#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি-১৬,১৭,১৮
।।১৬।।
জিসান কিংবা ওদের গ্রুপের সাথে তুলনা করলে সায়ানের পরিবারকে খুব উচ্চ বিত্তের কাতারে ফেলা যাবে না, আবার মধ্যবিত্তও তারা নয়। গাড়ি নেই সায়ানদের, তাই বলে বাসে ঝুলেও সে আসে না।
তবে সব সময় পরিস্থিতি এ রকম ছিল না, সায়ানের জন্ম হয়েছিল উচ্চ বিত্ত পরিবারেই। সায়ান বড় হয়েছে আম্মু আব্বুর কঠিন অশান্তি দেখে, চারিত্রিক শুদ্ধতা কিংবা জীবনসঙ্গীর প্রতি একনিষ্ঠতার প্রশ্নে দুজনের সংজ্ঞা ভিন্ন রকম ছিল।
সায়ানের আব্বু ছিলেন লিবারেল অর্থাৎ স্বাধীনচেতা মন মানসিকতার, ব্যবসার প্রয়োজনে কিংবা চলতে ফিরতে কাউকে ভালো লাগলে লাগতেই পারে, দিন শেষে ঘরে ফিরে আসলেই হলো, এই ধরণের চিন্তা ভাবনার মানুষ। আসলে হয়ত সিরিয়াস কোনো এফেয়ার ছিলও না তার।
কিন্তু একটু আধটু ফ্লার্টিং, পার্টিতে কারো রূপের প্রশংসা করাকে দোষের মধ্যে গণ্য করতেন না তিনি। অন্য দিকে এই ব্যাপারে সায়ানের মায়ের ছিল কড়াকড়ি শুচি বায়ু, তার এই সব অসহ্য বোধ হতো, মূলত সেটাই হলো কাল।
সায়ানের মা ক্রমেই হয়ে উঠতে লাগলেন সন্দেহ প্রবণ, সায়ানের আব্বুর ওপরে বাড়তে লাগল নজরদারি, খবরদারি। স্পাই লাগালেন সায়ানের আব্বুরই অফিসের অধীনস্থ একজনকে।
সায়ানের আব্বু যে অবিশ্বস্ত ছিলেন, বিষয়টা ঠিক তাও নয়। রিপোর্ট ঠিক ঠাক মতই ছিল।
গোলমাল বাঁধল সায়ানের আব্বুর এক স্কুলের বান্ধবী ডিভোর্স নিয়ে বিদেশ থেকে ফিরে আসবার পরে। বেচারি অনেক বছর পরে দেশে ফিরে হিম শিম খাচ্ছিল, প্রায়ই আসছিল সায়ানের আব্বুর কাছে।
চাকরি খুঁজে পাচ্ছিল না কোথাও, সায়ানের আব্বুর কাছেই চাকরি চেয়েছিল। প্রাক্তন বান্ধবীকে ছোট খাটো কোনো পোস্টে নিজের অধীনে নিয়োগ করতে ইতস্তত করছিলেন সায়ানের আব্বু, চেষ্টায় ছিলেন এদিকে ওদিকে যোগাযোগ করে কোথাও না কোথাও তাকে ঢুকিয়ে দেবার।
প্রাক্তন বান্ধবীর অফিসে এসে দেখা করা দোষের কিছু নয়। তার মন ভালো করার জন্য কোথাও কফি খেতে বসাও এমন কোনো বড় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে না।
কিন্তু ঘরে যখন সন্দেহপ্রবণ স্ত্রী, যিনি টাকার বিনিময়ে গুপ্তচর নিয়োগ করেছেন এবং সেই গুপ্তচরকে নিত্য বকাঝকা করছেন, অভিযোগ করছেন যে নিশ্চয়ই সে ঠিক মত তার দায়িত্ব পালন করছে না, তা না হলে এত দিনেও কেন একটা খবরের মত খবর এনে দিতে পারল না? তখন খবর না থাকলেও খবর বানাতে হয়।
সায়ানের আব্বুর দোষের মধ্যে এই টুকুই, তিনি যে রেস্টুরেন্টে বসেছিলেন বান্ধবীকে নিয়ে, সেটা বউকে না জানিয়ে অফিসের মিটিং এর কথা বলে। আর সায়ানের আম্মু সেই রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হয়ে যা নয় তাই বলে অপমান করেছিলেন তার বান্ধবীকে।
ঘটনা এই পর্যন্তই শেষ হতে পারত। কিন্তু সায়ানের আম্মু সব আত্মীয় স্বজনকে জানিয়ে দিলেন তার স্বামীর চারিত্রিক স্খলনের কথা।
