দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১৮,১৯,২০

0
806

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে-১৮,১৯,২০
শানজানা আলম
১৮

মনি অনেক দিন পরে কলেজের জন্য বের হলো। এত পরিচিত রাস্তা কেমন অপরিচিত লাগছে, বোরকা পরা তবু মনে হচ্ছে সবাই তার দিকে তাকিয়ে দেখছে। বোরকাটা নতুন। বিলকিস দিয়ে গেছে৷ রুমি আপা দিয়েছে সম্ভবত। রুমি আপার বিয়ের অনুষ্ঠান আটকে আছে। এই সব ঝামেলায় বিয়ের কথা হলেও বিয়েটা এখনো হয় নি। হয়তো ছয় মাস পরে হবে। আচ্ছা ছয় মাস পরে মনি কোথায় যাবে, নিজেদের ঘরে সব কিছু এখন বেদখল। মুক্তা এসে কান্না কাটি করে৷ ওকে নাকি খেতে দেয় না ঠিক মতো। মনিকে যত্ন করে খাওয়াতো কিন্তু মুক্তার প্রতি তেমন মায়া দরদ দেখায় না মেয়েটা। কারণ হতে পারে৷ মুক্তা পাড়া বেড়িয়ে ওনার নামে আজে বাজে কথা বলে বেড়ায়। কি অদ্ভুত বিষয়!

মনি বলেছে, তুই কারো জন্য বসে থাকবি না, কখন খাইতে দেবে। নিজে নিয়ে খাবি।

মুক্তাকে নিয়ে আলাদা একটা বাসা করবে? তালাক হয়ে গেলে মনি কি পাবে? কেন জেদ করল এমন? জাহেদ ভাই বাড়িতে একবারো আসে নি। ওই মানুষটার এত জেদ! মনি কি এতই অস্পৃশ্য! বাড়িতে এলেই কি ওনার ঘরে গিয়ে ঢুকত মনি! আচ্ছা, ওনাকে একদিন ফোন করবে মনি? বাড়িতে আসতে বলবে? না থাকুক ওর সাথে৷ রেনু চাচীর জন্য!

কলেজে গিয়ে অফিস রুমে ঢুকে ফরম ফিলাপের কাজ শেষ করল মনি। তারপর কমন রুমে গিয়ে বসল।
রুমা, সাদেকা সহ তিন চারজন বেঞ্চে বসে গল্প করছিল।
মনিকে দেখেই ওরা নড়ে-চড়ে বসল। সাদেকা বলল,
এই সর, বড়লোক বাড়ির বউ আসছে, বসতে দে!

মনি দূরেই বসেছিল, কোনো উত্তর দিলো না। রুমা নেমে কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছিস?

ভালো।

ফরম ফিলাম করলি?

হুম।

কই থাকিস? শশুরবাড়িতে?

হুম!

তোর স্বামী তো হেভী সুন্দর দেখতে।

মনি উত্তর দিলো না৷

তোরই কপাল, কি সুন্দর জামাই, বড়লোক শশুরবাড়ি পাইয়া গেলি! আবার ধইরাই রাখলি! তালাক দিলি না!

মনি বুঝতে পারলো, এলাকায় সবাই এই কথা জানে।

তোর স্বামী আসছিল?

না।

কই থাকে ঢাকায়? তোরে নিছিল? বাসর হইছে?

মনি উঠে দাঁড়াল।

সাদেকা বলল, বড়লোক বাড়ির বউ, এহন কথার উত্তরও দেবে না।

মনি কিছুই না বের হয়ে গেল। নিজের মোবাইলে জাহেদ ভাইয়ের ফোন নম্বর আছে। সেখান থেকে তাকে কল করবে কিনা! এই দ্বিধা কাটে না। কলেজের সামনে কম্পিউটারের দোকানে ঝোলানো, এখানে প্রাইমারির ফরম ফিলাপ করা হয়। মনি ঢুকে পড়ল। এই ফরমটাও ফিলাপ করে যাওয়া ভালো হবে।

চলবে

শানজানা আলম

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -১৯

ফরম ফিলাপ করে ফেরার পথে আওলাদ মিয়ার সাথে দেখা হলো মনির।
এই, তুমি মনোয়ারের বড় মাইয়াটা না? উকিল সায়েবের পুতের বউ?

