#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি,২৫,২৬,২৭
।।২৫।।
ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সকাল থেকেই আজ বৃষ্টির বিরাম নেই।
কাজী অফিসের সেই ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনার পর কেটে গেছে দুই সপ্তাহ। পরীক্ষা শেষের ছুটি শেষ হয়ে আবার নতুন করে ক্লাস শুরু হয়েছে আনানদের।
মানসিকভাবে একদম ভেঙে পড়েছিল আনান, যদিও এখন অনেকটাই সামলে উঠেছে। তারপরও ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে সব সময়।
প্রেম করা মানেই খরচের ব্যাপার, সায়ানের সাথে ঘোরাঘুরি করবার সময়ে বিল শেয়ার করার জন্য টিউশ্যনি থেকে অগ্রিম বেতন নিয়েছিল, মালিহা আপুর কাছেও ঋণ হয়ে গেছে অনেক। খাবারের বাজেট থেকে, রিকশা ভাড়া থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলছে আনান। আংটি তো ফেরত দিয়েই দিয়েছে, শাড়ির দামটাও দিয়ে দেবে সে সায়ানকে। ভাগ্যিস নতুন একটা টিউশ্যনি পেয়েছিল, না হয় সামলানো মুশকিল হয়ে যেত। কোচিং সেন্টারে একটা এক্সট্রা ক্লাস পেয়েছে, সেখান থেকেও কিছু আসবে। কিন্তু এত সব সামলে নিজের পড়ার জন্য প্রচণ্ড পরিশ্রম করতে হচ্ছে ওকে ইদানীং, টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে জেগে থাকতে হচ্ছে অনেক রাত পর্যন্ত। কমে গেছে ঘুমের সময়টা।
নিজের দিকেই প্রচণ্ড রাগ উঠে যায় এক এক সময়। কীভাবে এই রকম ভুল করে বসলো সে?
সকাল থেকেই এই মন খারাপ করা বৃষ্টিতে বের হতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। কিন্তু সকালে আই ডি স্যারের খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা ক্লাস ছিল আজকে।
এই স্যারের ক্লাসে প্রক্সি দেওয়া যায় না। যদিও প্রক্সি দেওয়ার মত প্রাণের বন্ধু কেউ নেই আনানের।
তারপরও আসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না, প্রক্সি দেওয়া সম্ভব হলে আজকে দিয়ে দিতে বলত। তা ছাড়া আজকে রেজাল্ট আউট হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
প্রথম ক্লাস শেষ করে ক্লাস রুম থেকে ইচ্ছে করেই একটু দেরি করে বের হলো আনান যেন কারো সাথে দেখা না হয়ে যায়। কিন্তু এত করেও শেষ রক্ষা হলো না।
সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে ছিল জিসানদের গ্রুপের সবাই। পাশ কাটিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আনান আচমকা পেছন থেকে তাকে ডাকল সুমাইয়া, “এনি এই এনি এদিকে শুনে যা!”
নিতান্ত অনিচ্ছায় পেছনে ফিরল আনান, “কী হয়েছে?’
“শুনলাম তুই নাকি ডিভোর্সি!”
মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে গেল আনানের মুখ। করিডোরে হেঁটে যাচ্ছিল আরো কয়েকজন, এ কথা শুনে তারাও ফিরে তাকাল এদিকে।
“তুই নাকি তোর হিরোকে আগে বলিস নাই? কাহিনীটা কী বল তো?”
“আমি বলছি কাহিনীটা কী।“ আনান কিছু বলবার আগেই উঠে দাঁড়াল সিঁড়িতে বসে থাকা জিসান।
আনানের মনে হতে লাগল পৃথিবীটা বন বন করে ঘুরছে। মাটিটা যেন একটু একটু দুলছে।
আজ এত দিন পর এই ভাবে এত মানুষের সামনে তার ডিভোর্সের ব্যবচ্ছেদ করা হবে এ কথা কখনো ভাবেনি সে। যেন কিছুটা জোর ফিরে পেতেই কাছাকাছি থাকা সিঁড়ির রেলিংটা আঁকড়ে ধরে ফেলল আনান।
“কাহিনীটা হচ্ছে”, কথা চালিয়ে গেল জিসান, “এনির যার সাথে বিয়ে হয়েছিল তার সাথে ম্যাচ করেনি, যে কোনো কারণেই হোক। তাই এনি তাকে ডিভোর্স করেছে। তোর মত হাজব্যাণ্ডকে সাইনবোর্ডের মত লাগিয়ে রেখে ভার্সিটি এসে আরেকজনের সাথে ঝুলাঝুলি করেনি!”
