মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১

0
1355

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১
#মৌলী_আখন্দ

সকাল সকাল যখন টিপ টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল আনান তখনই বুঝে নিয়েছিল আজকের দিনটা একটা বাজে দিন হতে যাচ্ছে। ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকে ডিপার্টমেন্টের সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই এক ঝলক প্রবল দমকা বাতাস বইল।
আর সেই বাতাসে উড়ে উলটো হয়ে গেল আনানের হাতে ধরা ছাতাটা। শুধু তাই না, মট মট শব্দে মনে হয় ছাতার শিকও ভাঙল একটা দুটো।
এই টিপ টিপ বৃষ্টিতে ছাতা না খুললেও চলত। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আনানের মাথার তালুতে দুএক ফোঁটা বৃষ্টির পানি পড়লেই হাঁচি শুরু হয়ে যায়।
সাইনুসাইটিসের সমস্যা আছে তার। সামনে স্টুডেন্টের পরীক্ষা।
রিস্ক নেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। তাই সে ছাতাটা খুলে মাথায় ধরেছিল।
কে জানত এমনটা হবে? আনান যখন বাতাসে উড়ে উলটো হয়ে যাওয়া ছাতাটা সোজা করবার ব্যর্থ চেষ্টা করছে তখনই একটু দূর থেকে শুনতে পেল সম্মিলিত হাসির শব্দ।
চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হলো জিসানের সাথে। বরাবরের মত সিঁড়িতে বসে আছে গ্যাঙের মধ্যমণি হয়ে।
হাসতে হাসতেই বলল, “তোর এই মুঘল আমলের স্যাম্পলটা কোন মিঊজিয়াম থেকে টুকায়ে আনলি?”
জবাব দিল না আনান। ছাতা ঠিক করবার বৃথা চেষ্টা বাদ দিয়ে হেঁটে গেল ক্লাসরুমের দিকে।
জিসানদের এই দলটার সামনে বরাবরই নিজেকে খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ মনে হয়। আর ওরাও সারাক্ষণ তার পেছনে লেগে থাকে।
আনান খুব ভালো করেই জানে যে ওয়েভার না পেলে তার পক্ষে এই ভার্সিটিতে পড়া সম্ভব হতো না। কিন্তু যে ব্যাপারটা সে জানত না তা হচ্ছে এখানে আসার পর এই বড়লোকের পোলাপানদের সাথে টিকে থাকা এতটা কঠিন কর্ম হবে তার জন্য।
না ওরা কেউই ছাতা আনে না, আনবার প্রয়োজনই পড়ে না। ওরা সরাসরি গাড়ি থেকে নামে, ওদের মাথায় বৃষ্টির আঁচ লাগে না।
কি রোদ কি বৃষ্টি ওরা গাড়ির কাঁচ তুলে দিয়ে এসির বাতাসে ঠাণ্ডা হতে হতেই আসতে পারে, আনানের মত বাস থেকে নেমে বাকিটুকু রিকশায় ঘামতে ঘামতে রোদে পুড়তে পুড়তে কিংবা বৃষ্টির ছাট থেকে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে আসতে হয় না। ওদের গায়ে ঘামের গন্ধও থাকে না, ওদের জুতোয় থাকে না কাদার দাগ।
আনানের মত ওরা কেউ হোস্টেলেও থাকে না। নিজের বাসার রান্না খেয়েই পড়তে আসে।
আনানের দিকে ওদের এত কীসের আক্রোশ কে জানে! বিশেষত জিসান, গত সেমিস্টারের মাঝখানে ঢোকার পর থেকেই আনানের জীবনটা বিষাক্ত করে ফেলছে এই ছেলেটা।
আনানের বেশি পাওয়ারের মোটা কাঁচের ওল্ড ফ্যাশনের চশমা, তেল দেওয়া চুল, পাটের ব্যাগ, সাধারণ ভয়েল প্রিন্ট কাপড়ের সালোয়ার কামিজ ওড়না, কমফিটের স্যাণ্ডেল আর ক্যান্টিনে রঙ চায়ের সাথে পুরি খাওয়া প্রতিটা ব্যাপারে ওর হাসি পায়। শুধু ওর একার হাসি পেলে সমস্যা ছিল না।
দলের বাকিদেরও উস্কানি দেয় ওর পেছনে লাগতে। আনান অবশ্য উত্তর দেয় না কোনো।
আজকে ক্লাস শেষে হিমিকাদের বাসায় যাওয়ার দরকার ছিল তাড়াতাড়ি। সামনে হিমিকার টার্ম এক্সাম।
কিন্তু ক্লাস শেষ হতে হতেই শুরু হয়ে গেল মুষলধারে বৃষ্টি। আনান বারান্দায় এসে দাঁড়াল হতাশ মুখে।
ছাতাটা ভেঙে গেছে, এই বৃষ্টিতে রওনা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। অসুস্থ হয়ে পড়বে ও।
জিসানদের গ্রুপটা হই হই করতে করতে লিফটের সামনে এসে দাঁড়াল। চোখ সরিয়ে নিল আনান।
লিফটে কল দিয়ে সরাসরি ওর দিকে তাকিয়েই বলল জিসান, “আমরা ক্যান্টিনে যাচ্ছি, সামনে পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রামে রিহার্সাল করতে, তুই যাবি?”
