একটি_রাতের_গল্প,পর্ব-২১,২২

0
1879

#একটি_রাতের_গল্প,পর্ব-২১,২২
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

আমরা সবাই দৌড়ে দর্পণ ভাইয়ার ঘরে গেলাম।ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পাই ভাইয়া মেঝেতে পড়ে আছে।কাছে গিয়ে ভাইয়াকে তুলে আবারো হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।লক্ষ্য করছি ভাইয়ার হাত পা এখনো কাঁপছে।ভাইয়া কথা বলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু বরাবরের মতো ব্যর্থ হলো।কিছুতেই বুঝতে পারছি না ও কি বলতে চাইছে।ভাইয়াকে রুমে রেখে আবারো গেটের সামনে গেলাম আমরা।তাজ ভাইয়া এখনো দাঁড়িয়ে আছে,তার সাথে শিমুল আপু।

—এবার বলো তাজ ভাইয়া,তুমি এতো রাতে কেনো এসেছো আমাদের বাড়িতে?
(আমি তাজ ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করি।)

—আমি বলছি ও কেনো এসেছে এখানে?

—তোমার থেকে আমরা কিচ্ছু শুনতে চাই না শিমুল আপু।আজ যা বলার তাজ ভাইয়া বলবে!

—ঠিক আছে বলছি আমি,দেখো আমি শিমুলকে এটাই বুঝাতে এসেছিলাম ও যেনো সব ভুলে আবারো আমার সংসারে ফিরে যায়।বিশ্বাস করো ওকে আমি মেনে নেবো,ওর সন্তানকেও মেনে নেবো।

আমি ভালো করেই বুঝতে পারছি তাজ ভাইয়া মিথ্যে বলছে।ও যে মন মানসিকতার মানুষ তাতে অন্য কারোর সন্তানকে মেনে নিতে পারে না।এটা হতেই পারে না।তাজ ভাইয়া মিথ্যে বলছে অথচ শিমুল আপু চুপ করে আছে তার মানে এই মিথ্যাচারের সামিল শিমুল আপুও।ওরা দুজনেই আমাদের সাথে হয়তো গেম খেলছে।এর আগেও ওদের দুজনের ভেতরে যে একটা কমিউনিকেশন টার্ম আছে তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছি।আমি তাজ ভাইয়াকে বললাম।

—তুমি যে সত্যি বলছো তার প্রমাণ কি তাজ ভাইয়া,আর হঠাৎ করে তোমার ভেতরে কেনো এতো মহানুভবতার উদয় হলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

—বিশ্বাস করো পল্লব,আমি নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি।

—তোমার কোনো কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয়।আমি তোমাদের দুজনের কাউকে বিশ্বাস করি না।

—পল্লব,তুই আমাকে ওর জন্য অবিশ্বাস করছি।আমি ভাবতে পারছি না।(শিমুল)

—তোমাকে আর কিছু ভাবতে হবে না।এবার যা করার আমিই করবো।

—কি করবি তুই?

আমি আর কোনো কথা না বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলাম।তাজ ভাইয়া একটু পরে চলে যায়।




পরের দিন সকালবেলা।আমি ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে রেডি হতে লাগলাম।ভাবী নাস্তা নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়ে।

—একি,তুমি কোথাও যাচ্ছো নাকি?

—হ্যাঁ,এখন নাস্তা খাবো না।নিয়ে যাও এগুলো প্লিজ।

—কিন্তু এতো সকালে যাচ্ছো কোথায়?

—থানায় যাবো একটু!

—থানায়?কেনো জানতে পারি।

—এই মুহূর্তে থানায় আমার আর কি কাজ থাকতে পারে প্রাচীর সাথে দেখা করা ছাড়া।

—ওহ,তার মানে ওর কথা মনে আছে তোমাদের,

—মনে কেনো থাকবে না ভাবী?

