গল্প :#উড়ো_পার্সেল (পর্ব -২)
লেখা:#নাজিফা_তাবাসসুম
ইকবাল সাহেব সোফায় বসে আছেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার দুই মেয়ে। তাদের বসার ঘরে আজ আলোচনা সভা বসেছে। ইকবাল সাহেব বেশ গম্ভীর হয়ে তার ছোট মেয়ে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি ঈশিতাকে প্রশ্ন করলেন, ‘প্রথম থেকে আবার বলো কি দেখেছো তুমি’?
ঈশিতা এক মুহূর্ত দেরি না করে বলতে শুরু করল, বাবা, ‘আমি আমাদের বাসার সামনে ড্রোন ক্যামেরা দেখেছি। সেই ক্যামেরাটা কাকের মত দেখতে। সেই ক্যামেরা দিয়ে আমাদের বাসায় ২৪ ঘন্টা নজর রাখা হচ্ছে। বাবা আমার তো মনে হচ্ছে এই ড্রোন ক্যামেরা দিয়ে আপুর উপরেই নজর রাখা হচ্ছে’।
– দেখো ঈশিতা, ‘তুমি বেশি কথা বলবেনা’। যা প্রশ্ন করেছি, সে উত্তরটাই তোমার কাছে আমি শুধু চেয়েছিলাম। তুমি দেখছি অতিরিক্ত কথা বলছো।
– ‘স্যরি বাবা’।
ইকবাল হোসেনের বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এ ব্যাপারে তোমার মন্তব্য কি’?
নিশাত তার বাবার দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘বাবা আমি এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছিনা’।
আমার কোন ধারণা নেই… যে কে আমাদের ফ্যামিলির দিকে নজর রাখছে।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি তাহলে ঘরে যাও। আরেকটা কথা, ‘এখন থেকে যা কিছুই হবে না কেন আমার কাছে বলবে।
কোন কিছুই লুকিয়ে রাখবে না’। ‘লুকিয়ে রাখার অভ্যাস কিন্তু একদমই ভালো না। এটা পরবর্তীতে অনেক বড় সমস্যায় ফেলবে তোমাকে’।
নিশাত বসার ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য পা ফেলবে এমন সময় কলিংবেল বেজে উঠলো। ঈশিতা দৌড়ে দরজা খোলার জন্য চলে গেল। সে ভীষন ছটফটে এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতে পারেনা। অন্যদিকে নিশাত তার সম্পূর্ণ বিপরীত স্বভাবের; প্রচন্ড চুপচাপ এবং ধীর-স্থির মানুষ সে।
সবাই অপেক্ষা করছিল কে কলিং বেল দিয়েছে সেটা দেখার জন্য। পরবর্তী সবার কানে একটি মোটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসলো তার সাথে সাথে ঈশিতার অনবরত কথা।
ঈশিতা বসার ঘরে প্রবেশ করল তার পিছনের মানুষটি ঘরে ঢুকতেই সবাই হতাশ হয়ে গেল । কারণ মানুষটি আর কেউ নয়। ইকবাল হোসেনের বড়বোন সুমাইয়া এসেছেন। নিশাতের এবং ঈশিতার বড় ফুফু।
হঠাৎ তার এই আকস্মিক আগমনে ইকবাল হোসেন তার বড় বোনকে জিজ্ঞেসা করলেন, ‘বড় আপা’… তুমি হঠাৎ আমার বাসায়?
– কেন? আমি কি যখন তখন তোর বাসায় আসতে পারিনা? নাকি টিকিট কেটে, রেজিস্ট্রেশন করে, তোর বাসায় আসতে হবে?
ইকবাল হোসেন তার বড় বোনকে ভীষণ ভয় পান। তাই তিনি আস্তে করে বললেন, না মানে… তুমি আসার কথা আগে জানিয়ে দিলে আমরা কিছু আয়োজন করতাম ।
– ‘কেন আমি কি মেহমান নাকি? যে যখন তখন আসতে পারি না’?
‘আমি তো তোদের কে তো আপন ভাবি। আর তোরা আমাকে পর ভেবে ঠেলে দিচ্ছিস’?
অনবরত প্রশ্নের বাণ ছুঁড়ে দিয়ে তিনি তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি রুমাল বের করে প্রত্যেকবারের মতো চোখের কোন মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, ‘তোরা আমাকে পর ভাবিস’!! অথচ আমি তোদেরকে কত ভালোবাসি!!কত ভালোবাসি!!
