#একটি_রাতের_গল্প,পর্ব-১৬,১৭,১৮
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
১৬
প্রাচীকে বললাম লাইটটা জ্বালাতে। ও ইতিমধ্যে গিয়ে ঘরের লাইট জ্বালিয়ে ফেলেছে।চারপাশটা আলোকিত হতেই আম্মা একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।দেখতে পাচ্ছি দর্পণ ভাইয়ার ছুড়িবিদ্ধ শরীর আমার পায়ের কাছে পড়ে আছে!সারা শরীর মূহুর্তেই কেঁপে উঠলো আমার!চোখের সামনে যা দেখছি কোনো দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে।বারবার মনে হচ্ছে এই বোধহয় স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো।কিন্তু না।আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যা ঘটছে সবটাই সত্যি।কেউ ভাইয়াকে খু ন করতে এসেছিলো।ভাইয়ার হার্ডবিড এখোনো শোনা যাচ্ছে।আশাহত মনে একটু হলেও আশার সঞ্চার হলো আমার।এদিকে আম্মা জ্ঞান হারিয়েছেন।প্রাচী তাকে নিয়ে খাটের ওপর শুইয়ে দিলো আর চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে ঘরের ভেতরে কোথা থেকে ভাবী ঢুকে পড়লো।আমি পেছন থেকে তার চিৎকারের আওয়াজ পেলাম শুধু।এতোকিছুর ভেতরে ভাবীর কথা মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিলো।জানি না কোথা থেকে হঠাৎ হাজির হলো সে।ভাবী এসে ভাইয়ার দেহের সামনে লুটিয়ে পড়ে,
—দর্পণ…এটা কি হয়ে গেলো তোমার,কে তোমার এতো বড়ো সর্বনাশ করলো বলো আমায়।
ভাবী প্রলাপ শুরু করে দিয়েছে।আমি ভাবীকে প্রশ্ন করি।
—তার আগে বলো তুমি এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?
—আমি আর কোথায় যাবো,বাথরুমে গিয়েছিলাম,কিন্তু এইটুকু সময়ের ভেতরে কি হয়ে গেলো এটা,
—ভাইয়াকে হাসপাতালে নিতে হবে,ওর হার্ডবিড শোনা যাচ্ছে,এখনো সবকিছু শেষ হয়ে যায় নি।
লক্ষ্য করলাম ভাইয়া বেঁচে আছে এটা শুনে ভাবি যেনো অবাক হয়ে গেলো,তার চোখ মুখের এক্সপ্রেশন কিরকম জানি লাগছে আমার।কোনোকিছুই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।এই মূহুর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে,বাসায় আব্বাও নেই।পুরুষ মানুষ বলতে আমি একা।আম্মার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়।পারিপার্শ্বিক পরিবেশ আমাকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দিয়েছে।
এরপর ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নিয়ে এম্বুলেন্সের নম্বরে কল দিলাম।কেনো জানি না কিছুতেই কানেকশন পাচ্ছি না।হঠাৎ গুঞ্জনের কথা মাথায় আসলো আমার।ওর বাড়ি হাসপাতালের কাছেই।আর এক মূহুর্ত দেরী না করে ওর নম্বরে কল দিলাম।একটু পরে ও ফোন রিসিভ করে।
—কি খবর,এতো রাতে ফোন দিয়েছিস কেনো?
—এতো কথা বলার সময় নেই ভাই,তুই তাড়াতাড়ি একটা এম্বুলেন্স ম্যানেজ করে আমাদের বাড়িতে আয়।
—এম্বুলেন্স,কেনো রে কী হয়েছে?
