মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-০৬,০৭,০৮

0
732

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-০৬,০৭,০৮
#মৌলী_আখন্দ
০৬

সেদিন রাতে যথারীতি আগের মতই মেসেজ এলো, “কী করছেন?”
আনান লিখল, “টাকাটা পেয়েছেন?”
“হ্যাঁ পেয়েছি।“
“থ্যাংকস। ভালো থাকুন। আর মেসেজ দেবেন না, কেমন? দিলেই আমি ব্লক করব।“
“ওহ, স্যরি স্যরি, কীসের টাকা? কোনো টাকা পাইনি তো!”
রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেলল আনান।
“না পেলে নাই।“
“কী করছেন এখনো বলেননি কিন্তু।“
“কিছু করছি না। দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়।“
“আমার সাথে কথা বলার জন্য বারান্দায় এসেছেন?”
“আপনি কে যে আপনার সাথে কথা বলার জন্য বারান্দায় আসতে হবে আমাকে!”
“আপনি কি রুমে একাই থাকেন?”
“না, রুমমেট আছে।“
“হোস্টেলে থাকেন আপনি?”
“ঠিক হোস্টেলে না, একটা স্টুডিও এপার্টমেন্টে। কেন বলেন তো? কী করবেন এত কিছু জেনে? কে আপনি?”
“আমি একজন মানুষ, যে আপাতত আপনার বন্ধু হতে চাই।“
“থ্যাংকস। আমার কোনো বন্ধু দরকার নাই।“
“সত্যিই?”
“ঠিক আছে, বাই। আর কথা বাড়াবার প্রয়োজন দেখছি না।“
“এই, শোনেন, শোনেন, ছাতাটা সারিয়েছিলেন? ভেঙে গেল যে সেদিন?”
চমকে উঠল আনান। কে এটা?
“আমার ছাতা ভেঙে গেল, এটা আপনি জানলেন কীভাবে?”
উত্তরে একটা হাসির ইমো ভেসে এলো।
“আপনার নাড়ি নক্ষত্র জানি আমি।“
এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল আনান। “কে আপনি? দূর থেকে আমার ওপরে নজর রাখছেন?”
“দূর থেকে রাখতে হবে কেন? কাছাকাছি থেকেই নজর রাখছি! আপনি আজকে পরেছিলেন একটা ছাই ছাই আর কালো প্রিন্টের জামা, কালো পাজামা আর কালো ওড়না। এত কালো পরেন কেন আপনি? কালারফুল পরতে পারেন না?”
ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আনানের মেরুদণ্ড বেয়ে। কে এটা?
মাথা ঠাণ্ডা করে লিখল, “আমি আর আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না!”
“কিন্তু একদিন এমন দিন আসবে, যেদিন আমার সাথে কথা না বলে আপনি থাকতেই পারবেন না!”
মেজাজ খারাপ করে অফলাইন হয়ে গেল আনান।
কিন্তু বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার পরেও যখন ঘুম এলো না, তখন আবার অনলাইন হয়ে “একলা আকাশ” নামের এই আইডিটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। আইডিতে মানুষটার সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যই নেই।
এমন কিছুই নেই যা থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যায়।
মনে মনে শক্ত হলো আনান। প্রেম করার মত বিলাসিতা আনানের সাজে না।
অপরিচিত কারো সাথে মেসেঞ্জারে কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না। ওপাশের মানুষটি পরিচয় দিলেও নাহয় একটা কথা ছিল।
কী মনে করে আইডিটা ব্লক করল না আনান। তবে ইগনোর লিস্টে ফেলে রাখল।
এরপর এই আইডি থেকে কোনো মেসেজ আসলে আনান সিন করলেও টের পাবে না ব্যাটা।
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুম আসবার আগে পর্যন্ত আনান ভাবতে লাগল সে কি আসলেই খুব নিঃসঙ্গ? আনানের আশেপাশে এমন একজনও নেই যার সাথে তার লাইফ স্টাইল মেলে, যার সাথে দুটো মনের কথা বলা যায়।
আনানদের ভার্সিটিটা রাজধানীর মোটামুটি অভিজাত এলাকায়। আনানের এই ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পেছনে কারণ ছিল দুটো।