আনান উত্তর দেওয়ার আগেই চলে এল লিফট, দরজা খুলে গেল। দলের অন্যরা উঠে গেল লিফটে, জিসান বলতে বলতে উঠল, ‘দেখার ইচ্ছা থাকলে আসিস!”
কিছু বলল না আনান। লিফট বন্ধ হয়ে গেল।
দেখা যাচ্ছে ওপরে উঠছে। লেভেল সিক্সে গিয়ে থামল।
আনান লিফট কল করল। ওর গন্তব্য লেভেল ফাইভ।
বৃষ্টি থামতে থামতে লাইব্রেরিতে গিয়ে কিছুক্ষণ পড়াশোনা করা যাক। লাইব্রেরি ফাঁকাই থাকে প্রায়।
এক কোণে তার প্রিয় জায়গাটায় বসে বাইরের দিকে চোখ রাখল আনান। এখান থেকে ক্যাম্পাসের কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যায়।
বৃষ্টির ঝাপটায় গাছের ডালপালা দুলছে, যেন মৃদু মৃদু বাজনার তালে এলো চুলে হালকা হালকা মাথা দুলিয়ে নাচছে কোনো চপল কিশোরী। আনান কিছুক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে আনমনা হতে হতেও আবার মনকে শাসন করে ফিরিয়ে আনল বইয়ের পাতায়।
এক ঘন্টা পরেও যখন বৃষ্টি ধরে আসার কোনো লক্ষণ নেই তখন আনানের মনে হলো এখন ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ চা খাওয়ার খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই চলে গেছে ওরা।
এখন আর কেউ আনানকে নিয়ে হাসবে না। কিন্তু আজকে আনানের দিনটা সত্যিই খারাপ ছিল।
ও ক্যান্টিনে গিয়ে এক কাপ আদা চা আর দুটো পুরির অর্ডার দিয়ে বসতেই ওর সামনে মূর্তিমান আতঙ্কের মত হাজির হলো জিসান। “এই যে এনি চলে আসছে!”
তার নাম “আনান” কে এরা সংক্ষিপ্ত করে ডাকে এনি। “এনি ঝটপট এক হাজার টাকা ফেল তো!”
“কীসের এক হাজার টাকা?”
“আমাদের প্রোগ্রামের চাঁদা। সবার পনেরশ। তোর মত কিপটার জন্য থার্টি থ্রি পারসেন্ট ডিসকাউন্ট।“
চোখ টিপল জিসান, যেন সে বিশাল কোনো সুসংবাদ দিচ্ছে। ক্যান্টিন বয় এসে আনানের সামনে আদা চা আর পুরির প্লেট নামিয়ে রেখে গেল।
জিসান সেদিকে তাকিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “হ্যাভ সাম কফি ইয়ার! এই বৃষ্টির দিনেই তো কফি খাওয়ার সময়! কফিতেই আসল স্পার্ক! কি নানি দাদির মত লাল লাল মিষ্টি গরম পানি খাস!”
আনান তাকিয়ে রইল জিসানের দিকে। এই ছেলেটার চেহারা এত সুন্দর, কিন্তু যারা ওর সম্পর্কে জানে না তারা কল্পনাও করতে পারবে না সে কী পরিমাণ নিষ্ঠুর।
একটা পুরি তুলে নিয়ে সামনে রাখা প্লেটের সসের মধ্যে ডুবিয়ে কামড় বসাল জিসান। “টাকাটা বের কর!”
