অলকানন্দা #পর্ব-৭,৮

0
619

#অলকানন্দা
#পর্ব-৭,৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

১৯.
আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকালো মাহা। শূন্যে ভাসছে সে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। আশপাশে অন্ধকার। তড়িৎ গতিতে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো সে। সে কারো কোলে! মস্তিষ্ক সচল হচ্ছে তার। এতক্ষণ তাহলে যা দেখেছিলো সব স্বপ্ন ছিল। সরু রাস্তা, চৈতি, ট্রেন, ভূট্টা ওয়ালা, হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা, শসা বিক্রেতা, ছোট বাচ্চাটা সব স্বপ্ন ছিল! তাহলে এতটা বাস্তব লাগলো কেন!
“আমরা কোথায়?”

অনেক কষ্টে কম্পিত ঠোঁট জোড়া দিয়ে প্রশ্নটা করে মাহা। সার্থক তাকে কোলে নিয়ে একটা বৃহৎ গাছের পিছনে লুকিয়ে আছে। চতুর্দিকে আঁধার। তখন হঠাৎ করেই মেয়েটাকে অজ্ঞান হতে দেখে ভরকে যায় সার্থক। দূর থেকে শুকনো পাতা আর ডাল-পালার শব্দ শুনেই বুঝতে পারে কেউ হয়তো আসছে এদিকটায়। আবারো মেয়েটাকে কোলে তুলে এলোমেলোভাবে জঙ্গলের আরো গহীনে প্রবেশ করে সে।
“কি হলো বলুন?”
“চুপ। কথা না। আশেপাশে মানুষ আছে।”

ভয়ে আবারো সিটিয়ে গেলো মাহা। একেবারে লেপ্টে গেলো সার্থকের বুকের মাঝে। হঠাৎ মনে হচ্ছে তার শীত লাগছেনা কেন! অতঃপর ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে তার গায়ে ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটার কালো হুডিটা। আর ছেলেটার গায়ে পাতলা একটা টি-শার্ট! অনেকটাই অবাক হয়েছে মাহা। মাহার শীত দূর করতে তবে কি ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটা এই হাড়কাঁপানো শীতের রাতে নিজের হুডি খুলে দিয়ে দিয়েছে! হঠাৎ কান্না পেলো মাহার। বরফ শীতল কপোলের উপর চোখের উষ্ণ ধারা প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। নিজেকে দমাতে পারছেনা মাহা। মা মারা যাওয়ার পর এতটা কখনো তাকে নিয়ে কেউ ভাবেনি। রুমানা আর চৈতিও না!

মাহার হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠার শব্দে তার মুখে দিকে তাকালো সার্থক। এই তো কিছুক্ষণ আগে যখন সে এলোমেলো পথ পাড়ি দিচ্ছিলো তখনই দেখে মেয়েটা তার কোলে ঠকঠক করে কাঁপছে। আর কিসব যেন বিড়বিড় করে বলছে। নিজেকে থামিয়ে সেখানে বসে কালো হুডিটা খুলে মেয়েটার গাঁয়ে পরিয়ে দিলো সার্থক। যদিও মেয়েটার গাঁয়ে হুডিটা অনেক বড় হয়েছে। অহংকারী, কুঁকড়া চুলের, হলদে ফর্সা শরীরে তার বৃহৎ হুডিটা কল্পনা করেই হাসি পেলো সার্থকের। যদিও সময়টা হাসির নয়। অতঃপর আবার পায়ের শব্দে এই বড় গাছটার পিছনে আশ্রয় নিয়েছে সে। ডাকাতের দল তো এতদূর আসার কথা না! তাহলে কি এটা জঙ্গলে বসবাসরত আদি বাসিন্দাদের পায়ের আওয়াজ! মেয়েটা এত কাঁদছে কেন!
“প্লিজ। একটু চুপ করো।”

সম্বোধনটা আপনি থেকে কখন যেন তুমিতে চলে গিয়েছে। অবশ্য সার্থকেরও দোষ নেই। মেয়েটা তার থেকে বয়সে অনেক ছোটই হবে।
“আরে! তুমি এমন ভাবে কান্না করছো কেন! আজ রাতটুকু একটু কষ্ট করো। আমি আছি তো!”