প্রথমে ঢাকায় এসে থাকার জায়গা পাচ্ছিল না সে। এই স্টুডিও এপার্টমেন্টে সিট পাওয়ার পর সেটার কাছাকাছি এই ভার্সিটিই ছিল। অন্য সবগুলোতেই যাতায়াত করতে সমস্যা হতো ঢাকায় নতুন বাসিন্দা আনানের।
দ্বিতীয় কারণটা হলো সে যখন ভর্তি হওয়ার জন্য ভার্সিটি খুঁজছিল, তখন সরকারিতে ভর্তি হওয়ার সময় সুযোগ শেষ হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোর খরচ ছিল তার সাধ্যের বাইরে।
সাধ্যের বাইরে খরচ আসলে এটারও, কিন্তু আনানের মত ভালো রেজাল্ট করা স্টুডেন্ট সচরাচর এখানে পড়তে আসে না বলে এখানে ওয়েভারের অফার ছিল। সেই ওয়েভার অর্থাৎ ছাড়টুকু অন্যান্য ভার্সিটিতে গেলে আনান পেত না।
প্রথম বর্ষ শেষ, সেকেণ্ড ইয়ারে উঠেও এখনো আনানের প্রায়ই মনে হয়, এখানে ভর্তি হওয়ার সিদ্ধান্তটা কি আসলে ভুল ছিল? বিশেষ করে জিসান সেমিস্টারের মাঝখানে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তার জীবন বিষ করে ছেড়েছে।
ভার্সিটিতে তার ক্লাসমেট দূরে থাকুক, রুমমেট মালিহা আপুর সাথেও প্রয়োজনের বাইরে কথা বলা যায় না, আপু নিজের চাকরি, নিজের জীবন নিয়েই সব সময় ব্যস্ত আর বিরক্ত। তার মুখে কখনো হাসি দেখেছে কিনা মনে করতে পারবে না আনান।
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতেই কখন যেন ক্লান্তি এসে দখল করে নিল তার চোখের পাতা জোড়া।

চলবে

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।৭।।
কালকে পহেলা বৈশাখ, সরকারি ছুটি। পরশুদিন অর্থাৎ দোসরা বৈশাখ তাদের ভার্সিটিতে কালচারাল প্রোগ্রাম হবে, প্রতি বছরই হয়।
প্রোগ্রামের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন, কোনো ক্লাস হয় না ওইদিন। ভার্সিটি ক্যাম্পাসেই সকাল সকালই চলে আসে সবাই, বিল্ডিং এর বাইরে হয় বৈশাখী মেলা।
খুব বেশি জায়গা নেই, হয়ত দশটা স্টল বসানো যায়। স্টুডেন্টরা নিজেরাই অর্নামেন্টস, জ্যুস, খাবার দাবার নিয়ে বসে, বেশিরভাগ টিচাররাই কেনেন, স্টুডেন্টরাও বন্ধু বান্ধবদের ডেকে এনে কেনায়।
লাঞ্চের এরেঞ্জমেন্ট থাকে। লাঞ্চের পর “এসো হে বৈশাখ” কোরাস গান দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান, তারপর নাচ, আবৃত্তি, নাটক সবই হয়।
বিকেলের দিকে টিচাররা চলে গেলে সন্ধ্যার পর হয় ব্যাণ্ড শো। গত বছর এই দিনটা ভার্সিটি আসেনি আনান।
যে কোনো রকম অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলে সে। এবারেও তাই করবে বলে ঠিক করে রেখেছিল।
সেদিনের জিসানের ওপরে গলা চড়ানোর সেই ঘটনার পর কিছুটা ভয়ে ভয়ে রইল আনান। জিসানের মত ছেলের তো এত সহজে চুপচাপ এই ঘটনা হজম করে ফেলতে পারার কথা নয়। কে জানে জিসানের গ্যাং তাকে আবার কীভাবে শায়েস্তা করে।
কিন্তু দেখা গেল ঘটনাটা হয় নেহাতই নিজের মধ্যে চেপে গেছে জিসান, কিংবা ভেতরে ভেতরে কঠিন কোনো প্রতিশোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। কারণ জিসান কিংবা তার গ্রুপের কেউই এমন কিছুই বলল না বা করল না যা সেদিনের সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভাবা যেতে পারে।
এমনকি জিসানও যেন স্রেফ গায়েব হয়ে গেল তার সামনে থেকে। একদম সামনেই পড়ে না ইদানিং।
কেমন এড়িয়ে এড়িয়ে চলে। অবশ্য আনানের এসাইনমেন্ট গ্রুপ, টিউটোরিয়াল গ্রুপ আলাদা হওয়ায় দেখা হওয়ার সম্ভাবনা এমনিতেই কম।
আগে এখানে সেখানে, সিঁড়িতে বারান্দায় বিভিন্নভাবে আনানের পেছনে লাগত বলে চোখে পড়ত। এখন আর সেরকম কিছু হয় না।
আজকে ক্লাস শেষে প্রতিদিনের মতই বের হয়ে রিকশা খুঁজছিল আনান, পেছন থেকে নিজের নামটা শুনে প্রায় চমকে উঠল।
“এনি!”
