অনুভবে (২য় খন্ড) পর্ব ৪৩

0
1642

অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৪৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য বিছানায় বসে গিটার বাজাচ্ছিলো। নীরব এক মহলে। হঠাৎ করেই জোহান সেখানে এসে লাফ দিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। আর সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “ব্রো হোয়াটস আপ?”
“তোকে না বলেছি আমার আশেপাশে এভাবে লাফালাফি করবি না।”
“আহা এমন রাগারাগি করছিস কেন? তাও আজ। কিছু ঘন্টা পর আমাদের প্রথম গান রিলিজ হবে। কোথায় তুই খুশিতে নাচানাচি করবি কিন্তু উল্টো মুখ ফুলিয়ে বসে আছিস।”
“আমার মুখ এমনই।” সভ্য উঠে যেয়ে গিটারটা পাশে রাখে।
কিন্তু জোহান তার পিছু ছাড়ে না। উলটো সভ্যের কাঁধে চড়ে বসে। আর উৎসুকভাব নিয়ে বলে, “আমি তো জানি মুখেই যত্তসব গম্ভীর ভাব প্রকাশ করিস কিন্তু মন থেকে তুইও আমাদের মতো যত নার্ভাস ততই উৎসুক।”
“আমার মন পড়ার জন্য তো তুই পি এইচ ডি করে রেখেছিস। এখন ভালোয় ভালোয় নেমে পড় পিঠ থেকে, নাহলে ফেলে দিলে পরে কাঁদতে পারবি না।”
“আমি কাঁদবো? আমার মতো বলিষ্ঠ পুরুষ কাঁদবে? অসম্ভব।”
সভ্য এক ঝটকায় তার হাত ধরে টান দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। ব্যাথা পায় জোহান। কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলে, “এভাবে কেউ ছুঁড়ে ফেলে না-কি?”
“আহারে আমার বলিষ্ঠ পুরুষ। ঢঙ শেষ হলে উঠে প্রাক্টিস কর। কয়দিন পর লাইভ গান গাইতে হবে।”
জোহান উঠে বসে। মেঝেতে বসেই হঠাৎ সে গম্ভীর গলায় বলে, “আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না অবশেষে আমরা আমাদের স্বপ্নপূরণ করছি। গানের পৃথিবীতে প্রবেশ করছি আমরা। গান দিয়ে সকলের জীবন সুন্দর করব, সকলের মন জয় করব। তোর কী মনে হয় সভ্য আমরা কী একবছর পর সাফল্য হতে পারব? পাঁচ বছর পর আমরা সকলের মন জয় করব? দশ বছর পরও কী আমরা এভাবে একসাথে গান গাইব?”
সভ্য বাঁকা হাসে। সে জোহানের উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে বলে, ” প্রথম দুটোর উওর আমার কাছে না থাকলেও শেষটার আছে। আমরা কেবল দশবছর পর না, সারাজীবন এভাবেই একসাথে গান গাইবো।”
জোহান হেসে সভ্যর হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। সভ্যের কাঁধে হাত রেখে বলে, “তা তো তোর গাইতেই হবে আমি সারাজীবন জোঁকের মতো তোর পিছে যে লেগে থাকব। হাজার বিরক্ত হলেও তোকে ছাড়বো না।”
“জানি তো সারাজীবন এভাবেই জ্বালাবি আমায়।”
সভ্য বিরক্ত ভাব নিয়ে এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। জোহানও যায় তার পিছনে। মুখ ফুলিয়ে বলে, “এভাবে বলিস কেন? আমি তোকে কোথায় জ্বালাই?”

দশবছর পূর্বের সেই স্মৃতি উঁকি দিলো সভ্যের মস্তিষ্কে। দিনগুলো মনে করতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল সভ্য। কত ওয়াদা করেছিল একসাথে থাকার কিন্তু সময়ের স্রোতে সব ভেসে গেল। আজ এত বছর পর সে জোহানের পাশে আছে এত সময় ধরে। তবুও জোহানের এমন করুণ অবস্থায়। সভ্যর বুক ভারী হয়ে গেল। নিজে অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরল।
.
.
ইনারা ও আইজা বসে আছে করিডরের শেষ কোণায়। দুইজনে চুপ করে আছে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। প্রথমে এই নীরবতা ভাঙলো আইজাই, “আমার উপর হাসার জন্য এখানে আলাদাভাবে ডেকে এনেছিস? তুই যা চাইতি তাই হয়েছে। আমার ক্যারিয়ার শেষ, আমার ভালোবাসা, পরিবার সব ছিনিয়ে নিয়েছিস তুই। তুই যা বলেছিস তাই করেছিস। আর কী করতে চাস তুই?”