নিশাত বিরক্ত হয়ে তার বড় ফুপুর এই ন্যাকা কান্না দেখতে থাকলো। তার ফুপু স্বভাবতই এরকম।
তিনি প্রত্যেকবারই কোন না কোন একটা উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের বাসায় আসেন এবং একইভাবে সেম ডায়লগ গুলো বলতে থাকেন। “তোরা আমাকে পর ভাবিস”!! “আমি তোদের আপন কত ভাবি”!! “তোরা নিষ্ঠুর”…”তোরা পাষান্ড”!!
তার এবারের উদ্দেশ্য কি? কে জানে? সে কথা চিন্তা করতেই নিশাতের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগল।কারণ তিনি যতবারই আসেন… নিশাতের জন্য একটা না একটা পাত্রের সন্ধান নিয়েই আসেন। তিনি কখনো একা আসতে পারেন না। তার হ্যান্ড ব্যাগ ভর্তি পাত্রের ছবি অবশ্যই থাকবে। এবারে তিনি কোন পাত্রের সন্ধান এনেছেন কে জানে!!
নিশাত যেই দুশ্চিন্তা এতক্ষণ করছিল সেটাই যেন কয়েক মুহূর্তের মাঝে সত্যি হয়ে গেল।
নিশাতের বড় ফুপু সুমাইয়া রহমান ঈশিতাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি তার কাছে এনে দিতে বললেন এবং তিনি সোফায় পা তুলে বসলেন।
ঈশিতা তার বড় ফুপুর খুবই বাধ্য। কারণ তারা তার আর ফুফুর স্বভাবে বিশেষ একটা পার্থক্য নেই। দুজনে অতিরিক্ত বাচাল এবং দুজনের মন মানসিকতাও একরকম।
নিশাতের বড় ফুপু সোফায় পা তুলে বসেই ক্ষ্যান্ত হলেন না। তিনি তাঁর হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি ছেলের ছবি বের করে তার বাবার হাতে দিয়ে বললেন, দেখ ইকবাল.. এবার নিশাতের জন্য একটা বড়লোক পাত্রের সন্ধান নিয়ে এসেছি। ছেলে বিরাট বড়লোক। ঢাকায় দুইটা বিল্ডিং রয়েছে। জমিজমার অভাব নেই। ‘নিশাতের সাথে বিয়ে দিলে, নিশাত রাজরানী হয়ে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকবে’।
ইকবাল হোসেন তার বড় বোনের সাথে বিশেষ কথা বলতে পারেন না। তিনি মিনমিনে স্বরে বললেন, ‘নিশাতের এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেবো না’। ‘ও সবে সেকেন্ড সেমিস্টার ফাইনাল দিল’। আরোও কিছুদিন যাক। আগে অনার্সটা কমপ্লিট করুক তারপর এসব নিয়ে ভেবে চিন্তে দেখব।
সুমাইয়া ভীষণ রেগে ঝাঁজালো গলায় তার ভাইকে বললেন, মেয়েকে এখন বিয়ে দিব না.. তখন বিয়ে দিব.. এভাবে করে করে ঘরে বসিয়ে রেখে তো বুড়ি বানাচ্ছিস।
রাহেলা বেগমের এবার তার স্বামীর উপর প্রচন্ড রাগ হল। তিনি বুঝতে পারেন না, তার স্বামী কেন তার বড় বোন কে এত ভয় পান? তাদের মেয়ের বিয়ে তারা কখন দিবে না দিবে সেটি তাদের ব্যাপার। এখানে কেন বাইরের একজন মানুষ এসে খবরদারি করবে এই বিষয়টি রাহেলা বেগম এর কাছে খুব খারাপ লাগল। তারপরও তিনি কিছু বললেন না। হাজার হলেও এই মহিলাটি তার স্বামীর বড় বোন। তার তার সাথে তো আর খারাপ ব্যবহার করা যায় না।
তিনি নিশাতের বিয়ের প্রসঙ্গটা ঘোরানোর জন্য বললেন, ‘আপা আজ দুপুরে কি খাবেন?আপনার পছন্দের চ্যাপা শুঁটকির ভর্তা করে দেবো’?
– না কিছু খাবো না। আসার সময় কাচ্চি বিরিয়ানী খেয়ে এসেছি।
ঈশিতা বলল, ফুপু তুমি একা একা কাচ্চি খেলে আমাকে না জানিয়েই?
– তোকে ও খাওয়াবো। সমস্যা নেই। আচ্ছা সবাই প্রসঙ্গ অন্যদিকে নিয়ে যাচ্ছ কেন? যেই কথায় ছিলাম নিশাতের বিয়ে..
ফুপুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে ঈশিতা বলল, নিশাতের বিয়ে হবে না এই তো ফুপু?
