অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ২১,২২

0
1419

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২১,২২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
২১

দু’পাশে গাছের বাহার। অনেকটা জঙ্গলের মতো। চাঁদের মৃদু রশ্মিতে গাছগুলো দেখা যাচ্ছে কিছুটা। রাতের মিষ্টি হাওয়া এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে ইনারার মুখখানি। সে জানালাতে কনুই রেখে গালে হাত রাখল এবং তাকিয়ে রইলো বাহিরের দিকে। তারপর সে সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “এই’যে মিঃ অসভ্য, কতক্ষণ লাগবে আমাদের যেতে?”
“সবে তো রওনা দিলাম। যেতে যেতে তো সকাল হবে।”
“এতক্ষণ?” ইনারা অবাক হয়ে তাকায় সভ্যের দিকে, “আমরা কি মঙ্গলগ্রহে যাচ্ছি?”
“তুমি আর তোমার কথাবার্তা! একটা কথাতেও কোনো সেন্স নেই।”
“আর আপনার সেন্স তো উতলে পরতেছে।”
“তোমার সাথে কথা বলা আর দেয়ালে নিজের মাথা মারা এক।”
“তো কে কথা বলতে বলল শুনি?”
“তুমিই কথা বলতে শুরু করেছ?”
“তো আপনাকে উওর কে দিতে বলেছে?”
সভ্যকে চুপ থাকতে দেখে সে-ই আবার বিরক্ত হয়ে বলে, “এখন কথা বলছেন না কেন?”
“আজব তো উওর দিলেও জ্বালা, না দিলেও জ্বালা। কি করব তোমার সাথে বলো?”
“থাক আপনার কিছু করতে হবে না। অসভ্য একটা!”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে ফিরে তাকাল। সভ্য চোখ ঘুরিয়ে বলে, “যদি বর্তমান যুগে জিজ্ঞেস করা হয় কোন জাতির সাথে সবচেয়ে বেশি জুলুম করা হয় তাহলে নিশ্চয়ই উওরটা বিবাহিত পুরুষই হবে। আর তোমার মতো বউ পেলে তো আগুনে ঘি ঢালার মতো অবস্থা। ওখানে যেয়ে দেখি কত উড়তে পারো। আর কিছু ঘন্টা।”

ইনারা বিরক্ত নিয়ে তাকায় সভ্যের দিকে, “মানে একথা বলতে লজ্জা লাগে না আপনার? আমার মতো সুইট মেয়েকে আপনি এভাবে বলতে পারলেন?”
“সুইট আর তুমি? আস্তো এক জংলী। নায়িকা হয়ে গেছে কিন্তু কথার ধরণ পাল্টালো না।”
ইনারা ভেংচি কেটে ভাব নিয়ে বলল, ” আপনার জন্য হতে পারি কিন্তু এখন আমার জন্য স্টুডিওর বাহিরেও ছেলে মেয়েরা চিৎকার করে আমার নাম নেয়।”
“সেটা আমার জন্যও নিয়েছে। তোমার থেকে ত্রিশগুণ বেশি ভক্ত ছিলো পঞ্চসুরের। রিমেম্বার?”
সভ্য শান্ত গলায় বলে কথাটা।
ইনারা কথার উত্তর না খুঁজে পেলেও দমে যায় না। সে জোর গলায় বলে, “তো কি হয়েছে? আপনারা পাঁচ বছর পর এত সাফল্য পেয়েছেন। আমি বাজি ধরলাম আমি তো তিন বছরেই সে কাজ করে দেখায়।”
“দেখব আসলে করো, না হাওয়ায় কথা বলো।”
“কেবল ফ্যানরাই না ইন্ডাস্ট্রির কতজনও আমার ভক্ত হয়ে গেছে। তাও এক সাপ্তাহে। আজ অনেক জনের সাথে কথা বললাম। ইনফ্যাক্ট আজমল স্যার নিজে আমার সাথে কথা বলেছেন। তার নতুন ফিল্মে আমাকে প্রধান চরিত্র নেবার কথাও বলেছেন। আর গেস হোয়াট সিনেমার আরেকটা প্রধান চরিত্র কে? ওয়াসিন খান। দেশের টপ অভিনেতা। আর কত হ্যান্ডসাম! সে তো আজ আমাকে পার্টিতে দেখে চোখই সরাতে পারে নি। সারাটাক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।”

কথাটা বালার সাথে সাথেই সভ্য ব্রেক লাগালো। ইনারার দিকে তাকাল কঠিন দৃষ্টিতে, “কি বললে আবার বলো তো?”
ইনারা এবার আমতা-আমতা করল, “এভাবে তাকানোর দরকার নেই। আমি ভয় পাই না।”
সভ্য তার সিট বেল্ট খুলে ইনারার দিকে এগিয়ে এসে তার কপালের চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে দিলো এবং কঠিন গলায় বলল, “শুনো ইনারা, এরপর যদি তুমি অন্যকোনো পুরুষের কথা আমার সামনে বলেছ অথবা কারও প্রশংসা করেছ তাহলে অনেক খারাপ হবে। তোমার সাথে অন্যভাবে থাকি এর মানে এই না যে আমি আর আগের মতো কঠিন নই। বুঝেছ?”
সভ্যের এভাবে তাকানো দেখেই তো ইনারার জান শুকিয়ে গেছে। সে ঢোক গিলল। দ্রুত মাথা নাড়ায় এবং হ্যাঁ বলে।
“গুড।”
সভ্য তার গালে একটু চুমু খেয়ে আবার ড্রাইভিং করতে বসে।