—ভাইয়ার অবস্থা খুব খারাপ গুঞ্জন,জানিনা ওকে বাঁচাতে পারবো কিনা,তুই আর একটাও কথা বলিস না।যতো তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয়।
—আচ্ছা আমি আসছি,তোরা আল্লাহকে ডাকতে থাক।চিন্তা করিস না।
গুঞ্জন ফোন কেটে দিলো।এদিকে আম্মারও জ্ঞান ফিরেছে।যদিও তার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছে না,মাঝে মধ্যে ভাইয়ার নামের অস্পষ্ট উচ্চারণ শুনতে পারছি।ভাবী সমানে কান্না করেই যাচ্ছে।
এই সময়ে প্রতিটা সেকেন্ড কয়েকঘন্টার মতো মনে হচ্ছে আমার কাছে।নিজের মৃত্যুপথযাত্রী ভাইকে নিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছি,কখন এম্বুলেন্সের আওয়াজ শুনতে পাবো।না জানি কখন ওর প্রানটা চলে যায়,এই ভয়ে শরীরটা কেঁপে উঠছে বার বার।
মিনিট বিশের মধ্যেই গুঞ্জন এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির হলো।আমরা সবাই মিলে ভাইয়াকে এম্বুলেন্সে তুললাম।ভাবীও হাসপাতালে যাবার জন্য কান্নাকাটি করতে লাগলো।আমরা আম্মাকে বুঝিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।প্রাচীকে দ্বায়িত্ব দিয়ে গেলাম যেনো ও আম্মাকে সামলে রাখে।আব্বাকেও ফোন করা হয়েছে।হয়তো কালকের ভেতরেই চলে আসবে।
–
–
–
–
পরেরদিন সকালবেলা।
ভাইয়ার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে।এখোনো জ্ঞান ফেরেনি ওর।চব্বিশ ঘন্টা না পেরোলে ডাক্তার কিছুই বলতে পারছে না।আমি বাড়িতে প্রাচীর নম্বরে কল দিলাম।
—প্রাচী আম্মা কেমন আছে?
—এখন মোটামুটি সুস্থ।বারবার ভাইয়ার কথা জিজ্ঞেস করছে।আচ্ছা ভাইয়ার কি অবস্থা এখন?
—অবজারবেশনে আছে।চব্বিশ ঘন্টা না কাটা পর্যন্ত ডাক্তার কিছুই বলতে পারছে না।তুমি একটা কাজ করো,
—কি কাজ।
—আম্মাকে বলো ভাইয়া মোটামুটি সুস্থ আছে।আর যদি এখানে আসার জন্য জোরাজুরি করে বলবে ভাইয়া সুস্থ হলে আমি নিজেই গিয়ে তাকে নিয়ে আসবো।
—ঠিক আছে।সাবধানে থেকো তোমরা সবাই।
ফোনটা রেখে চারদিকে তাকাতে লাগলাম।কোথাও ভাবীকে দেখতে পাচ্ছি না।আমি আরেকটু সামনে গিয়ে তাকে খুঁজতে থাকি।হঠাৎ হাসপাতালের করিডোরের দিকে দৃষ্টি গেলো আমার।ভাবী কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে।আমি তাকে পেছনে দাঁড়িয়ে আছি এখনো বুঝে উঠতে পারে নি।বুঝতে পারছি না কার সাথে এইভাবে ফিসফিস করে কথা বলছে।যার স্বামী কিনা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে সে এইভাবে নিশ্চিতে ফোনালাপে ব্যস্ত থাকে কিকরে,বড্ড অদ্ভুত ব্যপারটা।আমি ভাবীর দিকে এগোতে থাকি,আরেকটু কাছে যেতেই ভাবী আমার উপস্থিতি টের পায়।ফিরে তাকালো আমার দিকে।
—একি তুমি এখানে কি করছো?
—আমি কি করছি সেটা না জানলেও চলবে, আগে বলো তুমি কি করছো?
—ফোনে কথা বলছিলাম,
—সেটা তো আমিও দেখতে পেয়েছি।কার সাথে কথা বলেছো?
—বাড়িতে,বাড়ি থেকে কল এসেছিলো?