সার্থক জানেনা সে এই কথাটা কেন বললো। বলতে ইচ্ছে করেছে তাই বলেছে। মনে কথা চাপিয়ে রাখতে সে পারেনা।
“আমি আছি তো!”

বাক্যটা শুনে নিজের অজান্তেই কান্না থেমেছে মাহার। চেনা নেই, জানা নেই ট্রেনে দু’ঘন্টার জার্নিও তারা একসাথে করেনি। ঝাঁকড়া চুলের, ফর্সা ছেলেটা। অদ্ভুত কালো চোখের মণিওয়ালা ছেলেটা বলছে,
“আমি আছি তো!”

কই বাবাতো কোনোদিন মা মারা যাওয়ার পর বলেনি, “আমি আছি তো!”

“বাবা!” শব্দটা উচ্চারণ করেই মাহার মনে পড়লো সে তো বাবার জন্য ঢাকা ফিরে যাচ্ছিলো। মাহিন, তার সৎ ভাই ফোন দিয়ে বলেছিল বাবা হসপিটালে! কেমন আছেন বাবা? সার্থকের বুকে লেপ্টে কথাগুলো ভাবছিলো মাহা। সার্থকের চোখ, কান তখন ঘুরাঘুরি করছে আশেপাশে।

২০.
পশ্চিমদিক আর উত্তর কোনের দিকে খসখস আওয়াজ হচ্ছে। এটা কোনো প্রাণীর আওয়াজ নয়। মানুষের পায়ের আওয়াজ।
“আপনি আমাকে নামিয়ে দিন। আমি হাঁটতে পারবো। আমার এভাবে ভালো লাগছেনা।”

মেয়েটা এত কথা বলে কেন। জীবন মরণের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়েও আজাইরা কথা না বললে মেয়েজাতের হয়না!
“চুপ! আর একটা কথা না।”
“আজব তো! এভাবে কথা বলছেন কেন আপনি!”
“এই মেয়ে চুপ। দয়াকরে চিৎকার করোনা। আশেপাশে কয়েকজন আছে। যারা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে। ধরতে পারলে চিবিয়ে খাবে। তুমি কারো খাবার হতে চাও, মেয়ে?”

এহেন কথাবার্তায় থতমত খেলো মাহা। চিবিয়ে খাবে মানে কি! সে কি খাবার বস্তু নাকি যে চিবিয়ে খাবে। অন্ধকারে মুচকি হাসলো সার্থক। মেয়েটা তো অনেক ভীতু। ভয়ে আবারো লেপ্টে গেলো তার বুকের সাথে। হঠাৎ পিঠে একটা দাঁড়ালো কিছু ঠেকলো সার্থকের। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালো সে। দৌড় দিতে পারলোনা। আশপাশ ঘিরে ফেলেছে হারিকেন হাতে কয়েকজন মানুষ। সবার হাতে বর্শা। এত স্ট্রেস নিতে না পেরে আবারো জ্ঞান হারায় মাহা। সার্থক স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে আলোয় সয়ে আসছে তার চোখ। না, এদের দেখে তো আদিবাসী মনে হচ্ছেনা। এদের সবার পরনে সাদা লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত, সাদা ফতুয়া আর কোমড়ে, মাথায় গামছা বাঁধা। কিছুক্ষণ নিরবতা চললো। তাদের মধ্য থেকে একজন লোক এগিয়ে আসলেন। শুদ্ধ ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললেন,
“আপনারা কি হারিয়ে গেছেন বাবু?”

বাংলা শুনবে আশা করেনি সার্থক। নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
“জ্বি।”
“আমি কানু। সাঁওতাল উপজাতি। আমরা সবাই রাতে জঙ্গল পাহাড়া দেই। পাশেই আমাদের গ্রাম।”

ভরসা খুঁজে পেলো সার্থক। যদি আজ রাতটা কোনোভাবে কাটানো যেতো।
“আমাদের আজ রাতটুকু আশ্রয় দিতে পারবেন?”