জিসান!
“আয়াম স্যরি, এনি!”
এই মুহূর্তে আকাশ থেকে বিনা মেঘে বজ্রপাত হলেও এতটা অবাক হতো না আনান। জিসান স্যরি বলছে তাকে?
জিসান??
সেই জিসান যে কিনা তার ডেস্কে চিউয়িং গাম লাগিয়ে রেখেছিল, তার ব্যাগ কেটে রেখেছিল? সেই জিসান যে দল নিয়ে তার প্রতিটি ব্যাপারে হাসাহাসি করত?
“ইটস অলরাইট!”
কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে এতটুকুই বলতে পারল আনান।
“পরশু প্রোগ্রামে আসবি না?”
“না।“
খুব সংক্ষেপে উত্তর দিলো আনান।
“কেন?”
“কাজ আছে আমার।“
“কাজ মানে তো টিউশ্যনি? একটা দিন ছুটি নিলে কী হয়?”
বলবে না বলবে না করেও বলে ফেলল আনান, “ওসব তুই বুঝবি না!”
“বুঝিয়ে বললেই বুঝব!”
এবার সরাসরি জিসানের দিকে তাকাল আনান, “সেই সময়ও আমার নেই আর প্রয়োজনও দেখছি না। তাছাড়া চাঁদার টাকাও দেওয়া হয়নি আমার।“
“ইয়ে এনি…” ইতস্তত করতে থাকে জিসান…
“কী, বল?”
“আমি আসলে তোর চাঁদার টাকাটা দিয়ে দিয়েছি!”
“হোয়াট!” চিৎকার করে উঠল আনান।
ফ্যাকাসে মুখে বলল জিসান, “বেশি রাগ করলি?”
“হাউ ডেয়ার ইউ? আমি তোকে বলেছি দিতে?”
“না তা বলিস নাই। কিন্তু এতে এত রাগ করারই বা কী আছে? ধার মনে করলেই হয়! কোর্স শেষ হওয়ার আগে ধার শোধ করে দিলেই হবে! প্রয়োজনে ইনস্টলমেন্টে দিস।”
“পারব না আমি!”
“প্লিজ, এনি, নিজেকে এমন সেপারেট করে রেখে কার কী লাভ হচ্ছে?”
