অলকানন্দা #পর্ব-১,০২

0
1922

#অলকানন্দা
#পর্ব-১,০২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
০১

১.
“আমার স্বামী ছোট বাচ্চাদের মাংস খায়। ও বুবু শোনেন বুবু আমার স্বামী ছোট বাচ্চাদের মাংস খায় যে। হি হি হি।”

বলেই খপ করে মাহার হাতটা ধরলো সাদা এলোমেলো শাড়ি পরনে এক মহিলা। চুলগুলো জমাট বাঁধা, মুখের একপাশ দিয়ে লালা বেরুচ্ছে। ঈষৎ কালচে বদনের রঙ। ছিপছিপে পাতলা গড়নে শরীর। আহা! কি বিভৎস!
“আল্লাহ!” বলে চিৎকার করে উঠলো মাহা। তার হাতটা খামচে ধরেছে পাগলী। মাহার আকস্মিক চিৎকারে চা কিনা ফেলেই সেদিক পানে দৌড়ে এলো চৈতি। লোকজনের আনাগোনা নেই বললেই চলে। মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। চৈতিকে দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো মাহা।

“চৈতি, চৈতি আমাকে বাঁচা। দেখনা আমার হাতটা খামচে ধরেছে। আর কিসব বলছে।”

পাগলীটা হু হা করে হেসে উঠলো। তবে মাহার হাতটা ছাড়লোনা। বিকট হাসি থামিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো সে।
“ও বুবু, আপনার বিপদ আছে যে। আমার স্বামী মেয়েদের মাংসও খায় যে।”

চৈতি এগোনোর চেষ্টা করলো তাদের দিকে। পাগলী চৈতির দিকে ফিরে ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
“এই একদম কাছে আসবিনা।”

ব্যথায় কুঁকিয়ে উঠলো মাহা। খামচির কারণে ফর্সা হাত রক্তে ভরে যাচ্ছে। মাহা কান্নামাখা সিক্ত গলায় চৈতির দিকে ফিরে বললো,
“দোস্ত বাঁচা আমাকে। অনেক ব্যথা পাচ্ছি হাতে।”

চৈতি কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা। আশেপাশে লোকজন কম। চায়ের দোকানের মালিক দেখেও এগিয়ে আসছেন না। ব্যাপারটা বোধহয় উনার কাছে অনেকটা স্বাভাবিক। আশেপাশে নিজেদের গাইডকে খুঁজলো চৈতি। গাইডও পাশে নেই। হঠাৎ করেই আ আ চিৎকার।

চা বাগানের চৌকিদার একটা মোটা লাঠি নিয়ে তেড়ে এসে পাগলীকে আঘাত করেছে। পাগলী নিচে ছিটকে পড়লো। চৌকিদার খাজার শক্তপোক্ত শরীর। ইয়া বড় গোফ। পরনে লুঙ্গি, শার্ট আর উপরে কালো চাদর। মাহা ছাড়া পেতেই চৈতিকে জড়িয়ে ধরলো। আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে দূরে। শীতকাল হওয়ায় ঠান্ডা হাওয়া বইছে চারদিকে। পাগলী উঠে তেড়ে আসতে চাইলো চৌকিদারের পানে। চৌকিদার আবার আঘাত করলো পাগলীর শরীরে। পাগলী চা বাগানের মাটিতে গড়িয়ে চিৎকার করছে। মাহা আর চৈতি ভয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে। পাগলীর দিকে একটা তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চৌকিদার এগিয়ে এলেন তাদের দিকে। শুদ্ধ বাংলায় বললেন,
“আপনাদের গাইড কোথায়?”

