#অলকানন্দা
#পর্ব-১৮,১৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
১৮
৫২.
“উরুর দিকে ক্ষতটা দেখছেন মিঃ রেজওয়ান?”
“হুম।”
ছোট রুমের রেফ্রিজারেটর এর ভিতর থেকে বহু পুরানো ফ্রোজেন একখানা পায়ের খন্ড বের করলেন ডক্টর ওয়াসিফ। গ্লাভস পরিহিত হাতে সেটা নিয়ে রাখলেন টেবিলের উপর। সাদা পলিথিনে মোড়ানো পায়ের খন্ডটা পর্যবেক্ষণ করার কালেই মুখ খুললেন তিনি।
“এটা ২০১২ সালের শেষের দিকে প্রাপ্ত। হবিগঞ্জে একটা আবর্জনা স্তূপ থেকে। ক্ষতগুলো দেখে কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?”
ডক্টর ওয়াসিফের এমন হেয়ালি তে বিরক্ত রেজওয়ান। বহুদিনের পুরানো শরীরের খণ্ডাংশ। তারউপর হালকা বরফের আস্তরণ। এখানে কি কোনো ক্ষত আদোও বিদ্যমান! আর তা থাকলেও সেটা কি রেজওয়ান বুঝতে পারবে! সূক্ষ্ম ক্ষত নিয়ে তো তার ধারণা থাকার কথা না। মোবাইলটাও কাজ করছেনা। মায়ের সাথে কথা হয়নি আজ। মাহার খোঁজও তো নেওয়া হলোনা। কপালে বিরক্তির দুই তিনটা রেখা ফুটে উঠলো রেজওয়ানের।
“চুপ করে আছেন যে মিঃ রেজওয়ান ?”
“ডক্টর আপনি খোলাসা করে বললে ব্যাপারটা বুঝতে পারতাম।”
“সূক্ষ্ম পরিবর্তন মিঃ রেজওয়ান , সূক্ষ্ম পরিবর্তন।”
আশ্চর্য লোক। রাত সাড়ে বারোটা ছুঁইছুঁই। রাস্তার পাশ থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। নিরবতার মাঝে অদ্ভুত শুনাচ্ছে সে আওয়াজ। ডক্টর ওয়াসিফের জায়গায় অন্য কেউ থাকলে নির্ঘাত ধমক খেতো রেজওয়ানের কাছে। কিন্তু রেজওয়ান নিজের মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে। বর্তমানে একটা ক্লু মানেও অনেককিছু। রেজওয়ানকে নিরব দেখে আলতো হাসলেন ডক্টর ওয়াসিফ। গলা উঁচিয়ে ডাক দিলেন,
“জুলফিকার, নিয়ে এসো।”
নিরবতা। কুকুরের ডাক থেমে গিয়েছে রাস্তায়। শুরু হয়েছে নিশুতি রাতের কান্না। অদ্ভুত, বিচ্ছিন্ন সে আওয়াজ। এই আওয়াজ বর্ণনা করা যায়না, বিশ্লেষণ করা যায়না। কেবল অনুভব করা যায়। রাতের গভীরে কান পেতে শুনতে হয়। কখনো কখনো তারও প্রয়োজন নেই। সেই সুর আপনা-আপনি ধরা দেয় শ্রোতার কানে। ক্যাড়ক্যাড় আওয়াজ করে কাঠের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করলো জুলফিকার। নিশুতি রাতের কান্নার বিশাল ব্যাঘাত ঘটালো সে। হাতের উপরে একটা কাঁচের ট্রে। তাতে চৈতির পায়ের খন্ড। ছিপছিপে গড়নের ছেলেটার শরীরে এত শক্তি দেখে খানিক অবাক হলো রেজওয়ান। নির্লিপ্ত জুলফিকার পায়ের খন্ডাংশ রেখে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে ততক্ষণে। সেদিকেই তাকিয়ে ছিলো রেজওয়ান। ঘোর ভাঙলো ডক্টর ওয়াসিফের কন্ঠে।
“এদিকে খেয়াল করুন মিঃ রেজওয়ান ।”
অবাক হলো রেজওয়ান। খানিকটা হকচকিয়ে গেলো বোধহয়। নিজেকে ধাতস্থ করে তাকালো ছোট টেবিলটার পানে।
“ক্ষত দুইটা কিন্তু সামান্য মিঃ রেজওয়ান।”
“মানে?”
