মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি,১৯,২০

0
675

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি,১৯,২০

।।১৯।।
ফারুক আহমেদ প্লট দেখতে এসেছেন, ঢাকার অদূরে এই প্লটটায় সুন্দর একটা আন্তর্জাতিক মানের মাল্টি ডিসিপ্লিনারি প্রাইভেট হাসপাতাল গড়ে তোলার স্বপ্ন তার। আশেপাশে নব্য ধনীরা প্লট কিনে রাখছেন, কিন্তু কাছে ধারে ভালো প্রাইভেট হাসপাতাল নেই।
আশেপাশে দুটো সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলেও প্রাইভেট ক্লিনিক একটা প্রয়োজন, তার পরিকল্পনায় যে হাসপাতালটা আছে সেখানে আই সি ইউ, এইচ ডি ইউ, সি সি ইউ, এন আই সি ইউ, পি আই সি ইউ সবই থাকবে। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে ঠিকমত মার্কেটিং এর লোক লাগাতে পারলে রোগীর অভাব হবে না।
জিসান কিছু দেখে না, কেমন উদাস হয়ে ঘুরে বেড়ায়। ওকে এবার কাজে লাগাতে হবে, বড্ড বেশি গায়ে বাতাস লাগানো হয়ে যাচ্ছে।
রুবাবা মেয়েটার কথায় সেদিন মনে হলো জিসানের প্রতি সে দুর্বল, তাই রুবাবার বাবার সম্পর্কে খোঁজ খবর নিয়েছেন তিনি। রুবাবার বাবা রাকিব চৌধুরীর কর্মক্ষেত্রও কম বিস্তৃত নয়।
তার অনেকগুলো ব্যবসার মধ্যে একটা হচ্ছে মেডিকেল ইকুইপমেন্ট সাপ্লাইয়ের, মূলত সেই জন্যই তিনি আগ্রহী হয়েছেন। রুবাবা মেয়েটাও দেখতে শুনতে ভালো, এখন এটাকে পুঁজি করে সামনে যেতে পারলে দুই পক্ষের কোলাবোরেশনে দারুণ কিছু হবে বলেই তার বিশ্বাস।
জিসানকে তিনি দেশের বাইরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, অল্প কয়েক দিনেই দারুণ কেলেঙ্কারি করে ফেলেছিল ছেলেটা। টাকা ওড়াচ্ছিল দু হাতে, যদিও সেটা সমস্যা না।
ক্লাবে যাওয়া, মেয়ে ঘটিত নানান ঘটনা দুর্ঘটনা তো ছিলই, যেদিন ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করার মত অপরাধে সাজা পেতে হলো জিসানকে সেদিনই তিনি আদেশ জারি করলেন, যথেষ্ট হয়েছে। আর না।
সেমিস্টারের মাঝেই এনে ভর্তি করে দিলেন এই ভার্সিটিতে, এখন পর্যন্ত বড় কোনো অঘটনের খবর পাওয়া যায়নি। সেদিনই প্রথম রুবাবা এসে কিছু জানিয়ে গেল তাকে।
প্রথমে বিরক্ত হলেও ফারুক আহমেদ এটা বিশ্বাস করেন, প্রতিটি খারাপ ঘটনারই কিছু না কিছু ভালো দিক থাকে। এই ঘটনার ভালো দিক হচ্ছে রুবাবার সন্ধান পাওয়া, যে জিসানের প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং, দেখতে শুনতে ভালো, এবং খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ফ্যামিলিটাও ভালো।
জিসানের সাথে বসা দরকার, রুবাবার ব্যাপারে তার মনোভাব বোঝা দরকার। অবশ্য বিয়েটা এই যুগে শুধু আবেগের ব্যাপার নয়, এর সাথে অনেক কিছু হিসাব নিকাশ জড়িয়ে থাকে।
আজকে জমিটা দেখতে সাথে আসতে বলেছিলেন জিসানকে, কী একটা ছুতো দেখিয়ে আসলো না। একদম জেসমিনের মত জেদি হয়েছে, আর ফালতু ইমোশনের ডিব্বা।
তাও ভালো বিদেশ থেকে চলে এসেছিল এক কথাতেই, এখন তো তাও চোখের সামনে আছে। কী করে না করে দেখা তো যাচ্ছে।