ইনারা হাসে, “আমি কিছু করি নি, যা করেছ তুমিই করেছ। তোমার ক্যারিয়ার কখনো এই ফিল্ডে ছিলোই না, তুমি যা সাফল্য পেয়েছ তা হয়তো তোমার মামার সুপারিশে নয়তো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে।”
ইনারার মুখে এই কথা শুনে বিস্ময়ে তার দিকে তাকাল আইজা। ইনারা বলল, “তুমি কী ভেবেছ আমি জানি না? আমি সবই জানতাম। ভিডিও ছিলো আমার কাছে। আমি তো চাইলে সে কবেই তোমার সব শেষ করতে পারতাম। করি নি, কেন জানো? কারণ তুমি কত আগেই তোমার নিজেকে শেষ করে দিয়েছ। আমি জানি ফুফুর চাহিদা এবং তার কটু কথা সহ্য করতে না পেরে তুমি এই ফিল্ডে কাজ করতে এসেছিলে। যেখানে তোমার স্বপ্ন তো ছিলো সাধারণ এবং সুন্দর। শিক্ষক হয়ে অনেকের জীবন সুন্দর করে গড়ে তোলা। অথচ তুমি সবার জীবন নষ্ট করে দিলে। প্রিয়র মৃত্যুর কথা হয়তো তুমি ভাবো নি, কিন্তু তার সম্মানের মূল্য তুমি দেও নি। তার কথা ভাবো নি, তার পরিবারের কথা ভাবো নি। আর আমার সাথে হিংসা করে তুমি আমাকে বরবাদ করতে চেয়েছিলে? যে মেয়ে ছোট থেকে তোমাকে এত সম্মান করতো, এত ভালোবাসতো। যে সবসময় তোমাকে সুখে দেখতে চাইতো তাকে? লোভে পড়ে তুমি নিজের বাবাকে হারালে। এই জাঁকজমকপূর্ণ পৃথিবীতে থেকে তুমি বের হতে চাও নি তাই নিজের ভালোবাসাকেও বিসর্জন দিলে। তুমি সাইদ ভাইয়ার এত বছরের ভালোবাসার কদর করলে না তারপরও কীভাবে আশা করো সে নিজের স্ত্রীর পরিবর্তে তোমাকে নিজের হৃদয়ে স্থান দিবে? আর আমি অন্যের কথা কী বলছি? তুমি নিজেরই তো সম্মান রাখতে পারো নি। বিলিয়ে বেরিয়েছ। কী জন্য? কেবল কিছু মিথ্যে খ্যাতির জন্য। একটি মেয়ের জন্য তো তার সম্মান, তার চরিত্র তার জীবন থেকেও প্রিয় তাই না? আমিও কাকে কি বলছি। যাই হোক, যা হারিয়ে ফেলেছ তা তো আর ফিরে পাবে না। তাই যা আছে তা অন্তত যত্ন করে রাখো। আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না, কিন্তু আমি এটাও চাই না তুমি আরও কষ্ট পাও।”
কথাগুলো বলে ইনারা উঠে যায়। যাবার পূর্বে বলে, “আমি চাই না আমাদের আর জীবনের পথে কখনো দেখা হোক। তোমাকে আমি চেয়েও ঘৃণা করতে পারি না তাই ভাবতে চাই আমার আপু পাঁচ বছর আগেই প্রিয়’র সাথে হারিয়ে গেছে। সে পাঁচ বছর পূর্বে আমাদের সুন্দর স্মৃতিগুলো মনে রাখতে চাই। আশা করি এতকিছুর পর তুমি নিজের ভুল বুঝতে পারবে এবং নিজের বাকি জীবনটা আমার আগের আইজা আপু হয়ে কাটাবে। যে কাওকে কষ্ট দিতে জানতো না। কেবল ভালোবাসতে জানতো।”
শেষ কথাটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠে ইনারার। সে আর এক মুহূর্তও থাকতে পারলো না। সেখান থেকে চলে গেল।

আর এদিকে আইজা তার অতীতের সব স্মৃতি মনে করতে থাকল। তার মা বাবার সাথের স্মৃতি, ইনারার সাথে কাটানো মূহুর্ত, সাইদের সাথে সাজানো স্বপ্ন, তার বন্ধুদের কথা। সব। সাথে তার চোখের সামনে ভাসলো নিজের খারাপ কর্ম। ঈর্ষা ও লোভে সে অন্ধ হয়ে কেবল নিজের আশেপাশের মানুষদের জীবনই নয়, নিজেকেও ধ্বংস করে দিয়েছে। হঠাৎ করে খুব কান্না পেল তার। সে অঝোরে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু আজ তার আশেপাশে কেউ নেই। এখান থেকে বাসায় যেয়েও কাওকে পাবে না সে। সে নিজেকে আজ একা করে দিয়েছে, ইনারা থেকে সব ছিনিয়ে নিতে যেয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে নিয়েছে।
.