“হোয়াট ডু ইউ মিন? আমি ঝুলাঝুলি করি?” টকটকে লাল হয়ে গেল সুমাইয়ার মুখ।
“ইউ নো ভেরি ওয়েল হোয়াট আই ডু মিন! নিজের দিকে তাকিয়ে কথা বল!”
“তুই কী জানিস আমার সম্পর্কে?”
“জানি আমি, সবই জানি, তোর হাজব্যাণ্ড তোকে সময় দেয় না, এই জন্য তুইও তোর নিজের মত করে নিজের রাস্তা দেখে নিচ্ছিস, এই তো? সব খবরই রাখি আমি, সব কথাই কানে আসে আমার! তোর হাজব্যাণ্ড ক্যারেক্টারলেস, তারও আদার ইনভলভমেন্ট আছে, এই সব বলবি তো? তাহলে থাকার দরকার কি তার সঙ্গে? ছেড়ে দে না তাকে! ঠিকই তো তার দেওয়া ফ্যাসিলিটিজ এনজয় করছিস! গাটস থাকলে বের হয়ে আয়, নিজের খরচে ডিগ্রি কর! সেই সাহস তো নাই!”
“ক্লাসলেস একটা মেয়ের জন্য তুই আমাকে ইনসাল্ট করলি জিসান? নিজেকে কী মনে করিস তুই? তুই অনেক বড় কিছু হতে পারিস কিন্তু আমিও কম না!”
বাঁকা করে হাসল জিসান। “তুই আর কী? আসিস শ্বশুরবাড়ির গাড়িতে, পড়িস হাজব্যাণ্ডের টাকায়, অফ টাইমে শপিং করিস বয়ফ্রেণ্ডের টাকায়! এনি এট লিস্ট সেলফ মেইড পারসন, সে তার নিজের টাকায় চলে!”
“এই সব কথা তোর এখানে দাঁড়িয়ে বলতে হলো? এই সিঁড়ির সামনে? এই করিডোরে?”
“কী করব ইয়ার। তুই যেখানে কথা শুরু করেছিস সেখানেই তো শেষ করতে হবে!”
উঠে পড়ল সুমাইয়া। “এনাফ ইজ এনাফ! তুই আজকে যা করলি, এর ফল ভালো হবে না জিসান। এর রেজাল্ট তুই পাবি! জাস্ট সি হোয়াট হ্যাপেনস নেক্সট!”
ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গট গট করে বেরিয়ে গেল সুমাইয়া। সাধারণত রিয়াজ সব সময় সঙ্গ নেয় তার।
কিন্তু আজ সে নড়ল না জায়গা ছেড়ে। আনান তখনো রেলিং আঁকড়ে ধরে তাকিয়ে আছে ফ্যাকাসে মুখে।
জিসান সেদিকে তাকিয়ে থেকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “কিছু হয়নি এনি! এভরিথিং ইজ এবসোলিউটলি অলরাইট!”
