দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -৫,০৬,০৭
শানজানা আলম
০৫
রেণু চাচীদের রান্নাঘরে বেশ হাসাহাসি শোনা যাচ্ছে। মনি বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের এত বড় বিপর্যয়ে কারো কিছু আসে যায় না। সব সমস্যা তাদেরই। পৃথিবীটা এমন। কারো কোনো বিপদআপদে খুব কম মানুষের আসে যায়।
মুক্তা জিজ্ঞেস করেছিল, আপা, স্কুলে যাব?
মনি বলেছে, যা।
কেউ কিছু বললে?
বলবে, বলুক। চুপ করে থাকবি।
রেণুচাচী কিছুক্ষণ পরে বের হয়ে এলেন। মনিকে দেখে বললেন, ভেতরে যাইস নাই ক্যান! কখন আসছ?
মনি কিছু বলল না।
রেনু চাচী বললেন, শোন মনি, এখন দুনিয়ার মানসে হাবজাব বলবে। তোর বাপ করছে হারামির মত কাম। এত কিছু কানে নিলে মা টা মরবে। বাপ তো আগেই তালই হইছে, এখন মা মরলে কই যাবি। মুক্তা তো ছোটো মানুষ। তুই তোর মায়েরে দেখবি। এখন যা, টেবিলের উপর নাস্তা ঢাকা দিয়া রাখছি, নিয়া মায়েরে খাওয়া। না খাইতে চাইলে নিয়া আইসা আম্মার বিছানায় শোয়াইয়া রাখ। তোর বাপ যা মন চায় করুক।
মনি আস্তে বলল, চাচী, আম্মা আসবে না এখন।
আচ্ছা, আসার দরকার নাই। মাইয়াডার বয়স কেমন? কম মনে হইল?
জানি না চাচী, দেখি নাই।
আমার নাস্তা খবরদার তোর বাপ আর ওই বেটিরে খাওয়াবি না কইলাম। দুপুরেও রান্ধন লাগবে না। মায়েরে সামলা।
কষ্টেও মনির হাসি পেলো। এই রেনু চাচী, এত খারাপ মানুষ মনে করে মনি তাকে, মা শুধু চাচীরে ভালো জানত। সেই পাশে দাঁড়াইল। কেমন বাচ্চা পোলাপানের মত বলতেছে, আমার রান্না ওগোরে দিবি না। যেন কোনো অবুঝ বাচ্চা নিজের খাবার মাকে অন্য কাউকে দিতে না করেতেছে।
এমনি সময় মনির নিতে খারাপ লাগত, কিন্তু আজ খারাপ লাগছে না। ভালোবাসার দান মানুষ আলাদা করতে পারে।
ঘর থেকে ভাত, ডাল, ডিমের একটা বাটি আর একটা প্লেটে রুটি ভাজি নিয়ে মনি বের হচ্ছিল। জাহেদ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো তখনি। গতকালই তাকে দেখে লজ্জা লাগছিল, রাতেও মনে হয়েছে মানুষটা কী ভাববে, অথচ এখন এসব কিছু মনে হচ্ছে না। অনেক দূরের মানুষ সে। কী ভাবল না ভাবল এসবে এখন আর আসে যায় না মনির। আব্বা যা করছে, তার পরে মনি আর কোনোভাবেই আগের চিন্তা করতে পারবে না।
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -৬
মনি চলে যাচ্ছিল। জাহেদ ডাকল, মনি একটু শোনো।
মনি দাঁড়িয়ে পড়ল।
-তোমার বাবা যা করেছে, সেটার দায় তার একার। তুমি অবশ্যই এর জন্য ছোটো হয়ে থাকবে না, মাথা নিচু করবে না।
মনি কিছু বলল না।
জাহেদ আবারও বলল, প্রতিটি মানুষ আলাদা, তাদের জীবন বোধ, চিন্তা চেতনা সবই আলাদা, প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের কোনো কাজের দায় বাবা মায়ের থাকা উচিত না, আর বাবা মায়ের অন্যায়ের দায় সন্তানের তো নয়ই।
মনির বলতে ইচ্ছে হলো, আমাকে এত কিছু কেন বলছেন! কিন্তু আজ কথা বের হলো না৷
জাহেদ বলল, ঠিক আছে যাও।
মনি চলে গেল নিশ্চুপে। বাড়িতে গিয়ে দেখে, মা উঠে পেছনের বারান্দায় বসেছে। পাশের বাড়ির দুইজন মহিলা পাশে। আর আব্বা সামনে থেকে গলা খাকারি দিচ্ছে একটু পর পর। মনি কিছু শুনেও শুনলো না।
আম্মা চাচী তোমারে রুটি ভাজি পাঠাইছে। খাও।
আগত মহিলাদের একজন বললেন, এহন কী খাওন গলা দিয়া নামব!
