#প্রজাপতি মন (পর্ব-19)
♡আরশিয়া জান্নাত
রাতের কালচে আঁধারে অতীতের বহুগল্প প্রজ্জ্বলিত হয়ে প্রতিফলিত হয়ে ভেসে উঠে মানসপটে। এই তো ক’দিন আগেও হাসিখুশিতে ভরা একটা অসম্ভব সুন্দর জীবন ছিল নিশিথার। বাবা মায়ের আদরের চাদরে তারা তিনভাইবোন স্বর্গসুখে লালিত হয়েছিল। সেই সংসারে কোনোকিছুর অভাব ছিল না, দু’এক তরকারিতে দু’বেলা কাটানোর মতো অভাব ছিল না। যখন ইচ্ছে যা খুশি কিনে খাওয়া যেত।
এখানেও নিশিথার মা যথাসাধ্য লুকিয়ে টাকা পাঠাতো, নাতির জন্য এটাসেটা কিনে পাঠাতো। কিন্তু নাফিজ সাহেবের রাগ পড়ে না। যেদিন জানতে পারলেন আনিসা নিশিকে লুকিয়ে টাকা পাঠায় তিনি কি কঠিন রাগটাই না করেছিলেন। দু দিন বাসায় খাবার খান নি, আনিসার দিকে ফিরেও তাকান নি। সেই থেকে নিশির হাত খরচের টাকা পাওয়াও বন্ধ হয়ে গেছে। বেচারি যেমন মনঃকষ্টে ভুগে তেমনই অর্থসংকটেও ভুগে। এখন তার মনে হয় ইশ দুটোদিন যদি ও বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারতাম, পেটপুরে খেতে পারতাম অন্তত। নিশি জানতো ইমরান গরীব তবে মেধাবী। ওর ভবিষ্যৎ নিশ্চয়ই গোছানো হবে। তাছাড়া ওর নিজের চাকরির উপর ভরসা ছিল বলেই এমন ঘরে বিয়ে করে আসার সাহস দেখিয়েছিল। কিন্তু নিয়তি তার সব আশা ভরসাতে পানি ঢেলে দিয়েছে। ইমরান না বিশেষ কিছু করতে পারছে, না তাকে করতে দিয়েছে। শাশুড়ি তাকে প্রথম প্রথম বড় ঘরের মেয়ে ভেবে আদিখ্যেতা করলেও এখন বিশেষ দাম দেন না। তাছাড়া বাপের বাড়ির দাপট ছাড়া মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান কতখানিই বা দৃঢ় হবে? সে এখন তাদের এখানে অনাথের চেয়েও নিম্নবর্গের। সবকিছু মেনে নিলেও ইমরানের ব্যবহার সে মানতে পারেনা। যার হাত ধরে সে সবকিছু ছেড়ে এসেছে সে তাকে কোনদিকে সুখ দিয়েছে? নিশিথা বহুদিন চিন্তাভাবনা করে কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো। অবশ্য ওর কাছে এখন কোনো সিদ্ধান্তই কঠিন মনে হয় না। প্রজাপতি মন নিয়ে জীবনটাকে সে ইচ্ছেমতো উড়িয়েছে। একটা ভুল আবেগের জন্য এই জীবন সে এভাবে নষ্ট হতে দিবে না। অনেক হয়েছে জোড়াতালির ভালোবাসা,আর না।
নিশিথা খুব ভোরে তেমনিভাবে বেরিয়ে গেল যেমনভাবে এসেছিল এই অভাবের সংসারে। পেছনে রেখে গেল তার চার বছরের ছোট ছেলেকে। এই ছেলেকে সে নেবে না, সে জানে ওর কদর এই বাড়িতেই বেশি থাকবে।
??
