অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ২৭
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
ইনারা বাঁকা হাসে, “ইনারার কথার দাম আছে। সে মানুষকে কথা দিলে তা রাখতে জানে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নেও। টাকা পেয়ে নিজের শাশুড়ীর কটু কথা বন্ধ করবে, না’কি তোমার স্বামীকে ব্যাপারটা জানানোর পর ঘর থেক বের হয়ে ব্যাপারটা নিয়ে ভাববে?”
অমৃতা উওর দিলো না। তাকে বেশ খানিক সময় ধরে চিন্তিত দেখা গেল।
ইনারা উঠে দাঁড়ায়। বলে, “ঠিকাছে তাহলে সামনে যা হতে যাচ্ছে তার অপেক্ষা করো। আমি আসলাম।”
ইনারা উঠে যেতে নিলেই অমৃতা তাকে থামায়, “আ..আমি চিন্তা করে দেখব।”
“তোমার চিন্তা করে দেখার সময় আছে কিন্তু আমার তো এত সময় নেই। হ্যাঁ কিংবা না, উওরটা এখনই লাগবে আমার।”
অমৃতা পড়ে গেল দ্বিধায়। সে এত বড় ঝুঁকি নিতে পারে না। কিন্তু আবার এমনও না যে খুব সুখে আছে। তার শাশুড়ী উঠতে বসতে তাকে খোঁটা শোনায়। টাকাটা তার মুখের উপর ছুঁড়ে মারলে একটু তার মুখ তো থামবে। এর উপর ইনারা যদি আসলেই তার স্বামীকে কথাটা জানায়? না, এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়াটা বোকামি হবে।
“আমি রাজি।” অমৃতা জানায়।
ইনারা তার হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে, “আর তোমার কাছে কোনো প্রমাণ আছে যে আইজা ও তার মামাই এসব করিয়েছে?”
“পুলিশের কাছে মামলা দেবার পরদিনই মুশতাক সাহেব আমার একাউন্টে সাত লক্ষ টাকা পাঠিয়েছিলেন। তার কাগজ আছে।”
“গ্রেট। তাহলে আমি মিডিয়াকে আনার ব্যবস্থা করে দিব। আর তুমি সত্যিটা বলার ব্যবস্থা করো। আর তোমার শাশুড়িকে বলো চা নাস্তা করার জন্য অন্যদিন আসব।”
বলে ইনারা চলে গেল।
“সভ্য…সভ্য…” ঘরে ফিরে এসেই সে খুঁজতে শুরু করে সভ্যকে। সে ভুলেই গিয়েছিলো সভ্য অফিসের কাজে বিদেশের জন্য রওনা দিয়েছে আজ সকালেই। মনে পড়তেই তার ভেতরটা কেমন শূন্য হয়ে গেল। এই খালি ঘরে তার যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অথচ এ ঘরে কেবল তারা দুইজন থাকে।
ইনারা সভ্যকে কল দিয়ে পায় না। তারপর সে প্রতিদিনের কল দেয় খালাজানকে। কয়েকমাস আগে সে দেশে এসেছেন। এখন তার ছেলের সাথে থাকছেন গ্রামে। প্রতিদিন সে তার নাতিদের দুষ্টুমির খবর শোনায় ইনারাকে। আর ইনারা তাদের কথা শুনে হাসে। অথচ আজ তার মন খুলে হাসিও আসছে না। সুরভির সাথে কথা বলেও সে শান্তি পায় না। হঠাৎ কি হলো তার মনের?
সে লম্বা একটি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে। সভ্যের আলমিরা থেকে একটি স্কাই-ব্লু শার্ট বের করে শার্টটার দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে, “বেয়াদব ছেলে আমি কল করি, ধরছেন না কেন? আমি আপনাকে কত মিস করছি বুঝতে পারেন না? আই হেইট ইউ?”
বলে ভেংচি কেটে আবার শার্টটা বুকে জড়িয়ে ধরে। তা আলমিরায় ঢোকাতে নিয়েও থেমে যায়। কিছু একটা ভেবে শার্টটা পরে নেয়। আর হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। ঘুমে তার চোখ লেগে আসছে। তবুও সে বহুকষ্টে তাকিয়ে রইলো ফোনের দিকে। সভ্যের ফোন আসবে বলে। কিন্তু সারাদিনের খাটুনির পর শরীরটা আর তার মনের কথা শুনল না। ক্লান্তিতে চোখ লেগে এলো তার।
তারপর হঠাৎ করে ফোনটা বেজে ওঠে। লাফিয়ে উঠে ইনারা। হড়বড়ে ফোনটা হাতে নিলো, “হ্যালো..হ্যালো সভ্য?”