#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।২৬।।
ভার্সিটিতে সায়ান কিংবা জিসান, কারো সাথেই দেখা হচ্ছে না আর। ভাগ্যিস হচ্ছে না, হলে সেটা খুবই অস্বস্তির ব্যাপার হতো।
জিসানের সাথে যে দুই একটা ক্লাসের লেকচার গ্যালারিতে দেখা হয়ে যায় সেগুলোতে চোখে চোখ পড়ে না। জিসান না চেনার ভান করে এড়িয়ে যায় তাকে।
আনানও তাই।
আজকে সেকেণ্ড ক্লাসটা হবে না, দুই ক্লাসের বিরতিতে লাইব্রেরিতে বসে সময় কাটাচ্ছে আনান। লাইব্রেরিতে ব্যাগ নিয়ে ঢোকা যায় না, লাইব্রেরির সামনে ব্যাগ রাখবার জন্য একটা শেলফ আছে।
সেই শেলফে ব্যাগ রেখে তারপর ঢুকতে হয়। কেউ যেন লাইব্রেরিতে খাবার দাবার নিয়ে ঢুকতে না পারে কিংবা লাইব্রেরির কোনো বই ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতে না পারে সে জন্য এই ব্যবস্থা।
প্রতি দিনের মতই সেই শেলফের একটা তাকে ব্যাগ রেখে লাইব্রেরির ভেতরে ঢুকেছিল আনান। বৃষ্টিটা একটু ধরে এসেছে, লাঞ্চের জন্য উঠল আনান।
ব্যাগ রাখবার শেলফে এসে যেখানে ব্যাগ রেখেছিল সেখানে খুঁজে পেল না। হয়ত অন্য কেউ নিজের ব্যাগ রাখবার জায়গা না পেয়ে অন্য কোনো তাকে রেখেছে।
শেলফের সবগুলো তাক খুঁজতে লাগল আনান। তার ব্যাগে মূল্যবান কোনো জিনিস নেই, মোবাইল ফোন তার সাথেই সাইলেন্ট করে রাখা থাকে টাকার ছোট পার্সের ভেতর, সেটা বই খাতার সাথে নিয়েই ঢোকে সে লাইব্রেরির ভেতরে।
তার ব্যাগে কোনো দুষ্প্রাপ্য মেইন টেক্সট বুকও নেই কিংবা দুর্লভ কোনো নোটসও নেই যেটার জন্য কেউ তার ব্যাগ চুরি করতে কিংবা না বলে নিয়ে যেতে পারে। সুতরাং আনান শঙ্কিত হলো না একেবারেই।
হয়ত কোথাও মিসপ্লেসড হয়েছে। যা ভেবেছিল তাই।
শেলফের সামনের তাকগুলো দেখা শেষ করে পেছনের তাকগুলোর মধ্যে একেবারে নিচের তাকে নিজের ব্যাগটা খুঁজে পেল আনান। “কি একটা অবস্থা!”
নিজের মনেই কথাটা বলে ব্যাগটা তুলে নিয়ে ক্যাফেটারিয়ার দিকে রওনা দিল সে। ব্যাগ খোঁজাখুঁজি করতে গিয়ে অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে, লাঞ্চের সময় থেকে সেই সময়টা মাইনাস হবে।
না হয় নেক্সট ক্লাসটা মিস হয়ে যাবে। তাড়াহুড়ো করে গিয়ে বসে খিচুড়ির অর্ডার দিল সে।
হু হু করে উঠল বুকের ভেতরটা। কয়েক দিন আগেও এখানে সায়ানের সঙ্গে আসত।
সুন্দর সময়গুলো কেমন দ্রুতই ফুরিয়ে যায়।
রাশ আওয়ার তাই খাবার চলে এলো তাড়াতাড়িই, আনানও তাড়াতাড়িই খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে এলো। ক্লাস শেষ করে রেজাল্ট বোর্ডে রেজাল্ট দেখতে দাঁড়াল।
সেখানে যাওয়ার পর দেখল সবাই কেমন যেন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে পারল না আনান।
নোটিশ বোর্ডে রেজাল্ট শিটের কোথাও নিজের রোল খুঁজে পেল না আনান। এমনকি রেফার্ড লিস্টেও না।
আনান যখন হতবুদ্ধি হয়ে চিন্তা করছে ব্যাপারটা কী হলো এমন সময় তার চোখে পড়ল রেজাল্ট শিটের পাশাপাশি আরো একটা কাগজে বড় করে লেখা আছে তার নাম এবং রোল নাম্বার। প্রথমে নোটিশটা পড়ে মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না সে।
কয়েক বার পড়ে বুঝতে পারল পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের প্রমাণ পাওয়ার কারণে এই ব্যক্তির ফলাফল স্থগিত করা হয়েছে এই ধরণের কিছু একটা লেখা রয়েছে। পরবর্তী নোটিশ জারির আগে পর্যন্ত এই ব্যক্তি যেন ক্লাসে না আসে।
পরীক্ষায় অসদুপায়? আনফেয়ার মিনস?
এমন কিছুই তো মনে করতে পারছে না সে! নিশ্চয়ই কোথাও কিছু একটা ভুল হচ্ছে।
বিচলিত না হয়ে অফিস রুমের দিকে রওনা দিল সে। কিন্তু স্টুডেন্ট কোওর্ডিনেটর দেখা করলেন না তার সাথে।
তার পিএ জানিয়ে দিল, “এই ব্যাপারে তদন্ত চলছে, তদন্ত চলাকালীন সময়ে এই ব্যাপারে স্যার কারো সাথেই কথা বলবেন না।“
পুরোপুরি হতভম্ব অবস্থায় বেরিয়ে এলো আনান। টিউশ্যনিতে যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছে এমন সময় এক মহিলা এসে পথ আটকাল তার।
“আম্মা আমার স্যারারে একটা ফোন করতে দিবাইন?”