“পহেলা বৈশাখে পরে আসবার মত কোনো ড্রেস নেই আমার। আমি চাই না আমি প্রোগ্রামে আসি আর তোদের গ্রুপ আবার আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করুক।“
জিসানের মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সামনে একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে গেল আনান।
যথেষ্ট বকবক করা হয়েছে। আর সময় নষ্ট করবার মত সময় নেই তার হাতে।
“একলা আকাশ” আইডিটা ইগনোর দিয়ে রাখলেও প্রতিদিন রাতে স্প্যাম ফোল্ডারে গিয়ে মেসেজ চেক করা আনানের অভ্যাস। আজকেও সেই অভ্যাস অনুযায়ী মেসেজ দেখতে গিয়ে একটা নতুন মেসেজ দেখে চমকে উঠল সে।
“কাল সকালে ফোনটা রিসিভ করবেন প্লিজ? একটা সারপ্রাইজ আছে আপনার জন্য।“
রিপ্লাই দেবে কি দেবে না ভাবতে ভাবতে না দেওয়াই মনস্থ করল আনান। এই গভীর রাতে একটা কনভারসেশন শুরু করার অর্থই হলো প্রশ্রয় দেওয়া।
পরের দিন সকালে একটু দেরিতে উঠবে ভেবে এলার্ম দেয়নি আনান। ভেবে রেখেছিল প্রতিদিন ভার্সিটি যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠবার অভ্যাসে আজকেও ঘুম ভেঙে যাবে নিশ্চয়ই।
চোখ মেলে আনান দেখল ঘর ভেসে যাচ্ছে আলোর বন্যায়। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে সময় দেখল সকাল নয়টা পঞ্চান্ন বাজে।
ধড়মড় করে উঠে বসল আনান। সর্বনাশ হয়েছে!
হিমিকার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল সকাল সাড়ে দশটায়। বেইজ্জতিটা আর বুঝি আটকানো গেল না!
লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে উল্কার বেগে ছোটাছুটি করে রেডি হয়েও হিমিকার বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেল সকাল দশটা পয়তাল্লিশ। আন্টির কোঁচকানো ভ্রু দেখে আগেই হড়বড় করে বলল আনান, “আজকে পহেলা বৈশাখ তো, রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল আন্টি!”
“জানোই তো পহেলা বৈশাখ, সেটা হিসাব করেই রাস্তায় বের হতে হবে তো!”
কপাল ভালো আন্টি আর কথা বাড়ালেন না বেশি, হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আনানও। ফোন সাইলেন্ট করে রেখে দিল পাশে, কী প্রয়োজন একই দিনে আরো একটা নতুন অভিযোগ সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ দেওয়ার।
সাড়ে বারোটা পর্যন্ত পড়িয়ে রুমে ফিরল আনান।
মালিহা আপুকে সকালে দেখে গিয়েছিল আনান স্কুলের প্রশ্ন করছে। ফিরে এসে দেখল আপু উৎসুক মুখে বসে আছে, চোখে মুখে কৌতূহল।
আনান ফিরতেই কল কল করে উঠল আপু, “এই মেয়ে, তোমার এফেয়ার হয়েছে কবে? আমাকে বলনি তো?”
দারুণ অবাক হলো আনান। “এফেয়ার? আমার? এসব কী বলছেন আপু?”
“অম্বর থেকে ড্রেস পাঠাল কে তোমাকে? তুমি যে কঞ্জুস, তোমার তো অর্ডার করার কথা না!”
পারসেলটা বের করে দিল মালিহা আপু।
“ডেলিভারি ম্যান অনেক বার কল করেছে তোমাকে। তুমি নাকি ফোন রিসিভ করছিলে না। ভাগ্যিস আমি নিচে নেমেছিলাম ডীম আর চা পাতা কিনতে। আমি তাই তোমার নাম আর ঠিকানা দেখে নিয়ে এলাম হাতে করে!”
ব্যাগ থেকে ফোন বের করে আনান দেখল একটা আননোন নাম্বার থেকে কয়েকটা ফোন এসেছিল বটে কিন্তু ফোনটা সাইলেন্ট থাকায় টের পায়নি সে।
“খোলো দেখি!“
মালিহা আপুর চাপাচাপিতে কাঁচি এনে খোলা হলো পার্সেলটা। বিস্ময়ের শেষ সীমায় পৌঁছে আনান দেখল সুন্দর একটা কৃষ্ণচূড়া আঁকা সাদা থ্রিপিসের সাথে ছোট্ট একটা চিরকুট।
“মেঘবতী,
মেঘ ছাড়া আকাশ কেমন একলা থাকে জানো?”
হই হই করে উঠল মালিহা আপু। “আনু, এইসব তো ঠিক না! আগে বলনি কেন?”