মাহা তখনো ভয়ে কাঁপছে। চৈতি মাহাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আমরা ঠিক জানিনা। উনি অনেকক্ষণ হলো একটা কাজ আছে বলে গিয়েছেন।”
“আসরের আজান দিয়ে দিয়েছে। একে তো পর্যটক তার উপরে মেয়ে মানুষ মালনীছড়া কতটা ভয়ংকর জানেন।”

চৌকিদারের ধমকে দুজনেই কেঁপে উঠলো। চাদরে ঢাকা মুখ চৌকিদারের। বয়স আটত্রিশ না আটান্ন ঠাউর করা দায়। কালো কুচকুচে বদন। হাতটা পেশিবহুল। হাতে মোটা লাঠি। চৈতির মনে হলো গ্রিক মাইকোলজির কোনো অজানা শোষক রাজা যেন এই চৌকিদার।
“আপনারা কোন হোটেলে…

চৌকিদার বলতে বলতেই পাগলী তেড়ে এলো চৌকিদারের পানে। মুখভর্তি লালা মিশ্রিত থু থু নিক্ষেপ করলো চৌকিদারের মুখে। চৌকিদারের চোখ দুটো হিংস্র হয়ে উঠলো।

” শু*রের বাচ্চা। খা*কির বেটিরে..

বলে পুরুষালী শরীরের জোরে মোটা লাঠি দ্বারা আরেকটা আঘাত করলো পাগলীর শরীরে। চোখের সামনে এসব নজির দেখে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে চৈতি। মাহারও কান্না থেমে গিয়েছে।

২.

পাগলী আবার মাটিতে পড়ে গোঙাচ্ছে। একবার উঁচু কাঁপা গলায় বললো,
“তোর মুখে আমি মুতি রে খাজা।”

একটা অশ্লীল, উচ্চারণে অযোগ্য গালি দিলো চৌকিদার। মুখের নিক্ষিপ্ত থুতুটা কালো চাদরের প্রান্ত দিয়ে মুছে আবার মাহাদের পানে তাকালো চৌকিদার। চারিদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক ভেসে বেড়াচ্ছে। কয়েকটা কাক কা কা করে দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে। চৌকিদার বললো,
“চলুন আপনাদের রিকশা করে দেই। কোন হোটেলে উঠেছেন?”

চৈতির কেনো জানি আসল তথ্য দিতে ইচ্ছে করলোনা। সে কাঁপা গলায় বললো,
“হোটেল ফরচুন। আর আমাদের গাইড?”
“আরে রাখেন আপনার গাইড। ঐ বেটা ভাগছে। এমন অনেক ঘটনা আছে। টাকা নিয়ে গাইড ভাগে। কালো, লম্বা মতন ছিলোনা ছেলেটা?”
“হুম।”
“মানিক্কায় হবে। সে এমনই। আপনারা চলেন। এখানে আর থাকাটা সুবিধাজনক না।”

শীতকালের বিকেল। ঠিক বিকেল না আর কিছুক্ষণ পর আকাশ চিড়ে অন্ধকার নামবে। হৃদপিণ্ডে হিম লাগানো অন্ধকার। চা বাগানের চারিপাশটা কেমন জানি নির্জন, নিরব। শীতকালে পর্যটক এমনিতেও কম থাকে। তবে এতোটা কম হবে চৈতি, মাহা কখনো ভাবেনি। তারা যখন চৌকিদারের পিছনে আসছিলো তখন পাগলী চিৎকার করে বলছে,
“লম্বা বুবু তোর বিপদ। অনেক বিপদ।”

লম্বা গড়ন মাহার। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। চৈতি মাহা থেকে দুই, তিন ইঞ্চি খাটো। মাহা কুঁকড়ে আছে ভয়ে। হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে ধরে আছে সে।
“পাগলীর কথায় কিছু মনে করবেন না। মাথা খারাপ মানুষ। উল্টাপাল্টা বকে। স্বামী ছিলো দাগী আসামী। পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকেই এমন পাগলামি করে।”
বলে হাসার চেষ্টা করলেন চৌকিদার। যা অনেকটা বিভৎস দেখালো।

রিকশায় উঠে বসলো চৈতি আর মাহা। রিকশা চলছে মাজার রোডের দিকে। মাহা চুপ করে চৈতির কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠছে সে। চৈতি একহাতে জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। সকালেও কতটা খুশি ছিলো তারা! চোখ বুজে সকালের ঘটনাগুলো মনে করার চেষ্টা করলো চৈতি।

৩.
সিলেটে পৌঁছে হোটেল মুসাফিরে উঠেছে আতিয়া জামান চৈতি আর মাহা হোসেন। জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে দুজনে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সেরা বান্ধবী যুগল বলে বেশ খ্যাতি তাদের। সিলেটে আসার পিছনে যদিও একটা কারণ আছে তবে সেটা স্বীকার করতে চায়না মাহা। চৈতি জানে মাহা তার প্রিয় অচেনা মানুষটার সাথে দেখা করতেই সিলেট এসেছে। সেই বহু আকাঙ্খিত মানুষ। গত ছয়টা মাস ধরে যার কথা মাহার মুখে শুনতে শুনতে পাগল হওয়ার উপক্রম ছিলো চৈতির।

“আমরা কোথায় যাচ্ছি আজ?”