—তোমরা বিনা অপরাধে আমার বোনটাকে জেলে আটকে রেখেছো,তোমরা বিশ্বাস নাই করতে পারো।আমি আমার বোনকে এখনো বিশ্বাস করি ও এমন কাজ করতে পারে না।

—আমি জানি ভাবী,এই ব্যপারটা নিয়ে তোমার আমাদের প্রতি খুব আক্ষেপ।আমিও চাই প্রাচী নির্দোষ প্রমাণিত হোক,যদি ও নির্দোষ হয়ে থাকে।

—তোমার এখনো সন্দেহ আছে ওর ওপর,তাই না?

—আমি নিজের চোখে যা দেখেছি তাই বিশ্বাস করেছি।এখানে সন্দেহ করার কোনো অবকাশ নেই ভাবী।

ভাবী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নাস্তাগুলো নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।আমি ভাবীর মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি,যার একমাত্র ছোটো বোন লকাপে আটকে আছে সে আর যাই হোক ভালো থাকতে পারে না।তার ওপর ভাইয়ার এই অবস্থা।যাই হোক তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আমি থানার দিকে রওয়না হলাম।থানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় একঘন্টা লেগে গেলো।প্রথমে আমায় কিছু সময় বাইরে বসিয়ে রাখা হয়, তারপরে কল আসে।থানার লোকজন সময় নির্ধারণ করে দিলো,মাত্র দশ মিনিট কথা বলতে পারবো প্রাচীর সাথে।একজন কনস্টেবল আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলো।তারপর সেখান থেকে প্রাচীর সেলের সামনে।

প্রথমে বুঝতে পারিনি আমি।প্রাচী বিপরীত দিকে ফিরে মেঝেতে বসে আছে।ওর চুলগুলো বড্ড উসকো খুশকো।আমি মৃদু স্বরে পেছন থেকে প্রাচীকে ডাক দিলাম।ও আমার আওয়াজ শুনে ধীরে ধীরে ফিরে তাকায়।ওকে প্রথম ঝলক দেখেই বুকটা যেনো মোচড় দিয়ে উঠলো আমার।এটা কাকে দেখছি চোখের সামনে,এই প্রাচী আর আগের প্রাচীর ভেতরে আকাশ পাতাল ব্যবধান।চেহারার সেই আগের জৌলুস,মুখের হাসি সবকিছু সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে।আগের থেকে শুকিয়েছেও অনেকটা।এমন অবস্থায় কোনোদিন ওকে দেখতে হবে এটা ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগছে। যদি কখনো এটা প্রমাণিত হয় প্রাচী নির্দোষ আমি কিকরে নিজেকে ক্ষমা করবো জানিনা।প্রাচী শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছে,ওর মুখ থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না।তাই আমিই প্রথমে মুখ খুললাম।

—কেমন আছো প্রাচী?
(প্রাচী আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না।)

—কি হলো,আমার সাথে কি কথা বলবে না?

—তোমার সাথে সব কথা চুকে গেছে আমার।এখন নতুন করে কি বলতে চাও।

—আজ আমায় একটা সত্যি কথা বলো,তোমার একটা উত্তরের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।প্লিজ ফিরিয়ে দিও না আমায়।

—কি কথা বলো,

—মনে আছে তোমাকে একদিন আমার কিছু ছবির কথা বলেছিলাম,তুমি কি সত্যিই তার বিষয়ে কিছুই জানো না?

—তুমি কি আমার কাছে এইগুলো জিজ্ঞেস করতে এসেছো?

—হ্যাঁ।আর আমার ভাইয়াকে কে খুন করতে চেয়েছিলো বলো,সবাই যেটা সন্দেহ করছে তাই সত্যি?এই দুটো প্রশ্নের উত্তর দাও আমার।

–আমি যা বলবো বিশ্বাস করবে তো,

—হ্যাঁ,নিশ্চয়ই করবো।

—বলো,আমার উত্তর শুনে তুমি আমায় আর কোনো প্রশ্ন করবে না।সোজা এখান থেকে চলে যাবে।

—হ্যাঁ, তুমি যা চাইছো তাই হবে।তুমি দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।আমার মনের সকল সন্দেহ দূর করো।

—হ্যাঁ,তোমার ঐ ছবিগুলোর বিষয়ে আমি সবটা জানি।ওগুলো আমিই তুলেছি।আর তোমার ভাইয়াকেও আমি খু ন করতে চেয়েছিলাম।।

প্রাচীর কথাগুলো যেনো কিছু সময়ের জন্য থমকে করে দিলো আমায়।কেনো জানি না ওর কথাগুলো বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।ঘোর কাটতেই ওকে আবারো প্রশ্ন করি।

—কি,কি বললে তুমি?