নিজের বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল আনান। মাথাটা কেমন ঘুরছে।
কে পাঠাল এই জামাটা? একজনের চেহারাই চোখের সামনে ভেসে উঠছে, যাকে সে গতকাল বিকেলে বলেছিল, পহেলা বৈশাখের উৎসবে পরে আসবার উপযুক্ত কোনো ড্রেস নেই তার।
মালিহা আপুর চেহারা দেখে মনে হতে লাগল খুশিতে ফেটে পড়ছে। “খুব ভালো হয়েছে আনু, কালকে তোমার ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম বলেছিলে না? এটা পরে যেতে পারবে!’
কিছুই বুঝতে পারছে না আনান। সবাই এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন?
মালিহা আপুর মত মানুষের সাথেও তো এই আচরণ একদমই মেলে না! সব এমন অন্য রকম লাগছে কেন?
নিজেকে শক্ত করল আনান। এই সব বিলাসিতা তার জন্য নয়।
কঠিন গলায় বলল, “আমি এটা পরব না আপু। যে এটা পাঠিয়েছে সে আমার অনুমতি ছাড়াই পাঠিয়েছে। আমি তাকে এটা ফেরত দিয়ে দেব।“
“কী বলছ এইসব উল্টোপাল্টা? এইভাবে সাধা লক্ষ্মী কেউ পায়ে ঠেলে? তোমার বাপ মা তোমার খোঁজ খবর নেয় না, এই বান্দা নিজে থেকে এসে হাজির হয়েছে, এই চান্স কেউ ছাড়ে? তুমি কি ভাবছ তোমার মত মায়ে তাড়ানো বাপে খেদানো মেয়ের জন্য ছেলের লাইন লাগবে? মাছ নিজে এসে টোপ গিলেছে, এখন শুধু বঁড়শি গেঁথে তুলতে হবে।”
জামার প্যাকেট মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে আনান বলল, “আমার এইসব মাছ ধরা খেলায় আগ্রহ নাই আপু।“

চলবে

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।৮।।
“ড্রেসটা পেয়েছেন?”
“আপনি কোন সাহসে আমার জন্য ড্রেস পাঠিয়েছেন?”
“খুব রাগ হচ্ছে তো?”
“লিসেন। এইসব ফ্লেক্সি করে, ড্রেস পাঠিয়ে দিলেই মেল্ট হয়ে যাব আমি সেরকম মেয়ে না।“
“আমি জানি আপনি কী রকম মেয়ে।“
“কী জানেন আপনি?”
“আপনি একা থাকতে ভালোবাসেন। কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। সব কিছুকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন।“
“এই ড্রেস পাঠানোর পেছনে আপনার উদ্দেশ্য কী?’
“আহা, এটাকে এত বড় ইস্যু করছেন কেন। আপনার যদি গিফট নিতে এতই খারাপ লাগে রিসিটটা আমি এখনো ফেলিনি। নাহয় দামটা দিয়ে দিলেন। প্রয়োজনে ইনস্টলমেন্টে দিলেন। মিটে গেল।“
ইনস্টলমেন্ট? ইনস্টলমেন্টের কথা আরো একজন বলেছিল না?
আনান এবার মোটামুটি নিঃসন্দেহ হয়ে গেল এটা জিসানই হবে, তার সাথে ফেইক আইডি দিয়ে ফাজলামি করা শুরু করেছে। জিসানকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন সে তার সাথে এই রকম করছে।
“পারব না আমি! আমার হিসাবের টাকা। আপনাদের মত অঢেল টাকা নয়।“
“আমার অঢেল টাকা সেটাই বা কে বলল আপনাকে? দেখেন মেঘবতী আমার অনেক টাকা হয়ত নেই কিন্তু এতটা কমও নেই যে প্রিয় মানুষটাকে একদিন খুশি দেখার জন্য খরচ করতে পারব না।“
“হোয়াট দ্যা হেল! মেঘবতী কে? আর প্রিয় মানুষ? কে প্রিয় মানুষ! কার প্রিয় মানুষ? ভাবছেন এইসব সিনেমার ডায়ালগ লিখে দিলেই কাজ হয়ে যাবে?”