কনু হঠাৎ করেই কিছু বললোনা। তাদের ভাষায় কিছু পরামর্শ করে নিলো।
“আপনারা কি স্বামী-স্ত্রী আছেন?”
“হ্যাঁ।”

মিথ্যা বললো সার্থক। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটা বারেবারে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। একটু পানি পান করানো প্রয়োজন। তাছাড়া রাত এখনো অনেক বাকি। সারারাতে নির্ঘাত মেয়েটার জ্বর চলে আসবে।
“আপনারা কি মুসলমান বাবু?”
“জ্বি, আমরা মুসলমান।”
“ঠিক আছে। চলুন বাবু। কিছুদূর হাঁটলেই আমাদের গ্রাম। আপনার বিবির কি হয়েছে?”
“আসলে ও একটু ভয় পেয়েছে।”

সাঁওতাল উপজাতিদের সাথে মাহাকে কোলে নিয়ে যাচ্ছে সার্থক। হারিকেনের হালকা আলোয় আলোকিত হয়েছে চারপাশ। বিশাল বড় বড় গাছপালা। কত প্যাঁচানো ডালপালা! মাটিতে জমেছে শীতকালীন শুকনো পাতার দল। তাদের উপর লেপ্টে আছে শীতের শিশির ফোঁটা। এক-দুটো বাদুড় ঝুলছে কয়েকটা গাছে। হঠাৎ মাহার মুখের দিকে তাকিয়ে হৃদপিণ্ডের একটা স্পন্দন মিস করলো ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। হারিকেনের আলোয় অভূতপূর্ব লাগছে মেয়েটাকে। হালকা ঠোঁট জোড়া কাঁপিয়ে কি যেন উচ্চারণ করছে মেয়েটা। অনেক পাতলা মেয়েটা। কিছু কি খায়না নাকি। একেবারে তুলোর মতো। এতক্ষণ যাবৎ কোলে নিয়ে রেখেছে সার্থক তার একটুও কষ্ট হচ্ছেনা। একটুও না।

২১.
অবশেষে জঙ্গল পেরিয়ে লোকালয়ের দেখা মিললো। পাহাড়ি উপত্যকায় ছোট জনপদ। মাটির ছোট ছোট ঘর। প্রত্যেক ঘরের সামনে মশাল জ্বলছে। সামনে মাঝারি আকৃতির একটা মাঠ।
“আমরা ঠিক কোথায় যাচ্ছি?”

কানুকে প্রশ্ন করে সার্থক।
“আমাদের প্রধানের কাছে, বাবু। তিনি অনুমতি না দিলে আমরা আপনাদের জায়গা দিতে পারবোনা।”

অন্যান্য মাটির ঘর থেকে এই ঘরটা তুলনামূলক বড়। চারপাশে কলাপাতার বেড়া দেওয়া। সুন্দর, ছিমছাম, পরিষ্কার বাড়ি। সাঁওতালরা পরিষ্কার জাতি বলে জানতো সার্থক। তারা পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে। আজ নিজ চোখে দেখেও নিলো। ছয়জনের একটা দল কানুরা। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েই হাঁক ছাড়লো কানু। সার্থকও তাদের সাথে দাঁড়িয়ে। ধুতি, ফতুয়া পরনে বেরিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ ব্যাক্তি। ঘরের দুপাশে বড় বড় মশাল জ্বলছে। সার্থক খেয়াল করলো সাঁওতাল পুরুষ সকলের হাতেই উল্কার ছাপ।

বৃদ্ধ এসে এক নজর তাকালেন তার দিকে। অতঃপর নিজেদের ভাষায় কানুর সাথে কথা চালালেন। তাদের ভাষার নাম সান্তালী ভাষা। অস্ট্রো-এশীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্গত মুন্ডা উপপরিবারের একটি ভাষা, এবং হো এবং মুন্ডারি ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের বসতে দেওয়া হলো বাঁশের তৈরি মাচায়। এত এত পুরুষের মাঝে মাহাকে রাখতে ভালোলাগছেনা সার্থকের। সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে। একটা চিনচিনে রাগে মাথার একদিকটা ব্যথা করছে তার। হুডির ক্যাপটা মাহার মাথায় তুলে দিলো সে। যতটা আড়াল করা যায়। সে বসেছে ডানপাশে। বামপাশে বসেছে কানুদের দলের সবাই। মাঝে একটা রাজকীয় মেহগনি কাঠের চেয়ারে বসেছেন সাঁওতাল প্রধান।