—তুমি বলেছিলে প্রশ্নের উত্তর পাবার পরে আর একটাও কথা বলবে না।চলে যাও এবার।

এই বলে প্রাচী আবারও ঐদিকে ঘুরে নিজের জায়গায় নিয়ে বসে পড়লো।আমার কোনো কথাই কানে তুলছে না ও।ইতিমধ্যে আমার নির্ধারিত সময়ও শেষ।অগ্যতা বেরিয়ে আসতে হলো।

জেল থেকে ফিরে সোজা বাড়ি চলে আসলাম।সারাটাদিন প্রাচীর কথাগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো।এখনো বুঝতে পারছি না ও কি কথাগুলো সত্যি বললো,নাকি যা বলেছে আমার ওপর অভিমান থেকে।গতকাল রাতের ঘটনার পরে প্রাচীকে কেনো জানি না নির্দোষ মনে হচ্ছে আমার,মনে হচ্ছে আমরা সবাই ভুল রাস্তায় হাঁটছি।সেই কারণে আজ দেখা করতে যাই ওর সাথে।ও যদি একটি বার বলতো আমায় ও নির্দোষ আমি ওকে জেল থেকে বের করার চেষ্টা করতাম।কিন্তু দুর্ভাগ্য সেটা আর সম্ভব হলো না।




রাতের বেলা।
সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আমি জেগে আছি।কিছুতেই ঘরের ভেতরে ভালো লাগছিলো না।ভাবলাম একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসলে হয়তো মনটা হালকা হবে।এই ভেবে ছাদের দিকে পা বাড়ালাম।সাথে একটা টর্চ নিয়ে গেলাম।আমাদের ছাদের রেলিংএল একটা পাশ পুরোপুরি ভাঙা।অন্ধকারে হাঁটাচলা করা বেশ বিপজ্জনক।ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠতেই দেখি দরজাটা খুলে রেখেছে কেউ।সাধারণত আমরা রাতে ছাদের দরজা বন্ধ করে রাখি।আজ খোলা কেনো জানি না।হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে আসলো আমার কানে।ছাদে কেউ আছে মনে হচ্ছে।ধীরে ধীরে পা বাড়াতে লাগলাম আমি।একটু সামনে আসতেই এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য আমার চলার গতি থামিয়ে দিলো।ভাঙা রেলিং এর পাশে দর্পণ ভাইয়া হুইল চেয়ারে বসে আছে।ওর দুপাশে দুজন দাঁড়িয়ে।তারা ওকে ঠেলে নিচে ফেলে দেবার জন্য উদ্যত হচ্ছে!

চলবে….

#একটি_রাতের_গল্প
পর্ব—২২
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।

—দাঁড়াও,আমি তোমাদের ধরে ফেলেছি।শিমুল আপু,তাজ ভাইয়া তোমাদের খেলা শেষ।

আমার কথা শুনে বাড়ির অন্যরাও ছাদে চলে আসলো।শিমুল আপু তার তাজ ভাইয়াকে একসাথে দেখে সবাই অবাক।

—শিমুল,তুমি দর্পণকে এখানে নিয়ে এসেছো কেনো,আর এই লোকটা আবার এসেছে এই বাড়িতে?(ভাবী)

—বুঝতে পারছো না ভাবী,কেনো এসেছে।ওরা দর্পণ ভাইয়াকে এখান থেকে ফেলে দিতে চেয়েছিলো।

—কি হচ্ছে এখানে এসব আমরা তো কিছুই বুঝতে পারছি না।পল্লব বাবা কি হয়েছে বল আমাদের।(আম্মা)