অনেক দিন ধরে চেপে রাখা ক্ষোভ, বিরক্তি, সায়ানের আম্মুর সায়ানের বড় বোন সায়ন্তনী আর সায়ানকে নিয়ে সায়ানের নানু বাড়িতে চলে যাওয়া, বান্ধবী আনিকার অপ্রস্তুত কান্নাকাটি, বন্ধু মহলে সায়ানের আব্বুকে নিয়ে হাসাহাসি সব কিছু মিলিয়ে নাজনীনকে ডিভোর্সই দিয়ে দিলেন সায়ানের আব্বু সারওয়ার আলম। এতটার জন্য বোধ হয় নাজনীনও প্রস্তুত ছিলেন না।
যদিও তাকে অনেক বুঝিয়েছিল সবাই। কিন্তু তার এক কথা।
ওই সাইকো মহিলার সাথে সংসার করা সম্ভব না। তখন সায়ন্তনীর বয়স বারো, সায়ানের দশ।
প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে এই সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত মহিলাকে সহ্য করে আসছেন তিনি। আর সম্ভব না।
নাজনীনের দেন মোহরের সবটা টাকা দিয়ে নাজনীনের মামার সাথে শেয়ারে বিজনেস শুরু করেন নাজনীন। আর বাচ্চাদের খোরপোষ নিয়মিত দিয়ে গেছেন সারওয়ার আলম।
তাই সায়ান উচ্চ বিত্ত পরিবারের সন্তান, বেড়ে উঠেছে উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবেশে। কখনো আর্থিক সংকটের কষ্ট অনুভব করেনি কিন্তু অপ্রয়োজনীয় বিলাসিতায় গা ভাসাতেও দেননি নাজনীন।
আম্মু আব্বুর ঘটনাগুলো কিছুটা আপুর কাছে শুনে, কিছুটা আব্বুর সাথে ইদে দেখা হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে, আর কিছুটা নিজের বয়সোচিত পরিপক্কতা অর্জনের সাথে সাথে বুঝে নিয়েছে সে। আম্মু আব্বু কাউকে দোষ দেয় না সায়ান।
ডিভোর্সের তিন মাস পর আনিকাকেই বিয়ে করেছিলেন সারওয়ার। নাজনীনের সাথে ডিভোর্সের পর আনিকাকে জড়িয়ে তার নামে যে কলংক রটেছিল তাতে আনিকার একা টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ছিল।
আনিকার সাথে সারওয়ারের সমঝোতার বিয়ে, আনিকাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য বিয়ে। তবুও সেদিন মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদেছিলেন নাজনীন।
চিৎকার করে বলছিলেন পুরুষ মানুষকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না।
বিচিত্র ব্যাপার হচ্ছে নিজের ছেলেকেও তিনি পুরুষের কাতারেই ফেলেন। সায়ানের ওপরেও তার এতটুকুও বিশ্বাস নেই।
আর এই অবিশ্বাসের চাপে পড়ে ছোট বেলা থেকেই নাভি শ্বাস ওঠার উপক্রম সায়ানের। স্কুলে কলেজে কোচিং এ সব জায়গায় আম্মু নিয়ে যেত, নিয়ে আসত।
বন্ধু বান্ধবরা হাসাহাসি করত। ঠাট্টা করে বলত “মাম্মাস বয়।“
ফেসবুকে সায়ানের নিজের একাউন্টে কঠিন নজরদারি করতেন নাজনীন। অতিষ্ঠ হয়ে ফেসবুক চালানোই ছেড়ে দিয়েছিল সে।
কিন্তু একটা অদ্ভুত অভ্যাস হয়ে গেল সায়ানের। ফেইক আইডি খুলে নীল সাদা জগতে ঘুরে বেড়ানোর।
আনানকে স্টক করার জন্য “একলা আকাশ” আইডি খোলা আসলে সেই অভ্যাসেরই একটা অংশ, কিংবা ফলাফল বলা চলে।
আনান কি খুব সুন্দরী? খুব আকর্ষণীয়?