যদিও তিনি সব সময় নজর রাখতে পারেন না। কিন্তু বাসায় বিশ্বস্ত লোক আছে।
আব্বাস। জিসানের জন্মের আগে থেকেই আছে।
সেই সব কিছু রিপোর্ট করে তাকে। এখন পর্যন্ত উল্টোপাল্টা কিছু করবার অভিযোগ পাওয়া যায়নি জিসানের নামে।
ফারুক আহমেদ চারিদিকে তাকালেন, প্রাথমিকভাবে এটা ছিল স্রেফ একটা নিচু এলাকা, যেখানে কিছু দিন আগেও ধানচাষ হতো। শুকনো মওশুমে পানি না থাকলে ভেজা মাটির ওপর কচুরিপানার মাঠ হয়ে যেত।
কিছুদিন পর আর এই রকম থাকবে না, প্রয়োজনে অন্য এলাকা থেকে মাটি এনে এই নিচু অংশ সহ লাগোয়া অংশের ৫/৬ একর জমি ভরাট করে ফেলা হবে। ফারুক আহমেদ ছোট স্বপ্ন দেখতে অভ্যস্ত নন, তার স্বপ্ন সবসময়ই হয় বিশাল।
স্থাপত্যও হবে বিশাল। এর মধ্যেই কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে এলাকা ঘেরাও করা হয়েছে।
খুব শিগগির একটা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রীকে দিয়ে উদ্বোধন করিয়ে ফেলতে হবে। তৈরি হবে বিশাল ভবন।
বিশাল স্থাপত্যের সূচনাও ছোট্ট একটা ভিত্তির ওপরই হয়। বিরাট আকাশচুম্বী ভবনও ক্রমান্বয়ে টুকরো টুকরো অংশ সংযোজন করেই করা হয়।
জিসানকে এর সাথে সম্পৃক্ত করতে হবে, যে কোনো কিছুর সাথে তার দেখা হয় যখন কাজ শেষ হয় তখন। এবার আর তা হতে দেওয়া যাবে না।
হেলমেট মাথায় দিয়ে পিলারের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে না বেড়ালে মায়া জন্মায় না কোনো কিছুর প্রতি। রেডি মেড খাবার, রেডি মেড জামা কাপড়, রেডি মেড টাকা পয়সা, রেডি মেড সব ব্যবসা পেয়ে গেছে বলে কোনো কিছুর মর্ম বোঝে না জিসান।
মা নেই বলে তিনিও শাসন করতে পারেননি ঠিক মতো। তার ফলাফল তো দেখাই যাচ্ছে।
অবশ্য জিসান ভালো ছেলে, খুব একটা বখে যায়নি। দোষ দেওয়া যায় না তাকে, অনেক বড় কোনো অভিযোগ কখনো আসেনি তার নামে।
দেশের বাইরে যেগুলো হয়েছে, সেগুলো মূলত সঙ্গ দোষে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা ছিল। ভার্সিটিতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ঘটনাটাও তাই।
তারপরও জিসানের পাশে একটা মানানসই ভালো পরিবারের হাসি খুশি সুন্দরী মেয়ে এলে মনে হয় খারাপ হবে না। বাসাটাও কিছুটা প্রাণ ফিরে পাবে।
ওপরের দিকে তাকিয়ে মেঘমুক্ত নীল আকাশের দিকে তাকালেন ফারুক আহমেদ, কয়েক দিন ধরেই কেমন বিশ্রী গরম যাচ্ছে। এসি গাড়ী থেকে নেমে দম বন্ধ লাগছে, কেমন বৃষ্টি হবে হবে ভাব, সূর্যের প্রখর তাপে জলীয় বাষ্প জমা করবার যেন শেষ নেই।
কখন যে মেঘের ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি জলীয় বাষ্প জমা হবে আর শেষ পর্যন্ত বৃষ্টি নামবে, কে জানে? ভোরে রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও নানান ঝামেলায় একটু দেরি হলো রওনা দিতে।
একটু দেরিতে রওনা দিয়ে প্রায় তিন ঘন্টা জার্নি করে এই বেলা সাড়ে এগারোটায় পৌঁছালেন তারা। প্রায় ৮/১০ মিনিট হলো পৌঁছেছেন, কিছু ক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর এলাকা ঘুরে দেখবার পরিকল্পনা ছিল।
“স্যার, চা খাবেন?”
