দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -১
শানজানা আলম
“মণি, তোকে রেনু চাচী খুঁজছিলো সকালে, একটু দেখা কইরা আয় তো!” কলেজ থেকে ঘরে ঢুকতেই রেবেকা বললেন মণিকে।
রেবেকার শরীরটা ভালো না কয়েকদিন। খাওয়ায় রুচি নেই। আগুনের আঁচে কষ্ট হয়। ও বাড়ি থেকে যা ই দিক, রেবেকার মুখে খুব স্বাদ লাগে। গত সপ্তাহে বরইয়ের গুড়ে ডুবানো বয়ামটা পুরোটা দিয়ে দিলো। মণি মুক্তা ছুঁয়েও দেখেনি৷ রেবেকা বয়াম নিয়ে বসে মুখে পুরেছেন।
মণির মুখ কালো হয়ে গেল, ও বাড়িতে সচারাচর যেতে ইচ্ছে করে না। রেনু চাচী খোঁজা মানে তার কোন ব্লাউজের বোতাম খুলে গেছে, লাগাতে হবে, অথবা রাতের তরকারি বেচে গেছে, সেটা দিয়ে দিবে। ফেলে দিলে হয় কিন্তু সে ফেলে দিবে না। মণিকেই ডেকে ধরিয়ে দিবে। বিরক্তিকর বিষয় হচ্ছে মা আবার সেই তরকারি সোনামুখ করে খেয়ে ফেলেন। মণি, মুক্তাকেও সাধাসাধি করেন। যদিও ওরা কেউ খায় না।
-পরে যাচ্ছি মা, বলে মণি জামাকাপড় নিয়ে পেছনের পুকুরপাড়ের দিকে চলে গেল। বেশি বড় না, ছোট্ট একটা পুকুর, টলটলে স্বচ্ছ জল। জলের তলায় পুটিমাছের ছোটাছুটি দেখা যায়। কলেজ থেকে ফিরে এখানে মণি ঘন্টাখানেক থাকে।
-এই মণি, তোকে না সকালে খবর পাঠিয়েছিলাম, আসিস নাই ক্যান? -জিজ্ঞেস করছেন রেনু নিজেই, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন পুকুরের পাড় লাগোয়া কাঁটাতারের বেড়ার অপর দিকে, বেড়া তাদেরই দেওয়া। মণিদের হাঁস মুরগী তাদের উঠান নোংরা করে, তাই আটকানোর জন্য কাঁটাতার, জাল দিয়েছিলেন, জাল কিভাবে যেন বিলুপ্ত হয়ে গেছে, অবশিষ্ট আছে কাঁটাতার।
-চাচী কলেজ থেকে আসছি মাত্র, গোসল করি, খাই, তারপরে আসি?
-তোদের গোসল মানে তো একঘন্টা! আসবি কখন আর, তরকারিটা ফেলে দিলাম, সকালে আসলে নিতে পারতি, ইলিশ মাছের মাথা আর বেগুনের ঝোল ছিল রাতের।
মণির মনে হলো, জিজ্ঞেস করে, কেন, বাসী তরকারি সবসময় কেন দিতে হবে! কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারলো না।
পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা মণিদের ঘর। কাঠের দোতলা করা। সামনে একটা কাগজফুলের গাছ। মণির বাবার বাজারে মুদি দোকান আছে। পাশের বাড়িটা আশরাফ সাহেবের। রেণুর বর, জাহেদ আর রুমির বাবা। তিনি পারিবারিক ভাবেই অবস্থাসম্পন্ন। দোতলা বিল্ডিং করা। নিচটা টকটকে লাল সিমেন্টের মেঝে, বাড়ির সামনে লম্বা বারান্দা করা। আর তিনি এ্যাডভোকেট, জেলাসদর কোর্টে প্রাকটিস করেন।
সামাজিক এবং আর্থিক অবস্থানে দুটো পরিবারের পার্থক্য অনেক, তবুও পাশাপাশি থাকার সুবাদে সম্পর্কটা বেশ ঘনিষ্ঠ। তবে রেনু সবসময়ই বুঝিয়ে দেন, তারা টাকাওয়ালা পরিবার আর মণিরা গরীব। অবস্থা ভালো না। মণির মাও তাদের অদ্ভুত সমীহ করে চলে।
ও বাড়িতে মণির যেতে ভালো লাগে না। লাগেনা সত্যি না, জাহেদ ভাই থাকলে ভালো লাগে। কিন্তু জাহেদ ভাই খুব একটা থাকেন না। ঢাকায় পড়াশোনা করেন। কিচ্ছু ভালো না লাগা এ বাড়িতে জাহেদ ভাইকে ভালোলাগার কোন কারণ মণি খুঁজে পায়নি। তবুও ভালো লাগে। জাহেদের অবশ্য তেমন কোন ভালো লাগা-টাগা নেই। দেখা হলে, কেমন আছো মণি, এ পর্যন্তই থামে।
রুমি আপাও খারাপ না। এক রেনু চাচীই একটু কেমন যেন! জাহেদের দাদী খোদেজা বেগমও খারাপ না, বয়স হয়ে গেছে, চোখে কানে দেখে শোনে না, পেছনের বারান্দায় থাকেন,মণি গেলে চোখ পিটপিট করে বলেন, ক্যাডায়, মনোয়ারের গ্যাদা নাকি!