ইনারা সভ্যের চুমু খাওয়া স্থানে হাত রেখে কতক্ষণ তাকে বকে। তারপর লজ্জা পেয়ে হেসে দেয়। জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা পঞ্চসুরের কথায় মনে পড়েছে আপনার কি সামি ছাড়া অন্য কারো সাথে যোগাযোগ নেই?”
“হঠাৎ এ প্রশ্ন করলে যে?”
“এমনিতেই। বলুন না।”
“সামি ছাড়া আর কারো সাথেই যোগাযোগ নেই।”
“ঐশী এবং ইরফানের সাথেও না? কী হয়েছে তাদের সাথে?”
“বিশেষ কিছু না এমনিতেই যোগাযোগ নেই।”
“কিন্তু তাদের সাথে তো…”
ইনারা সম্পূর্ণ কথা বলার পূর্বেই সভ্য তাকে চুপ করিয়ে দিলো, “এসব কথা বাদ দাও। আর এত সুন্দর রাতের মজা নেও।”
সে গাড়ির একটা বাটন চাপ দিলো আর সাথে সাথে খুলে গেল গাড়ির ছাদটা। খোলা আকাশ দেখতেই ইনারার মুখে হাসি ফুটল। সে সিটে উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত পাখির ডানার মতো মেলে রাত্রিটা অনুভব করল। এই রাস্তায় কেবল তাদেরই গাড়ি। তাই খোলা আকাশের নিচে এমন স্বাধীনতা অনুভব করল সে বহু বছর পর।

সভ্য গাড়ি চালাতে চালাতে তাকে দেখে মৃদু হাসে। রাতের চন্দ্রিমার সাজে তাকে আরও পবিত্র দেখাচ্ছে। অপরূপ দেখাচ্ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা এলাকা ছাড়িয়ে গেল। আরও দুইটি গাড়ি আসলো। চারটা বডিগার্ড দাঁড়ানো। এর মধ্যে তিনজন সামনের গাড়িতে যায় এবং একজন তাদের সাথে গাড়িতে উঠে। সামনের সিটে বসে। গাড়িতে উঠার কিছুসময়ের মধ্যেই ইনারা ঘুমিয়ে পড়ে। সভ্য তার কোর্টটা দিয়ে ইনারাকে জড়িয়ে দিয়ে তাকে নিজের বাহুডোরে আবদ্ধ করে রাখে।

ইনারার ঘুম ভাঙ্গে সভ্যের কন্ঠে, “ইনারা, আমরা এসে পড়েছি। উঠো।”
ইনারা চোখ খুলে। চারদিকে আলো ফুটে উঠেছে। জানালার বাহিরে তাকায় সে। সাথে সাথে তার চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায়। লাফ মেরে উঠে বসে। বাহির থেকে দেখলে কোনো বাড়ি নয়, রাজবাড়ী দেখা যায়। বিশাল বড় একটা মহল। শ্বেতপাথর দিয়ে গড়া দুই মঞ্জিলের মহলটা। যদিও ইনারার এত অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। ইসমাত কোম্পানি তো আর ছোট না। দেশের সবচেয়ে বড় কোম্পনির মধ্যে একটা। তবুও এখন সুন্দর একটি মহল দেখে সে প্রভাবিত না হয়ে পারল না।
গাড়ি থেকে নেমে ইনারা দেখে তার দুপাশে বিশাল বড় বড় গাছ এবং স্ট্রিট লাইট লাগানো। সভ্য তাকে নিয়ে সে সুন্দর পথ দিয়ে এগোল। গাছগুলো থেকে ফুল ঝরে ঝরে তাদের পথে পড়েছে। সে পথ পেরিয়ে যে তারা যেয়ে দাঁড়ালো এক বিশাল দোয়ারের সামনে।

দোয়ারটি খোলা। সভ্য তার কাছে এসে মৃদু স্বরে বলে, “মহারাণী আপনার শশুড়বাড়িতে আপনাকে স্বাগতম।”
সভ্য তার হাত ধরল। আঙুলে আঙুল ঢুকিয়ে প্রবেশ করল বাড়িতে। সেখান থেকে ড্রইংরুমে গেল তারা। সোফায় সভ্যের বাবা ও দাদা বসে চা পান করছেন এবং সংবাদপত্র পড়ছেন।
সভ্য ডাকল, “দাদাজান দেখুন কাকে নিয়ে এসেছি?”
দাদাজান সংবাদপত্র থেকে মুখ তুলে তাকায় সভ্য এবং ইনারার দিকে। সাথে সাথে সে উঠে দাঁড়ায়। ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আরে তুমি সত্যি এসেছ। ভালো, খুব ভালো। তো কোনো সমস্যা হয় নি তো?”
“না দাদাজান।”
সভ্য মুখ বানিয়ে বলে, “আমি তো প্রতিমাসে আসি। এ কথা তো আজ পর্যন্ত আমাকে একবারও জিজ্ঞেস করলেন না দাদাজান।”
দাদাজান তার হাসিমুখটা কঠিন করে তাকায় সভ্যের দিকে, “কেন? তুও বিশেষ কেউ যে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে?”
সভ্য দ্রুত মাথা নাড়ায়, “না না আমাকে কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? আমি আর বিশেষ কে?”
আফসোসের নিশ্বাস ফালায় সভ্য।

সভ্যের বাবাকে ইনারা চিনলো। ছবিতে দেখেছিলো। সে এসে চশমাটা নড়াচড়া করে ভালো করে দেখলো ইনারাকে, “তোমাকে কোথাও দেখেছি আমি। নিউজপেপারে। তুমি নায়িকা না? নতুন কোন যে ছবি এসেছিলো সে ছবির নায়িকা?”
“জ্বি। আসসালামু আলাইকুম।”
সাথে সাথে সে উচ্চস্বরে বলে, “ও অভ্রের মা, দেখে যাও মেহমান এসেছে ঘরে। এই মিনু দেখে যা তোর পছন্দের নায়িকা এসেছে।”
তার হঠাৎ এমন উচ্চস্বরে কথা বলায় ইনারা ঘাবড়ে যায়। দাদাজান ধমক দিয়ে বলে, “এই ছাগল এভাবে চিৎকার করে কে ডাকে? মেয়েটাকে ভয় পাইয়ে দিলি তো তুই।”
“ওহ সরি আব্বা।” সভ্যের বাবা আবার ইনারার দিকে তাকিয়ে বলে, “আসলে মা আমার বোনের মেয়ে নতুন সিনেমাটা দেখে তোমার ভক্ত হয়ে গেছে। আমিও দেখেছি। অনেক সুন্দর অভিনয় করেছিলে তুমি।”
“থ্যাঙ্কিউ আঙ্কেল।”