ড্রাইভার জিজ্ঞেস করছে।
“কই পাবা?”
“নিয়ে আসছি তো ফ্লাস্কে করে।“
“দাও তাহলে। খেয়ে কাজ শুরু করি।“
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মাটির দিকে নজর দিলেন ফারুক আহমেদ। পুরো জায়গা নানান সাইজের পাথর আর পাথরে ভর্তি।
এগুলো এনে কি জমি ভরাট করবার চেষ্টা চলছে?
দূরে একটা নির্মাণাধীন ভবন, অনেকগুলো ক্রেন দেখতে লাগছে যেন দাঁত বের করে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা কুৎসিত দানব। আরো দূরে কয়েকটা বিল্ডিং।
সূর্য এখন প্রায় মাথার ওপর, দূরে দূরে বিল্ডীংগুলো যেন গাছ গাছালীর ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে। আঁকাবাঁকা সরু সরু লাল মাটির রাস্তা।
অল্প কিছু দূরেই গাছপালা দিয়ে একটা ছোটো খাটো জঙ্গল মনে হচ্ছে। কিন্তু এই এলাকা এই রকম থাকবে না।
ফারুক আহমেদের মানসপটে ভেসে উঠছে তার পরিকল্পনার দৃশ্যাবলী। এখানে উঠবে বহুতল ভবন।
গড়ে উঠবে অত্যাধুনিক হাসপাতাল। কল্পনায় কয়েক মুহূর্ত সেই দৃশ্য দেখার পর নতুন করে আত্মবিশ্বাসে উজ্জীবিত হলেন তিনি।
হাত পাগুলো টান টান করে এগিয়ে গেলেন। মাথার ওপরে জ্বলতে থাকা প্রখর সূর্যের তাপ উপেক্ষা করে মন দিলেন এলাকা জরিপের কাজে।
এক পাশে একটা ডোবার মত জায়গা, মশার ডিপো। এটা ভরাট করবার জন্য মাটি আসছে।
আর ঘন্টা খানেক সময় বাকি, এরপর রওনা দিতে হবে। বিকেলে একটা মিটিং আছে ফরেন ডেলিগেটদের সাথে।
মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে তার, মনে হয় তার বিকল্প কেউ যদি থাকত। যে একটু দায়িত্ব নিয়ে একটা দুটো কাজে সাহায্য করতে পারত। এত দূর এগিয়ে আসার পর আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।
আর তার এই পরিকল্পনা কেউ জানেও না। শেষ পর্যন্ত যাওয়ার আগে পরিকল্পনা শেয়ার করবার অর্থই হলো আইডিয়া চুরি হয়ে যাওয়া।
অনেক সাধ্য-সাধনার পর শূন্য থেকে শুরু করে তার এই পর্যন্ত অর্জন, এখন এই সাম্রাজ্য বাড়িয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর গত্যন্তর নেই।

চলবে

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।২০।।
“কোথায় বসে কথা বলছ, মেঘ?”
“এই তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছি!”
“চুল খোলা?’
“কেন?”
“আহা, বলোই না!”
“হ্যাঁ, চুল খোলা। কিন্তু কেন?”
“এই যে এখন জ্বিনে ধরবে তোমাকে!”
“ইস, জ্বিনরা তো সব ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে আমাকে ধরার জন্য!”