না এরকম বলা যাবে না। কিন্তু নিজের আম্মু আব্বুকে দেখে এইটুকু শিক্ষা সায়ানের হয়েছে যে বউ হতে হয় ম্যানেজেবল, মানে যাকে সহজে ম্যানেজ করা যায়।
আনান হয়ত বা প্রথাগত সুন্দরী নয় মানে সুন্দরীদের প্রচলিত বৈশিষ্ট্য যেমন দুধে আলতা গায়ের রঙ ঘন কালো এক ঢাল চুল ইত্যাদি ইত্যাদি কোনোটাই নেই ওর মধ্যে, তবে ওর মধ্যে আছে একটা মিষ্টি স্নিগ্ধতা। আর সায়ান ঠিক জানে না কোথা থেকে ওর এই আড়াল থেকে স্টক করবার অভ্যাসটা হয়েছে, খুব সম্ভব ওর মায়ের কাছ থেকেই এসেছে উত্তরাধিকার সূত্রে।
কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক নয় জেনেও নিজেকে আটকাতে পারেনি সে। লুকিয়ে লুকিয়ে ফলো করেছে আনানকে, সেই নবীন বরণের দিন থেকেই।
মেয়েটা একদম ডিসেন্ট, কারো সাতে পাঁচে থাকে না। লুকিয়ে লুকিয়ে আড়াল থেকে ওকে দেখা কেমন নেশার মত হয়ে গিয়েছিল সায়ানের।
অবশেষে এত দিন পর ফেইক আইডি থেকেই ওকে নক করেছিল সায়ান। ইচ্ছে ছিল মেয়েটার বিষণ্ণ বিবর্ণ দিনগুলোতে একটুখানি রঙ ছড়াবার।
কিন্তু এখন তো দেখা যাচ্ছে ওর জীবনে রঙ ছড়াবার লোকের অভাব নেই। এত বন্ধু বান্ধব কোথা থেকে আসলো এখন?