কানু দাঁড়িয়ে বললো,
“বাবু, উনি হলেন আমাদের প্রধান। জগত মুর্মু।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও হেসে বৃদ্ধের দিকে তাকালো সার্থক। এত নাটকের কি আছে শীতের রাতে। এতগুলো ঘর আছে এখানে। একটা রাতের জন্য একটা ঘর দিলে কি এমন হয়ে যাবে! বিরক্ত লাগছে তার। মেয়েটা কি ঘুমিয়ে গেলো না অজ্ঞান হলো আল্লাহই জানেন।

জগত মুর্মু সান্তালী ভাষায় কি যেন বললেন কনুকে। কানু মুখটা কাঁচুমাচু করে বললো,
“বাবু, আপনারা কি সত্যিই স্বামী-স্ত্রী?”
“জ্বী।”

একবার তো বললোই। বারবার বলার কি প্রয়োজন। অদ্ভুত লোকজন। আবারো সবার মাঝে নিজেদের ভাষায় কথোপকথন চললো।

“বাবু, আপনারা যে স্বামী-স্ত্রী তার প্রমাণ আছে কি?”
“আজব তো! আমরা কি কাবিননামা নিয়ে ঘুরবো নাকি!”

রেগে গেলো সার্থক। এখানে আসাটাই উচিত হয়নি। এসব পরীক্ষার চেয়ে ভালো ছিলো জঙ্গলে রাত কাটানো।
“দয়াকরে রাগবেন না, বাবু। এমন অনেক মানুষই আছেন যারা বাড়ি থেকে পালিয়ে আসে। আমরা তো না জেনে আপনাদের জায়গা দিতে পারিনা। আপনারা স্বামী-স্ত্রী নাও তো হতে পারেন।”

এসব কোলাহলে জেগে উঠলো মাহা। চোখ খুলে আলোর তীক্ষ্ণতায় আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। আস্তে আস্তে আবার চোখ মেললো। সার্থক কারো সাথে, না না কাদের সাথে ঝগড়া করছে। আশেপাশে তাকিয়ে আরো অবাক হয়ে গেলো মাহা। এটা তো জঙ্গল না লোকালয়!

“দেখেন বাবু। আপনারা তো বিবাহিত তাহলে আবার বিয়ে করতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা নেই?”
“বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন? আমার কথা কি বিশ্বাস হয়না আপনাদের?”
“বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের কথা না বাবু। আমরা আপনাদের চিনিনা। এভাবে আপনাদের রাত কাটাতে দিলে আমাদের দেবতা রুষ্ট হবেন।”
“তাহলে আমাদের কি করতে হবে এখন?”
“আমাদের এখানে একজন হুজুর আছেন। আমাদের জাতির নয়। আমাদের সাথেই থাকেন। তিনি এসে আপনাদের বিয়ে পড়াবেন।”

সার্থক হা করে কথাগুলো গিললো। এতটা ফ্যাসাদে সে কখনো পড়েনি। স্তম্ভিত হয়ে কেবল একটা শব্দই শুনলো মাহা। “বিয়ে!”

শব্দটা মৌমাছির ডাকের মতো কানের চারপাশে বাজছে তার। সে ছটফট করছে নামার জন্য। বিয়ে মানে! সে কেনো অজানা, অচেনা কাউকে বিয়ে করবে!

(চলবে)…..

#অলকানন্দা
#পর্ব-৮
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
২২.
মাহাকে ছটফট করতে দেখে সার্থক তাকে ফিসফিসিয়ে বললো,
“প্লিজ, তুমি এমন নড়াচড়া করোনা।”
মাহার মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে উঁচু গলায় কথা বলতে নিয়েও নিজেকে সামলালো। শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমাকে নামিয়ে দিন।”

মাহাকে নামিয়ে দিতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। সাথে সাথেই সার্থকের হাতটা জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থক তাকে ধরে পাশে বসিয়ে দিলো।
“আপনি কি বাবুর স্ত্রী আছেন?”