—তো বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলার জন্য এই জায়গায় আসার কি দরকার।আমার সামনেই বলতে পারতে।
—মানে, তুমি কি দেখছি পুলিশের মতো জেরা শুরু করেছো আমায়।
—আমি কাউকে জেরা করছি না ভাবী,তবে পুলিশ অবশ্যই করবে।আর একটা কথা শুনে রাখো যে আমার ভাইয়ের এতো বড়ো একটা ক্ষতি করলো তাকে কিন্তু এতো সহজে ছেড়ে দেবো না আমি।তাতে সে যেই হোক না কেন।
ভাবী আমার কথা শুনে কাচুমাচু করতে লাগলো।আর কিছু না বলে বেরিয়ে চলে গেলো। গতকাল রাত থেকে ভাবীর গতিবিধি-ব্যবহার কিছুই ভালো লাগছে না আমার,তার সবকিছু আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করছে।আমি আবারো ফোনটা হাতে নিয়ে শিমুল আপুর নম্বরে ডায়াল করি।সেই মাঝ রাতের পরে এখন একটু ফ্রি হলাম।ওকে বিষয়টা এক্ষুণি জানানো দরকার।ওর নম্বরে ডায়াল করতেই নম্বর নট রিচেবল বলছে।হতে পারে নেটওয়ার্ক প্রবেলেম।আবারো কয়েকবার ট্রাই করলাম,বারবার একই প্রবেলেম।উপায়ান্তর না পেয়ে আপুর নম্বরে কল দিলাম।আপু আমাদের বেশ পরিচিত,শিমুল আপুর বান্ধবী।গতকাল রাতে ওরই বিয়ে হয়েছে।
—হ্যালো আপু কেমন আছো তোমরা?
—আমরা ভালো আছি ভাই,কিন্তু তোমরা এটা কি করলে বলে তো,বিয়েতে আসার কথা দিয়েও কেউ আসলে না।
–আর বলো না,অনেক কিছু হয়ে গেছে এইটুকু সময়ের ভেতরে।পরে জানতে পারবে।
–আচ্ছা,তা এখন ফোন করলে কি মনে করে?
—শিমুল আপুর কি খবর,ওকে ফোনে পাচ্ছি না কেনো?ও তোমার আশেপাশে থেকে থাকলে আমার কথা বলো,
—শিমুল…কি বলছো ভাই,ও তো আসেনি বিয়েতে।তোমায় তখন কি বললাম আমি বুঝতে পারো নি?
(আপুর কথা শুনে আমি বেশ অবাক লাম!)
–কি?শিমুল আপু বিয়েতে যায় নি?
—না,কেনো ওর কি আসার কথা ছিলো নাকি?
আপুর কথা শুনে মাথাটা যেনো ভনভন করে ঘুরতে লাগলো আমার।শিমুল আপু বিয়েতে যায়নি?তাহলে বিয়ের কথা বলে কোথায় গিয়েছে ও??
আচমকা লক্ষ্য করলাম কেউ আমার পেছনে যেনো দাঁড়িয়ে আছে,আমি ফিরে তাকাতেই ভাবী আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো।এতোক্ষণ সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সব কথা শুনছিলো!
চলবে…..
#একটি_রাতের_গল্প
পর্ব—১৭
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
আচমকা লক্ষ্য করলাম কেউ আমার পেছনে যেনো দাঁড়িয়ে আছে,আমি ফিরে তাকাতেই ভাবী আমার চোখের আড়ালে চলে গেলো।এতোক্ষণ সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সব কথা শুনছিলো!আমি আর সময় নষ্ট না করে ভাবীর পিছু নিলাম।ভাবী আমাকে দেখতে পেয়ে থেমে গেলো।আমি এগিয়ে যাই তার দিকে।
—কি ব্যপার ভাবী,তুমি এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার সব কথা শুনছিলে তাই না?
—বিশ্বাস করো আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।আমি জাস্ট তোমার কথাগুলোই শুনতে চেয়েছিলাম,
—তাই নাকি,তা কি শুনলে?আর আড়ি পেতে আমার কথা শোনার কি এমন দরকার পড়লো তোমার?
—শিমুল তারিনের বিয়েতে যায় নি,তাই না?
(গত পর্বে শিমুলের বান্ধবীর নাম মেনশন করতে ভুলে গিয়েছিলাম?)
—সেটা তোমার জেনে কি হবে,কিসের এতো আগ্রহ তোমার?
—কিসের আগ্রহ মানে,দেখো আমি জানি শিমুল একটা সন্দেহজনক কাজ করেছে।আর দর্পণ শুধু তোমার ভাই নয়,ও আমারও হাসবেন্ড।ওর এতো বড়ো একটা ক্ষতি কে করেছে সেটা আমি জানতে চাইবো না কিকরে হয়?
—একদম নাটক করো না আমার সাথে,আমি ভালো করেই জানি আমার ভাইকে তুমি কেমন চোখে দেখো?তোমার বিন্দুমাত্র সিমপ্যাথি নেই ওর জন্য।
—তুমি এটা বলতে পারলে আমায়?