—এক্ষুণি বুঝতে পারবে কী হচ্ছে এখানে।শিমুল আপু,তাজ ভাইয়া তোমরা আমাদের ট্রাপে ফেঁসে গেছো।এবার ভালোয় ভালোয় সত্যিটা স্বীকার করো।

—তুই আমাদের ভুল বুঝছিস পল্লব,আসলে সেরকম কিছু না।(শিমুল)

আমি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম।

—ভাইয়া,তুই বলবি নাকি সবটা আমিই বলবো।

আমার কথা শুনে হুইল চেয়ার থেকে উঠে আসলো।ওকে সুস্থ অবস্থায় দেখে সবাই স্তম্ভিত।

—একি দর্পণ,তুই সুস্থ হয়ে গেছিস?কিন্তু এটা কিকরে হলো।(আম্মা)

—আমি বলছি আম্মা।ভাইয়া তো সুস্থ গতকাল রাতেই হয়েছিলো।মনে আছে আমরা সবাই ভাইয়ার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম।ঠিক তখন!

—তাহলে তখন সবটা জানাস নি কেনো আমাদের?

—যাতে আসল অপরাধী হাতে নাতে ধরতে পারি আমরা।আমরা জানতাম ভাইয়াকে ক্রমশ সুস্থ হতে দেখে শিমুল আপু আর ওর পার্টনার ঘাবড়ে যাবে।ওরা কখনোই চাইবে না ভাইয়া সুস্থ হয়ে উঠুক।ওরা আবারো ভাইয়ার সাথে সেটাই করবে যেটা আগেরবার করেছিলো।

—হ্যাঁ,আমাকে খুন করার চেষ্টা প্রাচী করে নি।তার পেছনে শিমুল আর ওর স্বামীর হাত ছিলো।ওরা আমাকে পুরোপুরি মেরেই ফেলতে চেয়েছিলো কিন্তু ওদের দুর্ভাগ্য আমি বেঁচে যাই।
(ভাইয়া বললো)

—আমি ঠিক জানতাম আমার বোন কোনো অন্যায় করতে পারে না।দর্পণ আমায় একটা কথা বলো,তুমি প্রাচীকে কেনো ফাঁসালে,সেদিন হাসপাতালে যখন পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসে তুমি এদের ধরিয়ে দিলে না কেনো?
(ভাবী ভাইয়াকে প্রশ্ন করে)

–ভয়ে,আমার মনের ভয় আমাকে মিথ্যে বলতে বাধ্য করেছিলো!

—ভয়,কিসের ভয়?

—তোমরা যখন সকালে হাসপাতালে আমায় দেখার জন্য আসলে মনে আছে তো শিমুল আগেই আমায় দেখার জন্য আসে।সেদিন ও আসলে আমায় দেখতে আসেনি।আমায় ব্ল্যাকমেইল করতে আসে।ও আমায় ভয় দেখায় যদি আমি সত্যিটা পুলিশকে জানিয়ে দেই তবে ওর লোক আমাদের পরিবারের সবাইকে শেষ করে দেবে।এর আগেও নাকি ও একবার প্রাচীকে খুন করতে চেয়েছিলো।কিন্তু ভাগ্যক্রমে প্রাচী বেঁচে যায়।ওর কথা শুনে প্রচন্ড ভয় পেয়ে যাই আমি।ওর কথামতো প্রাচীকে ফাঁসিয়ে দিলাম আমি।বিশ্বাস করো সিমরান আমার ঐ সময়ে এছাড়া আর কোনো উপায় ছিলো না।আমি যা করেছি তোমাদের সবাইকে বাঁচানোর জন্য।

—সব বুঝলাম আমরা।কিন্তু শিমুল দর্পণকে কেনো খুন করতে চেয়েছিলো,ওর দর্পণের সাথে কি শত্রুতা?