.
ইনারা আবার যেয়ে সভ্যর পাশে বসে। সুরভীও বের হয়ে গেছে। এখন সাইদের সাথে তার মা ও রিধু আছে। জোহানের রক্ত লাগতো। সভ্য এক দুই না ভেবে তাকে রক্ত দেয়। অতিরিক্ত রক্ত দেওয়ায় সভ্যের শরীরও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই তাকে একটি কেবিনে রাখা হয়। সামির সাথে সুরভি জোহানকে দেখে আসে। সুরভি এসে জানায় তাকে রক্ত দেওয়া হচ্ছে। হাতে, পা’য়ে, মুখে অনেক স্থানে ব্যান্ডেজ করা। কয়েক জায়গায় কাঁচের টুকরো ঢুকে গেছে। এসব জানিয়ে সুরভী বলে, “সবই তার কর্মের পরিণতি। ইনারা ও দুলাভাই তাকে ছেড়ে দিয়েছে কিন্তু নিয়তি তো কারও পাপ মাফ করে না।”
কথাটা শুনে সামি সরু দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে, “সুরভি মুখ সামলে।”
“মুখ সামলে? আমি ভুল কিছু বলেছি? আপনার থেকে ভালো তো কেউ জানে না যে জোহান কি করেছে? আপনি দুলাভাইয়ের সাথে সবসময় ছিলেন। আমি তো কখনো তাকে মাফ করতে পারব না ইনারার সাথে এমনটা করার জন্য। দুলাভাইয়ের সাথে এমন করার জন্য আপনি তাকে মাফ করতে পারবেন? ওহ হ্যাঁ সে তো আবার আপনার ভাই হয়।”
“সুরভি যা জানো না তা নিয়ে কথা বলো না।”
“আচ্ছা কি ভুল বললাম শুনি? সে মিথ্যা বলে সভ্য ভাইয়া এবং ইনারার সম্পর্ক ভাঙতে চায় নি? সে কি মিঃ হকের সাথে মোশতাক আহমেদের সঙ্গী ছিলো না? না’কি এতকিছুর পরও ইনারাকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে বের করার জন্য এত গুজব ছড়ায় নি? কোনটা ভুল বললাম আপনিই বলুন।”
সভ্য দুইজনের এমন তর্কাতর্কি শুনে বিরক্ত হয়ে বলে, “দুইজনে প্লিজ চুপ করো, নাহলে রুম থেকে বের হও।”
সামি বলল, “আমি কী করলাম? তোর শালীই যা তা বলে যাচ্ছে।”
“আবারও যা তা বলছি? আপনি আমাকে বলুন কোনটা ভুল বলেছি আমি। উনি এতকিছু করতে পারবে কিন্তু আমি সত্যিও বলতে পারব না? একটা কথা বলি? রাস্তার ক্ষুধার্ত কাওকে দেখলেও আমার কষ্ট লাগে। কিন্তু উনার এই অবস্থা দেখে আমার বিন্দুমাত্র আফসোস হচ্ছে না। উনি এটা ডিসার্ভ করে। আমার দুইটা বন্ধুর জীবন নষ্ট করার জন্য উনিও দায়ী। আপনাদের পঞ্চসুর ভাঙার জন্যও কেবল উনিই দায়ী। আপনি বলুন দায়ী না? উনি এতকিছু না করলে হয়তো আমাদের সবার জীবন অন্যরকম থাকতো।”
সামি মাথা নিচু করে নেয়। তারপর হঠাৎ রুম থেকে বের হয়ে যায়। ইনারা থামায় তাকে, “কোথায় যাচ্ছো?”
