতর উঁকি মেরে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, “আসতে পারি।”
“অবশ্যই আসেন। আপনারই কেবিন। আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার কেবিনে এসেছেন। কীভাবে সম্ভব?”
ইনারা ভেতরে ঢুকে। তার সকল স্টাফ বাহিরেই। সে ভেতরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বলে, “আসলে একটা শুটিং ছিলো এদিকে। তাই ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করেই যাই। এখন আপনাকে সতর্ক করে যাই।”
“সতর্ক? আমাকে? কেন?”
সুরভি উঠে এসে ইনারার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, “আসলে ইনারাই ইনু। আমার বেস্টফ্রেন্ড। ওই’যে বলেছিলাম আমাকে ডিস্টার্ব করায় তিনজনকে ও হাস্পাতালে পাঠিয়ে দিয়েছিল।”
“কী!” আহনাফ যেন আকাশ থেকে পড়ল, “তুমি তো আগে কখনো আমাকে এ কথা জানাও নি।”

ইনারা কঠিন দৃষ্টিতে তাকায় আহনাফের দিকে, “এই যে মিঃ, আমার সামনে আপনি আমার বান্ধবীর সাথে উঁচু স্বরে কথা বলছেন সাহস তো কম না আপনার। গলার কণ্ঠনালী ছিঁড়ে নিয়ে আসব।”
আহনাফ তার গলায় হাত রেখে আমতা-আমতা করে বলে, “আসলে হঠাৎ করে ঝটকা খেলাম তো তাই বের হয়ে গেছে।”
ইনারা একটি চেয়ার এনে আহনাফের সামনে রেখে বলে, “বলেন। আমার কাছে পঁচ মিনিট আছে এর মধ্যে কিছু কথা শেষ করি।”
আহনাফ ইনারার একটু আগের হুমকিতে এখনো ভয়ে ছিলো। সে ভয়ে ভয়ে যেয়ে বসলো চেয়ারে। ইনারা তার হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে জিজ্ঞেস করে, “আমার বান্ধবীকে ভালোবাসেন?”
“হুঁ?” সুরভির দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় সে। মাথা নেড়ে হ্যাঁ উওর দিতে বলে।
ইনারা আবারো উঁচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, “সুরভিকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ, অনেক।”
“ওকে সুখে রাখবেন?”
“অনেক।”
“ওর চোখে এক ফোঁটা জল আসলে আপনাকে ভর্তা করে দিব। এটাতে রাজি?”
“কী!”
“মানে আপনি ওর চোখে জল আনবেন?”
আহনাফ এবার আসলেই ভয় পেয়ে গেল, “না না, একদম না। স্বপ্নতেও না।”
“গুড।” ইনারা এবার শান্তির নিশ্বাস ফেলে,”আপনাকে জানিয়ে দেই আপনি কত লাকি আমার বান্ধবীকে পেয়ে। গানের দুনিয়ার সামির আহমেদ অর্থাৎ সামিকে চিনেন? সেও সুরভির উপর ক্রাশ খেয়েছিল। অথচ ও আপনাকে বাছাই করল।”

সুরভি নিজে এই কথা আজ প্রথম শুনল। সে অবাক হয়ে ইনারার কানের কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “আসলে?”
“আরে না, ফাপড় মারি। তুই চিল মার।”
দুইজনে ফিসফিস করে কথা শেষ করে ইনারা আহনাফকে বলল, “যাই হোক। আমার তাড়া আছে, নাহয় আরও কিছু সময় থাকতাম।”
“আল্লাহ বাঁচালো।”
“কি বললেন?”
“কিছু না। কিছু না।”
ইনারা রুম থেকে বের হবার পর আহনাফ এতক্ষণে প্রথম শান্তির নিশ্বাস ফেলে।

সেখান থেকে বের হয়েই ইনারা বাসায় যেয়ে চেঞ্জ করে নিলো। এখন সে এবং সভ্য দুইজন মিলে যাব সভ্যের বাড়িতে। এমনিতেই সে নার্ভাস। এর উপর সভ্যেরও খোঁজ নেই। এবার তার রাগ লাগছে। এর মধ্যে একজন স্টাফ এসে জানায়, “ম্যাম স্যার অফিসে থেকে এসে গাড়িতেই অপেক্ষা করছে। বলেছে আপনাকে জলদি করে বলতে গাড়িতে যেন উঠে যান। সব ব্যাগ আমি রেখে দিচ্ছি।”

ইনারা তার রাগ সব একপাশে রেখে হাসিমুখে সভ্যের সামনে যায়। এখন তো তার সভ্যকেই তেল মারতে হবে, নাহলে ওখানে যেয়ে নিশ্চয়ই জ্বালাবে লোকটা। সে যেয়ে দেখে সভ্য ড্রাইভারের সিটে বসা, “আপনি গাড়ি চালাবেন?”
“হ্যাঁ, ভাবলাম রাতটা সুন্দর। একটু তোমাকে নিয়ে ড্রাইভ করা যাক। কখনো তো আমরা লং ড্রাইভে যাই নি। এই এলাকা থেকে বের হতেই দাদাজান একটা গাড়ি পাঠাবে সেখানে উঠতে হবে।”
ইনারা হাসিমুখে তার দিকে তাকায়। তার বাহুতে মাথা রেখে বলে, “আসলেই। আমার কত ইচ্ছা ছিলো। এত সুন্দর রাত আপনার সাথে উপভোগ করার। আরে দেখেন আজ আপনাকে কত হ্যান্ডসাম লাগছে।”
সভ্য হেসে তাকায় ইনারার দিকে, “সত্যি?”
“একদম সত্যি।”
“লাভ নেই মাখন মেরে। এই একবছর যত জুলুম করছো সব কিছুর শোধ তুলব আমি। দাদাজানকে দিয়ে অনেক বকা খাইয়েছ না? এবার বুঝবে মজা।”

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here