“উফ আপনি তো ভীষণ কঠিন। একটু সহজভাবে ভাবেন তো ম্যাডাম।“
“আপনি আমার ঠিকানাই বা পেলেন কোথায়?”
“অফিসে থেকে নিয়েছি। সেজন্যও অবশ্য কিছু বকশিস দিতে হয়েছে।“
“কাজটা খুব খারাপ করলেন।“
“জানি। কিন্তু এছাড়া আর উপায় ছিল না যে! আপনি তো আমার মেসেজই সিন করছিলেন না। একটু ধাক্কা দিতে চাচ্ছিলাম।’
“আপনি আসলে কী চাচ্ছেন আমার কাছ থেকে?”
“আমি আপনাকে একটু খুশি দেখতে চাচ্ছি, তার বেশি কিছু না।“
“তো? একটা ড্রেস পেয়েই আমি খুশি হয়ে যাব? খুশি এত সস্তা?”
“না মেঘবতী। খুশি এত সস্তা নয়। কিন্তু এই ড্রেসটা পরে আপনি যখন সবার মধ্যে আসবেন, নিজের কমপ্লেক্স চিন্তাগুলোকে এক পাশে সরিয়ে রেখে সবার সাথে সহজভাবে মিশবেন, দেখবেন সবার ঠাট্টার উত্তরে আপনিও ঠাট্টা করতে পারবেন। তখন হয়ত জীবনটা এত কালারলেস লাগবে না আপনার।“
থমকে গেল আনান। উত্তরে কী লিখবে ভেবে পেল না।
কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে লিখল, “আপনি বার বার আমাকে মেঘবতী নামে ডাকছেন কেন?”
“একই কথা। যে আনান সেই মেঘ।“
“দেখেন মিস্টার। আপনি আমার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আর আমিও কিছুই জানি না আপনার সম্পর্কে।“
“আপনি সুযোগ দিলেন কোথায়?”
বুক ভরে একটা শ্বাস নিল আনান। “ওকে দেন। গো এহেড। সুযোগ দিচ্ছি। আগে আপনার টার্ন। আগে আপনি বলেন আপনি আসলে কে?”
“সব বলব কিন্তু সামনাসামনি, এরকম মেসেজ লিখে হয় না। কালকে ক্যাম্পাসে আসেন। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলব। আসবেন তো?”
“আচ্ছা আসব।“
“ড্রেসটা পরবেন তো?”
“এক শর্তে।“
“কী শর্ত?”
“রিসিটটার ছবি তুলে এখনই আমাকে পাঠাবেন। টাকাটা আমি আপনাকে পে করে দেব।“
“উফ আপনি ভীষণ জ্বালান।“
“রিসিট না দিলে আমি পরব না। কথা শেষ।“
“ঠিক আছে দিচ্ছি।“
ফোনটা নামিয়ে রেখে বারান্দার গ্রিলে থুতনি ঠেকিয়ে রাতের আকাশের দিকে তাকাল আনান। মিথ্যা বলবে না, তার নিজেরও কি ভালো লাগছে না একটু একটু?
টুং শব্দ করে মেসেঞ্জারে ছবিটা ভেসে এলো। মেসেজ ওপেন করল আনান।
“হয়েছে, এবার শান্তি? এবার পরবেন তো?”
“ভেবে দেখব!”
“নট ফেয়ার! আপনি বলেছিলেন যে রিসিট দিলে আপনি ড্রেসটা পরবেন!”
“আচ্ছা কী হবে আমি ড্রেসটা পরলে? একদিন একটা ড্রেস পরে আনন্দ করলেই কি আমার জীবনের সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে?”
“না তা হয়ত হবে না, কিন্তু আপনি টের পাবেন যে সমস্যার পাহাড় কিছুক্ষণের জন্য মাথা থেকে নামিয়ে রেখে আনন্দ করা যায়।“
“ঠিক আছে পরব। আপনি তাহলে বলবেন তো আপনি আসলে কে?”
“অবশ্যই বলব।“
“আমি আপনাকে খুঁজে পাবো কোথায়?”