এত দিন তো কারো টিকির দেখা পাওয়া যায়নি। সায়ানের কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে, ইনসিকিওরড লাগছে।
সে জন্যই মায়ের সাথে কথা বলেছিল সে। সায়ানের মা কড়া মানুষ হলেও কেন যেন রেগে না উঠে শান্তভাবেই বললেন মেয়েটাকে বাসায় নিয়ে আসতে।
তিনি প্রাথমিকভাবে কথা বলে দেখবেন। কথা বলে তার ভালো লাগলে পরে পারিবারিকভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া যাবে।
সায়ানের ইচ্ছাও সেই রকম। নিজের কাছে স্বীকার না করলেও তারও ভালোবাসার ওপরে খুব একটা বিশ্বাস নেই।
“যাহাকে ভালোবাসো, তাহাকে চোখের আড়াল করিও না। যদি প্রণয় বন্ধন দৃঢ় করিবে, তবে সুতা ছোট রাখিও।“ বঙ্কিমচন্দ্রের এই উক্তিতে অগাধ বিশ্বাস তার।
কিন্তু বাসায় আসবার কথা বলতেই ফ্যাকাসে হয়ে গেল আনানের মুখ। মনের ভেতর অন্য কিছু চলছে কি না কে জানে।
মাথায় কিলবিল করতে থাকা সন্দেহের চিন্তাগুলোকে ঝাঁকি দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল সায়ান। মেঘবতী ভালো মেয়ে।
মেঘবতী ভালো মেয়ে। নিজে নিজেই বিড় বিড় করে নিজেকে শোনাল।
মেঘবতীকে নিয়ে এরকম কিছু হবে না, তার আম্মু আব্বুর মত। তার মেঘবতীকে সে ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখবে, মুড়িয়ে রাখবে প্রেমের চাদরে।
নিজেও অন্য কোনো দিকে তাকাবে না। তার মেঘবতী আর সে নিজেদের জগতে মগ্ন হয়ে থাকবে কপোত কপোতীর মত।
চলবে
#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।১৭।।
ক্যাপসুল লিফটে আজ এত ভিড়, উঠতে ইচ্ছে করল না। এসকেলেটর ধরে ওপরে উঠে এলো আনান আর সায়ান।
আনানদের রিটেন পরীক্ষা শেষ আজকে, এক সপ্তাহ গ্যাপ দিয়ে ভাইভা আর ল্যাব পরীক্ষা। আনান আসতে চাচ্ছিল না।
গতকাল পড়াতে যায়নি, আজকে এক্সট্রা পড়িয়ে দিতে হবে। আসতে হলো সায়ানের জোরাজুরিতে।
ক্যাম্পাসের এত কাছেই এই শপিং মল, কিন্তু আনান কোনো দিনও আসেনি এখানে জেনেই তার ইচ্ছে হয়েছিল ওকে এখানে খাওয়াবে এক দিন। পরীক্ষার ছুতো দিয়ে এত দিন কাটিয়ে দেওয়া গিয়েছে, কিন্তু এখন আর কোনো অজুহাত ধোপে টিকল না।
ফুড কোর্ট সিক্সথ ফ্লোরে, সেকেণ্ড ফ্লোরে এসে এসকেলেটর থেকে নেমে আনানের চোখ আটকাল ইয়েলোর শো রুমের বাইরে থেকে কাঁচের দেয়াল ভেদ করে দেখা যেতে থাকা ডিসপ্লেতে ম্যানিকুইনের গায়ে পরিয়ে রাখা একটা ড্রেসের ওপরে। ওর চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে সায়ান বলল, “যাবে নাকি, পছন্দ হয়েছে?”
সংক্ষেপে মাথা নাড়ল আনান। “সময় নাই আজকে!”
“আহা চলো না, সেল চলছে তো! এই দেখো ৫০% সেল!”
আনানের প্রতিবাদের মুখেই ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে ইয়েলোর শো রুমের ভেতরে ঢুকল সায়ান। গাদাগাদি ভিড়, মানুষের ধাক্কাধাক্কি, দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল।
“দেখো জামাটা কাছ থেকে!’
মাথা নাড়ল আনান। “আমি লাল পরি না!”
লাল রঙের সাথে জড়িয়ে আছে ওর জীবনের একটা তিক্ত স্মৃতি, কিন্তু সেই কথা বলবার মত উপযুক্ত সময় কিংবা জায়গা এটা নয়।
“তাহলে অন্য কিছু দেখো?”
এই সময় ট্রায়াল রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে এলো সুমাইয়া। চোখাচোখি হয়ে গেল আনানের সাথে।
“আরে এনি যে, এখানে?”
আনান যথেষ্ট অপ্রস্তুত বোধ করল, কারণ একই সময় রিয়াজ এসে সুমাইয়াকে দেখে বলল, “আরে মাইণ্ড ব্লোয়িং!”