মাতাল করা ঘুমঘুম কন্ঠ শুনে বুকের ভেতর নাড়া দিলো সভ্যের। সে চেয়ার থেকে উঠে যেয়ে দাঁড়াল এক কাঁচের দেয়ালের সামনে। যেখান থেকে নিচের সবকিছু খুবই ছোট দেখা যাচ্ছে এবং আকাশটা পরিষ্কার। সে গভীর এক নিশ্বাস ফেলে বলে, “মহারাণী ঘুমাচ্ছিলেন না’কি? আপনার ঘুমন্ত কন্ঠে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাবার মতো অবস্থা।”
“আগে বলুন আপনি ছিলেন কোথায় এতক্ষণ? কতবার কল দিয়েছি জানেন আপনি?” ইনারার কন্ঠে রাগ রাগ ভাব।”
“কেন? আমাকে মিস করছিলে বুঝি?”
ভেংচি কাটে ইনারা, “আমি আপনাকে মিস করব? আর মানুষ পান নি? আমি তো এখানে সেই মজায় আছি। যা মন চায় তা করতে পারছি। আপনি বকার জন্য নেই।”
“তাই? ভেবেছিলাম চারদিনের মাথায় কাজ শেষ করেই আসবো। কিন্তু তুমি যেহেতু এত খুশি তাহলে আগামী সাপ্তাহে আসার ব্যবস্থা করছি।”
“না না, একদম না।” আঁতকে উঠল ইনারা, “আপনি যত দ্রুত সম্ভব এখানে আসুন।”
“কেন? তুমি তো ভীষণ খুশিতে আছো। তাই না?”
ইনারা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে মিনমিনে গলায় বলল, “আপনাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগছে না।।”
কথাটা শুনতেই সভ্যের ঠোঁটে গাঢ় এক হাসি এঁকে উঠে। গাল ভারী হয়ে আসে। মনের ভেতর প্রজাপতিরা নাচতে শুরু করে দেয়।
এই মুহূর্তে সে মিটিং এর ব্রেকে আছে। যে কোম্পানির সাথে মিটিং তার অফিসেই। সাধারণত এসব মিটিং তার অধীনে থাকা কর্মীরাই করে। কিন্তু এই মিটিং তার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কয়েকমাস পর দেশে একটা মিউজিক ফেস্টিভ্যাল করা হবে যেখানে দেশের গায়কদের সাথে ওয়েস্টার্ন মিউজিশিয়ানসরাও উপস্থিত হবে। এই আয়োজন করছে তার কোম্পানিই। তাই সে নিজেই এলো। নাহলে সে ইনারাকে রেখে আসে?
যদি এই মুহূর্তে সে হোটেল রুমে থাকতো তাহলে ঠিকই মনে হয় নাচতে শুরু করতো। ইনারার মুখের থেকে এই সামান্য কথাও তার বুকের ভেতর অদ্ভুত অনুভূতি তৈরি করে দেয়। পুরুষ মানুষ অপক্ক থেকে পরিপক্ক হয়। অথচ তার ব্যাপারে উল্টো ঘটছে। তার মনে কিশোরদের মতো অনুভূতি হচ্ছে। কিশোরদের মতো প্রেমে পাগলামো করতে ইচ্ছে করছে। আচ্ছা প্রেমে পড়লে সবার অবস্থা কি এমনই হয়?
“এই’যে মহারাজ, এখন চুপ করে আছেন কেন শুনি?”
ইনারা অভিমানী গলায় বলল।
“ভাবছি।”
“কী ভাবছেন?”
“ভাবছি কথাটা তুমি আমার সামনে বললে জড়িয়ে ধরে গভীর একটা চুমু খেতাম।”
“সারাক্ষণ এসব মাথায় ঘুরে আপনার তাই না? নির্লজ্জ।”
সভ্য হাসে, “আচ্ছা ওখানে এখন অনেক রাত। যেয়ে ঘুমান মহারাণী। আমারও ব্রেক টাইম শেষ হয়ে আসছে।”
“আচ্ছা ফ্রী হলে কল দিবেন।”
“দিব। যদি আবার বলো আমায় মিস করছিলে।”
“কচু বলব। আপনাকে মিস করতে আমার বইয়েই গেছে।”
কল কাটার পর ইনারা ফোনের দিক তাকিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছুসময়ের জন্য তার উড়ু উড়ু মনটা আবারও উদাসীনতায় ভরে যায়।
সভ্য কল রেখে মৃদু হাসে। আবার ফিরে যেতে নেয় মিটিং রুমে। দেখে সামি তার পিছনেই দাঁড়ানো। সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি’রে তুই এখানে?”