কাইয়্যুম দেশে এসেছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে। নিজ বাড়িতে যাওয়ার পথে আগেকার সব স্মৃতি উজ্জীবিত হয়ে উঠলো যেন। এই তো সেই ক্যাফে যেখানে সে নিশিথার সঙ্গে আড্ডা দিতো। কত ঘন্টা যে কাটিয়েছে এখানে বসে নিশিথার জন্য নোটস করতে! আরেহ এ যে অবকাশ পার্ক চেনাই যাচ্ছেনা কত সুন্দর করেছে পার্কটা। এই শহরটা ওর কাছে জলজ্যান্ত নিশিথা। এই শহরের প্রতিটি রাস্তা অলিগলি নিশিথার গল্পই বলে যায়। নিশিথা ওর জীবনের একমাত্র মানুষ যাকে সে অসম্ভব ভালোবাসতো। কত পাগলামিই না করেছিল সে, মাকে জোর করে এই শহরেই রয়ে গিয়েছিল। অবস্থাশীল হওয়া স্বত্বেও শুধুমাত্র নিশিথার কাছাকাছি থাকার জন্য ওর বোনকে পড়িয়েছে।
কলেজের কত মেয়ে ওর জন্য পাগল ছিল সবাইকে সে কঠিন গলায় সাফ সাফ বলেছিল নিশিথা ছাড়া আর কেউ ওর মনের আশেপাশেও ঘেষতে পারবে না। ফের যদি কারো এমন কিছু শুনে তার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।
হাহাহাহা কতটা ক্রেজি হলে কেউ এমন ডিক্লেয়ার করতে পারে? পুরো পৃথিবীর সবাই যেন জানতো কাইয়্যুম কেবল নিশিথার গোলাম। গোলাম ই তো! গোলামের মতোই তো ট্রিট করেছে তাঁকে। তার আবেগ কি সে টের পেতো না? ঠিকই জানতো একটা কুত্তা নিশিথার আশেপাশে লেজ নাড়িয়ে ঘুরঘুর করে, সবার থেকে প্রটেক্ট করে। কুত্তাই তো হাহাহা নিশিথা ওকে এরচেয়ে ভালো কিছু ভাবতো? নিশিথাকে সে এখন শুধুই ঘৃণা করে। আর কিচ্ছু না। না এটা রিজেক্ট করার কারণে না! সে তো মেনেই নিতো ওর রিজেকশন ওর যেমন ভালোবাসার অধিকার আছে নিশিরও রিজেক্ট করার অধিকার আছে। কিন্তু ওর রাগটা অন্য জায়গায়। সেই রাগ তার ভেতরটা পুড়িয়ে ছাই করে। সেই দহনে জ্বলতে থাকে প্রতিটা নিঃশ্বাসে।
আচ্ছা নিশিথা কি জানে ওর জন্য যে বুকে ভালোবাসার পাহাড় জমেছিল, সেই বুক এখন কেবলই ঘৃণার আবাস।
????
আনু আনু কই তুই? আর কতক্ষণ আমি অপেক্ষা করবো?
আনহা নিজের ফাইলপত্র ঠিকঠাক করে রুমে এসে বললো, এ কি তুমি এখনো রেডি হও নি? কয়টা বাজে দেখেছ?
এটার মানে কি? তোকে না বলেছি আমি টাই বাঁধতে পারবো না? তারপরো এতোক্ষণ কি করছিলি? দেখি তাড়াতাড়ি কর লেট হয়ে যাচ্ছে।
আনহা টাই বাঁধতে বাঁধতে বললো, আমিও বলেছিলাম তুই বলা চলবে না। তুমি বলো তুমি! ওয়াইফকে কেউ তুই বলে হু?
হাসিব ওর কোমড় জড়িয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো, বহুবছরের অভ্যাস ম্যাম এতো সহজে পাল্টাবে? তাছাড়া তুই বলাতে আপন আপন ভাব আছে না?
যতো লজিক দাও হবে না।
ওকে ওকে চেষ্টা করবো। আচ্ছা শোন স্যরি শোনো এবার তো হানিমুনের প্ল্যান করা উচিত না কি? আর কতকাল উপোস রাখবে?
তোমার মুখে কিচ্ছু বাঁধে না। সবেই হসপিটালে জয়েন করেছি এখনই হানিমুন সম্ভব না।
এসব ঠিক না আনু। আমি বলেছিলাম জয়েনিং এর আগেই কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি। তুই শুনিস নি আমার কথা।এখন আমি মানবো না এসব! আমি জানতাম তুই ভেজিটেবল কিন্তু তাই বলে আজীবন ভেজিটেবল থাকবি এটা কল্পনা করিনি! আমার মতো ছেলে যার রক্তের শিরা উপশিরাগুলিও রোমান্সে ভরপুর। তার বৌ কি না,,,,, না না এটা দীর্ঘস্থায়ী হতে দেওয়া যাবে না। তুই যদি রাজী না হস আমি তোকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবো। আমাদের বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো আনু! এখন অন্তত আমাদের কোয়ালিটি টাইম দরকার। I’ve waited a long please try to understand.
আনহার খুব মায়া লাগলো হাসিবের কাতরতা দেখে। ছেলেটা আসলেই দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে। ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে এতো ধৈর্যশীল হতো না নিশ্চিত। কেমন ব্যাকুল হয়ে কথাগুলো বলছে সে। আনহা নিজেকে সামলে নিলো। হাসিবের গালে হাত রেখে বললো, হাসিব আমি জানি তুমি যে স্যাক্রিফাইজ করেছ তা আর কেউ করতো না। কিন্তু এটা ভেবো না তুমি একাই কষ্ট পেয়েছ।
আমাকে ভোলাতে আসবা না। আমি সব এরেঞ্জ করছি তুমি যেভাবে পারো ছুটি নাও।
আচ্ছা বেশ আমি চেষ্টা করবো।
চেষ্টা না করতেই হবে।
আচ্ছা মশাই যথা আজ্ঞা।
আনু!
হু
একটা কথা জানো?
কি?
বললে বিশ্বাস করবা?
বলে দেখো।
আমি তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসি।
এটা শুধু জানি না জনাব মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও করি। কিন্তু আপনি হয়তো মানতে নারাজ আমিও আপনাকে ভালোবাসি
কতখানি?
উমম!! টেন টু দ্য পাওয়ার ইনফিনিটি,,,,,,
হাসিব মুচকি হাসি দিলো। আনহা মনে মনে বললো, ইশ হাসলে আমার বরটাকে কত্ত কিউট লাগে। মাশাআল্লাহ!
চলবে,,,