মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি (শেষ পর্ব)

0
991

#মেঘবতী_মিথ্যে_বলেনি
(শেষ পর্ব)

ছয় মাস পরের কথা। পাঁচ তারকা হোটেলটা আজ সেজেছে ঝলমলে সাজে, পুরো হল রুম বুক করেছেন ফারুক আহমেদ।
হতেই হবে, আজকে তার এক মাত্র ছেলে জিসান আহমেদের এনগেজমেন্ট, রাকিব চৌধুরীর মেয়ে রুবাবা চৌধুরীর সাথে। এত আয়োজনের সাথে একদম বেমানান সাজে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাধারণ একটি মেয়ে।
ফোন বের করে বার বার কাকে যেন কল করছে আর উদ্বিগ্ন মুখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। এক সময় প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এলো কাঙ্খিত মানুষটি।
মেয়েটি যেন প্রাণ ফিরে পেল তাকে দেখে। হাসল নার্ভাস ভঙ্গিতে।
“কী ব্যাপার জিসান?”
“কী করব, তুই তো প্রোগ্রামে আসতে রাজি হলি না!”
কাঁধ ঝাঁকাল মেয়েটি। “কী করব বল, ফাইভ স্টার হোটেলে পরে ঢুকবার মত জামা কাপড় নাই আমার! লোকজন ক্লিনার মনে করে ঝাড়ু ধরায়ে দিতে পারে!”
হি হি করে হাসতে শুরু করল আনান।
“উফ এনি, খালি টিজ করে কথা বলিস না তো!”
“আচ্ছা, আর বলব না! বলে ফেল তাহলে, কেন এমন জরুরি তলব?”
‘এনি, আমি না তোকে একটা কথা বলব ভেবেছিলাম, অনেক দিন আগে!”
আনান ঝলমলে গলায় বলল, “আমিও তোকে একটা কথা বলব জিসান!”
“কী কথা?”
“তুই আগে বল?”
“না তুই বল!”
“না তুই আগে বল!”
“সময় নষ্ট করিস না এনি, এক্ষুণি এনাউন্সমেন্টের জন্য ওরা আমাকে খোঁজাখুঁজি শুরু করবে! অনেক কষ্ট করে ওয়াশ রুমের কথা বলে বেরিয়েছি!”
“আমি একটা জব পেয়েছি জিসান! ক্যান ইউ বিলিভ?”
“ওয়াও, কংগ্র্যাচুলেশন্স! কী জব?”
“একটা অনলাইন পোর্টালের ট্রেইনি সাব এডিটর। একটা পেইজের দায়িত্ব পেয়েছি।“
“কী পেইজ?”
কাঁধ ঝাঁকাল আনান। “খুব একটা আহামরি কিছু না। ফ্যাশন এণ্ড কুকিং, এই সব হাবি জাবি আর কী!”
“স্যালারি কত?”
“স্যালারি খুব একটা বেশি না, লেখা অনুযায়ী টাকা। তবে অনলাইনে করতে পারব, এটাই বড় কথা। টিউশ্যনিগুলোর সাথে সাথে এটার বেতন দিয়ে হয়ে যাবে আমার।“
“তোর প্রেশার হয়ে যাবে না, ক্লাস টিউশ্যনি, আবার এটা?’
“কী করব, করতে তো হবেই! চালাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল।“
“তা ট্রিট পাচ্ছি কবে?”
আনান হাসল অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে। কিছু দিন আগেই রুবাবা তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছে, সে যেন জিসানের সাথে মেলামেশা না করে।
এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠানে জিসান দাওয়াত করলেও যেন না আসে। কারণ জিসানের আব্বু বিষয়টা পছন্দ করবেন না।
“জিসান, আমার মনে হয় তুই এখন আমার সাথে খাওয়া দাওয়া ওঠা বসা না করলেই ভালো!”
“কেন, কী হয়েছে? কেউ কি কিছু বলেছে তোকে?”
উত্তর দিল না আনান, অন্য দিকে তাকিয়ে রইল। জিসান নিজের মত করে বুঝে নিল কিছু একটা কিংবা আব্বুর সাবধানবাণী মনে করে চুপ করে গেল।
“তুই যেন কী একটা বলবি বলেছিলি?”
রাস্তার আলোকসজ্জার ঝলমলে আলোতে রহস্যময় দেখাচ্ছে আনানের মুখ, সেদিকে তাকিয়ে কষ্ট করে হাসল জিসান। “আসলে সময়ের কথাগুলো ঠিক সময়ে বলে ফেলতে হয়! ঠিক সময়টা হারিয়ে গেলে পরে আর সেই সব কথার কোনো অর্থ থাকে না!”
“বিড় বিড় করে কী বলছিস তুই?”
“কিছু না! এনি, তুই বাসায় ফোন করিস!”
“মানে?”
“মানে, তোর আম্মুকে ফোন করিস। ভালোবাসার মানুষগুলোকে দ্বিতীয় বার চান্স দিতে হয়। আমরা বাঁচি কয় দিন বল?”
“তোর কী হয়েছে জিসান?”
“আমার কিছু হয়নি এনি! তুই খুব ভালো থাকবি প্রমিস কর!”
“তা না হয় করলাম, কিন্তু তুই তোর সেই কথাটা বল!”