“জোহানের কথা হয়তো এখনো মামী জানে না। তাকে দেখে আসি।” বলে সামি চলে যায়।
ইনারা সুরভিকে বলে, “কেন এইসব কথা এখন তুলতে গেলি?”
“কারণ উনার জানা উচিত উনি তোকে জোহানের বিরুদ্ধে কিছু না করার অনুরোধ করলেই জোহান তার শাস্তি থেকে মুক্তি পাবে না।”
সভ্য অবাক হয়, “সামি ইনারাকে অনুরোধ করেছে?”
“হ্যাঁ দুলাভাইয়া ঐশির বিয়ের দিন করেছিল। যেন ইনারা জোহানকে ক্ষমা করে দেয়। ইনারা তাকে হয়তো ছেড়ে দিয়েছে। আপনিও হয়তো নিজের পুরনো বন্ধুত্বের খাতিরে তাকে কিছু করেন নি। কিন্তু সব কর্মের পরিণতি আছে। ভালো কর্মের পরিণতি ভালো, আর খারাপের খারাপ।”
.
.
এক ঘন্টা পর এলো সামি। এসে সবার পূর্বে ইরফানের কাছ থেকে জোহানের কথা জেনে সভ্যের রুমে এলো। ভেতরে ঢুকে দেখে ইনারা ও সুরভি এখনো সভ্যের সাথে। সভ্যকে জুস পান করাচ্ছে ইনারা। তাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে ইনারা জিজ্ঞেস করল, “সৌমিতা আন্টি কেমন আছে?”
“মামী জোহানের খবরটা জানে না। আমিও তাকে জানাই নি। মামীর মন এমনিতেই নরম। খবরটা শুনে সে অসুস্থ হয়ে পরলে সমস্যা।”
“ঠিক করেছ।”
সামি সভ্যের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোরও তো আজ ঐ রাস্তা দিয়ে যাবার কথা ছিলো তাই না? পরে যাস নি কেন?”
“কনসার্টের ব্যাপারে মিটিং ছিলো। লাস্ট মোমেন্ট ক্যান্সেল হয়ে গিয়েছিলো।”
“ওহ।” সামি এসে বসে সভ্যের পাশে। ইনারার হাতে একটি নীল রঙের পুরাতন ডায়েরি দিয়ে বলে, “পার্টনার এটা একটু পড়ে শুনাও।”
“আমি? কী আছে এখানে?”
“ডায়েরি খুলে দেখ এবং শব্দ করে পড়, যেন সবাই শুনতে পারে।”
ইনারা তার হাতের গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে ডায়েরিটা হাতে নিলো। ডায়েরি খুলে প্রথম পৃষ্ঠায় দেখল লেখা, ‘জোহানের জাহান’।
সে অবাক হয়ে সামির দিকে তাকায়, “এটা তো জোহানের ডায়েরি।”
“প্রথম থেকে পড়তে শুরু করো।”

ইনারা শব্দ করে পড়তে শুরু করে-

পৃষ্ঠা-১ঃ আমরা ক্যানবেরা, অস্ট্রেলিয়ায় এসেছি এক মাস হবে। এখানে স্কুলে অনেক বন্ধু হয়েছে আমার। আমি আগামীকাল থেকে নতুন মিউজিক ক্লাসে যাব। বড় হয়ে যে অনেক বড় গায়ক হয়ে বাবাকে গর্বিত করতে হবে। এই উপলক্ষে মা আমাকে এই ডাইরিটা উপহার দিয়েছে।
পৃষ্ঠা-২ঃ আজ প্রথম মিউজিক ক্লাসে গিয়েছি। অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে আমার। ক্লাসের সবাই আমার সাথে অনেক কথা বলেছে। একটি ছেলে ছাড়া। সে না’কি কারও সাথে কথা বলে না। ছেলেটা অদ্ভুত, কিন্তু ট্যালেন্টেড। সে ছেলেও না-কি আমার দেশ থেকে এসেছে। তার নাম সভ্য।
পৃষ্ঠা-৩ঃ অনেক মাস পর ডায়েরি নিয়ে বসলাম। আমার ডায়েরি লিখতে ভালো লাগেনা। তাও আজ লিখতে বসলাম। সভ্যের সাথে ভালোই বন্ধুত্ব হয়েছে। ও বাসায় এসেছিল। তাকে দেখে ঐশী হা করে তাকিয়ে ছিলো। সভ্যকে দেখে বেশির ভাগ মেয়েরাই ভাবে তাকিয়ে থাকে।
পৃষ্ঠা-৪ঃ আজ আটমাস হলো আমরা অস্ট্রেলিয়াতে এসেছি বাবা একটিবারও দেখা করতে এলো না। আমি জানি সে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত কিন্তু তার কথা অনেক মনে পড়ে।
এভাবেই কিছু পৃষ্ঠা পড়ে ইনারা। আবার অনেক পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে আসে পৃষ্ঠা-৫৬ঃ আজ আমি অনেক খুশি। আজ আমরা ‘ফিফথ মেলোডি’ অর্থাৎ পঞ্চসুরের গান রেকর্ড করেছি। অবশেষে আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। আমার বাবার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো পঞ্চসুরে সবাই আমার আপনজন। আমার বোন ঐশী, আমার কাজিন সামি, আর আমার ভাই সভ্য, সবাই আছে। ইরফান ছেলেটা নতুন। কিন্তু ওকেও জলদি আপন করে নিব।