যদিও কিছুই আসে যায় না, তারপরও আনান লজ্জা পেল, কারণ সুমাইয়া যে জামাটা পরে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়েছে সেটা ওয়ান পিস, আর যে ড্রেসটা বাসা থেকে পরে এসেছিল সেটা ওড়নাসহ ওর বাঁ হাতে ফেলে রাখা অবহেলায়। সুমাইয়া অবশ্য খুবই স্বচ্ছন্দভাবে বলল, “নিয়ে নেব?”
রিয়াজ বলল, “শিওর, হোয়াই নট! আরো দেখতে চাও?”
“না, আজকে আর না।“
সুমাইয়া আবার ঢুকে গেল ট্রায়াল রুমের ভেতরে, চেঞ্জ করে বাসা থেকে পরে আসা ড্রেসটা পরে বেরিয়ে এলো আবার। পছন্দ করা জামাটা তুলে দিল সেলস গার্লের হাতে।
পকেট থেকে কার্ড বের করে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পে করল রিয়াজ। পুরো ব্যাপারটাই এত অস্বাভাবিক লাগছিল আনানের কাছে যে সে চোখ সরাতে পারছিল না ওদের ওপর থেকে।
মানুষের ধাক্কা খেয়ে সচকিত হলো ও। বিরক্ত হলো সায়ান, “হোয়াট দ্যা হেল আর ইউ ডুয়িং? পছন্দ হয়েছে ওই ড্রেসটা?”
“না, পছন্দ হয়নি, আমি এখন বেরোব এখান থেকে”, বলে সায়ানের মতামতের জন্য অপেক্ষা না করেই শো রুম থেকে বেরিয়ে এল আনান। বিষয়টা কী হচ্ছিল আসলে বুঝতে পারছিল না সে আর বুঝতে চাচ্ছিলও না, ওর মনে হচ্ছিল এই দৃশ্যপট থেকে ওর বের হওয়া প্রয়োজন।
মানুষের ভিড় থেকে বেরিয়ে এসে এসকেলেটরের সামনে দাঁড়িয়ে যখন বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে আনান তখন সায়ান এসে রাগে ফেটে পড়ল।
“তোমার সমস্যা কী বল তো?”
“কিছু না, এত মানুষের মধ্যে ভালো লাগছিল না!”
“নাকি ক্লাসমেটদের দেখে ভয় পেয়েছ?”
“কীসের ভয়?”
কাঁধ ঝাঁকাল সায়ান। “আমি কি জানি নাকি কীসের ভয়? আমি কি জানি আর কারো সাথে তোমার কিছু চলছিল কিনা? কিংবা এখনো চলে কিনা!”
আনান তাকিয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। ওর বড় বড় চোখে জমা হতে লাগল অশ্রু।
এসকেলেটরে ওপরে ওঠার সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিল ও, এখন ঘুরে নিচে নামার সিঁড়ির দিকে রওনা দিল হন হন করে। এক মুহূর্ত পরেই সায়ান বুঝতে পারল কি ভয়ানক ভুল করে ফেলেছে সে!
“মেঘ শোনো শোনো স্যরি স্যরি, আয়াম রিয়েলি স্যরি…”
নিচে নামার সিঁড়ির মুখে আবার দেখা হয়ে গেল সুমাইয়া আর রিয়াজের সাথে, আনান রাগের মাথায় বলে বসল, “হ্যালো সুমাইয়া!”
সুমাইয়া হাসিমুখেই বলল, “হ্যালো এনি! নাইস টু মিট ইউ এগেইন!”
আনান সায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও সুমাইয়া, আর ও রিয়াজ। আর সুমাইয়া, ও হচ্ছে সায়ান, আমাদের ভার্সিটিতেই, থার্ড ইয়ারে, ইংলিশের স্টুডেন্ট। এখন সুমাইয়া আর রিয়াজ তোরা কাইণ্ডলি ওকে বলবি যে আমার কারো সাথে এফেয়ার…”
আনান কী বলতে যাচ্ছে অনুমান করে পেছন থেকে ওর মুখ চেপে ধরল সায়ান। “ওইটা বলতে হয় না, ওরা এমনিতে দেখেই বুঝতে পেরেছে!”