“সামি দীর্ঘশ্বাস ফেলে আফসোসের সুরে বলে, “মানুষ ঠিকই বলে বন্ধু বিয়ে হলে আর আপন থাকে না। পর হয়ে যায়। জীবনে কোনো মেয়ের থেকে ছ্যাঁকা খেলাম না কিন্তু তোর থেকে ছ্যাঁকা খেলাম।”
“কী হয়েছে বলবি?”
“কী আর বলব? সেন্টি খেয়েছি। গত একমাস ধরে একবার খোঁজও নেস নাই। পনেরোদিন ধরে যে আমি এখানেই তাও জানিস না। রহমানকে কল দিয়ে শুনি তুই এখানে। তাই চলে এলাম।”
“বাট তুই এখানে কী করিস?”
“ওহ কিছু ওয়েস্টার্ন আর্টিস্টের সাথে কাজ করছি। তাই এখানে। আর তুই ইনারার সাথে কথা বলছিলি? তো জনাব এতমাস হয়ে গেল। তোদের মাঝে তো সব ঠিকই চলছে। ওকে বলে দিলেই পারিস যে ওকে কতটা ভালোবাসতি।”
“অতীতের কথা টানব না। কিন্তু ওকে বলব। পঞ্চাশ দিনের মাথায় ওর জন্মদিন। অতীতে ওকে যেদিন হারিয়েছিলাম সেদিনই ওর কাছে নিজের ভালোবাসার স্বীকারোক্তি করে নিব।”
“দেরি করার কী প্রয়োজন? কয়েকবছর আগেও এমন দেরি করেছিলি। তারপরের ঘটনা আমরা দুইজনই জানি।”
“কিন্তু এখন এমন হবে না। কারণ তখন আমাদের মাঝে কেউ ছিলো। কিন্তু এখন কেউ নেই। আর কোনো কিছু আমাদের মাঝে আসতে পারবে না। এখন ও আমার। তখন আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিলো না, কিন্তু আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে ওর উপর। এছাড়া… ”
“এছাড়া? ”
“এছাড়া আমার মনে হয় ইনারাও আমাকে ভালোবাসে।”
.
.
অমৃতা দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো মানুষের মাঝে। একটি ছোট রুমে কতগুলো ক্যামেরা তার মুখের সামনে ধরা। সে ব্যাপারটার জন্য গত দুইদিন ধরে প্রস্তুতি নিলেও ভাবে নি এতগুলো মানুষ ও ক্যামেরার সামনে তার বক্তব্য দিতে হবে। ইনারার পাঠানো একজন লোক তাকে ইশারা দিতেই অমৃতা তার কথা বলল। প্রিয়কে পছন্দ করা থেকে শুরু করে তাকে ফাঁসানোর প্রস্তাব স্বীকার করা, সবটা। আইজা যে তাকে এই কাজের প্রস্তাবটা দিয়েছে তাও বলল৷ সাথে মুশতাক সাহেবের একাউন্ট থেকে টাকা পাঠানোর রিসিট দেখাল। সবটা লাইভ হচ্ছিল টিভি চ্যানেলে। সে লাইভ টিভিতে শো দেখছিল ইনারাও। সে টিভিতে দেখল রুমটাতে প্রবেশ করছে পুলিশরা। অমৃতাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অমৃতা চিৎকার চেঁচামেচি করছে। তার কথা কেউ শুনছে না৷ তাকে টেনে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে টিভি অফফ করে দিলো ইনারা। অপেক্ষা করতে শুরু করল তার ফোনের দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার ফোন বেজে উঠবে।
তাই হলো। ইনারার ফোন বাজল। ইনারা ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে অমৃতার আঁতকে থাকা কন্ঠ শোনা গেল, “ই-ইনারা মেডাম দেখেন পুলিশরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আপনি দয়া করে তাদের সাথে কথা বলেন।”
“কথা বলব? আমিই তো তাদের পাঠালাম তোমাকে অতিথিসেবা করতে। কিন্তু আফসোস প্রিয়কে যেভাবে করল তোমাকে সেভাবে করতে দেখলাম না এটা তো অন্যায়।”
অমৃতা বিস্ময়ের জন্য কিছুসময় ধরে কোনো কথা বলতে পারল না। বহু কষ্ঠে বলল, “আপনি বলেছিলেন আমার কোনো ক্ষতি হবে না।”
“আমি তো এটাও বলেছিলাম তোমাকে পঁচিশ লক্ষ টাকা দিব৷ টাকা কি গাছে উঠে? আমি তোমার পিছনে ওয়েস্ট করব কেন?”
“আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন। আপনি যা বলেছেন আমি তা করেছি। আপনি বলেছিলেন আপনি একবার কথা দিলে সে কথা ফিরিয়ে নেন না। আপনি এখন নিজের কথা ফিরিয়ে নিতে পারেন না।”
“ভুল। আমি বলেছিলাম আমি মানুষকে কথা দিলে সে কথা ফিরিয়ে নেই না। তুমি কাওকে হত্যা করার পর নিজেকে মানুষ মনে করো? কীভাবে?”
“আ-আমি কাওকে হত্যা করিনি। আপনি আমার সাথে ছলনা করেছেন। আমি আপনার সত্যিটা সবাইকে বলে দিব।”
“আগে নিজের সত্যির ধাক্কা তো সামলাও। কয়েকবছর আগে যেমন তুমি লোভে পরে প্রিয়র জীবন নষ্ট করেছিলে আজ সে লোভই তোমায় ডুবাল। ওকে কি বলতে তুমি? তুমি ওকে ভালোবাসো? ভালোবাসার অপমান করেছ তুমি। কাওকে ভালোবাসলে তার সাথে এমন জঘন্য কাজ মানুষ কখনোই করতে পারে না। আর হত্যা করো নি? ওর জীবন শেষ করে তুমি বলছ ওর হত্যা করো নি? তোমার মতো কিছু মেয়েদের জন্য আজ সমাজের এই অবস্থা। কতগুলো মেয়ে আসলে ধর্ষণ হওয়া সত্ত্বেও ন্যায়বিচার পায় না। আর তোমার মতো মেয়েরা এই আইনের অপব্যবহার করে অন্যের জীবন নষ্ট করে। কেন? কিছু টাকার জন্য? এখন জেলে বসে বসে হিসাব করতে থেকো কত টাকার লোকসান হলো। আমি নিশ্চিত করব তোমার জেল যেন অনেক লম্বা কাটে।”
“না না আপিনি এমন করতে পারেন না। আমার একটা সংসার আছে। আমার পরিবার, স্বামী তাদের কী হবে? আপনি এভাবে আমার জীবন নষ্ট করতে পারেন না। আমি আপনার পা’য়ে পড়ি। হ্যালো…হ্যালো ইনারা…”
ইনারা ফোন কেটে দেয়। সে চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দেয়। তার চোখের সামনে ভেসে উঠে জেলে থাকা প্রিয়’র করুণ চেহেরা। সত্য যাচাই করা ছাড়াই তার উপর অনেক অত্যাচার করা হয়েছিল। মুখের বিভিন্ন অংশে রক্ত জমে গিয়েছিলো। যখন সে প্রিয়কে নিয়ে থানা বেরোলো তখন অনেকে তাকে ঘৃণার নজরে দেখে কিছু বাজে কথা বললেন। তাকে ধিক্কার জানালেন। অথচ প্রিয়’র এই ঘৃণা পাওয়ার কথা ছিলো না। সে তো কিছুই করে নি। সততার সাথে কামাই করে এতটুকু বয়সে নিজের সংসার চালাতো। আর সেই সৎ মানুষেরই মৃত্যু হলো এত বড় এক মিথ্যা অপবাদে। আজ হয়তো সে নিজের বন্ধুকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কিন্তু অন্তত তার নামের উপর কলঙ্ক মোছার চেষ্টা তো করেছে।
“মেডাম আপনার গাড়ি রেডি আছে। আপনার শুটিং এ দেরি হয়ে যাচ্ছে। আসুন।” ড্রাইভারের কন্ঠ ঘোর ভাঙলো ইনারার। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মনে হচ্ছে আজ তার বুকের থেকে অনেক বড় এক পাথর সরে গেছে। শান্তি লাগছে তার। সে উঠে নিজের শুটিং এর জন্য রওনা দিলো।