পৃষ্ঠা ৫৭ঃ আজ মায়ের সাথে শ্রীমঙ্গল থেকে আসলাম। তার এক বান্ধবীর মেয়ের সাথে দেখা হলো। ও তো আমার গান শুনেই আমার ফ্যান হয়ে গেল। আমার প্রথম ফ্যান। শুনতেই কী ভালো লাগছে! আশা করি কয়েক মাস পর এমন হাজারো ফ্যান হবে আমাদের, পঞ্চসুরের।
পৃষ্ঠা-৫৮ঃ আজ আমাদের প্রথম গান রিলিজ পেয়েছে। অনেক নার্ভাস ছিলাম। আমি কেন সকলে ভীষণ অস্থির হয়ে আছি। কিন্তু সভ্য মোটেও চিন্তিত না। ও এতো শান্ত থাকে কীভাবে তা বুঝি না। আমারও মাঝেমধ্যে ওর মতো হতে ইচ্ছা করে। সভ্য বেস্ট।
পৃষ্ঠা ৫৯ঃ আমাদের গান প্রথমদিনেই ট্রেন্ডিং এ এসে পড়েছ। অবাক কান্ড। এমন প্রথম কোনো ব্যান্ডের সাথে হলো।
পৃষ্ঠা-৭০ঃ বাবা আজ আমাকে বলল, আমার মতো ছেলে হওয়া থেকে না হওয়া হাজারো ভালো ছিলো। সে আমার জন্য এত কষ্ট করে কোম্পানি শুরু করেছিলেন অথচ এই ব্যান্ডে আমার থেকে বেশি সভ্য জনপ্রিয় হয়ে গেছে। এটা তো ভালো কথা তাই না? ও এত ভালো গান গায়, বাদ্যযন্ত্র বাজায়, সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করে ওরই তো সবার প্রিয় হওয়া উচিত। আমি ওর জন্য অনেক খুশি কিন্তু বাবা এমন রুক্ষ ব্যবহার করছে কেন? শুধু আমার সাথে নয়, মা এবং ঐশির সাথেও।
পৃষ্ঠা-৭১ঃ আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কিছুই ভালো লাগছে না। বাবা আমার সাথে নারাজ। প্রতিদিনই থাকে। আমি ভেবেছিলাম যখন আমি গায়ক হবো তখন তিনি আমার উপর গর্ব করবেন। কিন্তু উল্টো তিনি আমাকে অনেক কথা শোনালেন। সভ্যের থেকে এগিয়ে যেতে বললেন। সভ্যের নামে অনেক বাজে কথাও শোনালেন যা আমার ভালো লাগে নি। মা’কেও মারলেন। আমার সামনে। আমার চোখের সামন। অথচ আমি কিছু বলতে পারলাম না। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। যন্ত্রের মতো।
পৃষ্ঠা-৭২ঃ বাবা বললেন আমাকে পঞ্চসুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় সদস্য হবার জন্য তার কথা মতো চলতে হবে। মডেলিং করতে হবে, এডস করতে হবে, জনপ্রিয় একজন অভিনেত্রীর সাথে সম্পর্কের নাটক করতে হবে। এতে আমার জনপ্রিয়তা বাড়বে। কিন্তু আমার কোন কিছু করার ইচ্ছা নেই। আমি কেবল গান গাইতে চাই। আর কিছু না।
পৃষ্ঠা-৭৩ঃ সভ্য, সভ্য, সভ্য। যেখানে যাই সেখানে সভ্য ছাড়া কোন কথা নেই। আমার আর ভালো লাগে না। কেবল ওর জন্য আমার বাবার কাছ থেকে এতকিছু শুনতে হচ্ছে। ও না থাকলে বাবা আমার থেকে এত বেশি আশা তো রাখতো না। আজ ওর জন্য বাবার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। বাবা আমাকে এতকিছু শোনাচ্ছে যা আমি সহ্য করতে পারছি না। আমি আর হাসতে পারি না, মজা করতে পারি না, কাঁদতেও পারি না। দিনরাত আমার কাজ করতে হয়। কাজ না করলে প্রাক্টিস করতে হয় যেন আমি সভ্যর থেকে ভালো হতে পারি। আমি ঐ মুহূর্ত নিয়ে আফসোস করছি যখন সভ্যর সাথে বন্ধুত্ব করেছিলাম আমি।

ইনারা পড়া থামাল। সে সভ্যের দিকে তাকাল এক মুহূর্তের জন্য। সভ্য চোখ নিচু করে আছে। সামি বলল, “সামনে পড়ো। এই ডায়েরিতে জোহানের সব মনের কথা লেখা।”
সুরভি জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু এই ডায়েরি এখন পড়ার কী দরকার?”