“সেই কথাটা…” নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে রাস্তায় চলমান যানবাহনগুলোর দিকে তাকাল জিসান।
“এনি তোর কি মনে আছে এক দিন ক্যাম্পাসে আমি তোর পার্স থেকে এক হাজার টাকা তুলে নিয়েছিলাম জোর করে, পহেলা বৈশাখের প্রোগ্রামের চাঁদার জন্য?”
“হ্যাঁ, মনে আছে, মনে থাকবে না কেন? খুব তো বেশি দিন আগের কথা নয়!”
“সেই দিন তুই বৃষ্টি থামার পরে মাটিতে বসে কৃষ্ণচূড়া ফুল কুড়াচ্ছিলি, তোর মনে আছে?”
“হ্যাঁ আছে, কেন মনে থাকবে না! এই তো সেদিনের কথা!”
“সেদিন তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল, কখনো বলা হয়নি!”
প্রাণ খুলে হেসে উঠল আনান। “এই কথা বলার জন্য এত ঢং করা লাগল?”
পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল জিসান। সিক্রেট পকেট থেকে বের করে আনল একটা প্লাস্টিকের টুকরোয় মোড়ানো কৃষ্ণচূড়া ফুল।
“এই দেখ এনি, এটাও সেদিনের ফুল! তুই চলে যাওয়ার পর সেদিন আমিও কুড়িয়ে রেখে দিয়েছিলাম সেদিনের একটা ফুল!”
“তোর কী হয়েছে জিসান?”
সন্তর্পণে ফুলটা ছিঁড়ে দুই ভাগ করল জিসান। এক ভাগ আনানের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “একটা পাপড়ি তোর কাছে থাক, আরেকটা আমার কাছে! এখন হিসাবটা বেশ সমান সমান হয়েছে!”
“এসব কথার মানে কী, জিসান?’
“জিসান তুই এখানে? ওই দিকে সবাই তোকে হারিকেন দিয়ে খুঁজছে!”
ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে জিসানের এক কাজিন, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জিসানের দিকে। জিসান রুক্ষ গলায় বলল, “তুই যা আমি আসছি!”
আচমকা সতর্ক হয়ে গেল আনান। অনেক হয়েছে, জিসানের এই সব পাগলামিকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
আনান চাপা গলায় বলল, “জিসান ভেতরে যা, আর রাত হয়েছে, আমিও গেলাম!“
“তুই অনেক ভালো থাকবি তো?”
“হ্যাঁ, অনেক ভালো থাকব, আর বাসায় ফোনও করব! প্রমিস! এবার যা! বাই!”
রাস্তার এ পাশে বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ, কিন্তু কোনো ফুল নেই তাতে। এটাই নিয়ম, ঝুম বর্ষায় ঝরে যায় সব কৃষ্ণচূড়া।
গাছ মুষড়ে পড়ে না তাতে, অপেক্ষা করে পরের বছরের জন্য, নতুন করে আবারও নিজেকে সাজাবে বলে। একটা ভুল জীবনকে থামিয়ে দিতে পারে না, শুধু অপেক্ষা করে যেতে হয় সঠিক মৌসুমের।
জিসানকে ওভাবে রেখেই হাঁটতে শুরু করল আনান, একই শহরে একই ক্লাসে খুব কাছাকাছি পাশাপাশি থেকেও হয়ত আর কোনো দিন কথা হবে না তাদের দুজনের। আচ্ছন্ন চোখে তাকিয়ে থেকে জিসান দেখতে লাগল শহরের জনারণ্যে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে।
যে মেয়েটি মিথ্যে বলেনি কিন্তু ভুল করেছিল, ভুল করেছিল, ভেঙে গিয়েছিল তারপর আবারও শুরু করতে চেয়েছিল। যে মেয়েটা জানে সে কখনো সিণ্ডারেলা হবে না, হতে চাইবেও না, যার জন্য আসবে না কোনো ফেইরি গডমাদার কিংবা রাজকুমার।
কাঁচের জুতো নয়, যাকে হাঁটতে হবে সাধারণ জুতো পরেই। যে নিজেই খুঁজে নিতে শিখবে নিজের পথ।
মেয়েটা চলে যাচ্ছে দূরে আরো দূরে, এই সব আনন্দ আয়োজন থেকে বহু দূরে। দূরে আলোর বিন্দুগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে, জিসানের চোখের সামনে থেকে মেয়েটা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের ওপরে জমে ওঠা জলের পাতলা পর্দায়।
এক সময় ঝাপসা হতে হতে দৃষ্টিসীমার আড়ালে হারিয়ে গেল মেয়েটির অবয়ব।

(মেঘবতীর অনলাইন জার্নি এখানেই সমাপ্ত। যারা গল্পটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সাথে ছিলেন ও গঠনমূলক মন্তব্য করে উৎসাহ দিয়ে গেছেন সবাইকে জানাই অশেষ কৃতজ্ঞতা আর প্রাণ ঢালা ভালোবাসা। আল্লাহ্‌ হাফেজ।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here