এক ডাকে সকলে এসে হাজির হয় কক্ষে। প্রথমে দাদীজান রাগান্বিত স্বরে বলে, “ইসমাঈল তোকে কতবার বলেছি এত জোরে কথা বলবি না। এটাকে কোন দিক থেকে ভদ্রতা বলে?”
কিন্তু সভ্যকে দেখতেই তার মেজাজের হঠাৎ পরিবর্তন ঘটলো। সে হাসিমুখে যেয়ে সভ্যের কপালে চুমু খেয়ে বলে, “কতদিন পর এলি তুই? দাদীজানের কথা মনে পড়ে না বুঝি?” আবার সে ইনারার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ও কে? তোর পরিচিত কেউ? আগে কাওকে তো বাড়িতে আনিস নি।”
উওর পাবার পূর্বেই আরেকবার উঁচু আওয়াজ শুনতে পায় ইনারা। সিঁড়ি থেকে একটি তরূণী চিৎকার করে দ্রুত গতিতে ছুটে এসে ইনারার হাত ধরে বলে, “আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আপনি আমার সামনে। আপনি জানেন আমি আপনার কতো বড় ফ্যান। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি আমার সামনে দাঁড়ানো। চিমটি কাটুন তো।”
“কী!” হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করে ইনারা।
“চিমটি কাটুন। চিমটি।”
ইনারা চিমটি কাটে। সাথে সাথে মেয়েটা খুশিতে লাফানো শুরু করে। তখন একটি মহিলা বলে, “আরে মিনু ওর কথাই না তুই গত কয়েকদিন ধরে বলছিস। দেখ তুই বলতে না বলতেই সভ্য তোর জন্য ওকে নিয়ে এলো।”
মিনু সাথে সাথে তাকায় সভ্যের দিকে৷ তাকাতেই লজ্জায় মাখা মাখা হয়ে যায় এবং হেসে বলে, “তাই না’কি সভ্য ভাইজান। আপনি আমার কত খেয়াল রাখেন! থ্যাঙ্কিউ ভাইজান।”
ইনারা প্রথমে চোখ বড় করে নেয়। মনে মনে বলে,”ভাই বলে ঠিক আছে। সঙ্গে আবার জান লাগানোর কি আছে?”

দাদীজান হেসে বলে, “ও তাই? যাক ভালো হলো। মুনি বৌ’মাকে ডাক দেও। বলো মেহমানের যেন ভালো আদর যত্ন করে।”
“দাদীজান,” সভ্য ইনারার হাত নিজের হাতে নিলো, “ও মেহমান না, এই ঘরের বউ। আমার স্ত্রী।”
কথাটা ভীষণ সাধারণ ছিলো। সভ্যর হয়তো তার পরিচয় এভাবেই দেওয়ার ছিলো৷ কিন্তু ইনারার বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠে। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে একপলক তাকায় সভ্যের দিকে। আবার চোখ নামিয়ে নেয়।

“তোর স্ত্রী মানে?” হতভম্ব হয়ে বলে দাদীজান, “মশকরা করিস? তোর বিয়ের কথা তো আমি মিনুর সাথে চিন্তা করে রেখেছি। কথা নাই বার্তা নেই এভাবে বললেই হবে যে কাওকে বিয়ে করে এনেছিস?”
“তুমি কার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছ এতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমি মিনুর কথায় আগেও না করেছি। ওকে আমি ছোট বেলা থেকে বোনের মতো দেখে এসেছি। ও আমার বোন হয়। আমি এ কথা আগেও বলেছি। তাই এতোটুতেই কথা শেষ হওয়া উচিত ছিলো।”
“তাই বলে কি যে কোনো মেয়েকে এনে বিয়ে করে বসে থাকবি। রূপ দেখিয়ে ফাঁসালো আমার নাতিকে। তোর টাকার পিছনে পাগল হয়ে গেছে। ওর বংশকে চিনি না, ওর পরিচয় জানি না। তুই খোঁজ নিয়েছিস?”
“আমার খোঁজ নেবার প্রয়োজন নেই।”
“তাহলে আমি এই বিয়ে মানি না।”

ইনারা স্তব্ধ হয়ে গেল। আগে সে সভ্যের সাথে বিয়ে নিয়ে এত গভীর করে ভাবি নি। তার যে পরিবার বলতে কেউ নেই তা ইনারা ভালো করে অনুভব করে। কিন্তু দাদীজানের এক প্রশ্নে সে অনুভূতিটা বুকে আঘাতের মতো লাগলো। সত্যিই তো তার বংশ কী? পরিচয় কী?
ইনারা আস্তে করে সভ্যের হাত ছাড়তে নিলেই সভ্য তার হাত আরও শক্ত করে ধরে নিলো।

যতটা জোর গলায় কথাটা দাদীজান বললেন, এর থেকেও বেশি জোর গলায় সভ্য বলল, “তুমি মানাতে, না মানাতে এখন কিছু আসে যায় না। আমি মানুষ দেখে বিয়ে করেছি, বংশ পরিচয় দেখে না। আর তোমার ওর পরিচয় এতই লাগলে বলে দেই ওর নিজের পরিচয় গড়ছে, অভিনেত্রী হিসেবে। আর ওর অন্য পরিচয় আমি, ওর স্বামী এবং ও আমার অর্ধাঙ্গিনী।”