সুমাইয়া হাসি মুখে বলল, “এফেয়ারের খবর তো আমরা শুধু মুখে নিই না!”
“অবশ্যই! আমরা ফুড কোর্টের দিকেই যাচ্ছিলাম! তাই না, মেঘ?”
আনান ওর মুখ থেকে সায়ানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী ভঙ্গিতে তাকাল। সায়ান অস্ফুটে বলল, “স্যরি, স্যরি, প্লিজ…”
“মান অভিমান পর্ব চলছে নাকি?” বলে হাসতে হাসতে ওপরে ওঠার এসকেলেটরের দিকে রওনা দিল সুমাইয়া আর রিয়াজ। এসকেলেটরে উঠে রিয়াজের বাহু জড়িয়ে ধরল সুমাইয়া।
ওদের পেছন পেছন আনানের হাত মুঠোতে পুরে নিয়ে রওনা দিল সায়ানও, বাধা দিল না আনান। ফুড কোর্টেও আজকে অনেক ভিড়, সায়ান এক সাথে বসার জন্য চারটা সিট খুঁজছিল, কিন্তু পাওয়া গেল না।
সুমাইয়া বলল, “ডোন্ট বি সো সিরিয়াস, পরে আবার আসব আরেক দিন! আই থিংক ইউ নিড সাম প্রাইভেসি টুডে!”
রিয়াজের হাত ধরে আরেক কোণায় অদৃশ্য হয়ে গেল সে, প্রাইভেসিটা যে আসলে কার লাগবে বুঝতে অসুবিধা হলো না কারো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আনানও, কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিল তার।
“কী খাবে?”
“তুমি যা খাবে তাই!”
হাণ্ডি বিরিয়ানির অর্ডার দিয়ে এসে বসল সায়ান, “মন খারাপ তোমার? প্লিজ প্লিজ মন ভালো কর! প্লিজ!”
“চেষ্টা করছি।“ সংক্ষেপে উত্তর দিল আনান।
তার মধ্য বিত্ত মন মানসিকতা আসলে এখনও ব্যাপারটা হজম করতে পারছে না পুরোপুরি। সে ভেবেছিল আজকে সায়ানকে খুলে বলবে তার সব কিছু, তার পরিবার।
কিন্তু শুরুতেই কেমন এলোমেলো হয়ে গেল সব। কথা খুঁজে পাচ্ছে না দুজনের কেউই।
প্রথম উদ্যোগ নিল সায়ানই, “ওকে লেট মি ব্রেক দ্যা আইস দেন। এজ ফার এজ আই ক্যান রিমেম্বার। তুমি আমাদের বাসায় যাওয়ার আগে আমাকে কিছু বলতে চাইছিলে মেঘ? ইন ফ্যাক্ট আমরা তো সেই জন্যই আজকে এখানে এসেছি তাই না?”
“হ্যাঁ তাই। আসলে আমার ফ্যামিলির ব্যাপারে বলতে চেয়েছিলাম।“
“ওকে, তুমি ইজি হতে হতে আমি আমারটা বলি? আমিই যেহেতু প্রপোজ করেছি, আমিই তোমাকে বাসায় ইন্ট্রোডিউস করাতে চাচ্ছি, তোমার রাইট আছে আমারটা আগে শোনার!”
হাত ওলটাল আনান। “এজ ইউ উইশ!”