-জি চাচা।

-আছ কেমন? স্বামী আসছে বাড়িতে? মিটমাটের ব্যবস্থা হইল?

-ভালো আছি চাচাজি।

আর কিছু বলল না মনি।

শোনো, তোমার যে ছোটো বোন মুক্তা, ওরে দেখছি ওপারের একটা বখাইটটা পোলার লগে কই যেন যায়। তুমি মানি লোকের বউ, মান সম্মান গেলে তোমার শ্বশুর বাড়িতে টেকা দায় হইবে। খেয়াল রাইখো। তোমার বাপেরেও কইলাম, তার তো এহন নয়া সংসার! তোমাগো কিছু হইলেও আসে যায় না।

জি আচ্ছা চাচাজি।

মনির মনে হলো, আর কি কি সহ্য করা তার জন্য বাকি আছে! মুক্তার বিপথে যাওয়ার কারণ আছে, সেও তো মুক্তার পাশে থাকে নাই। সুযোগ পেয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিতে নেমে পড়েছে। আজকে কোন মুখে মুক্তাকে শাসন করবে!

তবু রাতে একবার বুঝাতে হবে, আজ রাতে ওই ঘরে থাকতে হবে, মনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।

ফিরতে ফিরতে দুপুর। দুপুর বেলা এই বাড়িতে সবাই ঘু্মায়। সামনের দরজার খোলার কেউ নেই, পেছনের দরজাও বন্ধ। মনি নক করতে সাহস পেলো না।

কিছুক্ষণ পুকুরঘাটে বসে থাকার পরে বিলকিস এসে ডেকে নিলো ঘরে। বেলা গড়িয়ে বিকেল, খাওয়ার রুচি নেই। তবু ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে রেনু চাচী সামনে এলেন৷

ফরম ফিলাপ হইছে তোর?

মনি ঘাড় নাড়ল। তারপরে বলল, চাচী, আজকে ওই ঘরে থাকতে যাব।

ক্যান, ডাকছে?

না।

তাইলে?

মনি ইতস্তত করে বলে ফেলল, মুক্তা নাকি কোন বখাইটটা ছ্যাড়ার সাথে ঘোরে। ওর সাথে একটু কথা আছে।

কে বলছে?

আওলাদ চাচা দেখছে।

হুম, আচ্ছা, যাইস।

একটু থেমে রেনু জিজ্ঞেস করলেন, ছয় মাস হইতে তো আর বাকি নাই। জাহেদ তো আসলই না এদিকে। কি করবি এরপরে? ওই বাড়িতে থাকবি? টাকা পয়সা না হয় দিলাম আমরা?

মনি উত্তর দিলো না। জাহেদ ভাই এতটা নিষ্ঠুর হয়ে যেতে পারে, মনি কল্পনাও করে নি। কোথাও একটা আশা ছিল হয়তো ওর দিকে মন ফিরতেও পারে। সত্যিই তো, কি করবে এরপরে? আব্বা তো জায়গা দিলেও কথা শুনাবে, সেই তো ফিরলি, আগে আসলে জমি জায়গা পাওয়া যাইতো!

রাতে মনি যাওয়ার আগেই ওই ঘর থেকে চিৎকার ভেসে এলো, মনি যেতে চাইলেও রেনু বললেন, আগে বিলকিস দেখে আসুক। তারপরে যাইস৷

বিলকিস দেখে এসে খবর দিলো, মুক্তাকে কচার ডাল দিয়ে মনির বাপ মেরেছে। পিঠে দাগ পড়ে গেছে। এমন শক্ত মেয়ে, এক ফোঁটাও কাঁদে নি!