দাদীজান ইনারার দিকে তাকিয়ে বলল, “যা ইচ্ছা তা কর।” এবং রাগে হনহনিয়ে চলে গেল। তার পিছনে গেল সভ্যের ফুপিও। আর যেতে যেতে মিনুর হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে গেল।
দাদাজান দাঁড়ানো থেকে সোজা বসেই পড়লেন। সে চিন্তিত সুরে বললেন, “এ তো ভারী ঝামেলা হয়ে গেল। আমার মনে হয় তোমাদের ডাকাটা ঠিক হয় নি। নাতবৌ আমাকে ক্ষমা করে দেও। আমার জন্য তোমার এসব শোনা লেগেছে। একটা কাজ করো তোমরা চলেই যাও। আমি তোমাদের কষ্ট দিতে চাই না।”
ইনারার আরও বেশি কষ্ট হচ্ছিল দাদাজানের কথা শুনে। সে যেয়ে দাদাজানের পা’য়ের কাছে বসে হাত ধরে বলল, “আপনি আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমার উপর পাপ লাগাবেন না। আপনি আমার আপন দাদার মতো। আর রইলো দাদীজানের কথা তার দায়িত্ব আমাকে দিন। আমি আবার ভয়ে পালিয়ে যাওয়ার মেয়ে না। যাস্ট দুইদিন দিন, দাদীজানকে করব আমার দলে ইন।”

চলবে…

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

দ্বিতীয় মঞ্জিলে সভ্যের রুম। দাদাজান ইনারা ও সভ্যকে রুমে পাঠায় ফ্রেশ হতে। ইনারার সভ্যের বাবাকেও ভালো লেগেছে। সে দাদাজানের মতো মিষ্টি ভাবে কথা বলেছেন তার সাথে। দাদাজানের কন্ঠটা কঠিন হলেও সভ্যের বাবার কথার ধরণ অনেক মিষ্টি।

ইনারা রুমে এসেই লাফ দিয়ে বসে পড়ে বিছানায়, “আমিতো সেই ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
“ক্লান্ত!” সভ্য হতবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “সারারাস্তা ঘুমিয়ে তুমি ক্লান্ত হয়ে গেছো?”
“তো কি? হাত পা না ছড়িয়ে ঘুমানো কত শান্তির আপনি জানেন?”
সভ্য মুখ বানায়, “হ্যাঁ, অনেক কষ্টের৷ আমি সারারাত তোমার জন্য ঘুমাই নি তো তাই সঠিক জানি না।”
“কিন্তু জানা উচিত।”
সভ্য বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে , “আসলে কোন পাগলের সাথে যে বিয়েটা করলাম।”
“এই কি বললেন আপনি?”

দরজায় টোকা পরে। ইনারা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে একটি অপরূপ সুন্দরী মহিলা রুমের ভেতর ঢুকছেন। মহিলাটি সভ্যের মা হন। ঢুকেই তিনি সভ্যের বাহুতে জোরে মারল, “তোকে তো গালে মারা উচিত। কত রাগ উঠছে আমার তোর উপর জানিস?”
ইনারা এবার ভয় পেল। সে ভাবল সভ্যের মা’ও তাকে অপছন্দ করবেন। তাই হয়তো রাগ। কিন্তু তিনি উল্টো বলেন, “একতো আমার বড় ছেলে বিয়ে করবে না। আর ছোট ছেলে বিয়ে করে বসে আছে আমাকে জানায়ও নি। কত স্বপ্ন দেখেছিলাম তোদের বিয়ের। কত ফাংশন করব। বউকে পুতুলের মতো সাজিয়ে, ধুমধাম করে অনুষ্ঠান করে ঘরে এনে তুলব। কিন্তু তোরা দুই ভাই তো আমার ইচ্ছার কদরই করিস না। কর তোরা নিজের মর্জি মতো, আমার স্বপ্নগুলো ভেস্তে যাক তাই না?”
বলতে বলতে তার চোখে জল এসে পড়লো।

সভ্য তার গালে হাত রেখে বলল, “আমার ইমোশনাল মা, এখন তো ব্লাকমেইল করে লাভ নেই। কাজ তো সেরেই ফেলছি। এবার দেখো তো তোমার বৌ’মা দেখতে পুতুলের মতো না’কি?”

ইনারা সভ্যের মা’কে রুমে ঢুকতে দেখেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো এবং কাঁদতে দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েছিল। তাই যখন সভ্যের মা’কে ঘুরিয়ে তাকে দেখাল, তখন ইনারা মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। সভ্য তার মা’কে ঘুরাঘুরি পর সে চমকে গেল। ইতস্তত করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম আন্টি।”
সভ্য তার মা’য়ের কাঁধে মাথা রেখে বলে, “পুতুলের মতো লাগছে?”
ইনারা সামনের আয়নায় একবার নিজেকে দেখে মনে মনে বলল, “রাতভর জার্নি করে ভূতের মতো লাগছে আর এই গর্দভটা না’কি জিজ্ঞেস করে পুতুলের মতো লাগছে নাকি? একটু রেডি হতে বলতো। কিন্তু না, আমাকে তো লজ্জায় ফেলতে হবে তার।”