কানুর কথার কিছুই বুঝলোনা মাহা। সে অবাক হয়ে তাকালো সার্থকের দিকে। সার্থক অসহায় চোখে কিছু একটা ইশারা করছে। মাহা কিছুটা বুঝতে পেরে বললো,
“জ্বি।”

সার্থক যেন এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
“দেখুন ও যেহেতু বলে দিয়েছে নিশ্চয়ই আপনাদের আর কোনো সমস্যা নেই?”
“মাফ করবেন বাবু। আমাদের প্রধান যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার উপরে আমরা কিছুই বলতে পারবোনা।”
“মানে!”

কানু জবাব দেওয়ার আগেই দেওয়ান চলে এলেন। বয়সে হয়তো সাঁওতাল প্রধানেরও বড় হবেন। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। ওদের একজনই তাকে আনতে গিয়েছিল। এসেই জগত মুর্মুর সাথে কুশল বিনিময় করলেন তিনি। এতগুলো পুরুষের সামনে নিজেকে অনেকটা অসহায় লাগছে মাহার। তার ওড়না কোথায় পড়েছে সে জানেনা। গাঁয়ে পানপাতা আর বেগুনি রঙের বাটিকের থ্রি-পিস উপরে সার্থকের কালো হুডিটা। যা মাহার হাঁটু ছুঁই ছুঁই । ডানপাশে একটা মাচায় বসে আছে সে পাশে ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটা। সাঁওতাল প্রধান নিজের আসনে বসলেন। দেওয়ান অপরপাশে কানুদের সাথে বসলেন। একবার তাকালেন মাহা আর সার্থকের পানে। সাঁওতাল প্রধান সান্তালী ভাষায় কিছু বলতেই বিয়ে পড়ানো শুরু করেন দেওয়ান। মাহা মাথা নিচু করে কাঁদছে। এ কেমন পরিস্থিতি!
“আপনার নাম?”
দেওয়ান সার্থকে জিজ্ঞেস করলেন।
“খন্দকার ফায়রাজ সার্থক।”
“বাবার নাম?”
“খন্দকার ফিরোজ ফারহান।”

এবার মাহাকে ইশারা করলেন তিনি। নাম জানতে চাচ্ছেন। মাহা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সার্থক কোনো জবাব দিতে পারলোনা। সে তো মেয়েটার নাম জানেনা।
“মা, আপনার নাম?”

কোনো জবাব দিলোনা মাহা। দেওয়ান জগত মুর্মুর দিকে তাকালেন। জগত মুর্মু কনুকে সান্তালী ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করতেই সে সার্থককে বললো,
“আপনার বিবি কাঁদছেন কেন? তিনি কি বিয়ে করতে চান না?”
“আসলে…

কি জবাব দিবে সার্থক! এ কেমন পরিস্থিতি!
“আমার নাম মাহা। মাহা হোসেন। বাবা আজাদ হোসেন।”

দেওয়ান এবার সার্থককে জিজ্ঞেস করলেন,
“দেনমোহর কত দেওয়া হবে?”

এবারো জবাব দিলোনা সার্থক। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। আশেপাশের সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আজ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করেনি সে। আর আজ কিনা তাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হচ্ছে! দেওয়ান নিজের মতো একটা দেনমোহর দিয়ে দিলেন। কবুল বলার সময় বুক ফেটে কান্না আসছিলো মাহার। চেনা নেই, জানা নেই একটা অজানা ছেলের সাথে সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো!
তাদের একটি মাটির ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘরটা জগত মুর্মুর বাড়িতেই। একটু আগে এসে একজন মহিলা খাবারও দিয়ে গেলেন। ঘরের এককোনায় কাঠের দরজার দিকটায় একটা মোমবাতি জ্বলছে। সারা ঘর জুড়ে কেবল ছোট একটা কাঠের চৌকি। পাশে একটা কাঠের টেবিল। সেখানে আপাতত খাবার ঢেকে রাখা। চৌকির একপাশে বসে নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদছে মাহা। সার্থক দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছটায়। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো,
“প্লিজ কাঁদবেন না।”