—হ্যাঁ,পারলাম।কারণ আমি তোমার আসল রুপটা ভালো করেই জানি।তুমি আমার সাথে সেদিন রাতে কি ব্যবহারটাই না করেছিলে ভুলে গেছি ভেবেছো?
সিমরান ভাবী আমার কথা শুনে কাঁদতে লাগলো।যদিও সবটাই তার মায়াকান্না।ভালো করেই বুঝতে পারছি।একটু পরেই একজন নার্স আসলো আমার কাছে।
—আপনার নাম পল্লব হাসান?
—হ্যাঁ,বলুন।
—শিমুল নামে কেউ দেখা করতে এসেছে আপনার সাথে,উনি রিসেপশনেই আছেন।আপনাকে খুঁজছে।
—কি শিমুল আপু এসেছে হাসপাতালে?
—জ্বী,
শিমুল আপুর কথা শুনে আমি ছুটে গেলাম রিসেপশনের দিকে।লক্ষ্য করলাম ভাবীও আমার পেছন পেছন আসতে লাগলো।আমি আরেকটু সামনে যেতেই দেখি শিমুল আপু আমাকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকেই আসছে।আমি এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।
—পল্লব,এটা কিকরে হয়ে গেলো,আমি তো বুঝতে পারছি না কিছুই।
—সে তো আমরাও কেউ বুঝতে পারছি না।কাল রাতে কেউ আমাদের বাড়িতে এসেছিলো ভাইয়াকে খু ন করার উদ্দেশ্যে নিয়ে।
—পুলিশদের খবর দিস নি?
—হ্যাঁ,ওনারা সকালে এসেছিলো।ভাইয়ার জ্ঞান ফিরলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।ডাক্তার চব্বিশ ঘন্টার অবজারবেশনে রেখেছে ওকে।
—আমি একটু দেখতে পারি,আমায় নিয়ে চল!
—সেসব হবে,আগে বলো বিয়ে বাড়িতে কেমন কাটলো তোমার?
(আমি দেখতে চাইছি শিমুল আপু এবার কি উত্তর দেয়,ও মিথ্যে বললে বেশ সহজেই ধরতে পারবো আমি)
—আর বলিস না,আমার বিয়েতে যাওয়া হয় নি রে।জানিনা তারিন মনে মনে কি না কি বলে গালি দিচ্ছে আমায়।
—কেনো শিমুল কি এমন ঘটলো তুমি নিজের বন্ধুর বিয়েতে যেতে পারলে না?
(ভাবী পেছন থেকে এসে শিমুল আপুকে প্রশ্ন করে)
—মাঝরাস্তায় ব্রিজ ভেঙে যাবার কারণে রাস্তা ব্লক করা ছিলো সারারাত,তখন শর্টকাট দিয়ে যাবো তারও কোনো উপায় ছিলো না।
—তো সারারাত গাড়িতেই বসে বসে কাটিয়ে দিলে?
—না,আমরা একটু পরেই বাড়ির দিকে ব্যাক করি।ভোররাতে বাড়িতে পৌঁছে প্রাচীর কাছে সবটা শুনলাম।আমি তক্ষুণি হাসপাতালে চলে আসতাম,ওই লেইট করে আসতে বললো।
—গল্প দিচ্ছো না তো,দেখো পুলিশ কিন্তু সবটা খুঁজে বের করবে।তখন কেউ বাঁচতে পারবে না?
—সিমরান ভাবী আমি মিথ্যে কেনো বলবো,আর শুধু তুমি কেনো আমিও চাই দর্পণ ভাইয়া তার ওপর হওয়া অন্যায়ের বিচার পাক।
আমি শিমুল আপু আর সিমরান ভাবী দুজনকেই শান্ত হতে বলি।ওরা আমার কথা শুনে চুপ হয়ে যায়।হাসপাতালে বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই আমাদের কাছে।চব্বিশ ঘন্টা কাটতে এখনো অনেক সময় বাকি।ভাবীকে ডেকে আমি বললাম সে যেনো বাড়িতে চলে যায়।ঐদিকে প্রাচী একা আছে।ওর একার পক্ষে আম্মাকে সামলানো,বাড়ির অন্যান্য কাজ করা কষ্টকর।ভাবী বাড়িতে চলে গেলো।আমি আর শিমুল আপু হাসপাতালে থেকে গেলাম।
–
–
–
বিকেল বেলা আমি রিসেপশনের পাশে বসে আছি।শিমুল আপু আমার পাশে এসে বসলো।ও আমার কাধের ওপর হাত রাখলো।আমি ফিরে তাকাই ওর দিকে।বুঝতে পারছি কিছু বলতে চাইছে আমাকে।
—কিছু বলবা?