“আমি খুঁজে নেব আপনাকে। আপনার নাম্বারে কল দেব। ফোনটা ধরবেন। আজকের মত সাইলেন্ট করে রাখবেন না আবার।“
“ঠিক আছে।“
বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে রুমে ফিরল আনান। মালিহা আপু অন্য খাট থেকে বলল, “কথা হলো?”
চমকে উঠল আনান। “ঘুমান নাই আপু?”
“ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমাব আবার। আর তুমিও ঘুমাও। এত টেনশন করো না। জীবনকে সুযোগ দিতে হয়। এক জায়গায় বসে থাকলে জীবন চলে না।“
আরো কিছুক্ষণ অন্ধকার ঘরে স্থানুর মত বসে রইল আনান। এই একুশ বছর বয়সে স্বপ্ন দেখতে চায় বৈকি মন।
কিন্তু আনান যে…
আর কিছু ভাবতে চাইল না আনান। বালিশে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করল শক্ত করে।
পরদিন সকালে মালিহা আপু নিজে থেকেই কাজল আর লাল লিপস্টিক ধার দিল। ভীষণ অবাক লাগছিল আনানের।
আপুর সাথে এইটুকু উদারতাও যেন যায় না। “চুল খুলে যেও আজকে, আজকেও যেন মাঝে সিঁথি করে খোঁপা করে যেও না।“
তাড়াহুড়ো করে নেমে গেল আপু, তার আর সময় নেই। আপু বেরিয়ে গেলে আয়নার সামনে লজ্জারুণ মুখে দাঁড়াল আনান।
সত্যিই কি আজ এভাবে যাবে? এই পিঠময় ঢেউ খেলানো খোলা চুলে?
একটা নিঃশ্বাস ফেলে চুলগুলো খোঁপা করে ফেলল, প্রতিদিনের মতই মাঝখানে সিঁথি করে। আনানের স্বপ্ন দেখতে মানা।
হিমিকার স্কুল বন্ধ আজকে, ভার্সিটি যাওয়ার কথা ছিল না আনানের। তাই এর আগের দিন বলে এসেছিল আজকেও সকাল সকাল পড়িয়ে আসবে।
হিমিকা তাকে দেখে খুশি হলো খুব। “আরে আপু আজকে লিপস্টিক যে?”
“হ্যাঁ দিলাম একটু, ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম আছে তো তাই”, ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল আনান।
“চুড়ি পরেন নাই কেন আপু?”
“এমনিই, আমার এত সব কিছু ভালো লাগে না!”
পড়া শেষ করে হিমিকা বলল, “এক মিনিট দাঁড়ান আপু, আগেই চলে যাবেন না!”
অপেক্ষা করতে লাগল আনান। হিমিকা ফিরে এলো হাতে লাল চুড়ি আর টিপের পাতা নিয়ে।
“একটা দিন পরে দেখেন আপু, খুব সুন্দর লাগবে আপনাকে!”
খুব অস্বস্তি হলো আনানের, বার বার নিষেধ করছিল সে। কিন্তু হার স্বীকার করতেই হলো।
“কালকে ফেরত দিয়ে দিলেই হবে আপু!”
আনান যখন ক্যাম্পাসে এসে ঢুকল তখন ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁয়েছে। গেট দিয়ে ঢোকার সাথে সাথেই এক রাশ লজ্জা আর সংকোচ যেন ঘিরে ধরল তাকে।
কেন এলো সে আজ, কী প্রয়োজন ছিল? ময়ূরপুচ্ছ লাগালেই কাক ময়ূর হয়ে যায় না।
এরকম জোড়া তালি, ধার দেওয়া সব জিনিস পরবার কি আসলেই প্রয়োজন ছিল? কিন্তু পরার পর এই ভালো লাগাটাই বা অস্বীকার করে কীভাবে?
একটু নিজের মত করে থাকতে চেয়েছিল সে, সবাই মিলে তাকে যেন ঠেলে দিচ্ছে একটা ষড়যন্ত্রের দিকে। না, আর না।
আজকেই শেষ করতে হবে এই খেলা। জিসানকে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন সে এই রকম করছে।
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে গেল সে। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে জিসানকে।
জ্যুসের স্টলে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কী যেন বলছে স্টলের মেয়েটাকে। আশে পাশে অন্যরাও আছে।
আনানকে দেখে অন্যরা একটু অবাক হলেও কিছু বলল না। জিসান ডাকল তাকে।
“এই এনি, এত দেরি যে? আয় দেখ ফায়িকা দারুণ গ্রিন ম্যাংগো জ্যুস বানানো শিখে গেছে!”