তুমি বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। ছোট মেয়েটার জীবনই সে নষ্ট করে দিলো। মেয়েটার হয়তো মনের মানুষও আছে।

২৩.
মাহা তার কথায় কর্ণপাত করলো কিনা কে জানে। চুপচাপ কাঁদতে কাঁদতে চৌকির একপাশে শুয়ে পড়লো।
“দেখুন আমি নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করিনি। আসলে ব্যাপারটা যে এমন গোলমেলে হয়ে যাবে ধারণা ছিলোনা আমার। আমি যদি স্বামী-স্ত্রী পরিচয় না দিতাম তারা হয়তো আমাদের চরিত্রে আঙুল তুলতো। তাছাড়া এই শীতের রাত জঙ্গলে কাটানোর চেয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে মিথ্যা বলে তাদের কাছে যদি কোনো সাহায্য পাই। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন…

কথাটা বলতে বলতেই পিছু ফিরে তাকালো সার্থক। মাহা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো সে। গাঁয়ে তার পাতলা একটা টি-শার্ট। শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। তবুও যেন শীত লাগছেনা তার। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ভোর হয়ে যাবে। পায়ের কাটা স্থানটায় জ্বলছে। আবারো পিছনে ফিরে তাকালো সার্থক। মাহা অপরদিকে ফিরে শুয়ে আছে। মোমবাতির আলোয় কুঁকড়া চুলগুলো জ্বলজ্বল করছে। বড় ক্লান্ত লাগছে সার্থকের। ঘরে বসার মতো কিছুই নেই। দাঁড়িয়েও থাকতে পারছেনা। বাধ্য হয়ে ছোট চৌকিটার একপাশে গিয়ে বসলো সার্থক। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে ঘুমের দল নেমে এসেছে। মাহার পাশেই শুয়ে পড়লো সে।

মুরগ ডাকছে দূরে। টিনের চালে শিশির পড়ার টুপটুপ মোলায়েম শব্দ। বাইরে জ্বলজ্বলে মিষ্টি রোদ। বন্য তরুলতার মাতোয়ারা ঘ্রাণ ভেসে আসছে নাকে। চোখ মেলে তাকায় মাহা। উঠে বসেই অবাক হয় সে। তার পাশে একটা ছেলে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটার ঝাঁকড়া চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। ফর্সা কপালটা কুঁচকে রেখেছে সে। যেন একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা। কি স্নিগ্ধ! কি পবিত্র! আচ্ছা? মাহা তো এতদিন জানতো ঘুমন্ত মেয়েরা সুন্দর। তবে কি সে ভুল! ঘুমন্ত ছেলেরাও অনেক সুন্দর হয়। আজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতোনা মাহা। হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো সার্থক। চোখ দুটো হালকা লাল। ঘুম হয়তো হয়নি ঠিক মতো। মাহাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সার্থক জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবেন?”

মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো মাহা। আজ এই লোকের কারণেই একটা অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে সে। কি হতো সত্য বললে! উঠে বসে নিজেকে কিছুটা সময় দিলো সার্থক। মাহা উঠে জানালার পাশটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
“মাহা? মাহা না আপনার নাম?”

কোনো জবাব দিলোনা মাহা। সার্থক জবাব না পেয়ে বললো,
“দেখুন মাহা। গতরাতে যা ঘটেছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমাদের দুজনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ভালো হবে যদি আপনিও এটি ভুলে যান। আর আমিও।”
“আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”