মনি বলল, নামবে না ক্যান। যা করার আব্বায় করছে, আমাদের কী দোষ! সে খাইতে পারলে আমরাও পারব।
মনির আব্বা বাড়ির পাশ দিয়ে থেকে ঘুরে পেছনে এসে দাঁড়ালেন৷
মনির মা, একটা ভুল করছি, তোমার সংসার তোমারই থাকব, ওরে আমি ওর বাপের বাড়িতেই রাইখা আসব।
তুমি একটু শান্ত হও। মাইয়াটা খায় নাই এহন পর্যন্ত। এদিকে তোমরা খাইতে বসছ। কি মনে করবে মানুষজন।
মনি বলল, বাড়তি নাস্তা নাই। আপনে মন্টুর হোটেল দিয়া পরোটা মিষ্টি আনেন। আমি দিতেছি।
মনির কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক শুনে মনোয়ার সাহস করে বলল, অরে ডাইকা আইনা বসা মা। আমি আনতেছি নাস্তা পানি।
কেউ কোনো কথা বলল না। মনির আব্বা ঘরে উঠে গিয়ে ভেতর দিয়ে খিল খুলে দিলো।
শোনা গেল, নতুন বউকে বলতেছে, আসো, ভেতরে আসো। আমার মাইয়াগুলা খুবই লক্ষী। তোমারে কিছু বলবে না৷
মনির মা নিঃশ্বাস ফেলল, ওরে আল্লাহ রে!
মনি বলল, আম্মা, আহাজারি বন্ধ করো। চুপচাপ খাও। ওনারে ওনার মতো থাকতে দাও। আমরা বেশি কানলে এলাকার মানুষ পাইয়া বসবে।
মুক্তা এসে দাঁড়িয়েছে।
-মুক্তা, ভাত খা। খাইয়া স্কুলে যা।
মুক্তা কোনো উচ্চ বাচ্য না করে প্লেটে ভাত নিয়ে খেতে বসল। খাবারের সাথে রাগ করা চলে না। কেউ ডেকে খাওয়াবে না এরপর।
মনি রুটির প্লেটটা মায়ের হাতে দিলো। রেবেকা রুটি ছিড়ে মুখে দিলো। ডিম ভাজা, পেপে আলুর সবজিতে গিলা কলিজা দেওয়া, বিলকিস রানছে মনে হয়। ওই বাড়ির খাবারের মজাই আলাদা। নিজের সংসার গেছে, না সংসার যায় নাই, এতদিনের সংসার এত সহজে সে ছাড়বে না। গেছে স্বামী। অভাবী মানুষের কাছে খাবার এক আজব জিনিস। সামনে ভালো খাবার আসলে রাগ দুঃখ অনুভূতি কেমন হালকা হয়ে যায়।
মনি খেতে পারলো না। কেমন গা গুলিয়ে আসছে। আব্বা হোটেল থেকে সুজির হালুয়া পরোটা ভাজি নিয়ে এসেছে। মনি ঠান্ডা মাথায় সেসব প্লেটে করে নতুন বউ আর আব্বাকে দিলো। তারা এখন মধ্যঘরে বসা। মেয়েটির এখনো চোখে মুখে পানি পড়েনি।
এই প্রথম মেয়েটি মনিকে বলল, আমি একটু “বাইরে” যাব।
“বাইরে” মানে টয়লেট বোঝায়। মনি বলল, আসেন।
পুকুর পাড়ে যেতে যেতে মেয়েটি সবকিছু তাকিয়ে দেখছিল।
মনির ইচ্ছে হলো জিজ্ঞেস করে, এত কম বয়সে আব্বার মতো বয়স্ক মানুষের সাথে বিয়া বসলেন কেন! কিন্তু কিছুই জিজ্ঞেস করা হলো না। মেয়েটি টয়লেটে গেল, বের হয়ে চোখে মুখে কল টিপে পানির ঝাপটা দিলো।
মনি পুকুরের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, রাতারাতি জীবনটা কী অনেকটা পাল্টে গেল? নাকি সব স্বাভাবিক আছে!
চলবে
শানজানা আলম
দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -৭
মনোয়ার মিয়া দোকান থেকে পরোটা মিষ্টি নিয়ে এসেছে। নতুন বউকে পরোটা মিষ্টি দেওয়া হলো। মণি খেয়াল করে দেখল, মেয়েটি খুব গুছিয়ে খেয়ে নিলো। খিদে আছে মনে হয়৷ দুটো পরোটা শেষ করার পরে মণি জিজ্ঞেস করল, আরেকটা দিব?