হেসেই গড়িয়ে পড়ল ফায়িকা। “জ্যুস বানানো আবার কঠিন নাকি, কেটে প্রোসেস করে দেওয়ার লোক থাকলে? লবণ চিনি কাঁচা মরিচ মিশিয়ে ব্লেণ্ডারে দিলেই হয়ে যায়!”
স্টলের এ পাশ থেকে দেখা যাচ্ছে ভেতরে একটা কম বয়সী ছেলে কাঁচা আম কেটে ছোট করছে। এখানের বেশিরভাগ খাবারের স্টলগুলোতে এরকমই হয় অবশ্য।
কোনো দোকান থেকে নিয়ে আসা হয় কাউকে, মূল কাজটা তারাই করে। স্টুডেন্টরা শুধু সাথে থেকে বিক্রি করে।
“ওই চিনি লবণ মরিচের হিসাবই তো আসল জিনিস সুন্দরী, ওইটা তুমি বুঝবা না!” বলল জিসান।
“এত বোঝা লাগবে না আমার, জ্যুস খেতে চাইলে আগে টাকা ফেলতে হবে। পে ফার্স্ট!”
আনান পার্সে হাত দেওয়ার আগেই পে করে দিল জিসান। কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল আনান।
এখানে আরো অনেকেই আছে, সবার সামনে সিন ক্রিয়েট করতে ইচ্ছা করছে না। হাতলওয়ালা বড় গ্লাস ভর্তি কাঁচা আমের জ্যুস খেতে খেতে আনানের অবশ্য মনে হতে লাগল এই গরমের মধ্যে এসে এই মুহূর্তে এইটুকু খুব প্রয়োজন ছিল তার।
জ্যুসের গ্লাস হাতে নিয়ে এক পাশে সরে গেল আনান। জিসান বরাবরের মতই অন্যদের সাথে হাসি আড্ডায় ব্যস্ত, আচমকা কেন যেন বিচিত্র একটা অভিমান ঠেলে উঠতে চাইছে আনানের বুকের ভেতর থেকে।
কিন্তু এটা তো একেবারেই অযৌক্তিক! কী আশা করেছিল আনান, তাকে দেখামাত্রই তার কাছে ছুটে আসবে জিসান?
জ্যুস খাওয়াচ্ছে, এই না কত! আনান ঠিক করল জ্যুসটা শেষ করেই বাসায় চলে যাবে সে।
যথেষ্ট হয়েছে আজকের মত, আর না।
জ্যুসের গ্লাস যখন অর্ধেকে পৌঁছেছে, জিসান এগিয়ে এলো হাসিমুখে।
“টিস্যু নিস নাই তো, এদিকে লিপস্টিক নষ্ট হয়ে গেল যে, সেই খেয়াল আছে?”
আনান কিছু বলবার আগেই হাতে টিস্যু ধরিয়ে দিয়ে সরে গেল জিসান। গ্লাসের বাকি জ্যুসটুকু শেষ করে গ্লাস ফেরত দিয়ে এপাশে এসে টিস্যু খুলে চমকে গেল আনান।
সেখানে বড় বড় করে ক্যাপিটাল লেটারে লেখা আছে, “থ্যাংকস ফর কামিং।“ নিচে একটা স্মাইলি ইমো।
মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে তাকাল আনান। অনেক ওপরে দৃষ্টি সীমার বাইরে উড়ে বেড়াচ্ছে একটা নিঃসঙ্গ চিল।
এত কড়া রোদ, চোখ ঝলসে যায়। তবু এই ভীষণ কড়া রোদেও আনানের মনে হলো আজকের দিনটা খুব সুন্দর।
কেন যেন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল তার, আহ এত সুন্দর কেন পৃথিবী?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here