চৈতির প্রশ্নে মাহা মিষ্টি হেসে বলে,
“লাক্কাতুরা চা বাগান তারপরে মালনীছড়া।”
“খুব খুশি মনে হচ্ছে আপনাকে? হুম? ব্যাপার কি?”
“ব্যাপার কিছুই না।”

চৈতির অদ্ভুত তাকানোতে মাহা আবার লাজুক হেসে বললো,
“ও বলেছে পরশুদিন দেখা করবে আমার সাথে।”
“বাহ্বা, তাই আমাদের লাজুকলতা এতো লজ্জা পাচ্ছে বুঝি?”
“চৈতি, ভালো হবেনা কিন্তু। কেন লজ্জা দিচ্ছিস।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো চৈতি। মাহাটা না বড্ড লাজুক।

বেলা বারোটায় সকল ক্লান্তি ঘুচিয়ে দুজনে মিলে রওনা দিলো লাক্কাতুরার পথে। তাদের সিলেটি বান্ধবী রুমানা খুব করে বলেছিলো তার বাসায় উঠতে তবে তারা হোটেলেই উঠেছে। রুমানার মা অসুস্থ হওয়ায়ও সেও ওদের সাথে সিলেট এসেছিলো। আজ ঘুরতে আসতে পারেনি বলে বার কয়েক মাফও চেয়েছে। হালকা কুয়াশা চারদিকে। এখনো সাদা, ধূঁয়াটে কুয়াশা কাটেনি। রিকশা করে লাক্কাতুরা যাওয়ার পথে দুইপাশে ঘন সবুজ চায়ের বাগান। টিলা গুলোর উপরে স্তরে স্তরে সাজানো চায়ের বাগানে কাজ করছে কত মানুষ।

লাক্কাতুরা পৌঁছে গেট দিয়ে ঢুকার সময় কয়েকটা কিশোর বয়সী ছেলে চাঁদাবাজি করে। তাদের কিছু টাকা দিয়ে পরে ঢুকতে হয়।

“দেখলি চৈতি কেমন বেয়াদব ছেলেগুলো। ওদের কাছে কোনো কার্ড আছে! আমরা কেন টাকা দিবো ওদের?”
“তবুও তোর ঝগড়া করাটা ঠিক হয়নি।”
“তুই সারাজীবন ভীতুই থাকবিরে চৈতি।”
“হ্যাঁ, আর আপনি সাহসী মহারাণী।”
“তা অবশ্য বলতে পারিস। আমি মাইন্ড করবোনা।”

মাহার কথার ধরনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে চৈতি। আজ দুজনে গোলাপি রঙের উপর নীল ডোরাকাটা থ্রি-পিছ পড়েছে। উপরে নিয়েছে কাশ্মীরী চাদর। মাহাকে বেশি সুন্দর লাগছে বলাই বাহুল্য। সাদা ফর্সা বদনের রঙ। লম্বাও অনেক। সব দিক দিয়ে পারফেক্ট। চৈতি অনেকটা হলুদ ফর্সা। মাহার মতন আগুন সুন্দরী না হলেও বেশ মায়াবী।

“আপা, গাইড লাগবো?”

লাক্কাতুরা ঘুরার সময় পিছন থেকে বলে উঠে একজনে।
“এই মাহা শুন?”
“কি?”
“মালনীছড়ায় শুনেছি অনেক প্যাঁচানো পথ। গাইড নিয়ে নেই?”