মণি পুকুরে নেমে ডুব দিয়ে উঠলো। জামা কাপড় নিয়ে টিনের আটকানো গোসলখানায় গিয়ে ভেজা কাপড় পাল্টে নিলো। মা ভাত নিয়ে বসে আছে। খাবার একপদের তরকারী, পুইশাকের পাশে ছোট ছোট ট্যাংরা মাছ। খিদে ছিলো, মণি চুপচাপ খেয়ে নিলো, এমনিতেও সে ঝামেলা করে না। ঝামেলা করে মুক্তা। প্রতিবেলায়ই যে তরকারি থাকবে, সেটা তার খেতে ইচ্ছে করবে না।
-মণি, যা একটু ওই ঘরে, চাচী ডাকছে!
-মা, দুইবার বইল্যা ফেলছো, যাবো তো! খাইয়া নি!
-যা মা, কি জানি দিবে মনে হয়!
-মা রেনু চাচী কোনদিন ভালো কিছু দেয় না, তবু তুমি এমন ভাব করো, যেন কতো কিছু দিতেছে।
মণির মা লজ্জা পেলেন, তবুও কেউ কিছু দিলে তার খুব ভালো লাগে। মণি মনে হয় আনতে চায় না, পোলাপান মানুষ, বয়স কম!
মণি গেল তখন আসরের আযান দিয়েছে। রেনু নামাজ পড়ে উঠলেন। মণির দিকে তাকিয়ে বললেন, এতক্ষণে আসলি, তোদের তো বড় নাক উঁচু, আমি দিতে চাইলেও তোদের নিতে মন চায় না।
মণি কোন কথা বললো না। রেনু বললেন, শোন, আমার সাথে কয়টা পিঠা বানায়ে দিবি রাত্রে। রুমিকে দেখতে আসবে কালকে। এইজন্য ডাকছিলাম।
আর ফ্রিজ খুলে দেখ, একটা বাটিতে চারটা মিষ্টি আছে, ওইটা নিয়া যা।
খোদেজা বেগম কথা শুনে উঠে বসলেন, ক্যাডা, মনোয়ারের বেটি নাকি?
-জ্বী দাদীবু, আপনের শরীর ভালো?
-আর ভালো, কব্বরে এক পাও দিয়া আছি!!
-কি যে বলেন দাদীবু!
রেনু বললেন, এত আস্তে বললে শুনবে না, জোরে বল কাছে যাইয়া।
মণি কাছে গিয়ে বসলো। খোদেজা বেগম গায়ে মাথায় হাত দিয়ে বললো, মাইয়াটা লক্ষীমণ্ত, জাহেদের বউ কইরা আনো বউ!
রেনু হা হা করে উঠলেন, যেন জাহেদের বিয়ে হয়েই গেলো।
চিৎকার করে বললেন,
-আপনের যেমন কথা আম্মা , মাথাডা একছের গ্যাছে নাকি, যারে তারে পাইলেই আপনে জাহেদের বিয়া দেন!!
মণি লজ্জা পেয়ে উঠে চলে গেল। জাহেদ ভাইকে বড় ভালো লাগে কিন্তু সেও তার মায়ের মতোই নাক উঁচু। খুব একটা মিশতো না। মণির সাথে কথাই বলেছে হাতে গোণা কয়েকবার মাত্র।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মণির মনে হলো, সত্যি সত্যি জাহেদ ভাইয়ের সাথে তার বিয়ে হয় যদি! তাহলে কেমন হবে!
এই বাড়িতে তার আসতেই ইচ্ছে করে না, তখন এই বাড়িটা তার হবে! ধূর্, কি সব ভাবছে মণি।
ভাবনার কোন মাত্রা নেই! কেন যে এসব চিন্তা মাথায় আসে!
(চলবে)