সভ্যের মা সালামের উওর দিয়ে ইনারার দিকে এগিয়ে গেল, “মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ পুতুল থেকেও বেশি মিষ্টি।”
তিনি ইনারার গালে হাত রেখে আদর করে দিলো তাকে। আরও বলল, “এত মিষ্টি মেয়েটাকে পেলি কীভাবে তুই?”
“একদিন বাঁদরদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। ঠুস করে আমার সামনে এসে পড়লো।”
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল সভ্যের দিকে। মা বললেন, “এই ছেলের কথা কানে দিও না তো। দিন দিন ভদ্রতাই ভুলে যাচ্ছে। আগে তো ভালোই ছিলো। বিগত কয়েকবছর যে কিসব ভাষায় কথা বলছে না?”
“সঙ্গদোষ মা, সবই সঙ্গ দোষ।” ইনারাকে উদ্দেশ্য করে বলল সভ্য। ইনারা নিজেকে খুব কষ্টে সামলে হাসি এঁকে রাখল মা’য়ের সামনে।

“এমন খারাপ সঙ্গ রাখতে নেই। তোকে না বললাম। তাই না মামনী?” মা ইনারাকে কথাটা জিজ্ঞেস করলে। কথাটা শুনে জোরপূর্বক হাসলো। আমতা-আমতা করে বলল, “একদম আন্টি।”
“ওকে বুঝাও। ওর দায়িত্ব তো এখন থেকে তোমার। আর তোমার লজ্জা পেতে হবে না। সভ্যের মা মানে আমি তোমারও মা, বুঝেছ?”
মা শব্দটা শুনে ইনারার ঠোঁটের হাসিটা কিছু মুহূর্তের জন্য আড়াল হলো। কিন্তু পরক্ষণেই একগাল হাসি এঁকে এলো তার ঠোঁটে। তার বুকে কেমন করে উঠলো। কেন যেন অনেক খুশি অনুভব হলো। খুশিতে লাফাতে মন চাইল। কিন্তু সে নিজেকে সামলে বলল, “জ্বি।”
মা নিজের হাতের চুড়িটা খুলে ইনারাকে পরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু সে বাঁধা দেয়, “আন্টি কি করছেন? এসব লাগবে না।”
“একদম চুপ। এটা আমার দোয়া তোমার জন্য। আমি যখন প্রথম আমার শাশুড়ীর সামনে গিয়েছিলাম তখন উনি আমাকে পরিয়েছিল।”
মা ইনারার হাতে চুড়ি পরিয়ে কপালে চুমু দেয় এবং বলে, “তুমি আজ থেকে কেবল এ ঘরের বউ না, মেয়েও বুঝেছ। এ বাড়িটা তোমার। তাই অস্বস্তিবোধ করবে না। এখন জলদি করে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো নাস্তা করার জন্য। আমি নাস্তা লাগাচ্ছি টেবিলে।”
“জ্বি।”
ইনারা মা’য়ের যাবার দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কেমন একটা মায়া অনুভব হলো তার সভ্যের মা’য়ের কথায়, আদরে।

সভ্য ইনারার পাশে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, “কি দেখছ?”
ইনারা চকিতে তাকায় পিছনে। সভ্য তার পিছনে এসে দাঁড়ানো এটা না জেনেই। সে সভ্যের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে যেতে নেয় তখনই সভ্য তাকে ধরে নেয়। এবং বলে, “আয়হায় আমার বউ একটু দেখে শুনে হাঁটো। এমনিতেই তো দাদীজান রেগেমেগে ফায়ার হয়ে আছেন। এর উপর তোমার হাত পা ভেঙে গেলে দুইদিনে ইন কীভাবে করবে শুনি।”
ইনারা সভ্যের পা’য়ে জোরে একটা লাথি মেরে বলে, “আমি বান্দর? বান্দরগিরি করি?”
“বান্দরগিরি আবার কী?” সভ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“ওই’যে বললেন আমি বাঁদরদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। ঠুস করে আপনার সামনে এসে পড়লাম। আর আমার সঙ্গদোষে আপনার ভাষা এমন হয়েছে?”
“তো কী? বান্দরগিরি আবার কোন শব্দ?”
ইনারা অপ্রস্তুত হয়ে হাসে, “আপনাদের মতো বিদেশে পড়া লোকরা এসব বুঝবেন না। এখন এত শুদ্ধ ভাষা বলতে হয়। যখন কলেজে ছিলাম তখন মুখে যা আসতো তাই বলতাম। আহ কী দিন ছিলো! এই আপনি কথা ঘুরাচ্ছেন কেন? আন্টির সামনে আপনি আমাকে উদ্দেশ্য করে কত খোঁটামার্কা কথা বলছিলেন কেন? আর একবার এমন দেখলে… ”
“দেখলে কী করবে শুনি?”
“আপনাকে আমি ছাড়ব না। মেরে তক্তা বানিয়ে দিব।”
“সভ্য হাসে, ” ম্যাডাম এটা আমাদের ঘর নয়। এখানে আপনার দাদাগিরি চলবে না তো। আগে দাদীজানকে সামলে নিজে টিকে নেও, তারপর আমাকে তক্তা বানাতে এসো। এখন যেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও, তোমার খারাপ সময় চালু হচ্ছে।”
“দাদীজান কি বেশি রুক্ষ?”
“আরে না, দাদীজান একদম সুইটহার্ট। অনেক সুইট। কিন্তু আমার জন্য, তোমার জন্য না।”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে, “ইতর, পাঁজি, অসভ্য একটা।”
বলে যে রাগে হনহন করে চলে গেল বাথরুমে।

সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “কিছু হোক না হোক দাদীজান এবং এই জংলীটার রাগ একদম একরকম। কখন এসে নাকে বসে নিজেও জানে না।”
.
.
ফ্রেশ হবার পর সভ্য এবং ইনারা নিচে নামে। ইনারা সকালে উপরে যাবার মতো নিচে নামার সময়ও একতলা এবং দোতলার মাঝের ঝাড়বাতিটা দিকে বেখেয়ালি ভাবে তাকিয়ে রইলো। এই বেখেয়ালি ভাবে তার নিচে নামার সময় পিছলে খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। ভাগ্যিস সভ্য সময়ে তাকে ধরে নেয়। এবং বলে, “আজ দ্বিতীয়বার পড়ে যেতে নিলে। এমন বেখেয়ালিভাবে থাকলে কীভাবে হয় বলো তো। কোনদিন না বড়সড় একটা এক্সিডেন্ট ঘটাও তুমি।”
“বকা ছাড়া আর কিছু পারেন না তো তাই না?”
“এখন না ধরলে পরে হাড্ডি ভাঙত। কোথায় কৃতজ্ঞতা জানাবে কিন্তু তা না করে উল্টো….”