ছেলেটার আড়ালে কথোপকথন চালিয়ে আড়াইশত টাকায় গাইড ঠিক করে নিলো তারা। মালনীছড়া এক অসাধারণ জায়গা। মাঝে মেঠোপথ। দুইপাশে কাঠবাগান। রাবার বাগান। অদ্ভুত রাবার সংগ্রহ করার কৌশল । যেদিকে তাকায় কেবল চা বাগান আর চা বাগান। মাহা আর চৈতি অবাক নয়নে উপভোগ করলো সেই অপরূপ দৃশ্য। সবুজের সায়রে ভেসে বেড়ালো দুজনে। ছবি তুললো।

“এই চৈতি ঐ যে কেমন দু টুকরো কাপড় পরে চা পাতা তুলছে মহিলারা। এদের লজ্জা করেনা?”
“এসব বলতে নেই। এরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। এই কাপড়কে বলা হয় ফতা। এসব পোশাকই ওদের সংস্কৃতি।”
“তা অবশ্য ঠিক বলেছিস।”

মাহা, চৈতি যখন প্রকৃতি উপভোগে ব্যস্ত তখন সুযোগ বুঝে গাইড ছেলেটা বললো,
“আপা, আমি একটু আসতেছি।”
“মানে কই যাবেন আপনি। আমরা আরো ঘুরবো তো।”

মাহার উচ্চকণ্ঠ। ছেলেটা কাচুমাচু হয়ে বলে,
“ইয়ে মানে একটু..

ইঙ্গিত ধরতে পেরে চৈতি বলে,
” মাহা যেতে দে।”

অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও ছেলেটার খোঁজ নেই। মাহা তো পুরো রাগে গজগজ করছে। চৈতি তখন চা আনতে গেলো পাশের দোকান থেকে। তারপর……

হঠাৎ থেমে যায় চৈতিদের রিকশা। মাহা ঘুমিয়ে পড়েছে চৈতির কাঁধে। চৈতির ডান হাতটা শক্ত করে ধরা। রোডের ধারে হালকা সোডিয়াম বাতির আলোয় মাহার মুখটা দেখে বুকটা কু ডেকে উঠলো চৈতির। কি হতে যাচ্ছে সামনে!

(চলবে কি?)

#অলকানন্দা
#পর্ব-২
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৪.
“মানুষের মাংস খাবেন বুবু? খুব মজা! দেখেন বুবু দেখেন লাল লাল তরতাজা মাংস। এত স্বাদ! একটু খান না বুবু। কচি মানুষের মাংস। একটু মুখে দেন না বুবু।”

সাদা এলোমেলো শাড়ি পরনে পাগলীটা দু হাতে কয়েকটা মাংসের টুকরো নিয়ে এগিয়ে আসছে মাহার দিকে। তার মুখের একপাশ দিয়ে মানুষের তরতাজা রক্ত মিশ্রিত লালা পড়ছে। চোখ দুটো ভয়ানক লাল। হঠাৎ একহাত থেকে মাংসের টুকরো গুলো ফেলে খপ করে হাত ধরে ফেললো মাহার। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। পা থেমে গিয়েছে তার। গলায় আওয়াজ নেই। পাগলী হু হা করে হেসে এক টুকরো মাংস জোর করে মাহার মুখে ঢুকিয়ে দিলো
“আল্লাহ!” বলে চিৎকার করে উঠলো মাহা। হন্তদন্ত হয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো চৈতি। মাহা ভয়ে কাঁপছে। ফর্সা মুখ ঘামে একাকার।
“এই কি হয়েছে তোর?”
“পা পা পা…নি।”

মাহার কণ্ঠ কাঁপছে। পাশের টি-টেবিলের উপর থেকে পানির জগ তুলে কাঁচের গ্লাসে পানি ঢাললো চৈতি। ভোরবেলা। বাইরে পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাকি সব নিরব। কাঁচের গ্লাসে পানি পড়ার আওয়াজটাও কত ভয়ানক শুনালো যেন। অদ্ভুত সম্মোহনী আওয়াজ। যা বর্ণনা করা যায় না। কেবল অনুভব করা যায়। যে আওয়াজে শরীর ক্ষণেক্ষণে কেঁপে উঠে। কেমন যেন সম্মোহীত হয়ে দুজনেই গ্লাসে পানি পড়ার আওয়াজ শুনছিলো এমন সময় ক্রিং ক্রিং ক্রিং।