—আমি বলছি আম্মা।দর্পণ ভাইয়া ওকে আর তাজ ভাইয়াকে একসাথে দেখে ফেলেছিলো।আর ওদের সমস্ত প্ল্যানের ব্যপারেও জেনে গিয়েছিলো।তাই ওদের দর্পণ ভাইয়াকে মেরে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় ছিলো না।সবাই ভাবছো তো কিসের প্ল্যানের কথা বলছি আমি।শোনো তবে।

শিমুল আপু আর তাজ ভাইয়ার ভীষণ পারিবারিক অস্বচ্ছলতা চেয়ছিলো।ওরা চেয়েছিলো কিভাবে অনেক টাকা উপার্জন করা যায়।আর তার জন্য আমাকেই মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে।শিমুল আপু আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে,আমাকে বাধ্য করে ওর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক করতে।আমি রাজিও হলাম।শিমুল আপু তখন আমাদের সেই ঘনিষ্ঠ মূহুর্ত রেকর্ড করে যাতে পরবর্তীতে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা আদায় করতে পারে।কিন্তু ওদের দুজনের কপাল এতোটাই খারাপ ছিলো ভিডিও রেকর্ডার ক্যামেরাটা বাড়ির গেটের সামনে ফেলে যায়।আর সেটা অন্য কারো হাতে পড়ে।(আমি জানি সেই ভিডিও রেকর্ড ভাবীর হাতে পড়েছিলো,আর ভাবীই আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতো। কিন্তু ভাবীর সম্মান বাঁচানোর জন্য আর সেই প্রসঙ্গ তুললাম না।ভাবী যেহেতু নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেছি,আমি চাইনা সে সবার সামনে অসম্মানিত হোক।)শিমুল আপুদের সমস্ত প্ল্যান ভেস্তে গেলো।এরপর শিমুল আপু জানতে পারে ও সত্যিই অন্তঃসত্তা।ও কখনোই আমার সন্তানের মা হতে চায় নি, চেয়েছিলো আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে।কিন্তু হয়তো সৃষ্টিকর্তা এটাই চেয়েছিলো,শিমুল আপুর গর্ভে আমার সন্তান আসে।ওদের এদিক থেকে লাভই হয় একপ্রকার।শিমুল আপু আর তাজ ভাইয়া নতুন করে প্ল্যান করে কিকরে এই সন্তানকে কাজে লাগিয়ে আমার সম্পত্তি হস্তগত করা যায়।ভাইয়া ওদের এই সমস্ত প্ল্যান জেনে গিয়েছিলো,পরিশেষে ওরা ভাইয়াকেই সরিয়ে দেবার কথা চিন্তা করে।ভাইয়া গতকাল আমায় সবটা খুলে বলেছে।আমিই ওকে বলি দুটো দিন অপেক্ষা করতে,যাতে এদের হাতে নাতে ধরতে পারি।

—এবার বুঝতে পেরেছি ওরা আমার বোনটাকে কেনো ফাঁসিয়েছে,প্রাচীর সাথে তোমার বিয়ে হলে ওদের যে স্বার্থসিদ্ধি হতো না।(ভাবী)

—একদম ঠিক।এর আগেও প্রাচীর ড্রয়ারে ছবি লুকিয়ে(ঐদিন রাতে তাজ ভাইয়া বাহির থেকে আমাদের অন্তরঙ্গ মূহুর্তের ছবি তোলে,সেগুলো প্রাচীর ঘরে লুকিয়ে আমার সন্দেহের দৃষ্টি ওর দিকে ঘোরাতে চেয়েছিলো)ওর ঘরে ছুরি লুকিয়ে রেখে ফাঁসানোর চেষ্টা করে।আর সেটাই হয়।বেচারী প্রাচী শুধু এদের জন্য আজ জেলে বিনা দোষে শাস্তি ভোগ করছে।

শিমুল আপু আমাদের কথা শুনে সবার সামনে কান্না জুড়ে দিলো।

—বিশ্বাস কর পল্লব, আমি তোর সাথে এমনটা করতে চাইনি।কিন্তু তাজ আমাকে বাধ্য করে।ওর প্ররোচনায় আজ আমার এই অবস্থা।