—আমাদের সন্তানের কি কোনো সুরহা হবে না,আমরা ওর সাথে কোনো অন্যায় করছি না তো?
(শিমুল আপু এটা বলে নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে হাত বুলাতে লাগলো।ওর গর্ভ ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে,কিছুদিনের ভেতরে সবাই বুঝতে পারবে।একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম ওর গর্ভের দিকে,ভাবতেই অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে আমার সন্তান বড়ো হচ্ছে ওখানে।নাহ,ভাইয়া সুস্থ হলে আর দেরী করবো না আমি।সবাইকে সবটা খুলে বলবো।এই নিষ্পাপ শিশুটা যেনো আমার পরিচয়ে পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হতে পারে,ও তাজ ভাইয়ের মতো একটা নোংরা মানুষের সন্তান হিসেবে এই পৃথিবীতে আসুক আমি চাই না।)
—ভাইয়াকে সুস্থ হতে দাও,তারপর আমি একটা ব্যবস্থা করছি।আর কারোর সাথে কোনো অন্যায় হবে না,তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো।আমাদের সন্তানের সাথে তো নয়ই।
শিমুশ আপু আমার কথা শুনে যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।এরপর ডাক্তারের সাথে কথা বলে আমরাও বাড়িতে চলে আসলাম।আবার কাল সকালে যাবো।বাড়িতে পৌঁছে প্রথমে আম্মার ঘরে যাই,তার সাথে কথা বললাম।সবার মুখ মলিন।মনে হচ্ছে এর থেকে হাসপাতালে থাকাই ভালো ছিলো,অন্তত সবার মলিন মুখ দেখতে হতো না এভাবে।পুরো বাড়ি জুড়ে একরকম শোকাবহ অস্থির পরিবেশ আমার দম বন্ধ করে দিচ্ছে।
–
–
–
রাতের বেলা।রিংটোন এর আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো।স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি আব্বা কল করেছে।ফোনটা রিসিভ করি।
—কিরে, তোরা কোথায়?
—আমরা তো বাড়িতে চলে এসেছি আপনি কোথায়?
—আমি একটু হাসপাতালে এসেছি।পথে গাড়ি খারাপ হয়েছিলো তাই ফিরতে এতো দেরী হলো।
—আপনি কি এখন বাড়ি আসবেন?
—নাহ,এখন অর ফিরে কি করবো।তোরা কাল সকালে আসবি না আবার?
—হুমম,আমরা সবাই সকালে হাসপাতালে আসছি।আপনাকে কষ্ট করে এখন আর বাড়িতে আসতে হবে না।
আব্বার সাথে কথা বলতে বলতে জানালার দিকে চোখ পড়লো আমার।পূর্ণিমার আলোতে বাহিরের সবকিছু মোটামুটি দেখা যাচ্ছে।হঠাৎ খেয়াল করলাম কেউ যেনো একটা সামনের দিকে হেঁটে গেলো।ফোনটা রেখে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।হ্যাঁ,সত্যিই তো।কেউ একটা হেঁটে বাগানের দিকে যাচ্ছে।আমি আর বিন্দুমাত্র দেরী না করে রুম থেকে বেরিয়ে যাই।তারপর বাগানের দিকে এগোতে থাকি।এই বাগানের পাশ দিয়ে রাস্তা বয়ে গেছে।দিনের বেলাতে এই জায়গা গিয়ে গাড়ি চলাচল করে।বাগানের কাছাকাছি আসতেই যা দেখতে পেলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না।একটা মেয়ের হাতে ধারালো ছুঁড়ি।ছুড়ির অগ্রভাগে রক্তের দাগ স্পষ্ট।মনে হচ্ছে সেই ছুড়িটা যেটা দিয়ে ভাইয়াকে জখম করা হয়েছিলো।মেয়েটা মাটি খুঁড়ে ছুড়িটা তার নিচে চাপা দিয়ে রাখলো।আমি লুকিয়ে লুকিয়ে সবটা দেখলাম।কাজ শেষ করে মেয়েটা আমাদের বাড়ির দিকে ফিরলো।তারপর চারপাশটা তাকিয়ে হেঁটে আসতে থাকে।একটু কাছাকাছি আসতেই আমার মনের সন্দেহ সঠিক প্রমাণিত হলো।
—হে খোদা, যা ভেবেছিলাম,এটা তো প্রাচী!