শুটিং -এ পৌঁছাতেই সে শুনে আইজা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে তার জন্য। ইনারা ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। আরেকটু অপেক্ষা করতে বলে নিজে তৈরি হতে যায়। তার তৈরি হতে সময় লাগে আরও এক ঘন্টা। তৈরি হয়ে সে রাজি হয় আইজার সাথে কথা বলার জন্য। আইজাকে ভেতরে পাঠানো হয়। ইনারা মেকাপ টাচ-আপ করছিল। সে আইজাকে দেখে বলে, “সরি আপনাকে অপেক্ষা করানোর উদ্দেশ্যটা আমার ছিলো না। আপনি আমাদের দেশের এত বড় এক নায়িকা, সরি ভুল হয়ে গেছে। এত বড় এক নায়িকা ছিলেন। যে এখন নাকি বড় কোনো মুভির অফার পাচ্ছেন না।”
আইজা ইনারার সামনের চেয়ারে বসে শান্ত গলায় বলে, “ইনারা দেখ আমি জানি আমাদের অনেক ঝামেলা হয়েছে অতীতে। কিন্তু এভাবে আর কয়দিন? তুই আমার ব্যাপারে সমস্যা তৈরি করার চেষ্টা করছিস আর আমি তোর। একে অপরকে আর কয়দিন এভাবে জ্বালাবো বল? তুই অমৃতাকে পুলিশ স্টেশনে দিয়েছিস, ওকে। এখানে আমার নাম আনলি তাও ঠিক আছে। আমার দোষ ছিলো, আমি মানছি। ওসব আমি সামলে নিব। কিন্তু এখন আমরা এসব বন্ধ করি প্লিজ। সামনে কি হবে? আমরা একে অপরের পিছনে এভাবে কয়দিন পরে থাকব? দেখ তুই মিডিয়ার সামনে যখন থেকে তোর আর জোহানের এনগেজমেন্টের সময় আমার ওর সাথে রিলেশন শুরু হবার কথা তুলেছিস তার পর থেকে অনেক হেইট পেয়েছি আমি। তুইও কষ্ট পেয়েছিস। আমিও পাচ্ছি। এখন থেকে একে অপরের পিছনে পড়া বন্ধ করে দেই?”
“ঠিকাছে করতে পারি। কিন্তু পরিবর্তে আমি কী পাব?”
আইজা অস্থির হয়ে বলে, “তুই… তুই চাইলে মামার সাথে কথা বলে আমি বড় একটা প্রজেক্ট দেওয়াতে পারি।”
ইনারা হাসে, “ফিল্মের কথা তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমার সাফল্যের জন্য কারও সাহায্যের দরকার নেই। অন্যকিছু বলো। বড় কোনো অফার দেও। এতকিছুর পর কেন আমি তোমাদের ছেড়ে দিব? এটা বলবে না যে তোমরা আমার কোনো ক্ষতি করবে না এজন্য। তোমরা যা ইচ্ছা করতে পারো। আই ডোন্ট ইভেন কেয়ার।”
আইজা কতক্ষণ চিন্তা করে বলল, “ঠিকাছে, তোর কি লাগবে তা বল।
ইনারা ভ্রু কপালে তুলে বলল, “আমার মা’য়ের বাড়ি যেখানে আপনারা সবাই বেহায়ার মতো থাকছেন? ওটা লাগবে। একসাপ্তাহ পর আমি আসবো। একসাপ্তাহে ঘর খালি করে দিবেন। এখন আসতে পারেন। আমারও শুটিং শুরু হয়ে গেছে। পরিচালক আজমল তো আর যেকোনো পরিচালক না যে তাকে অপেক্ষা করাব।”
শেষের দেওয়া খোঁটাটা আইজা ঠিকই ধরতে পারে কিন্তু এ ব্যাপারে কিছু বলে না। কিন্তু জিজ্ঞেস করে, “ঠিকাছে আমি মামার সাথে কথা বলব। কিন্তু এর কি গ্যারান্টি যে এরপর আমাদের কোনো ক্ষতি তুই করবি না।”
“আহা আপু, তুমি আমাকে চিনো না? আমি মানুষকে কথা দিলে সে কথা রাখি।”
.
.