হাতটা কেঁপে উঠলো চৈতির। কাঁচের গ্লাসটা ছিটকে পড়লো নিচে। আঁতকে উঠলো দুজনেই। চৈতি হন্তদন্ত হয়ে নিচে বসে গেলো। মাহা তখনো খাটে হেলান দিয়ে বসে। হাঁড় কাঁপানো শীতের মাঝেও তার কপালের দুইপাশ বেয়ে সূক্ষ্ম ঘামের রেখা বেয়ে যাচ্ছে।
“ইস! গ্লাসটা ভেঙে গেলো। এটার আবার জরিমানা দিতে হবে।”
চৈতির কন্ঠে হতাশা। অতঃপর ভাঙা গ্লাসের টুকরোগুলো উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। কলিং বেল বেজে চলেছে। মাহা ভয় ঝেড়ে বললো,
“কে… কে এসেছে? চৈতি?”
“তুই বস। আমি দেখছি। তুই জগ থেকে পানি খেয়ে নে। রুমানার আসার কথা ছিলো।”
“আচ্ছা।”

কাঁচের গ্লাসের ভাঙা টুকরোগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দরজার কাছে এগিয়ে গেলো চৈতি। ওদের রুমটা ছোট। দুই বেডের। পাশাপাশি দুই বেড। মাঝে ছোট টি-টেবিল। তারউপরে একটা ল্যাম্পসেড। নীল রঙা দেয়াল। দেয়ালে কতক ছবি টানানো। একটা অর্ধবৃত্ত আঁকা। মাহা তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ছবিটা জানি কেমন। চতুস্তল কালো রঙের মাঝে সাদা অর্ধবৃত্ত।
“টুকি।”

রুমানার ডাকে বাস্তবে ফিরে মাহা। কাঁধ সমান চুলগুলো এলোমেলো, অবিন্যস্ত। চুলগুলো ঠিক করার বৃথা চেষ্টা করে সে বলে,
“আন্টি কেমন আছেন?”
“ভালো।”

বলতে বলতে মাহার বেডে বসে রুমানা। চামড়ার খয়রী ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখে পাশে। চৈতি বসেছে তার বেডে। মাহা সামনে আসা চুলগুলো সরাতে নিজের বামহাতটা কম্বলের নিচ থেকে বের করে চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো আবার। প্রথমে খেয়াল না করলেও এবার বিষয়টা চোখ এড়ালোনা রুমানার।
“টুকি, তোর হাতে এসব কিসের লালদাগ?”

আবারো কেঁপে উঠছে মাহার হৃদপিণ্ড। কাঁপা শরীরটা বিছানায় হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো সে। মাহার এমন রিয়েকশন দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছে রুমানা। কালো রঙা মুখে ঈষৎ সন্দেহের আভাস।
“টুকির কি হয়েছে রে কোকিল?”

রুমানার প্রশ্ন চৈতির কাছে। হলদে গাঁয়ের রঙে অভূতপূর্ব মায়াবতী চৈতি। তেমনই অভূতপূর্ব, হৃদপিণ্ড থমকে দেওয়া কন্ঠ তার। তার উচ্চারিত শব্দগুলো কানে কেমন যেন গানের মত শোনায়। তাই তাকে কোকিল বলে সম্বোধন করে রুমানা। এমন অদ্ভুত নাম প্রথমে অপছন্দ ছিলো তার। তবে সময়ের পরিক্রমায় মানিয়ে নিয়েছে।

৫.
“মালনীছড়ায় এক পাগলী ধরেছিলো। হাতে খামচি দিয়ে একাকার করে ফেলেছে হাতটা।”
“আল্লাহ বলিস কি?”

আঁতকে উঠলো রুমানা। মাহার অবাক দৃষ্টি তার দিকে।
“রুৎবা পাগলী যাকে ধরে সে কিছুদিনের মধ্যে হয়তো মারা যায় নয়তো গায়েব হয়ে যায়।”
“আবোল তাবোল বলিস না। বর্তমান যুগে এসবও হয়!”