“মাঝ রাতে চুল খোলা মেয়ে দেখলেই জ্বিনরা চলে আসে, জানো না?”
“তুমি কখনো জ্বিন দেখেছ?”
“না, জ্বিন দেখিনি তবে পরী দেখেছি।“
“সত্যি? কোথায়? কবে?”
“এই তো, পরশু দিনই তো দেখলাম!”
“কোথায়?”
“তুমি দেখতে চাও?”
“হ্যাঁ, চাই তো!”
“তোমার রুমের কি লাইট নেভানো?”
“হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’
“রুমমেট ঘুমাচ্ছে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু কেন?”
“তোমাদের ওয়াশরুমে কি আয়না আছে? বেসিনে?’
“হ্যাঁ, আছে তো!”
“ওয়াশরুমে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াও, আয়নার ভেতরে পরী দেখতে পাবে!”
“যাহ্‌!” লজ্জা পেয়ে গেল আনান।
“যাও এখনই গিয়ে দাঁড়াও, আর দেখে এসে আমাকে বল।“
“আমি গেলাম! আর কথা বলব না আমি!”
“পরীটা দেখতে ভুলো না কিন্তু!”
ফোন রেখে সত্যি সত্যিই ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে এসে দাঁড়াল আনান। সত্যিই কি আয়নার ভেতরের মেয়েটাকে কেউ পরী ভাবে?
সায়ানের বাসায় খাওয়ার দাওয়াত আজকে, মালিহা আপুর একটা ড্রেস ধার নিয়েছে আনান। সেদিন সুমাইয়ার চক্করে পড়ে সায়ানকে বলা হলো না তার কথাগুলো, অগত্যা তাকে সব খুলে বলার আগেই সিটিং দিতে হচ্ছে সায়ানের মায়ের সাথে।
খুব নার্ভাস লাগছে তার, কিন্তু কিছু করারও তো নেই। সায়ান অবশ্য অভয় দিয়েছে যে আজকের সেশন হবে একদমই ইনফরমাল, বিয়ে সংক্রান্ত কোনো কথাই সেখানে উঠবে না।
তবুও হবু শাশুড়ির সাথে প্রথম মোলাকাতে যে মেয়ের হৃদকম্প উপস্থিত না হয়, তাও যেখানে রিজেক্ট হওয়ার সম্ভাবনা ষোল আনার ওপরে আঠারো আনা, তার হৃদয় হতে হবে ইস্পাতের তৈরি। আর আনান নিতান্তই সাধারণ একটা মেয়ে।
আর এই অল্প কয়েক দিনেই উথাল পাথাল ভালোও বেসে ফেলেছে সায়ানকে। যদিও মালিহা আপু বার বার সতর্ক করেছে।
আজকে মালিহা আপু মিষ্টি গোলাপি একটা ড্রেস বের করে দিয়েছে, তার গায়ের রঙে নাকি মিষ্টি গোলাপিই ভালো মানাবে। মালিহা আপু আবার সাজিয়েও দিয়েছে তাকে, আনানের সাজের কোনো জিনিস নেই বলে।
যদিও সারা ক্ষণই গজগজ করছিল আপু, “তুমি একদম গা বাঁচিয়ে চলতে পারো না, আনু! এমন হাবুডুবু প্রেমে পড়ার দরকার কী ছিল? একটু তো নিজের স্পেস রাখতে হয়!”
আসলে সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই কেবলই থেকে থেকে চোখে পানি চলে আসছে আনানের, আম্মা আব্বা আরিফ ভাইয়া আর আরশির কথা মনে করে। আজকে তার জীবনের একটা বড় দিন, আর কেউ না হোক অন্তত আরশিকে তো সে বলতে পারত, কমাতে পারত হৃদয়ের ভার!