সাবিনা হ্যা সূচক ঘাড় নাড়ল।
রেবেকা রান্নাঘরে পিঁড়ি পেতে বসেছে। আশপাশের দুয়েকজন আসছে, তাদের সাথে বড় করে নিঃশ্বাস টেনে কথা বলছে। মুক্তাকে জোর করেই মণি স্কুলে পাঠিয়ে দিলো।
পাশের বাড়ির রাঙ্গা দাদী এসে বসে পান চিবুতে চিবুতে বলছেন, ব্যাডা মানু, বিয়া করছে, ভালো হইছে, জেনা তো আর করে নাই। নাইতে তোমার নাই গতর, ব্যাডাগো খাউজ কী এত সহজে কমে? কমে না। শুকরিয়া করো, ঘরেই আইছে।
কান ঝিম ঝিম করে উঠল মণির। নতুন বউ বেশি কথা বার্তা বলছে না। কিন্তু মেয়েটিকে খারাপও মনে হচ্ছে না। দুপুরের ভাত চড়াতে হবে। রেনু চাচী হয়তো সবার জন্য ভাত দেবেন না। মেয়েটি তো দুপুরে খাবে। আর শুধু দুপুরে কেন, এখন তো প্রত্যেক বেলায়ই খাবে।
কথা হয়েছিল, সাবিনাকে তার বাড়িতে রেখে আসবে মণির বাপ৷ কিন্তু সে-রকম কোনো লক্ষন দেখা গেল না। মনোয়ার মিয়া দোকানে চলে গেল সকালের নাস্তার পরে।
মেয়েটি জড়োসরো হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ।
মনি বলল, আপনারে নিতে আসবে কে?
কেউ না।
কেই না? আপনেরে না নিয়া যাবে শুনলাম?
আপনের আব্বায় আমার মামারে জুয়ার চালে চল্লিশ হাজার টাকা দিছিল। সেই টাকার জন্যেই আমাগো বাড়ি যাইতো কেলি কেলি, টাকা না দিয়া আমারে বিয়া দিয়া দিছে মামা। যামু কই? মামা তো বিয়া দিয়া দায় সারছে।
মনি বুঝতে পেরে জিগ্যেস করল, আপনে দেখেন নাই আব্বা বয়স্ক মানুষ!
দেখছি।
তার সংসার আছে জানতেন না?
মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। জানত না।
মণি বুঝল এই মেয়ে এখানেই থাকবে। আব্বা সংসারে টাকা না দিলেও মানুষকে টাকা দিয়ে বেড়ায়। একটা কথা মনি আরো বুঝতে পারছে, নরম হয়ে থাকাটাও এই জগতে দোষের।
দুপুরে রেনু চাচীর ঘর থেকে খাবার এলো। নতুন বউ তখন শাড়ি পাল্টে জামাকাপড় পরে নিয়েছে। রেবেকা মাথায় তেল পানি দিয়ে মধ্যঘরে বসেছে। তাকে মণি খাইয়ে দিয়েছে। রেনু ভাবী কাতলা মাছের তরকারি আর জালি চিংড়িমাছ পাঠিয়েছিল। বেশ খানিকটা ভাত খেয়ে রেবেকার দুঃখ কষ্ট কমে আসছে।
নতুন বউ আর মণি খেতে বসেছে। মণি ভাত রান্না করেছিল আর একটা ডিম ভেজে এনেছে। রেনু চাচী সকালে নিষেধ করেছ খাবার যেন নতুন বউ আর আব্বাকে না দেওয়া হয়। সকালে দেয় নি কিন্তু এইবেলায় দুজন খেতে বসে তাকে তরকারি না দিয়ে পারা যায় না। মণি বাটি থেকে বড় মাছের তরকারি দিতেই মেয়েটির মুখ ঝলমল করে উঠল।
রেবেকা তাকিয়ে খাওয়া দেখছে। এখন মেয়েটিকে তার সতীন মনে হচ্ছে না৷ মনে হচ্ছে কোনো অতিথি এসেছে, যাকে নিয়ে মণি খেতে বসেছে।
মুক্তার জন্য মাছ রেখে মণি ডিমভাজা নিলো৷ মনি মাছ নেয়নি দেখে মেয়েটি নিজের মাছ ভেঙে মনিকে দিলো। রেবেকার এখন মনে হচ্ছে এই মেয়ে অতিথি না। মনির আগে তার একটা বাচ্চা মারা গিয়েছিল, সেই বাচ্চা বড় হয়ে এসেছে৷ রেবেকার ঘুম ঘুম পাচ্ছে৷ মাথার ভেতরটা কেমন দপদপ করছে। খাওয়া দাওয়া করার পরেও মনে হচ্ছে কিছু একটা খেতে মন চাইছে।
মণি খাওয়া শেষ করে উঠার সাথে সাথেই একটা আওয়াজ হলো ধপ করে। কিসের আওয়াজ সহসা মণি বুঝতে পারলো না।
চলবে