“আমার আম্মু আব্বু ডিভোর্সি, আমরা আম্মুর কাছেই মানুষ। আব্বু তার চাইল্ডহুড ক্রাশকে বহু দিন পর ফিরে পেয়ে আমাদের ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল।“
বিরিয়ানি রেডি হয়ে গেছে ওদের, ডাক পড়ল সায়ানের। সায়ান উঠে গেল বিরিয়ানি আনতে।
বিরিয়ানি নিয়ে এসে দুজনের প্লেটে ঢেলে খেতে খেতে সায়ান বলল, “আম্মু স্কুল টিচার, তা ছাড়া ডিভোর্সের সময় আব্বুর কাছ থেকে পাওয়া টাকাটা আমার মামার সাথে ব্যবসায় খাটানো। আর আব্বু আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও মাসে মাসে আমাদের নামে টাকা পাঠাত, তাই আমাদের খরচ নিয়ে কোনো অসুবিধা কখনো হয়নি। আমার বড় বোনের নাম সায়ন্তনী, সোহরাওয়ার্দি মেডিকেল কলেজে ফিফথ ইয়ারে পড়ে। হোস্টেলে থাকে। এখন বাসায় আমি আর আম্মু আমরা দুজনই থাকি, আপু বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বাসায় আসে, শনিবার খুব ভোরে চলে যায়। বুঝতেই পারছ আপু ভালো স্টুডেন্ট, আমিও খারাপ ছিলাম না খুব একটা। কিন্তু এডমিশন টেস্টের আগে আগে আমার টাইফয়েড হলো, পুরো একুশ দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম। ভালো কোথাও চান্স হলো না, আর এটা আমাদের বাসার কাছে ছিল। আম্মু আসলে,“ এক মুহূর্ত বিরতি নিল সায়ান, “আমাকে ঠিক বিশ্বাস করে না। তাই ঢাকার বাইরে কোথাও পরীক্ষা দিতে যেতে দিল না। মেডিকেলে দেওয়া যেত সেকেণ্ড টাইম, আপুর পড়ার চাপ দেখে আমার ইচ্ছা করেনি।“
খাওয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে, আনানের দিকে তাকাল সায়ান।
“নাউ ইটস ইওর টার্ন, এবার তুমি তোমার কথা বলো!”
চলবে
#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।১৮।।
বুক ভরে একটা শ্বাস নিল আনান। যদিও কখনো ভাবেনি যে এই রকম গিজগিজে ভিড়ের মধ্যে বসে এই কথাগুলো বলতে হবে তাকে।
কিন্তু বলতে তো হবেই, এই কোলাহলেই বলে ফেলা ভালো। আনান শুরু করতে যাবে এমন সময় দেখা গেল মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে সুমাইয়া এদিকেই এগিয়ে আসছে, তার পেছন পেছন রিয়াজ।
এই ফুড কোর্টে বসার জায়গাগুলো আসলে সোফা, এক এক সোফায় চাপাচাপি করে দুজন বসা যায়। সুমাইয়া এসে ধপ করে বসে পড়ল আনানের পাশে।
রিয়াজ দাঁড়িয়ে রইল, হিসাব মত সায়ানের এখন উচিত একটু ভেতরের দিকে চেপে রিয়াজকে বসার সুযোগ দেওয়া, কিন্তু সায়ান চেপে বসার বদলে উঠে পড়ল।
“তোমরা বসো, আমি ড্রিংকসের অর্ডার দিয়ে আসি। তোমাদের জন্য কী বলব?”
“থ্যাঙ্ক ইউ! আমার জন্য ফান্টা বলবেন।“ সহজভাবেই বলল সুমাইয়া।
রিয়াজের দিকে তাকাল সায়ান। “তোমার?’
“পেপসি।“
চলে গেল সায়ান, সুমাইয়া চোখ নাচাল আনানের দিকে তাকিয়ে। “তোরটা শুনতে চাইল না যে?”