চলবে….
#একটি_রাতের_গল্প
পর্ব—১৮
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
প্রাচী চারদিকে তাকাতে তাকাতে বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়।আমি গিয়ে ওর সামনে দাঁড়ালাম।আমাকে দেখে যেনো ও আকাশ থেকে পড়লো।
—একি,পল্লব তুমি এখানে?
(ও কন্ঠে ভয় আর আতংকের ছাপ স্পষ্ট)
—খুব ডিস্টার্ব করে ফেললাম তাই না,
—তুমি এখানে কি করছো?
—এইযে তুমি ছুরিটা মাটির নিচে লুকালে সেটাই দেখলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।ভাগ্যিস আব্বার ফোনকলটা এসেছিলো রাতে,নয়তো এতো সুন্দর একটা মোমেন্ট যে মিস হয়ে যেতো।
প্রাচী আবারো সামনের দিকে পা বাড়ালো।আমি পেছন থেকে খপ করে ওর হাতটা চেপে ধরি।
—কোথায় যাচ্ছো শুনি,আজ আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না তুমি?
—আমায় ছাড়ো বলছি,
আমি প্রাচীর বাহুদুটো শক্ত করে ধরে একটা গাছের সাথে চেপে ধরি।ও চোট পেয়ে আঁতকে উঠলো।আমি ওকে প্রশ্ন করি।
—বলো,এই ছুরিটা কিসের?যা তোমাকে এতো রাতে এসে মাটির নিচে লুকোতে হলো।
—আমি কিছু জানি না,বিশ্বাস করো।ছেড়ে দাও আমায়।
—একদম চালাকি করার চেষ্টা করো না প্রাচী।আমায় মিথ্যে বললে আজ এখানেই শেষ করে ফেলবো তোমায়।কেউ বাঁচাতে আসবে না।
—প্লিজ ছাড়ো আমায়,তারপর বলছি।
আমি প্রাচীকে ছেড়ে দিলাম।ও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।তারপর গাছের নিচে বসে পড়ে।
—দেখো এখন এসব কান্নাকাটির নাটক করে কোনো লাভ নেই।তুমি ধরা পড়ে গেছো।ভালোয় ভালোয় সবটা স্বীকার করো আমার সামনে।
—বিশ্বাস করো পল্লব,আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলো না,
—ভনিতা না করে যা করার ক্লিয়ারলি বলো।মেজাজ বিগড়ে দিও না আমার।
—তুমি বিশ্বাস করবে তো আমার কথা,আমি জানি হয়তো তুমি আমার কোনো কথা এখন বিশ্বাস করবে না।
—কি হয়েছে আগে বলো,বিশ্বাস করার হলে নিশ্চয়ই করবো।
—এটা কিসের ছুরি অর কোথা থেকে এলো আমি সত্যি জানি না।
—মানে,
—আজ রাতে হঠাৎ করে মাইগ্রেন প্রব্লেম শুরু হয় আমার।তারপর যখন মেডিসিন নেবার জন্য ড্রয়ারটা খুললাম অমনি চমকে উঠি আমি।ড্রয়ারের ভেতরে দেখি একটা রক্তমাখা ছুরি পড়ে আছে।বিশ্বাস করো পল্লব এটা কে রেখেছে আর কেনো রেখেছে আমি কিচ্ছু জানি না।তবে আমি এইটুক বুঝতে পারলাম কেউ হয়তো ফাঁসাতে চাইছে আমাকে তাই আমার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে ছুরিটা আমার ঘরে রেখে গেছে।যাতে আমায় সহজে ফাঁসাতে পারে।
—তারপর কি করলে?
—আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।কি করবো বুঝতে পারছিলাম না।একবার ভেবেছি তোমায় সবটা জানাবো,কিন্তু তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস না করে উল্টো সন্দেহ করো সেই ভয়ে আমি সিধান্ত নিলাম ছুরিটাই লুকিয়ে ফেলবো।এরপর আর দেরী না করে এখানে চলে আসলাম আমি,তারপর কি হয়েছে তুমি তো নিজের চোখেই দেখেছো!