আনান ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি প্রোগ্রামে আসব না।“
“টাকা দেওয়ার ভয়ে প্রোগ্রামে আসবি না? আর না আসলেও টাকা দিতেই হবে চান্দু!”
“আমার কাছে এখন টাকা পয়সা নেই।“
“কই দেখি?” বলে আনান কিছু বোঝার আগেই সামনে রাখা আনানের পার্সটা খপ করে তুলে নিল জিসান।
আঁতকে উঠল আনান। পার্সের চেনটা খুলতেই বেরিয়ে পড়ল এক হাজার টাকার একটা নোট।
আনান প্রায় চিৎকার করে বলল, “জিসান প্লিজ! ওটা আমার বাজারের টাকা!”
জিসান মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ!”
আনানের কী করা উচিত ছিল? ঘটনাটা ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই টাকাটা হাতে নিয়ে বিজয়ীর মত চলে গেল জিসান।
তার দুএক মুহূর্ত পরেই একটু দূর থেকে সম্মিলিত হাসির কলরোল উঠল। চা না খেয়েই সজল চোখে বেরিয়ে এল আনান।
তার দোষটা কোথায়, এটাই আজ পর্যন্ত বুঝতে পারল না সে। সে তো ওদের গ্রুপের কারো কোনো ক্ষতি করেনি!
উফ, কেন যে এখন ক্যান্টিনে এসেছিল সে! শুধু শুধু এক হাজার টাকা গচ্চা দিতে হলো!
ডাইনিং এর টাকার জন্য আবার ধার করতে হবে রুমমেটের কাছে, ভাবতে গিয়ে চোখে জল এসে গেল আনানের। চোখ মুছতে মুছতে লাইব্রেরিতে এসে ঢুকল আনান।
বৃষ্টি এখন একটু কমে এসেছে, এখন বের হওয়া যায়। বইখাতা গুছিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে পড়ল আনান।
রিংটা বাজল তখন। স্ক্রিনে তাকিয়ে জিভে কামড় দিল সে।
হিমিকার আম্মু ফোন করেছেন।
“হ্যালো আন্টি, আসসালামু আলাইকুম!”
“ওয়ালাইকুম সালাম! কয়টা বাজে এখন?”
“স্যরি আন্টি! আসলে বৃষ্টি ছিল তো! আমি আসছি এখুনি!”
“এক্সকিউজ দেখানোর জন্য বেতন দেওয়া হয় তোমাকে?”
এই ধরণের বাক্য আনানের কাছে চাবুকের মত লাগে। যেন কেটে কেটে বসছে গায়ে।
সে শুধু সংক্ষেপে বলল, “আন্টি আমি রাস্তায়, আসছি!”
নিচে নেমে আনান দেখল বৃষ্টির আঘাতে ঝরে পড়া কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো ছড়িয়ে আছে ক্যাম্পাসের আঙিনা জুড়ে। নিচু হয়ে বসে কয়েকটা বৃষ্টি ভেজা আহত ফুল কুড়িয়ে নিতে লাগল সে।
প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষের সাথে কিছু অদ্ভুত খেলা খেলে। ঠিক ওই মুহূর্তেই ক্যান্টিনের পাশের জায়গাটায় বসে থাকা জিসান নিচে তাকাল ছয়তলার ওপর থেকে।
তার চোখে পড়ল মফস্বল থেকে আসা সাধারণ মেয়েটা মাটিতে উবু হয়ে বসে ঝরে পড়া ফুল কুড়িয়ে নিচ্ছে। অতি সাধারণ একটা দৃশ্য।
কিন্তু এই সাধারণ দৃশ্যের মধ্যে এমন কিছু ছিল যাতে জিসানের বুকের ভেতরে কিছু একটা নড়ে চড়ে গেল। কথা ছিল আনানকে আজকে সিল দেওয়া হবে অর্থাৎ ওর কাছ থেকে টাকা আদায় করে খাওয়া দাওয়া করা হবে।
কিন্তু জিসান আনানের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া নোটটা লুকিয়ে ফেলল মানিব্যাগের ভেতরের খোপে। গ্রুপের কেউই জানতে পারল না যে গ্রুপে সেদিন খাওয়া দাওয়া হলো ঠিকই তবে আনানের টাকা দিয়ে নয়, জিসানের টাকা দিয়ে।
আমাদের গল্পটা শুরু হলো এখান থেকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here