সভ্যের সম্পূর্ণ কথাটা শেষও হলো না। একটা মহিলার কণ্ঠ ভেসে উঠল তাদের কানে, “ছিঃ ছিঃ কি জমানা এসে পড়লো রে ভাই। এখন এসব দেখার বাকি ছিলো?”
সভ্য এবং ইনারা দেখল ফুপি তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভেংচি কেটে আরও কথা বলতে বলতে গেল ডাইনিংরুমের দিকে।

ইনারা হতভম্ব, “এটা কী হলো?”
“উনার কথায় কান দিও না। ভেজাল লাগানো উনার ফেভারিট টাইমপাস। মা’য়ের সাথেও সারাক্ষণ এসব করে। আমিই বিরক্ত এসব দেখে। আসো, সবাই ওয়েট করছে।”
ডাইনিংরুমে যেয়ে দেখে সবাই বসে নাস্তা শুরু করে দিয়েছে। কেবল সভ্যের মা নাস্তা বেড়ে দিচ্ছেন। তিনি দুইজনকে দেখেই চেয়ার টেনে দিলেন বসার জন্য। ইনারা জিজ্ঞেস করল, “আন্টি আপনি খাবেন না?”
“আমি পরে খাব। তোমরা খেয়ে নেও।”
দাদীজান রাগান্বিত সুরে বলে, “মানুষের লজ্জা শরমও নেই। এতকিছু হলো একটু আগে তারপরও খাবার টেবিলে এসে বসে গেছে খাওয়ার জন্য।”
ইনারা অবুঝের মতো করে বলল, “দাদীজান আপনি চাইলে আমি সোফায় বসেও খেতে পারি। অভ্যাস আছে আমার। যাব?”
উওরে দাদীজানের আরও রাগ উঠলো। কিন্তু কিছু বলার পূর্বেই সভ্য দাদীজানের পাশের চেয়ারে বসে বলে, “দাদীজান প্লিজ রাগ করেন না। আপনি আমাকে এত ভালোবাসেন তাহলে এমন করছেন কেন? আমার খুশিতে আপনি খুশি না?”
কথাটা শুনে বোধহয় দাদীজানের রাগ একটু কমলো। সে বলল, “তোমাদের খুশি থেকে বড় কিছু হতে পারে না’কি?”
সভ্য হেসে দাদীজানের গাল টেনে বলে, “এইত্তো আমার সুইট দাদী। অনেক মাস হলো আপনার হাতে খাই না। আজ আপনার হাতে খাব। খাইয়ে দিবেন না?”
” আমার নাতি আমার হাতে খাইতে চাইবে আর আমি খাইয়ে দিব না?”
দাদীজান নিজের প্লেট থেকে একটা লোকমা খাবার তুলে সভ্যকে খাইয়ে দিলেন।

সভ্যের ফুপি খিটখিটে গলায় বলে উঠেন, “আম্মা জানো একটু আগে কিসব দেখে এসেছি। ছিঃ! আমার তো বলতেই লজ্জা লাগছে। সিঁড়িতেই নতুন বউ সভ্যের সাথে জড়াজড়ি শুরু করে দিয়েছিল। ভাবতে পারছ? আমার তো দেখেই লজ্জা লাগছিলো। আল্লাহ কি যুগ এসে পড়লো।”
সভ্য বিরক্ত হয়ে বলে, “ফুপি যা তা কথা বলো না তো। ইনারা সিঁড়ি থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিলো তাকে শুধু ধরেছি।”
ফুপি যেন সভ্যের কথাটা কানেই নিলো না। সে দাদীজানকে বলল, “মা এখানেই খোলামেলা এসব করছে
বাহিরে যেন কি না করে। আরও আছে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। ওখানের মানুষ কেমন হয় জানোই তো। নায়কদের সাথে কত কি করে কে জানে। আমাদের বংশের সম্মান ডুবে যাবে।”
ব্যাপারটা সামলাতে সভ্যের মা মাঝে হস্তক্ষেপ করে, “আপা থাক না এসব কথা। সবে এলো দুইজন একটু নাস্তা করতে দিন।”
“তুমি চুপ থাকো ভাবি। তোমাকে কে এসব বিষয়ের মাঝে কথা বলতে?”
ইনারা এতক্ষন চুপ ছিল। কিন্তু সভ্যের মা’য়ের সাথে বেয়াদবি করতে দেখে সে আর চুপ থাকতে পারে না। গালে হাত দিয়ে হেসেই উওর দেয়, “তো ফুপি এখন উনি হচ্ছেন সভ্যের মা। উনি না বললে কে বলবেন? আপনার দেখি নিজের মেয়ের থেকে বেশি সভ্যের চিন্তা। দেখুন আপনার মেয়ে আমার ভক্ত। আমি যদি খারাপ ছবি করি তাহলে আপনি নিজের মেয়েকে এসব দেখতে দেন। ছিঃ ছিঃ ছিঃ! আমার তো ভাবতেও লজ্জা লাগছে।”
ইনারার উওর শুনে ফুপি লজ্জায় পড়ে যায়। সভ্যের বাবা নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে শব্দ করে হেসে দেয়। আর দাদাজান বহু কষ্টে নিজের হাসি লুকায়।