—হ্যাঁ দেখেছি।সবটাই দেখেছি।কিন্তু তুমি যে সত্যি বলছো তার প্রমাণ কি?কেনো হতে পারে না তুমি নিজেকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বলছো আমায়।
প্রাচী আমার কথা শুনে আবারো কাঁদতে লাগলো।আমি ওকে একটা ধমক দেই।
—কী হলো,আবার কান্না করছো কেনো?দেখো তুমি যদি মিথ্যে বলে থাকো এই চোখের জল কিন্তু বাঁচাতে পারবে না তোমায়।
—আমি জানতাম তুমি বিশ্বাস করবে না আমার কথা,আর এখন কিনা প্রমাণ চাইছো?কি প্রমাণ দেবো আমি?
—সেটা তুমিই ভালো করে জানো।
—দেখো তোমার তো সন্দেহ হচ্ছে আমি তোমার ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করেছি কিনা।কিন্তু আমি এমনটা কেনো করবো।ভাইয়ার ক্ষতি করে কি লাভ আমার?তার থেকেও বড়ো কথা এই ছুরিটা যদি লুকোনোরই ছিলো আমি গতকাল রাতেই লুকোতে পারতাম যখন তোমরা কেউ বাড়িতে ছিলে না।বলো তাহলে আজকে রাতের জন্য কেনো অপেক্ষা করলাম আমি,ধরা পড়বার জন্য?এই প্রশ্নের উত্তর দাও আগে।
প্রাচী যে যুক্তি দেখাচ্ছে ফেলে দেবার মতো নয়।ও চাইলে গতকাল রাতেই ছুরিটা লুকিয়ে ফেলতে পারতো।কিন্তু সেটা তো করেনি।কোনো অপরাধী অপরাধ করে তার প্রমাণ এক মূহুর্তও নিজের কাছে রাখতে চাইবে না,সেটাই স্বাভাবিক।তার প্রথম কাজ হলো সেই প্রমাণ লুকিয়ে ফেলা।প্রাচী আসল অপরাধী হলে ও সেটা কেনো করলো না।তবে কি সত্যিই মনের ভয় থেকে কাজটা করেছে।ভাবছি এই মূহুর্তে বাড়ির কাউকে বিষয়টা জানাবো কিনা।সকালে ভাইয়ার জ্ঞান ফিরলে হয়তো সবটা জানা যাবে,সেইটুকু সময় পর্যন্ত না হয় নিজেকে চুপ রাখি।
—দেখো আমি এক্ষুণি কাউকে কিছু বলছি না।তুমি এখন থেকে আমার আশেপাশেই থাকবে।কোথাও যাবে না।কাল সকালবেলা সবাই মিলে হাসপাতালে যাবো আমরা।ভাইয়ার জ্ঞান ফিরলে এমনিতেও প্রমাণ হয়ে যাবে তুমি সত্যি বলছো না মিথ্যে।
—ঠিক আছে।আর ছুরিটা কি করবো এখন?
—চলো এটা তুলে নেই।হতে পারে এটা অপরাধের কোনো শক্ত প্রমাণ।এইভাবে ফেলে রাখাটা ঠিক হবে না।
ছুরিটা মাটি থেকে তুলে আমরা বাড়ির ভেতরে চলে গেলাম।প্রাচী যাই বলুক না কেন,ওর ওপর থেকে সন্দেহের ছায়া বিন্দুমাত্র দূর হয়নি আমার।কাল সকাল না হওয়া পর্যন্ত কিছুতেই একা ছাড়া যাবে না ওকে।কারণ যে একবার অপরাধ করে ফেলে তার পক্ষে পরবর্তীতে হাজারওবার অপরাধ করা সম্ভব।
প্রাচীর সাথে আমিও ওর ঘরে গেলাম।ও আমাকে দেখে বেশ অবাক হয়।
—একি,তুমি এখানে?
—আমি আজ রাতে এখানেই থাকবো।
—মানে?