চৈতির কন্ঠে অবিশ্বাস। এমন অদ্ভুত কথা যেন সে ইহজন্মেও শুনেনি। মাহা হেলান দিয়ে ছিলো খাটে। তন্মধ্যে কেঁপে উঠলো সে।
“বিশ্বাস করছিস না তো। শাহিনূর খালাও এরকম করতো জানিস।”
“কাহিনী কি খুলে বলতো?”
চৈতির প্রশ্নে তার দিকে ফিরে রুমানা। লালচে বাদামী চাদরটার একপ্রান্ত হাতের মুঠে পুরে বলে,
“পাগলীর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেই ২০১২ র দিকে। তখনকার সময় সিলেটি সিরিয়াল কিলারের ১০১ খুনের খবর তোদের মনে আছে?”
“হুম, শুনেছিলাম বোধহয়। মাতব্বর না কি যেন নাম ছিলো?”
“মাতব্বর শরীফ। পুলিশের মতে মাতব্বর শরীফ সেই সিরিয়াল কিলার। এখনো জেল হাজতে আছে। উপযুক্ত প্রমাণ মেলেনি তাই ফাঁসিও কার্যকর হচ্ছেনা। তবে আমার কি মনে হয় জানিস?”
“কি মনে হয়?”
“শরীফ চাচাকে ফাঁসিয়ে ব্যাপারটা সাময়িক ধামাচাপা দিয়েছে পুলিশ। যদিও তারপর থেকে ছিন্ন পা আর কোনো লাশ পাওয়া যায়নি। জানিস শরীফ চাচা লোকটা খুব ভালো মানুষ ছিলেন।”
“পাগলী কি উনার স্ত্রী?”
“হুম। কত সুন্দর সংসার ছিল দুজনের। রুৎবা চাচিও ভালো মানুষ। আমাদের মাজার রোডের সবাই একনামে চিনতো তাদের। গলির মোড়ে চা পান বিক্রি করতো দুজন মিলে।”
“স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর থেকেই এমন হয়ে গিয়েছেন মহিলা?”
“না। একটা ছেলে ছিলো ফয়সাল নামে। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো সিলেট ইমপেরিয়াল কলেজে। ছেলেটা জাফলংয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়ে চোরাবালি তে ডুবে প্রাণ হারালো। তখন থেকেই আধপাগলা মতন হয়ে গেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে কিসব আবোল তাবোল বকতেন। চাচা কতবার শিকল পড়ায় রাখছেন! চাচাকেও পুলিশ ধরে নিয়ে গেলেন। তারপর থেকে মালনীছড়ায় থাকেন রুৎবা পাগলী।”
“শাহিনূর খালার ব্যাপারটা কি?”
“শুধু যে শাহিনূর খালা তা না রুৎবা পাগলী এখন পর্যন্ত যার হাতই ধরেছেন সেই গায়েব হয়ে গেছে। মালনীছড়ায় স্থানীয় কেউ ভয়ে তার কাছে যায়না। তার ছোঁয়া অশুভ। শাহিনূর খালাকে ছোঁয়ার কিছুদিনের মাথায় আগুন পাহাড় থেকে পোড়া দেহ পাওয়া গেছিলো তার। পরে আবার….

মাহা বারেবারে কেঁপে উঠছে। চৈতি চোখের ইশারায় রুমানাকে থামতে বললো। এমনিতেই মাহার অবস্থা খারাপ। রুমানা থতমত খেয়ে চুপ করে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টায় বললো,
” ধুর। আমি মজা করছি আর তোরা বিশ্বাস করে নিলি? কেমন ভয় দেখালাম বল?”

হু হা করে হাসার চেষ্টা চালালো রুমানা। চৈতিও ঈষৎ হাসিতে যোগ দিয়ে বললো,
“তুইও না রুমানা। এভাবে কেউ ভয় দেখায়?”
“তোরা তো বাড়িতে আসলি না। চাচি তোদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়েছে।”

বলে খাবারের বক্সগুলো খয়রী রঙা চামড়ার ব্যাগ থেকে বের করলো রুমানা।
“টুকি, তোর না গরুর মাংস খুব পছন্দ? দেখ চাচি লাল লাল করে বেশি ঝাল দিয়ে ভুনা করে দিয়েছে? খেয়ে দেখ।”

৬.