“কে আপনি?”
“আমি আমার স্যারারে হারায়ে লাইছি! আমার ব্যাগ আছিন স্যারার কাছে, ব্যাগে মুবাইল, টেয়ার ব্যাগ…”
অঝোরে কাঁদতে শুরু করে মহিলাটি।
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে! নাম্বার বলেন আমি ডায়াল করে দিচ্ছি!”
নাম্বারে ডায়াল করে দিল আনান। মহিলাটি ফোন কানে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে শুরু করল, “আব্বা তুই কই?”
কথা বলতে বলতে উলটো দিকে ঘুরে গেছে মহিলাটি, হয়ত কী কথা হচ্ছে আনানকে শুনতে দিতে রাজি নয় সে। তাকে প্রাইভেসির সুযোগ দিয়ে একটু দূরে সরে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল আনান।
এক মিনিট পরেই ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে চলে গেল মহিলাটি। আনানও চলে গেল টিউশ্যনিতে।
টিউশ্যনি শেষ করে ঘরে ফিরে কলিং বেল চাপতে গিয়ে আনান অবাক হয়ে দেখল দরজাটি হালকা খোলা। কী ব্যাপার?
মালিহা আপু কি কোনো জরুরি প্রয়োজনে দরজা খোলা রেখেই বাইরে গেছে? হালকা সতর্ক হয়ে জুতো খুলে ঘরে ঢুকল আনান।
সব তো ঠিকই মনে হচ্ছে। গেট লাগিয়ে ভেতরে ঢুকে ব্যাগটা রেখে ওড়নাটা খুলে চেয়ারে ঝুলিয়ে রাখল আনান।
আচমকা পেছন থেকে কে যেন জড়িয়ে ধরল তাকে। এক জোড়া শক্ত পুরুষালী হাত গা ঘিনঘিন করা কুৎসিত স্পর্শ নিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগল তার সারা শরীর জুড়ে।
নিজের অজান্তেই চিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ দিয়ে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা সাথে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল সে।
মনে প্রাণে খোদাকে ডাকতে লাগল সে। খোদা কি তাকে রক্ষা করবে না?
যেন তার প্রার্থনার উত্তরেই কলিং বেলটা বেজে উঠল আবার। একটু বুঝি শিথিল হয়ে এলো হাতের বাঁধন, এক ছুটে গেটের সামনে এসে গেট খুলে দিল আনান।
গেটের সামনে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন বাড়িওয়ালা আন্টি, মুখে রাজ্যের কাঠিন্য। তার পেছনে দারোয়ান।
কেঁদে ফেলল আনান।
বাড়িওয়ালা কঠিন মুখে বললেন, “আমি খবর পেলাম এই ফ্ল্যাটে নাকি অসামাজিক কাজ চলছে?”
বিস্ময়ে চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে গেল আনানের। অসামাজিক কাজ?
আনান হতভম্ব হয়ে বলল, “মানে?”
“মানেটা তো তোমারই ভালো জানবার কথা!”
ভেতর থেকে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হেলে দুলে বেরিয়ে এলো এক লোক, যাকে আনান জীবনেও কোনো দিন দেখেনি। কিছু ক্ষণ আগের ঘটনার কথা চিন্তা করেই গা শিউরে উঠছিল, তাই চোখ তুলে ভালো ভাবে তাকিয়ে দেখতেও পারছিল না সে।
লোকটা এসে বিরক্ত ভঙ্গিতে আনানকে বলল, “এই মেয়ে তুমি তো বল নাই তোমার ফ্ল্যাটে এত ঝামেলা? তুমি তো বললা তুমি তোমার রুমমেটকে বের করে দিচ্ছ, কোনো সমস্যা নাই? এত অসুবিধা জানলে তো হোটেলেই যেতে পারতাম!”
রীতিমত আকাশ থেকে পড়ল আনান। “আমি বললাম আপনাকে এই কথা? আমি!”
“তো কি মেয়ের অভাব আছে নাকি ঢাকা শহরে? তুমিই তো বিকাল চারটায় ফোন করে বললা! আপনারা ওর ফোন চেক করে দেখেন!”