নির্লিপ্ত কন্ঠ মাহার।

২৪.
মোবাইল, ব্যাগ সবকিছু ট্রেনে ফেলে এসেছে মাহা। সার্থকের মোবাইলটা অবশ্য তার পকেটে। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক নেই। দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দিলো মাহা। ইনি তো কালরাতের মহিলাটাই। হাসিমুখে খাবারের প্লেটের দিকে ইশারা করে নিতে বললেন তিনি। পরনে ‘ফতা’। সাঁওতাল নারীরা এমন দু টুকরো কাপড়েরই পোশাক পরেন। উপরে একটা শাল। হাতে রূপার বালা, কানে ঝুমকা। হাতে করে একটা খয়রী রঙের শালও নিয়ে এসেছেন তিনি। মাহার দিকে এগিয়ে দিলেন তা। মহিলার এতটুকু আপ্যায়নে খুবই খুশি হলো মাহা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা মনের দিক থেকে অনেক ভালো। তারা অনেকটা সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে যা বাঙালির বড়ই অভাব।
“আপনি কি একটু বাইরে যেতে পারবেন?”
“যাচ্ছি।”

কোনো প্রশ্ন না করেই বেরিয়ে গেলো সার্থক। কালো হুডিটা খুলে শালটা ভালোভাবে গাঁয়ে জড়িয়ে নিলো মাহা। হুডিটা থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এই ঘ্রাণটা ঐ ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটার। মাহার গাঁয়েও তো লেগে আছে সে ঘ্রাণ!
“আপনার কি হয়েছে?”
“হ্যাঁ।”

ভেতরে প্রবেশ করলো সার্থক। তাকে কালো হুডিটা ফিরিয়ে দিলো মাহা।
“কালকে রাতের ঘটনাটুকু বাদে অনেকটুকু সাহায্য করেছেন আমার। দয়াকরে আমাকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দিন। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।”

কালো হুডিটার হাতের একটা দিক ছিঁড়ে গেছে। তবুও তা গাঁয়ে জড়ালো সার্থক। চেন লাগাতে লাগাতে বললো,
“আপনি খেয়ে নিন। কানুর সাথে কথা হয়েছে। এখান থেকে আধাঘন্টা হেঁটে গেলেই বাজার। বাজার থেকে লেগুনা করে স্টেশন যেতে পনেরো কি বিশ মিনিট লাগতে পারে।”
“আমি এখন কিছু খেতে চাইনা।”

অনেকটা রাগ নিয়েই কথাটা বললো মাহা। হলদে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠলো নিমিষেই। নাকটা একটু ফুলে উঠলো। কুঁকড়া চুলগুলো খোঁপা করেছে সে। এলোমেলো কয়েকটা অবাধ্য চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাহার সারা কপাল জুড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের মাহার চুলগুলোর প্রতি বড় হিংসে হচ্ছে। হচ্ছে মানে হচ্ছে! কেন হচ্ছে তার কোনো উত্তর নেই তার কাছে।

গ্রামটা সুন্দর। তবে বাড়ি ফেরার তাড়নায়, বাবা কেমন আছেন তা জানার জন্য অস্থির মাহা সেসব খেয়ালই করেনি। লেগুনা তাদের স্টেশন নামিয়ে দিয়ে গেছে। রাজধানীর ট্রেন চলে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। একটা স্টিলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে মাহা আর সার্থক। নিরবতা বিরাজ করছে তাদের মাঝে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে সার্থকের। একটু পানি পান করা প্রয়োজন। মাহাকে রেখে যেতেও পারছেনা। ঢাকা পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত মাহা তার দায়িত্ব। আর স্টেশনেও ট্রেন থামে কেবল মিনিট তিনেকের জন্য।
“আমি একটু পানি খাবো।”

মাহার কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকায় সার্থক। কতক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।”

ট্রেন ততক্ষণে হুইসেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনের দিকে ছুটে আসছে। সেদিকে খেয়াল নেই সার্থকের। যতক্ষণে স্টেশনে ফিরলো সার্থক ততক্ষণে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ। বুঝতে আর বাকি রইলোনা মাহা ইচ্ছে করেই তাকে পানি আনতে পাঠিয়েছিলো। তার সাথে ঢাকা ফিরতে চায়না সে। পানির বোতলটা হাতে নিয়েই বেঞ্চে বসে পড়লো সার্থক। বিড়বিড় করে বললো,
“আর কি তোমার সাথে আমার কখনো দেখা হবে? অলকানন্দা?”

(চলবে)……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here