সাদা সালোয়ার, মিষ্টি গোলাপি ড্রেস আর সাদা গোলাপি শেডের ওড়নায় আনানকে দেখতে আজ খুব একটা খারাপ লাগছে না। সামনের চুলগুলো একটা পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে আটকে বাকিগুলো পিঠের ওপরে ছড়িয়ে দিয়েছে মালিহা আপু, আবার বাক্স খুলে বের করে দিয়েছে এক জোড়া মুক্তার দুলও।
হাতে ঘড়ি, ব্যস আনানের সাজ শেষ। আজকে ছুটির দিন, সকালে একটা পড়িয়ে এসেছে আনান, বিকেলে আরেকটা টিউশ্যনি।
বিকেলের টিউশ্যনি শেষ করে যখন বেরুল আনান, রোদের তেজ তখন একটু কমে এসেছে কিন্তু তাপ কমেনি। গরমটা আসলেই অতিরিক্ত পড়েছে, টিস্যু বের করে সাবধানে মুছে নিল নাকের নিচে জমে উঠতে থাকা বিন্দু বিন্দু মুক্তোদানার মত ঘামের ফোঁটা।
আনান যখন গুলশানে সায়ানদের বাসার নিচে এসে পৌঁছাল, ঘড়ির কাঁটা তখন সাতটা দশে। কথা ছিল ঠিক সাতটায় আসবে আনান।
নিচে সিকিউরিটিতে বলাই ছিল, রেজিস্ট্রার খাতায় নাম ঠিকানা ফোন নাম্বার লিখে ওপরে উঠল সে। ইন্টারকম থেকে ফোন করে বলে রেখেছিল, দরজা খুলে গেল আসার প্রায় সাথে সাথেই।
বাসার কাজে সাহায্যকারী ছেলেটা দরজা খুলে বসাল ওকে, কিছু ক্ষণ পর টি ট্রলিতে ঠাণ্ডা শরবত, পানি, চায়ের ফ্লাস্কে গরম পানি, টি ব্যাগ, চিনি, দুধ সব চলে এলো।
পেছন পেছন যে সম্ভ্রান্ত চেহারার মহিলাটি আসলেন, আনানকে বলে দিতে হলো না যে উনিই সায়ানের মা। উঠে দাঁড়াল সে।
“বসো বসো। বাসা চিনতে অসুবিধা হয়নি তো?”
“জি না, অসুবিধা হয়নি।“
“নাও শরবত নাও।“
ভদ্রমহিলার গলার স্বর শীতল আর মসৃণ, যেন অনেক দূর থেকে কথা বলছেন। আওয়াজটা যেন একটা মাটির কলসির ভেতর থেকে আসছে, এমনটাই মনে হলো আনানের।
আনান শরবত খেতে খেতে টুকটাক কথা শুরু করলেন নাজনীন।
“তোমার বাড়ি কোথায়?”
“ময়মনসিংহ।“
“নিজেদের বাড়ি?”
“জি না, ভাড়া থাকি!”
“বাড়িতে কে কে আছে?”
“আম্মা আব্বা বড় ভাই আর ছোট বোন।“
“বাবা কী করেন তোমার?”
“মার্কেটে একটা দোকানে বসেন।“
“কোন মার্কেটে?”
“বাসাবাড়ি মার্কেট”, ঢোক গিলল আনান।
“ওহ! তোমার বাবা তাহলে দোকানদার!”
কথাটা একটু খট করে লাগল আনানের কানে, কিন্তু কিছু বলল না সে।
“মা কিছু করেন?”
“জি না, হাউজওয়াইফ!”
“বড় ভাই?”
“পাস করেছে গত বছর, চাকরি খুঁজছে।“
“ছোট বোন?”
“ইন্টার পরীক্ষা দেবে সামনের বছর”, আনানের নিজেকে ফাঁসির আসামি বলে মনে হচ্ছিল।
“ওহ! তোমার পড়ার খরচ কে দেয়?”
“আমি নিজেই দিই আন্টি! আমি টিউশ্যনি করি তো!”
“টিউশ্যনি করে হয় এত খরচ?”
“আন্টি আমার জিপিএ ভালো ছিল তো, ফিফটি পারসেন্ট ওয়েভার পাই আমি! এইজন্য চালাতে পারি।“
“আচ্ছা! নাও চা নাও!”