“আমার চয়েস ও জানে”, মৃদু স্বরে বলল আনান। রিয়াজ আর দাঁড়িয়ে না থেকে বসে পড়ল ফাঁকা সোফায়, সুমাইয়া উঠে গিয়ে বসল ওর পাশে।
সুমাইয়া বসেছে রিয়াজের গা ঘেঁষে, অস্বস্তি লাগছে আনানের। অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল সে।
“এনি, তোকে একটা কথা বলব, যে কারণে এদিকে আসলাম।“
চোখ তুলে তাকাল আনান।
“আমাদের ব্যাপারটা”, নিজেকে আর রিয়াজকে দেখাল সে, “এটা নিয়ে ক্লাসে গসিপ করার দরকার নেই।“
আনানের ইচ্ছে হলো বলে, “গসিপ না করলেও সবাই জানবেই এক দিন না এক দিন, কিংবা অলরেডি হয়ত জানেই।“
কিন্তু সায়ান চলে এসেছে, আনান মৃদু স্বরে শুধু বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে।“
সুমাইয়া আর রিয়াজকে এক সোফায় ঘেঁষাঘেঁষি হয়ে বসতে দেখে সায়ান একটু হাসল শুধু। আনান সরে গিয়ে ওর ব্যাগটা কোলে নিয়ে বসার জায়গা করে দিল সায়ানকে।
সায়ান পাশেই বসেছে আনানের কিন্তু এক আঙুল ফাঁক রেখে। ভালো লাগল আনানের।
আনানের ডান হাত টেবিলের নিচে, কোলের ওপরে রাখা ব্যাগ আঁকড়ে ধরে আছে। সায়ান টেবিলের নিচেই আলতোভাবে ওর বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুল রাখল আনানের ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলের নখের ওপর।
আনান ভীষণভাবে চমকে উঠলেও পর মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে হাসল সায়ানের দিকে তাকিয়ে। পাশের টেবিলে বসে সুমাইয়া রিয়াজকে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে বলল, “হ্যাভ আ লুক! হাউ শি ইজ গ্লোয়িং!”
রিয়াজ বলল, “আরে ফোন কই তোর, ছবি তোল একটা!”
সায়ান গলা নামিয়ে বলল, “তোমার গল্পটা শোনা হলো না তো!”
আনানও গলা নামিয়ে বলল, “নাহ, বলতে আর পারলাম কই!”
সুমাইয়া কয়েকটা স্ন্যাপ নিয়ে নিল দুজনের। ড্রিংকস চলে আসায় সম্বিত ফিরল ওদের।
আরো কিছু ক্ষণ হালকা কথা বার্তার সাথে ড্রিংকস শেষ করে সুমাইয়া বলল, “আমি উঠি, আমার তো আবার ক্যাম্পাসে ফিরতে হবে!”
সায়ান জানে না, বলল, “ক্যাম্পাসে? আবার? কেন?”
“এই একটা দরকার আছে ভাইয়া।“
“বাসা কোন দিকে তোমার?”
আনান তাড়াতাড়ি বলল, “চলো আমি বুঝিয়ে বলছি তোমাকে!”
বের হতে হতে ভুলে গেল সায়ান, আনানও বাঁচল হাঁফ ছেড়ে। মুখ ফসকে বলে ফেলে সুমাইয়াও বিপদে পড়ে গিয়েছিল, সে তাকাল কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে।
রিকশায় ক্যাম্পাসে ফিরে পেছনের গেট দিয়ে ভার্সিটিতে ঢুকে সামনের গেটে পার্কিং এ রাখা শ্বশুর বাড়ির গাড়িতে বাসায় ফিরতে ফিরতে ওদের ব্যাচের ফেসবুক গ্রুপে আজকের তোলা ছবিগুলো পোস্ট করল সুমাইয়া। ক্যাপশন দিল, “নিউ কাপল ইন টাউন।“
ছবিগুলো দেখে বুকের ভেতর কোথায় যেন একটু জ্বালা করে উঠলেও কমেন্ট করল জিসান, “কংগ্র্যাচুলেশন্স!”
চলবে