—আমরা জানি,যা হয়েছে তাতে তাজ ভাইয়া দোষী,ঠিক তেমনি তুমিও সমান দোষী।তোমার ভেতরে যদি লোভ না থাকতো কিছুতেই তাজ ভাইয়াকে সঙ্গ দিতে না তুমি,ওকে সাপোর্ট করতে না।তাই এখন কেঁদে কোনো লাভ নেই।নিজেদের অপরাধের শাস্তি ভোগ করার জন্য প্রস্তুত হও।






এরপর পুলিশ এসে শিমুল আর তাজকে গ্রেফতার করে।প্রাচীকে ছেড়ে দেওয়া হলো।ভাইয়া আদালতে সাক্ষী দিলে আদালত শিমুল আপু আর তাজ আপুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দন্ডিত করে।কারাগারের ভেতরেই শিমুল আমার মেয়ে সন্তানের জন্ম দেয়।আমরা ওকে বাড়িতে নিয়ে আসি।ততোদিনে প্রাচীর সাথে বিয়ে হয়েছে আমার।আমার আর শিমুলের মেয়েকে ও নিজের কোলে তুলে নেয়।আমার নামের সাথে মিলিয়ে আমাদের মেয়ের নাম পল্লবী রাখা হলো।এর একবছর পরে প্রাচীর গর্ভে সন্তান আসে।আমাদের ছোটো মেয়ের নাম প্রজ্ঞা রাখা হয়।নামটা ভাবীই রেখেছে পছন্দ করে।ভাবী এখন পুরোপুরি শুধরে গিয়েছে,দর্পণ ভাইয়ার সাথে বেশ ভালো আছে সে।আমি প্রথম প্রথম শিমুলের সাথে দেখা করার জন্য যেতাম,কিন্তু ও দেখা করতে চাইতো না আমার সাথে।জানি না, কিসের জন্যে।হয়তো একটা সাংঘাতিক অনুশোচনাবোধ কাজ করে ওর ভেতরে,তাই ও আমাকে ফেইস করতে ভয় পায়।আবার অন্য কোনো কারণও হতে পারে।হতে পারে আমার ওপরে ওর ক্ষোভ এতটুকু কমেনি।তবে যাই হোক না কোনো আমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চাই নিজের অতীতকে ভুলে যেতে।আর সেটাই আমার প্রশান্তি।বাড়িতে আমার দুই মেয়ে পল্লবী আর প্রজ্ঞা ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।আমিও পড়াশুনা শেষ করে চাকরি নিলাম।



এরপর কেটে যায় বিশটি বছর।



বাসরঘরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে পল্লবী।একটু পরেই ওর হাসবেন্ড পারিজাত এসে ভেতরে ঢুকলো।ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দিলো ও।তারপর ধীরে ধীরে স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায়।তারপর ঘোমটাটা টেনে নামানোর চেষ্টা করতেই পল্লবী ওকে বাঁধা দেয়।পারিজাত হেসে বললো –

—কি হলো,আমি কিন্তু সবটা জেনেই বিয়ে করেছি তোমায়।তারপরেও কিসের এতো সংকোচ।দেখো তোমার চেহারা যেরকমই হোক না কেনো।কিছু আসে যায় না আমার।আমি তোমার সুন্দর মনটা দেখে বিয়ে করেছি তোমায়।আর কখনো কারোর সামনে নিজের চেহারা নিয়ে লজ্জিত হবে না কেমন!