আনান চা নিতে নিতে বাসায় বানানো ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, নুডলস চলে এলো। নাজনীন কাজের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এগুলো ডাইনিং রুমে দিয়ে দাও, আর তোমার ভাইয়া আপুকে বল টেবিলে আসতে।“
কিছু ক্ষণ পর আনান নিজেকে আবিষ্কার করল ডাইনিং টেবিলে সায়ান, সায়ন্তনী আপু আর নাজনীনের সাথে। আজকে শুক্রবার তাই সায়ন্তনী বাসায় আছে।
নাজনীন আনানের দিকে তাকালেন না আর, সায়ন্তনীর সাথে নিজের বুটিক ব্যবসা নিয়ে কী একটা কথা শুরু করলেন। সায়ন্তনীর অবশ্য খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না আনানের প্রতি, আবার অনাগ্রহও না।
পুরোটা সময় টেবিলে বসে ফোন স্ক্রল করে গেল সে, ফোন স্ক্রল করতে করতেই মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। আনানের দিকে একবার তাকিয়ে “কী খবর? ভালো?” বলা পর্যন্তই শেষ।
টেবিলের নিচে সায়ান একবার কনিষ্ঠা আঙুল ছুঁয়েছিল আনানের, কেন যেন এত কিছু রেখে কনিষ্ঠা আঙুলটাই খুব প্রিয় তার। কিন্তু আনান হাত সরিয়ে নিল ভয়ে, দুটো হাতই রেখে দিল টেবিলের ওপরে।
ভয়ে তার হৃদস্পন্দনের হার বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে গেছে রীতিমত, যদিও তার কোনো কারণই নেই! খাওয়া শেষ হলে টেবিল পরিষ্কার করে নিল ছেলেটা, নাজনীন সায়ন্তনীকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের ঘরে।
তারা দুজন উঠে গেলে সায়ান নিজের রুমে নিয়ে গেল আনানকে, বারান্দায় নিজের গাছের কালেকশন আর দোলনা দেখাবার জন্য টেনে নিল। বারান্দায় বড় একটা ড্রামে কাঠ গোলাপ, এক পাশে বেলি ফুলের গাছ আর ওপরে টানানো জালে অপরাজিতার লতা।
আনান যখন সেগুলো দেখছিল আচমকা বলে বসল সায়ান, “মে আই কিস ইউ মেঘ?”
রক্ত জমল আনানের মুখে। “এই সব কী ধরণের কথা?’
‘খুবই নরমাল ধরণের কথা। হরমোনাল প্রবলেম নাই এমন যে কোনো মানুষ এই মুহূর্তে এই কথাই বলবে!”
“প্লিজ সায়ান, তুমি…”
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, টেইক ইওর টাইম! চলো তাহলে ঘরে যাই!”
“থাকি আর একটু! ভালো লাগছে তো এখানে!”
“আমার লাগছে না, খুব গরম আমার বারান্দায়!”
“তাহলে এলে কেন?” একটু রেগে গেল আনান।
হাসল সায়ান। “বারান্দায় এনেছিলাম তো তোমাকে কিস করব বলে, ঘরে সিসি ক্যামেরা লাগানো তো!”
“কী! সত্যি?”
“মিথ্যা বলব কেন? তোমাকে বললাম না আম্মু আমাকে বিশ্বাস করে না? আচ্ছা চলো ঘরে চলো, রিয়েলি আই ফিল সাফোকেটেড হিয়ার!”
আনানের কী মনে হলো, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে ফেলল, “ইউ মে কিস মি!”
এখান থেকে দেখা যাচ্ছে সন্ধ্যার ঢাকার আলো ঝলমলে রূপ, বারান্দায় আলো না থাকলেও অন্ধকারও নেই। কথাটা বলে ফেলেই চোখ বন্ধ করে ফেলল আনান, এটা কী বলে ফেলল সে?
শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল অধর স্পর্শের, কিন্তু কনিষ্ঠা আঙুলে ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলল অবাক হয়ে। হাসছে সায়ান।
“তুমি আমাকে ভয় পাও কেন মেঘ? তুমিও কি আমাকে বিশ্বাস কর না! আমি কি জানি না তুমি কেমন মেয়ে?”
তীব্র আনন্দে জল এলো আনানের চোখে, ভয় হলো এত সুখ সইবে তো ওর কপালে? সায়ান ওর হাত মুঠোতে পুরে নিয়ে এলো ঘরে, মৃদু স্বরে বলল, “আম্মু সিসি ক্যামেরায় দেখছে আমাদের, এতক্ষণ বারান্দায় থাকতে দেখলে সন্দেহ করবে!”
একটু পরেই ডিনারের জন্য ডাক পড়ল ওদের, সায়ান বলল, “মাত্রই হাবিজাবি খেলাম, পেটে জায়গা নাই তো আম্মু!”
“না থাকলে নাই, আমি আর তনু এখন লোকেশন দেখতে যাব। নতুন একটা শো রুম নেব এখানে, একদম প্রাইম লোকেশনে।“
“তাহলে চলে যাও, আমি সার্ভ করে দেব আনানকে!”
“না, এটা কোনো কথা হলো? ও গেস্ট না?”
আনান পরিস্থিতি বুঝতে পেরে বলল, “আন্টি ঠিক আছে, আমি খেতে পারব! সায়ান তুমি একটু পরেই খেলে নাহয়?”
“হ্যাঁ তাই হোক, ওরই তো বাসা, ও পরেই খাক। তুমি খেয়ে নাও!”
নাজনীন আদর করেই বেড়ে খাওয়ালেন আনানকে, অনেক দিন পর বাসার খাবার খেতে পেয়ে আবার চোখে পানি এসে পড়তে চাইছিল ওর কিন্তু সামলে রাখল জোর করে। খাওয়া শেষ করে আবার বক্সে ভরেও দিলেন খাবার, আনানের মনে হতে লাগল মিছেমিছি ভয় পাচ্ছিল ও।
খাওয়া শেষ হতে জিভ কামড়ে বললেন নাজনীন, “ইস ড্রিংক্স আনা হয়নি যে? এ রকম ভুল কীভাবে হলো?”
সায়ান বসে ছিল পাশেই, বলল, “নিচে দারোয়ানকে পাঠিয়ে দাও, কিংবা ইউনুসকে?”
“না, তুমিই যাও, দারোয়ানকে পাঠানো যাবে না, আর ইউনুসেরও এখন কাজ আছে!”
“তাহলে ড্রিংকস খাওয়া লাগবে না আনানের!”
“বেয়াদবি করো না, আমি বলছি যাও! আর আসার সময় ফার্মেসি হয়ে আসবে, আমার ওষুধ শেষ!”
“তাহলে তো অনেক সময় লাগবে আম্মু!”
“লাগুক, আমি আনানকে উবার ডেকে দেব!”
“ড্রিংক্স লাগবে না আন্টি” বলে আনানের ক্ষীণ প্রতিবাদ কানেই পৌঁছাল না তাঁর। খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে ডাইনিং টেবিলেই এসে আবার বসল আনান।
সায়ান বেরিয়ে যাওয়ার পাঁচ মিনিট পর নাজনীন বসলেন আনানের সামনে, মুখোমুখি। কিছুটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বললেন, “আমার ছেলেটা একটা পাগল!”
কথাটা বুঝতে পারল না আনান। “জি আন্টি?”
“যখন যেটার ঝোঁক ওঠে তখন সেটা লাগবেই!”
আনান চুপ করে রইল। অপেক্ষা করতে লাগল।
“এই দেখো না, একবার ডাস্টবিন থেকে ময়লামাখা নোংরা একটা রাস্তার বিড়াল কুড়িয়ে নিয়ে এসে সে কি আদর যত্ন! আমি যতই বোঝাই যে রাস্তার বিড়ালকে বাসায় এনে নিজের খাটে তোলা যায় না, বাসায় দরজার সামনে খাবার খাইয়ে বিদায় দিলেই চলে! বিড়াল পোষার শখ হলে একটা পারসিয়ান বিড়াল কিনে দিই, না তার সেই রাস্তার বিড়ালটাই লাগবে, সেটা ছাড়া চলবেই না! আরে আমাদের একটা লেভেল আছে না?”
কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করতে লাগল আনান। লেভেল?
“বিয়ের বয়স হয়েছে বলেই কি যাকে তাকে ধরে এনে বিয়ের কথা পাড়তে হবে? লেভেল বুঝতে হবে তো!”
কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল আনানের। কী বলবে ভেবে পেল না সে।
“বাই দ্যা ওয়ে তোমার বাবা কী করেন বললে? দোকানদার না?”
উঠে দাঁড়াল আনান। এত অপমান সহ্য করার কোনো অর্থ হয় না।
“আন্টি আপনার যেমন বুটিকের বিজনেস, আব্বার তেমনই একটা শাড়ীর দোকান। স্রেফ তারটা ছোট, আর আপনারটা একটু বড় পরিসরে এই আর কী! আর ব্যবসা বলেন আর দোকানদারি, কোনোটাই কিন্তু হারাম কিছু নয়। ব্যবসা করা সুন্নত, আমাদের নবীজীও ব্যবসা করতেন।“
“হাউ ডেয়ার ইউ! বেছে বেছে আমার ছেলেটাকে বোকা পেয়ে টার্গেট করে আবার আমাকে সুন্নাত শিখাচ্ছ?”
“না আন্টি আপনাকে শেখাব এত শিক্ষা কোথায় আমার। তবে কাউকে টার্গেট করার শিক্ষা আমার দোকানদার আব্বা আমাকে দেননি। নিজের পথ নিজে চলার মত শিক্ষাটুকু আমি পেয়েছি। রান্না খুব মজা ছিল আন্টি। থ্যাংকস ফর দ্যা ডিনার। আসি আজকে। আসসালামু আলাইকুম।“
দরজা খুলে বেরিয়েই আনান দেখল সায়ান দাঁড়িয়ে আছে দরজায়, হাতে ড্রিংক্সের বোতল। দেখেই কান্না উথলে উঠতে লাগল তার।
সায়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বেরিয়ে গেল আনান। লিফটের অপেক্ষা করল না, নেমে গেল সিঁড়ি বেয়েই।
পেছন থেকে ভেসে আসতে লাগল সায়ানের আকুল করা ডাক। আসুক, আপাতত এই ডাক শোনার সময় নয় আনানের।
স্রষ্টা আমাকে বধির করে দাও, আমি যেন প্রিয়র ডাক শুনে বিচলিত না হই, আমি যেন তার কাছে ছুটে না চলে যাই। হায় এই অল্প কিছু সময় আগেও যে সন্ধ্যা এত মনোরম, এত রঙিন ছিল, তার আগাপাশতলা এমন নিকষ কালো কালির অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল কে?
সুখ তোমার স্থায়ীত্ব কতই না অল্প সময়ের জন্য। হাওয়াই মিঠাইয়ের মত, রঙিন সাবানের ফেনার বুদবুদের মত কেবলই উড়ে যেতে, উবে যেতে শিখেছ।
যদি সুখের মুহূর্তগুলোকে মুঠোয় বন্দি করা যেতে, পুরে রাখা যেত কোনো জাদুর বাক্সে! এত মন খারাপ করা সন্ধ্যা এই শহরে আর কখনো নামেনি আনানের জন্য।
আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল তখন, সারা দিন ধরে জমিয়ে রাখা জলীয় বাষ্প উজাড় করে দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরে পড়তে লাগল আকাশের অশ্রু। আর সেই অশ্রুর সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যেতে লাগল এক দুঃখী তরুণির চোখের জল, অল্প কিছু ক্ষণ আগেই নতুন করে যার স্বপ্নগুলো ভেঙে চুরে টুকরো টুকরো হয়ে ছত্রখান হয়ে ছড়িয়ে গেছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here