– মানে ? কি বলছিস তুই? কেন বিয়ে হবে না? আমি যথেষ্ট ভালো একটা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
– আরে ফুপু.. ‘তোমার পছন্দ করা পাত্রের সাথে কি মনে করেছ নিশাত আপুর বিয়ে দিব’? আমরা নিশাত আপুর জন্য আরো ভালো ভালো পাত্র পাব।অলরেডি একজন তো ডায়…
ঈশিতা লক্ষ করল কথাটা যখন সে বলছিল, তখন তার বাবা-মা এবং নিশাত আপু তিনজনেই চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এর অর্থ হলো সে যদি কথাটা সম্পূর্ণ করে তাহলে আজ ফুপু চলে যাবার পর বাসায় তার বাসায় শনির দশা আছে ।
তাই সে আর কথাটি সম্পন্ন করল না। সে বলতে চেয়েছিল, ডায়মন্ডের নেকলেস এর কথা।
কিন্তু সে সেটা না বলতে পেরে সেখানে চুপ করে গেল।
এতে করে ঈশিতার অদ্ভুত আচরণে ঈশিতার বড় ফুপু সুমাইয়া রহমানের বেশ খটকা লাগলো তিনি প্রশ্ন করতে থাকলেন। কি বলতে চাচ্ছিলি??
– না ফুপু… কিছু না।
-আরে বল না!! তোকে আমি ডবল কাচ্চি খাওয়াবো!
তুই বল।
– না ফুপু কিছু না।
এমন সময় দরজায় আরেকবার কলিং বেল বেজে উঠলো। ঈশিতা দৌড়ে দরজা খুলতে যাওয়ার আগেই নিশাত দৌড়ে গেল।কারণ সে আর এখানে থাকতে পারছে না। সবার এত ঘন কথায় তার মাথা ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে। তাই সেখান থেকে এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।
দরজার সামনে এসে সরু পিনহোলের ছিদ্র দিয়ে সে দেখতে পেল বাইরে কেউ নেই। নিশাত কিছুটা ঘাবড়ে গেল; তারপর সে দরজা খুলে সামনে একটা মাঝারি আকারের বাক্স পেল। আবারো তার কাছে গিফট এসেছে। ঈশিতার কথা মতে “উড়ো পার্সেল”। আচ্ছা তাকে কে এই উড়ো পার্সেল গুলো পাঠাচ্ছে?
নিশাত এই প্রথম তাকে গিফট পাঠানো এই অজ্ঞাত ব্যক্তির ওপর বিরক্ত কিংবা রাগ হলো না। বরং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কারণ এখন এই পার্সেলটির জন্যই বড় ফুপুর কাছ থেকে সে ছাড়া পেল। নিশাত নিজের রুমে গিয়ে বাক্সটি খুলতেই বেশ অবাক হয়ে গেল…
বাক্সে একটা কালো রংয়ের ডায়েরী এবং ডায়েরীর সাথে একটা চিরকুট যেমনটি প্রত্যেকবারের গিফটের সাথে থাকে। নিশাত চিরকুটটি খুলে পড়তে শুরু করল।
প্রিয় নিশাত,
আজ তোমার জন্য একটা অন্যরকম গিফট পাঠালাম। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমার উপর ভীষণ রাগ করছো। আমি তোমাকে গিফট পাঠিয়েই যাচ্ছি সেজন্য…তাইতো? তবে আজ তোমাকে এই ডায়েরী পাঠানোর কারণ হচ্ছে, এইটাইতে তুমি আমার সম্পর্কে… যা যা প্রশ্ন আসবে, তুমি সব লিখবে।তোমার মনের কথাও লিখতে পারো, যা তোমার মনে চায় তাই লিখবে। তারপর এই ডায়েরী তুমি আমাকে গিফট করবে।
কি করবে না? নাকি এখনো আমার উপর রাগ করে আছো?
ইতি,
তোমার গিফটের প্রতীক্ষায় থাকা একজন হতভাগা…
নিশাতের বেশ মজা লাগলো চিরকুটটি পড়ে। একটুখানি লজ্জা ও অনুভব করলো সে।
এমন সময় ঈশিতা পিছন থেকে এসে তার হাত থেকে চিরকুটটি টেনে নিয়ে বলল,’আপু তুমি আরো একটা উড়ো পার্সেল পেয়েছো’!!
আর আমাকে বলোনি। আরে, আপু তুমি তো দেখছি লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছো। লাল থেকে আস্তে আস্তে বেগুনি হয়ে যাচ্ছ…!!
চলবে…