পারিজাতের কথা শুনে পল্লবীর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।তারপর ও মৃদু স্বরে পারিজাতকে বলে।

—তোমার মনটা সত্যিই ভীষণ বড়ো,নয়তো এরকমভাবে কেউ ভাবতে পারে।জানি না কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলাম তোমায়,আমি এই কারণে সৃষ্টিকর্তার কাছে চিরঋনী হয়ে থাকবো।উনি আমাকে তোমার মতো একজন স্বামী দিয়েছেন।

এই বলে পল্লবী পারিজাতের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।পারিজাত ওর হাতটা শক্ত করে ধরে।আজ থেকে কয়েক মাস আগে এক রাতে পল্লবী,ওর বাবা মা পল্লব আর প্রাচী বাড়িতে ফিরছিলো।পথিমধ্যে ওদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যায়।বাধ্য হয়ে হাঁটতে শুরু করে ওরা তিনজন।হঠাৎ কোনো আততায়ী এসে পল্লবীর মুখে এ সি ড ছুঁড়ে মারে।তারপর পালিয়ে যায় সে।এসিডের তীব্র যন্ত্রণায় রাস্তার মাঝেই ছটফট করতে থাকে পল্লবী।ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে পল্লবীকে বাঁচানো গেলেও ওর মুন্ডমন্ডলের অনেকটা জায়গা পুড়ে যায়।পল্লবী নিজের সৌন্দর্য চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলে।এরপর কয়েকমাস পরে পারিজাতের সাথে পরিচয় হয় ওর।পারিজাত সবটা জেনেশুনেই ওকে বিয়ে করতে রাজি হয়।নিজেদের বড়ো মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে পল্লব আর প্রাচীও আপত্তি জানালো না।পল্লবী আজও জানে না,সেইদিন রাতের অজ্ঞাত ব্যক্তি কে ছিলো।কে ওর এতো বড়ো একটা সর্বনাশ করলো,আর কিসের জন্য।তবে এখন যেনো পারিজাতকে পেয়ে নিজের দুঃখের দিনগুলো ভুলতে বসেছে ও।পল্লবী আর পেছনে ফিরে তাকাতে চায় না,পারিজাতের হাত ধরেই বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চায়।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে স্বামীর বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো পল্লবী।


এরপর সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গে ওর।চারদিকে তাকিয়ে দেখে পারিজাত রুমে নেই।হয়তো হাঁটতে গিয়েছে।পল্লবী বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।হাত পা কেনো জানি ভীষণ ব্যথা করছে ওর।মাথাটাও ঘুরছে হালকা।মনে হচ্ছে এক্ষুনি পেইন কিলার না নিলে হচ্ছে না।কিন্তু এই ঘরে পেইন কিলার কোথায়।আশেপাশে খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ ঘরের দরজার দিকে নজর পড়লো পল্লবীর।একটা চাবির থোকা পড়ে আছে।নিশ্চিত এটা পারিজাতের।ও হয়তো ভুলে চাবির থোকাটা এখানে ফেলে গেছে।পল্লবী ভাবলো ড্রয়ারের ভেতরে পেইন কিলার থাকলেও থাকতে পারে।এর আগে খোলার চেষ্টা করেছিলো একবার,কিন্তু লক করে রাখার কারণে খুলতে পারেনি।এখন যেহেতু চাবি পেয়ে গেছে হাতে তাই আর কোনো বাঁধা নেই।
ধীরে ধীরে ড্রয়ারের দিকে এগিয়ে গেলো পল্লবী।ড্রয়ারটা খুলতে দেখতে পায় ভেতরে কয়েকটা পেইন কিলার।যাক,পাওয়া গিয়েছে তাহলে।পেইন কিলারগুলো হাতে নিয়ে ড্রয়ারটা অফ করতে যাবে ঠিক তখন একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়লো ওর।ড্রয়ারের শেষ প্রান্তে একটা শিশি।দরজার দিকে একবার ঘুরে তাকিয়ে শিশিটা বের করে আনে পল্লবী।

—হে খোদা।এটা তো কোনো এসিডের শিশি।আর শিশিতে কর্ক নেই!
ঠিক ছ মাস আগে এরকম আকৃতির একটা শিশি দিয়েই পল্লবীর ওপর এ সি ড ছোঁড়া হয়েছিলো।ওর এখনো স্পষ্ট মনে আছে।আর ঐ সময় সেই অজ্ঞাতব্যক্তি ভুল করে তার কর্কটা ফেলে রেখে যায়,আশ্চর্যজনকভাবে এই শিশিটাতেও কর্ক নেই!

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here