“দরকার আছে। পার্টনার পড়ো।”

ইনারা সামনের কিছু পৃষ্ঠা এসব নিয়েই পড়লো। জোহান তার বাবা এবং সভ্যকে নিয়েই লিখেছে। এক পৃষ্ঠায় এসে চোখ আটকে গেল তার,
পৃষ্ঠা-৮৫ঃ আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এটা এই শরীরের মাঝে আমি আর নিজেকে অনুভব করতে পারি না। এটা কে? আমি? গত সাপ্তাহে আমি একটি মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছি। মৌ তার নাম। বড় এক নায়িকা। কিন্তু অনেক ভালো। তার সাথে মিথ্যে প্রেমের অভিনয় করতে করতে ভালোবেসে ফেলেছি তাকে। অথচ আজ বাবা বলল তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলতে। এভাবে মেয়েটার মন আমি ভাঙতে পারি? ওকে ওয়াদা করেছি আমি। ওকে ভালোবাসি আমি। কিন্তু বাবার কথা মানতে হবে, নাহয় ঘরে আবার আতঙ্ক ছড়াবে। আর বাবা ঐশিকে গান গাইতে দিবে না কারণ তার মতে মেয়েরা ক্যারিয়ার গড়ার যোগ্য নয়।
পৃষ্ঠা-৮৬ঃ মৌ এর নামে খুব খারাপ খবর ছড়িয়েছে সব জায়গায়। আমি জানি এটা বাবা করিয়েছে। এর জন্য দোষী আমি। আমার ওর প্রেমে পড়া উচিত হয় নি।
পৃষ্ঠা-৮৭ঃ আজ দুইমাস পর আমার পঞ্চসুরের সাথে দেখা হয় আর প্রথম সভ্যের সাথে ঝগড়া হয়। এক পর্যায়ে এমন অবস্থায় চলে যায় যে আমি ওর উপর হাত তুলি। দোষ ওর, ওর কেন সবকিছুতে বেস্ট হতে হবে? ওর সাথে তুলনা না করলে হয়তো বাবাও আমার উপর গর্ব করতো। সবাই ওর স্থানে আমাকে ভালোবাসতো। আমার ছোট থেকে দুটোই স্বপ্ন ছিলো। গান গেয়ে সবাই মনে রাজ করা এবং আমার বাবাকে গর্বিত করা। ও কেবল আমার থেকে আমার স্বপ্ন ছিনিয়ে নেয় নি। আমার মা, বোন, আমার কাজিন সবাইকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছে। ওরা আমার থেকে ওকে বেশি আপন মনে করে। বাবা ঠিক বলে, সভ্য আমার বন্ধু নয়, শত্রু। আমার সব ছিনিয়ে নিতে চায় ও। ওর নাম থেকেও ঘৃণা হতে শুরু করেছে আমার। ও যা করতে পারে সব আমিও তো করতে পারি তাহলে কেন ওঁকে সবাই ভালোবাসে?
পৃষ্ঠা-৮৮ঃ সভ্যর সাথে ঝগড়া হয়েছে তিনমাস হলো। ও প্রতিদিন আমাকে বেহায়ার মতো কল দেয়, কথা বলার চেষ্টা করে। ও বুঝে না আমি ওকে ঘৃণা করি?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here