শুটিং শেষে ইনারা বাসায় ফিরে। আজও সে শূন্য ঘরে তার বুকের ভেতরটা হাহাকার করবে। সে সভ্যতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। গত কয়েকমাস তাকে ছাড়া একদিনও থাকে নি। আর এই তিনদিনে তাকে একপলকও দেখে নি। বাহিরে কাজ করার সময় যেমন তেমন করে সময়টা পার হলেও বাড়িতে যেতেই তার বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যায়। কিছু ভালো লাগে না। কেবল ফোনটার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে সভ্যর ফোনের। আর একদিন, কালই সভ্য আসবে দেশে। আসলেই খুব করে মারবে তাকে। এত অপেক্ষা করায় কেউ? অসভ্য একটা।
বড় প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে ঢুকার পর গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে এগোয় ইনারা। স্বাভাবিকভাবেই বাগানের রাস্তা পেরিয়ে দরজা দিয়ে ঢুকতে নেয়। হঠাৎ তার চোখ পড়ে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের দোলনায়। সেখানে বসে আছে সভ্য। প্রথমে সে ভাবলো সে স্বপ্ন দেখছে। তাই নিজের চোখ ঢলে আবার তাকাল। সভ্য সেখানেই বসা। মুহূর্তে তার গালভর্তি হাসি এঁকে উঠে। সে তার হ্যান্ডব্যাগ সেখানেই ফেলে সভ্যের দিকে দৌড়ে যায়।
সভ্যও উঠে দাঁড়ায়। দুই হাত ছড়িয়ে অপেক্ষা করে তার মহারাণীর আসার। ইনারা ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে সভ্যের বাহুডোরে। সভ্যও তাকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। গাছ থেকে ঝরতে থাকে কৃষ্ণচূড়া ফুল।
সভ্য ইনারাকে খানিকটা তুলে হাওয়াতে ঘুরায়।
ইনারা সভ্যর গলা জড়িয়ে ধরে তার দিকে তাকিয়ে হাসে।
কপালে কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ” আপনার না আগামীকাল আসার কথা ছিলো?”
“সিউর ছিলাম না। তাই দুইদিনের টিকিট বুক করে রেখেছিলাম। সেখানে মন বসছিল না। তাই জলদি করে সব কাজ শেষ করে চলে আসলাম আমার মনের কাছে।”
ইনারা লজ্জায় লাল হয়ে যায়। সে সভ্যের কোল থেকে নেমে যায়। কিন্তু সভ্যের গলায় হাত আবদ্ধ করে রেখেই বলে, “তাই কে আপনার মন?”
“আছে একজন। তুমি তাকে চিনো। তবে তাকে ব্যাপারটা জানানো হয় নি।”
“না জানালে জানবো কি করে শুনি?”
সভ্য তার কোমরে আলতো করে হাত রাখে। তার চোখে চোখ রাখে, “মুখে সব বলতে হয়? চোখে চোখেও তো কত কথোপকথন হয়। তো মহারাণী আপনি আমাকে মিস করেছেন?”
“আমি আর আপনাকে মিস করব?” ইনারা সভ্যর বুকে হাত রেখে তাকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলল, “একদম না। উল্টো এ কয়দিন এত শান্তিতে ছিলাম। দিলেন তো সব শান্তি নষ্ট করে।”
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে ভেংচি কেটে অন্যদিকে তাকায়।
সভ্য ভ্রু কপালে তুলে নেয়, “তাই? ঠিকাছে তাহলে তো হলোই। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে পনেরোদিনের জন্য। ভেবেছিলাম যাব না। এখন যেহেতু তোমার শান্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে তাহলে ভাবছি চলেই যাই।”
মুহূর্ত না গড়াতে ইনারা সভ্যের কলার চেপে ধরে, “খবরদার। আমাকে ছেড়ে যাবার কথা বললে খুন করে ফেলব একবারে।”
সভ্য হাসে, “কেন মহারাণী আপনি তো আমাকে মনেই করেন নি তাই না?”
সে ইনারাকে কাছে টেনে নেয়। দুই হৃদয়ে হয় উথাল-পাথাল। ইনারার কঠিন মুখ হয় নম্র। সে সভ্যর গাল ছুঁয়ে বলে, “খুব মনে করেছি। আপনাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না আমার। খুব খারাপ অভ্যাস করিয়েছেন আমার।”
“কিন্তু আমি তো অনেক সুন্দর এক আসক্তে জড়িয়েছে।”
“তাই? কোন আসক্তে?”
“তোমার আসক্তিতে।”
চলবে…