দাদীজান ধমক দেয়, “সবাই চুপ। এখানে কী হাসি ঠাট্টা চলছে?”
ফুপি তো রাগে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে, “মা দেখেছ মেয়েটা কী বেয়াদব?” সে আবার ইনারাকে বলল, “এই মেয়ে তোমাকে তোমার মা কোনো শিক্ষা দেয় নি এখানে আসার আগে?”
ইনারা চাইলেই কঠিন উওর দিতে পারতো। কিন্তু সবার সামনে সে এমন করল না। অবুঝের মতো বলল, “আমি তো আপনাকে কেবল পরামর্শ দিচ্ছিলাম। বেয়াদবি তো করতে চাই নি। বেয়াদবি মনে হলে সরি। আর আমার মা তো অনেক আগেই মারা গিয়েছেন তাই কোথায় কীভাবে কথা বলতে হয় শিখতে পারি নি। আপনি আমাকে শিখিয়ে দিয়েন ঠিকাছে?”

ইনারার মা নেই কথাটা শুনে টেবিলে বসা সকলে নীরব হয়ে গেল। সভ্যের মা তার মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার মা নেই?”
“না, আমি যখন ছোট ছিলাম তখনই মারা গিয়েছেন।”
ফুপি আবারও বলতে নিলো, “মা দেখো সভ্য এই মা মরা মেয়েকে ঘরে এনে উঠিয়ে….”
তার সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার পূর্বেই এবার দাদীজান ধমক দিলেন, “চুপ কর। অতিরিক্ত মুখ চলছে তোর। এ বিষয়ে আর একটা কথাও আমি শুনতে চাই না।”
ইনারা দাদীজানের দিকে তাকায়। তার চোখে নিজের জন্য খানিকটা মায়া দেখতে পায়। তাও কিছু মুহূর্তের জন্য। পরে আগের মতোই চোখ দুটো কঠিন হয়ে যায়।

সভ্যের মা ইনারার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, “আজ থেকে আমি তোমার মা বুঝেছ? আমাকে মা বলে ডাক দিও।”
ইনারা উনার দিকে তাকায়। অনেক খুশি অনুভব হলো তার। কিন্তু কেন যেন সাথে কাঁদতেও মন চাইছে। সে আগ্রহ নিয়ে তাকাল মা’য়ের দিকে, “সত্যি?”
উনি মিষ্টি হাসি দিয়ে ইনারার গাল টেন বলে, “একদম সত্যি। আসো আমি তোমাকে খাইয়ে দেয়।”
মা প্লেটে খাবার নিয়ে আদর করে তাকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। ইনারার চোখ নিচে ঝুঁকানো। তার চোখে খুশির পানি এসে জমেছে। তার স্মৃতিতে ভাসছে সে দৃশ্যগুলো যখন তার মা ছোটবেলায় তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতো।

খাবারের টেবিলে দাদীজান কেবল বলল, “নতুন বউদের কিছু নিয়ম পালন করতে হয়। নতুন বউকে কেউ বলে দিও যেন শাড়ি পরে আসে সবার সামনে। আর আগামীকাল নিজের শশুড়বাড়ির জন্য নিজের হাতে কিছু রান্না করে খাওয়ায়।”
ইনারা পড়ে গেল দ্বিধায়। রান্না এবং সে? পানিও ফুটাতে পারে না সে। পড়লো তো এক ঝামেলায়। তবে আজ ভালো লাগছে তার। সে কখনো টেবিলে বসে পরিবারের সাথে খায় নি। কখনো তার পরিবার ছিলোই না। আজ মনে হচ্ছে সে একটি পরিবার পেয়েছে। তার পরিবার।

ফুপিকে ইনারার পছন্দ না হলেও মিনুর সাথে ইনারার কিছুই হয় নি। উল্টো তাকে দেখার সাথে সাথে যেভাবে তার কাছে ছুটে এসে হাত ধরে নিয়েছিল মনে হলো মেয়েটা মিষ্টি। তাই ইনারা নাস্তা শেষে নিজেই তার সাথে কথা বলতে গেল, “হ্যালো।”
মিনু ইনারার দিকে তাকিয়ে প্রথমে আমতা-আমতা করে তারপর সেখান থেকে চলে যেতে নেয়।
“তুমি কী আমার সাথে রাগ করেছ?” ইনারা বলল। মিনু যে গতিতে গিয়েছিল তার দ্বিগুণ গতিতে ফিরে এসে বলল, “সভ্য ভাইয়াকে বিয়ে করলেন কেন? আমি আপনাকে এত লাইক করতাম এখন আপনিও গেছেন, সভ্য ভাইয়াও গেল। এখন আমি হ্যান্ডসাম সেলিব্রিটি বর কীভাবে পাব?”
অনেকটা কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে বলল মিনু। ইনারা নিজেকে সামলাতে না পেরে ফিক করে হেসে দেয়।