আনান কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়িওয়ালা আন্টি ফ্ল্যাটের ভেতরে ঢুকে বললেন, “কই বের কর তোমার ফোন!”
হতবিহবল হয়ে পার্স থেকে ফোন বের করে দিল আনান। বিকাল চারটায় সত্যি সত্যিই একটা আননোন নাম্বারে কল করা হয়েছে।
বাড়িওয়ালা আন্টি কল করলেন সেই নাম্বারে। ফোন বেজে উঠল লোকটার পকেটে।
বিজয়ীর ভঙ্গিতে হাসল সে। “বলছিলাম না, এই রকম মেয়েরা কত নাটক জানে! নিজেই মিটিং ফিক্স করে এখন সতী সাজতেছে!”
আর পারল না আনান। কান্নায় ভেঙে পড়ল।
“আন্টি আপনি বিশ্বাস করেন এই সব কিছুই আমি জানি না!”
“কই দেখি তোমার জিনিসপত্র চেক করে!”
আনানের ব্যাগের সব জিনিস ঢেলে ফেলা হলো। ব্যাগের একটা সিক্রেট পকেট যেখানে আনান স্যানিটারি ন্যাপকিন রাখে হুট করে পিরিয়ড শুরু হয়ে গেলে বিপদে না পড়ার জন্য সেখান থেকে টুপ করে নিচে পড়ল এক প্যাকেট কনডম!
মাটিতে বসে পড়ল আনান। কাঁপতে কাঁপতে বলল, “আল্লাহ্র কসম বলছি আন্টি, এই সবের কিছুই আমি জানি না!”
#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
।।২৭।।
নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না আনানের। বাড়িওয়ালা আন্টি তার সব জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছেন সিঁড়ির ওপর থেকে।
সেই সাথে মুখে অশ্রাব্য গালি গালাজ। আশে পাশের ফ্ল্যাটগুলো থেকেও মেয়েরা বের হয়ে এসে উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে।
আনানের মনে হচ্ছে কোনো অলৌকিক উপায়ে মাটিটা দু ভাগ হয়ে যেত এখন। সে তাহলে মাটির নিচে ঢুকে যেতে পারত।
“ভদ্র ঘরের মেয়ে দেখে থাকতে দিয়েছিলাম, ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্ট! সে যে ঘরে কাস্টমার নিয়ে আসবে তা কে জানত? আরে সেমিস্টার ফি দিতে না পারলে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়া লাগে কেন? এই জন্যই সবাই বলেছিল প্রাইভেট ভার্সিটির স্টুডেন্ট না রাখতে! আরে ঢাকা শহরে কি হোটেলের অভাব? সেগুলোর কোনোটায় কাস্টমার নিয়ে উঠতি!”
সব কিছু ছুঁড়ে ফেলা শেষ করে সশব্দে গেট বন্ধ করে দিলেন আন্টি। ঘটনার আকস্মিকতায় এবং তীব্র ধাক্কায় আনানের চোখের জল শুকিয়ে গেছে।
তার হলুদ রঙ করা স্টিলের ট্রাংকের ওপরে বসে আছে সে চুপ করে, রাত আনুমানিক সাড়ে দশটা বাজে। এই এত রাতে কী করবে সে, কোথায় যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
কিন্তু যেতে তো হবেই, যাওয়ার আগে এক বার মালিহা আপুকেও ফোনে জানিয়ে যেতে হবে। আপু তার কাছে বেশ কিছু টাকা পায়, এভাবে না বলে চলে যাওয়াটা ভালো দেখায় না।
তা ছাড়া মালিহা আপু তার রুমমেট, অন্যদের কাছ থেকে ঘটনাটা শুনে ভুল ধারণা করলে ভালো লাগবে না আনানের। সব কিছু ভেবেই স্টিলের ট্রাংকের ওপরে বসেই মালিহা আপুকে ফোন করল সে।
মালিহা আপু তার ফোন রিসিভ করেই প্রায় চিৎকার করে বলল, “আনু! তুমি কোথায়? কেমন আছ!”
আনান হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “আমি ঠিক আছি আপু! কিন্তু আপনি কোথায়?”
“আমি তো তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি! তুমি আসলে ঠিক কোথায় বল তো? ওয়ার্ড নাম্বার কত?”
“ওয়ার্ড নাম্বার! ওয়ার্ড নাম্বার মানে? কীসের ওয়ার্ড নাম্বার?’
“ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের ওয়ার্ড নাম্বার!”
“মানে? ঢাকা মেডিকেলে কী?”
“কেন তুমি এখানে ভর্তি না?”
“কই আপু, না তো! আমি তো বাসার সামনে, মানে গেটের সামনে!”
“শিট! আমাকে যে একজন ফোন করে বলল তুমি এক্সিডেন্ট করেছ, তোমাকে ঢাকা মেডিকেল নিয়ে এসেছে?”
“এই সব কী বলেন আপু? আমি তো এই টিউশ্যনি শেষ করে ফিরলাম! আপনি আমাকে ফোন করেন নাই কেন আপু?”
“অসংখ্য বার ফোন করেছি! প্রত্যেক বার বিজি দেখায়!”
“কিন্তু কেন?”
“আচ্ছা আমি আসছি! কী যে হলো কিছুই বুঝতে পারছি না!”
ফোন রেখে নিজের ফোনটা চেক করল আনান। তার ফোন থেকে মালিহা আপুর নাম্বার ব্লক করে রাখা।
এই জন্যই মালিহা আপু প্রতি বারই তার ফোন বিজি পাচ্ছিল। কিন্তু সে তো ব্লক করেনি!
কে করল তাহলে? আনানের ইচ্ছে হলো হাত পা ছড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদে।
সেই কোন সকালে বের হয়েছে, ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে এখন। চোখের সামনে গরম ভাতের থালা ভেসে উঠছে বার বার।
আচ্ছা এখন যদি সে গেটে নক করে বাসার ভেতরে না ঢুকে দারোয়ান ভাইকেই বলে এক গ্লাস পানি দিতে, সে কি দেবে না? মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে?
আরো এক ঘন্টার মত সময় লাগল মালিহা আপুর ফিরে আসতে আসতে। আনান তখন রাস্তায় পা লম্বা করে বসে পড়ে ট্রাংকের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়েছে, আর পারছিল না সে।
“আনু! এ কী অবস্থা তোমার? রাস্তায় এই ভাবে…”
মালিহা আপু কখনোই আনানের কাছের মানুষ ছিল না, কিন্তু আজকে এই রাত এগারোটায় এই স্ট্রিট ল্যাম্পের হলুদ আলোর নিচে এই রাস্তায় বসে একটা সামান্য কোমল কথায় হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল আনান।
“কেঁদো না! আরে এত কাঁদলে আমি বুঝব কী করে কী হয়েছে?”
কান্নার ফাঁকে ফাঁকে একে একে সব ঘটনা মালিহা আপুকে বলল আনান। সব শুনে আনানের মত হতবুদ্ধি হয়ে গেল মালিহা আপুও।
অসহায়ের মত জিজ্ঞেস করল আনান, “আপু, আমি এখন কী করব? কোথায় যাব?”
উঠে দাঁড়াল মালিহা আপু। “চলো, আমার বাসায়!”
“আপনার বাসায়?” কিছুটা অবাক হলো আনান।
মালিহা আপুর যে বাসায় আছে এবং সেটাও আবার ঢাকাতেই, ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি সে। গত দুইটা ইদের ছুটিতেও বাসায় যায়নি মালিহা আপু।
ফোনে উবার কল করে কাকে যেন ফোন করল মালিহা আপু। “আম্মু, আমি আসছি! আমার রুমমেটকে নিয়ে।“
ও পাশ থেকে কিছু একটা শুনে নিয়ে আবার বলল, “এসে বলছি!”
উবার পাওয়া গেল তাড়াতাড়িই, আনানের সব জিনিসপত্র আঁটল না সেখানে। স্টিলের ট্রাংকটা আগে ডিকিতে তুলে বই খাতা পত্র তোলা হলো।
অনেক টুকি টাকি জিনিস রাস্তাতেই ছড়িয়ে পড়ে রইল। গুছিয়ে প্যাকিং করে নামলে হয়ত আরো কিছু জিনিস নেওয়া যেত।
কিন্তু এখন আর সম্ভব না। পেছনে রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে লাগল আনানের টুথ ব্রাশ, সোপ কেস, সাবান, অর্ধেক খালি মুখে মাখার ক্রিম, টেবিল মোছার কাপড় আরো আরো অনেক কিছু।
রাত সাড়ে এগারোটায় মালিহা আপু আর বিধ্বস্ত আনানকে নিয়ে রওনা দিল উবারের গাড়ী।
চলবে