বলেই খাবারের বক্সটা মাহার সামনে ধরলো রুমানা। মাহা একবার মাংসের বক্সটার দিকে তাকিয়ে আরেকবার তাকানোর সাহস পেলোনা। যা খেয়েছিলো রাতে সব বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। মুখ চেপে ধরে বিছানা থেকে উঠে দৌঁড়ে বাথরুমে চলে গেলো মাহা। ঘটনাটা এতটা দ্রুত ঘটলো যে উপস্থিত কারোই মাথায় আসেনি হচ্ছে কি। যখন ধ্যান ভাঙলো দুজনের তারাও পিছনে ছুটে বাথরুমের দিকে এগুলো। মাহা বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে বাথরুম। আঁশটে গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কেমন ঘিনঘিনে ব্যাপার। রুমানা, চৈতি কেউই ভিতরে প্রবেশ করলোনা। পানির কলটা ছেড়ে দিয়েছে মাহা। আস্তে আস্তে বাথরুমটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে।

মাহা যখন বেরুলো বাথরুম থেকে তখন অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে দুজোড়া নেত্র। মাহা চোখের ভাষা পড়েও প্রতুত্তর না করে নিজের বেডে বসে পড়েছে। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার মুখ। চৈতি, রুমানা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার। মুখ খুললো রুমানা।
“টুকি, ঠিক আছিস?”
“হুম।”
“শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?”
“না। মাথা ঘুরাচ্ছে একটু।”
“খাবারটা খেয়ে নে। ভালো লাগবে।”

আঁতকে উঠলো মাহা। নিজের চমকিত ভাবটা লুকিয়ে বললো,
“মাংস খেতে ইচ্ছে করছেনা। আর কিছু এনেছিস?”
“হুম। সবজি ভাজি আছে।”

তিনজনে মিলে খাওয়া সেরে নিয়েছে। মাঝে কোনো কথাই হয়নি। কেমন যেন শ্মশানঘাটের মতো নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে হোটেল মুসাফিরের ৩০৩ কক্ষে। নিরবতা ভাঙলো চৈতি।
“আজকে খাসিয়া পল্লী ঘুরে এলে কেমন হয়?”

রুমানা প্রতুত্তরে বললো,
“ঘন্টা দুয়েকের পথ। টুকি জার্নি করতে পারবে? শরীর দুর্বল তো ওর।”
“পারবো। আমারও খাসিয়া পল্লী দেখার ইচ্ছে।”

সকল ক্লান্তিকে, ভয়কে ঘুচিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাচ্ছে মাহা। আদোও কি এতো সহজে স্বাভাবিক হওয়া যায়? মানুষ মৃত্যুকে কখনো স্বাভাবিক ভাবে নিতে পারেনা। এই পৃথিবীতে মৃত্যু চরম সত্য। মৃত্যুর ভয় একবার মানুষকে ঝেঁকে ধরলে তা ছাড়ানো দায়। চাইতেও কিংবা না চাইতেও অদ্ভুত খেলার জটিল অংশে গুটি মাহা। চৈতি, মাহা সব হলো নামের খেলা। নামে পরিচয়, নামে বিনাশ। কিছু খেলা বড় করুণ। ভাগ্য অলৌকিক ভাবে সব মিলিয়ে দেয়। খেলা রচনাকারী যাদের নিয়ে খেলছে সে কি জানে তার গুটি তাকে নিয়ে খেলছে? এটা একটা বিস্তৃত মাঠে অদেখা চোরাবালির মতন। মাঠের এপাড়ের লোক আর ওপাড়ের লোক দুজনেই স্থান বদলাচ্ছে। চোরাবালির অতলে কে হারায় দেখার বিষয়। চিকচিকে চোরাবালির প্রেমের দহন যন্ত্রণা। চোরাবালির প্রেমে পড়লে তাতে ডুবতে হয় অতলে। গভীর থেকে গভীর অতলে। সেই অতল থেকে সৃষ্টি হয় নতুন গল্প, নতুন প্রেক্ষাপট। যা অহর্নিশের মধ্যভাগের মতন খা খা। নিশ্চল। বড় নিশ্চল।

খাসিয়া পল্লীতে কি অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?

(চলবে)…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here