মিনু এবার রাগী গলায় বলে, “আমি কী মজার কিছু বলেছি? আমার কষ্টে আপনি হাসছেন কেন?”
“আরে তোমার কষ্টে হাসছি না তো। ওই ব্যাঙের ছাতা অসভ্যকে তোমার হ্যান্ডসাম মনে হচ্ছে শুনে হাসছি।”
“অসভ্য কে আবার?” মিনুর চোখ কপালে উঠে গেল।
“আরে ওসব বাদ দেও।” ইনারা মিনুর কাঁধে হাত রেখে বলল, “সভ্য কী জিনিস তার থেকে বেশি হ্যান্ডসাম বর আনব তোমার জন্য।”
“সভ্য ভাইয়া থেকে বেশি হ্যান্ডসাম? কিন্তু সে তো সেলিব্রিটি হবে না।”
“আরে সভ্যের তো ডেট চার বছর আগে এক্সপায়ার হয়ে গেছে। নতুন কোন সেলিব্রিটি পছন্দ তোমার বলো। আমি সেট করিয়ে দিব।”
“জোহান জোহান।”
জোহানের নাম শুনতেই ইনারার মুড অফফ হয়ে গেল, “সব ছেড়ে ও? ও তো প্লে বয়। লুইচ্চা। একে ছেড়ে ওকে করতেই থাকে। ভালো টেস্টের একজন বলো।”
“তাহলে আমার সেকেন্ড ফেভারিট হলো…” মিনু চিন্তা করে বলে, “ওয়াসিন খান।”
“আরে জোস চয়েস। লোকটা আসলে হ্যান্ডসাম আছে।” ইনারা বিড়বিড় করে বলল, “যদিও আমার দিকে যেভাবে তাকাচ্ছিল মনে হয় না সেট করতে পারবো। যাই হোক ট্রাই করতে কি সমস্যা।”
“কিছু বলছেন?” মিনু জিজ্ঞেস করে।
“না না। প্লানিং করছিলাম কীভাবে তোমাদের সেটিং করাব। সে তো আমার কো-স্টার এই ফিল্মে।”
“বলেন কী সত্যি? আমার সাথে দেখা করাবেন ভাবি?”
“কাজ হতে না হতেই ভাবি ডাকা শুরু। ভালোই তো। আচ্ছা আমি দেখা করাব কিন্তু কিছু সাহায্য লাগবে আমার। তোমার সাহায্য করতে হবে কিন্তু।”
“আমি এক পা’য়ে রাজি। কিন্তু আগে আমি কি আপনার সাথে ছবি তুলে আমার ফ্রেন্ডদের দিতে পারি।”
“অফকোর্স। এরপর তুমি আমাকে দাদীকে পটানোর ভিন্ন ভিন্ন উপায় বলবে। ডিল?”
“ডিল।”
দুইজনে হাইফাই দেয়। তারপর কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় দুইজনে মিলে। যতক্ষণ পর্যন্ত ফুপি এসে মিনুকে টেনে না নিয়ে যায়।

মিনুকে নিয়ে যেতেই ইনারা সারাঘরে ঘুরতে শুরু করে। সবটা দেখতে থাকে। বাড়ির ভেতর থেকে সে বাগানে এসে পড়ে। ঘুরে দেখতে থাকে বাগানটা। হঠাৎ করে কেউ একজন তার পিছনে এসে তার কানের কাছে বলে, “এই’যে মহারাণী…”
হঠাৎ এমন হওয়ায় ইনারা ঘাবড়ে যায়। লাফিয়ে উঠে ভয়ে। পিছনে ফিরে সভ্যকে দেখে বলে, “ভূতের মতো আমার মাথার উপর চড়ে বসেছেন কেন? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“দেখলাম মিনুর সাথে ভালো খাতির জমেছে। কাহিনী কি?”
“কাহিনী বাদ দেন। ও একটা মজার কথা বলছিলো বুঝলেন? ওটা শুনে আমি হাসতে হাসতে শেষ।”
“তাই? এমন কী বলল?”
“বলল আপনি না’কি হ্যান্ডসাম। মানে সিরিয়াসলি আপনি!” হাসতে হাসতে বলে ইনারা।
সভ্য সরু দৃষ্টিতে তাকায় ইনারার দিকে, “তোমাকে আমাকে হ্যান্ডসাম মনে হয় না?”
“এহ আসছে। দেখতে ব্যাঙের ছাতা, না ভূতের মাথার মতো তাকে আমি হ্যান্ডসাম বলব।”
ইনারা ভেংচি কেটে যেতে নিলেই সভ্য হাত ধরে নিলো। তার পিছনে এসে দাঁড়িয়ে কানের কাছে ঠোঁট এনে বলল, “মহারাণী আমি দেখতে যেমন হই না কেন আপনারই বর কিন্তু।”
ইনারা পিছনে ঘুরে বলে, “তো বরসাহেব আপনি যে আমাকে ফাঁসালেন তার কী করব বলুন? আমি আর রান্না দূর দূর পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক নেই। একতো দাদীজান যা কঠিন। এর উপর আপনার ফুপি, আগুনে ঘি এর ডিব্বা উল্টায় দেয়। দাদাজানকে বলে তো দিয়েছি কিন্তু এখন তো ভয় করছে। কী করব?”
সভ্য ইনারার হাত ছেড়ে বলে, “সেটা আমি জানি না। তোমার ব্যাপার, তুমি সামলাও। এ একবছর আমার উপর যে জুলুম করছ তার বদলে তোমাকে চিন্তা করতে দেখেই আমার মন ভরে গেছে।”
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, “বিশ্বাস করেন এটা আপনার বাড়ি না হলে যে অবস্থা করতাম আপনার, দাদীজানও আপনাকে চিনতো না। আচ্ছা একটা কথা, যখন আমার মা মারা যাবার কথা বলেছিলাম তখন অল্প কিছু মুহূর্তের জন্য দাদীজান আমার দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো।”
“ওহ সম্ভবত তার নিজের কথা মনে পড়েছিল।”
“নিজের কথা?”
“ছোট থাকতে দাদীজানেরও মা মারা গিয়েছিল। স্বামীর অশান্তি সহ্য করতে না পেরে আত্নহত্যা করেছিলো শুনলাম। এরপর সৎ মা তার উপর অত্যাচার না করলেও কঠিন ব্যবহার করতো। এরপর থেকে তিনিও নিজের মনকে কঠিন করে ফেলল। কিন্তু দাদীজানের মন নরম করা কিন্তু অনেক সহজ। সে দেখায় না কিন্তু সে মা’কেও অনেক ভালোবাসে।”

চলবে…

[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here