মনি কারো আদেশের অপেক্ষা না করে বের হয়ে গেল এবার।

চলবে

শানজানা আলম

দূরে তুমি দাঁড়িয়ে -২০

মুক্তার জ্ঞান নেই। সাবিনা নির্লিপ্তভাবে রান্নাঘরে কিছু কাজ করছে। মনির আব্বা ঘরে নেই। মনি পিঠ থেকে কামিজ সরিয়ে মারের দাগ দেখল।

সাবিনা এসে দাঁড়ালো পাশে।

মনি সম্বোধন না করে বলল, আপনের অনেক রাগ মাইয়াটার উপ্রে? আব্বারে আটকান নাই!

সাবিনা বলল, আমার শইল ভালো না। আটকাইতে গেলে যদি আমারে ধাক্কা দেয়! আপনের আব্বার রাগ মেলা!
আর সে তো নির্দোষ না। কি না কি করছে, আপনে তো খোঁজ রাখেন না!

মনি জোরে বলল, আমি খোঁজ রাখি না, আপনে রাখেন? আপনের কোনো দায়িত্ব নাই? বয়স কম দেইখা সব কিছু মাফ? মাইয়া মইরা গেলে?

সাবিনা আবারো কিছু হয় নি, এমন ভাবে বলল, মরবে না। মাইয়া লোকের জান এত সহজে যায় না।

মনি বলতে গিয়েও থেমে গেল, আমার মা? আমার মা রে তো বাড়িতে ঢুইকাই কব্বরে পাঠাইছেন।

মনি পানির ছিটা দিয়ে মুক্তাকে তুললো। জ্বর এসে গেছে, মুক্তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেল তারপর। মেয়েটা হাঁটতে পারছে না। ফেরার পথে মনে হলো, কই যাবে মনি? রেনু চাচীর বাড়ি? নাকি বাপের ঘরে? দুইটার একটা জায়গাতেও তারা গ্রহণযোগ্য না, নিজেদের কিছুই নেই তাদের। এই পৃথিবীতেই দুই বোন একদম একা, এতিম!

নিজেদের ঘরেই ঢুকলো মনি। বিলকিস তখনি এলো। রেনু চাচী মুক্তাকে নিয়ে যেতে বলেছে। মনি বলল, আজকে সে এই ঘরেই থাকবে। সব ছেড়ে দিয়েছে বলেই আজ এই দশা তার!

সাবিনা রান্নাঘরে ছিল। রাতের খাবার জোগাড় করছিল। মনি ঘরে ঢুকে মধ্যঘরের বিছানার চাদর বালিশ তুলে ফেলে দিলো। পেছন থেকে নিজেদের খাতা বালিশ নিয়ে এসে নতুন করে বিছানা করে মুক্তাকে শুইয়ে দিলো।

সাবিনা এসে বলল, এই বিছানে ক্যান?

মনি বলল, আমরা এখন হইতে এইখানে থাকব।

তাইলে আমি কই শোব?

সেইটা আব্বায় আসলে জিগাইয়েন।

মনি কিছু না বলে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল ডিমের তরকারি, ভাজি রান্না হয়েছে, একটা গামলায় ভাত তরকারি তুলে এনে মুক্তাকে খাওয়ালো। ওষুধ খাইয়ে দিয়ে মশারী টানিয়ে দিলো।

মনির আব্বা এসে দেখলো সব। সাবিনা কিছু বলতে গেলে হাতের ইশারায় নিষেধ করে দিলো।

সাবিনা সামনের বারান্দার চৌকিতে ঘুমের ব্যবস্থা করল।

মনি ঠিক করল, রেনু চাচীর বাড়িতে আর থাকবে না। এখন থেকে সে এই বাড়িতেই থাকবে। মনে হয় না ওই বাড়ি থেকে কেউ নিষেধ করবে। করলোও না। মনি নিজেদের বাড়িতে থাকা শুরু করল। কলেজে যাওয়া আর সেই সাথে প্রাইমারির পরীক্ষার জন্য পড়া।

দেখতে দেখতে ছয় মাস কেটে গেল।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here