—মানে কিছু নয়,আমি সকাল না হওয়া পর্যন্ত এখান থেকে যাচ্ছি না।
—দেখো এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।
—ভয় নেই,আমি তোমার কোনো ক্ষতি করবো না।এই সোফায় শুয়েই রাত কাটিয়ে দিতে পারবো।তুমি গিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ো।
—কেউ তোমায় আমায় একঘরে দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।কেনো বুঝতে পারছো না।
—আর আমি আজ তোমায় একলা ছেড়ে দিলে আরোও বড়ো সর্বনাশ হবে না তার কি নিশ্চয়তা আছে।
—তুমি আমার সাথে একদম ঠিক করছো না।
প্রাচী গিয়ে ওর বিছানায় শুয়ে পড়লো।আমি সোফায় নিজের আধিপত্য বিস্তার করে নিলাম।তারপর ঘরের লাইটটা অফ করে দেই।
একটু পরে কারোর উপস্থিতির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো আমার।একটা হাত আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।পূর্ণিমার আলো কাচের জানালা দিয়ে ঠিকরে পড়াতে ঘরের ভেতরটা বেশ আলোকিত হয়ে আছে।আমি চোখ মেলে তাকিয়ে বেশ অবাক হই।
—একি প্রাচী তুমি?
—হ্যাঁ,আমি?
—তুমি এসেছো কেনো?
—চলো বিছানায় গিয়ে শুবে।তোমার ঠান্ডা লাগছে।
—কিন্তু সেটা কি ঠিক হবে।
—কোনো ভুল হবে না।তুমি চলো আমার সাথে।
প্রাচী আমার হাত ধরে ওর বিছানার কাছে নিয়ে গেলো।ঘুমের রেশ তখনো পুরোপুরি কাটেনি আমার।প্রাচী আমাকে বিছানার এক পাশে শুইয়ে দিলো।তারপর ও গিয়ে অপর পাশে শুয়ে পড়ে।আমাদের দুজনের মাঝখানে বিস্তর ব্যবধান।প্রাচী আমার গায়ের ওপরে ওর চাদরটা টেনে দিলো।তারপর চাদরের শেষ প্রান্ত দিয়ে নিজেকে আবৃত করে।সত্যি বলতে বেশ ঠান্ডা পড়েছে বাইরে।সকাল পর্যন্ত সোফার ওপর শুয়ে থাকলে আমার কি হতো নিজেই জানি না।
–
–
–
–
এরপর সকালবেলা।ডাক্তার সাহেবের ফোন পেয়ে আমরা সবাই মিলে হাসপাতালে গেলাম।জানতে পেরেছি ওর জ্ঞান ফিরেছে।যদিও এখন পর্যন্ত কথা বলতে পারছে না।পুলিশ যেকোনো সময় আসবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য।
আমি, আম্মা, আব্বা, ভাবী, প্রাচী, শিমুল আপু সবাই ভাইয়ার কেবিনে।একটু পরে পুলিশ চলে আসলো।পুলিশ অফিসার ভাইয়াকে প্রশ্ন করে।
—দর্পণ সাহেব,আমরা জানি এই সময়ে আপনার পক্ষে কথা বলা সম্ভব নয়।আমরা চাই যতো দ্রুত সম্ভব এই কেসের সূরহা হোক,তাই আপনাকে কিছু প্রশ্ন করছি।যতোটা সম্ভব আমাদের কো-অপারেট করুন।
ভাইয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে পুলিশ অফিসারের দিকে।ও পুলিশের সব কথা শুনতে ও বুঝতে পারছে।কিন্তু নিজের মুখ থেকে শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না।
—গতকাল রাতে আপনার ঘরে কে এসেছিলো, কিছু বলতে পারবেন?হ্যাঁ,মুখে বলা সম্ভব না হলে আমাদের অন্য কোনোভাবে বুঝিয়ে দিন।আপনাকে খু ন করতে কে এসেছিলো ঘরে?
পুলিশের কথা শুনে ভাইয়া নিজের হাতটা উঁচু করে।তারপর আঙ্গুল গিয়ে ইশারা করে।
—হ্যাঁ,বলুন।আপনি কি বুঝাতে চাইছেন,অপরাধী এখানেই আছে?আপনি আমাদের তাকে আইডিনটিফাই করতে সাহায্য করুন।
ভাইয়া সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের আঙ্গুলটা আমার দিকে তাক করলো!পুলিশ সন্দেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাতে থাকে।ভাইয়ার এই কান্ড দেখে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
চলবে…..