“ফ্রোজেন খন্ডটার দিকে খেয়াল করুন। উরুর দিকে কাটা দেখে মনে হচ্ছে আঁকা বাঁকা।”
অতঃপর সামান্য হেসে ওয়াসিফ বললেন,
“ছন্নছাড়া ক্ষত।”
হাসিটা খেয়াল করেছে রেজওয়ান। এই লোকের সাথে মাত্র কিছুদিনের পরিচয় রেজওয়ানের। সবাই বলে ডক্টর নাকি পাগলাটে ধরনের লোক। তবে কাজ করার সময় তেমন কোনো পাগলাটে রূপ দেখেনি রেজওয়ান। এখন লোকের কথাগুলোই সঠিক মনে হচ্ছে রেজওয়ানের। এই ডক্টরের মাথায় নির্ঘাত সমস্যা আছে।
“রাত বাড়ছে ডক্টর। হেয়ালি না করে একটু খুলে বলুন।”
বিরক্তির প্রকাশ না চাইতেও বেরিয়ে এলো খানিকটা।
“ধৈর্য রাখুন মিঃ। চাকুরীতে নতুন। আপনার পেশায় ধৈর্য বড়ই প্রয়োজন।”
এমন অপ্রকৃতস্থ কথাবার্তা ভিষণ অদ্ভুত ঠেকলো রেজওয়ানের কানে। মানুষ কত ভিন্ন প্রাণী। চোখের সামনে বিরাজমান কিছুদিনের পরিচিত ডক্টর ওয়াসিফকেও ভিন্ন ঠেকছে রেজওয়ানের নিকট।
৫৩.
“নতুন প্রাপ্ত খন্ডখানা এককোপে কাটা। কোনো ধারালো জিনিস দিয়ে দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ধরুন ছুরি কিংবা চাপাতি। কিন্তু ফ্রোজেন খন্ডখানা সার্জিক্যাল ব্লেড দিয়ে কাটা। কোনো সিরিয়াল কিলার অতন্ত্য যত্নের সহিত কেটেছেন। আঁকাবাঁকা, ছন্নছাড়া ভাবে নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন হয়তো।”
এবার ভালোভাবে তাকালো রেজওয়ান। সত্যি! তাইতো! কিন্তু তার কাছে বোধগম্য হলোনা সম্পূর্ণ বিষয়।
“তাহলে আপনি বলতে চাচ্ছেন মাতব্বর শরীফের সাথে নতুন প্রাপ্ত পায়ের খন্ডের কোনো সম্পর্ক নেই?”
“সেটা তো বলতে পারছিনা। কে বা কারা ঘটাচ্ছে এই বিষয় উন্মোচন করার দায়িত্ব আপনার। আমার মনে হচ্ছে খুন দুইটা করেছেন একই ব্যাক্তি। কিন্তু দুইটা কেটেছেন ভিন্ন ব্যাক্তি।”
হেয়ালিগুলো বড্ড অদ্ভুত ঠেকলো রেজওয়ানের কানে। ক্লু খুঁজতে এসে আরো জটলা বেঁধে গেলো যেন। ডক্টর ওয়াসিফ কে আর প্রশ্ন করলোনা রেজওয়ান। উনি সবকিছুতেই হেয়ালি করেন। তার প্রশ্ন তো থেকে যায়। দুইখুন যদি একই ব্যাক্তি করে থাকে তাহলে কে সে? মাতব্বর শরীফ কি দোষী না! কারা করছে এসব। আরো শতশত প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে রেজওয়ানের। কি উত্তর সেসব প্রশ্নের!
_______________
গুলশানের বহুতল বিল্ডিংয়ে সার্থকের ডুপ্লেক্স বাসা। মাহাকে কোলে নিয়ে নিজের বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। বোন নিভা বসে আছে সোফায়। দুইজন গৃহ পরিচারিকা নিজেদের কাজ করে যাচ্ছেন। একজন ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। অপরজন হাতে ট্রে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নিভার দিকে। গাড়িতে থাকতেই ফোন করে সার্থক বলেছিলো মেইন দরজা খুলে রাখতে। তাই বিশাল কাঠের দরজা খুলে রেখেছিলো নিভা। একটা মেয়েকে সার্থকের কোলে দেখে চমকে গেলো সকলে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সার্থকের দিকে। নিভা কিছু বলারও সুযোগ পেলোনা। সার্থক হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। পিছুপিছু এলো নিভাও। নিজের খাটে মাহাকে আলতো করে শোয়ালো সার্থক। আস্তে করে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ দিলো ঠোঁটে। সরে পাশে বসতেই দরজায় হালকা টোকা পড়লো। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে ইশারা করলো শব্দ না করতে। নিভা আস্তে আস্তে প্রবেশ করেছে ঘরে। সার্থকের পাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে প্রশ্ন করলো,
“মেয়েটা কে ভাইয়া?”
ভোরের সূর্য উঠার মতো হাসির রেখার সন্ধান মিললো সার্থকের ফর্সা মুখে। ঝাঁকড়া চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে সার্থক বললো,
“আমার বিশেষ একজন।”
“আমার ভাবী বুঝি?”
“ধরে নেও তাই।”
নিভার মুখেও হালকা হাসি। পরক্ষণেই চিন্তিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে ওর?”
“একটু দুর্বল। নাহারকে গিয়ে বলো স্যূপ করতে,
সাথে আনারের জুস।”
“তোমার জন্য?”
“আমার জন্য এক মগ কফি।”
“ঠিক আছে।”
ঘুমন্ত মাহার হলদে বর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো নিভা। সার্থক কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হয়ে মাত্র বেরিয়েছে। গোঙাচ্ছে মাহা। তোয়ালেটা সোফায় ফেলে রেখে মাহার দিকে দৌড়ে গেলো সার্থক। মাথায় স্পর্শ করে দেখলো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। ভেতর কেঁপে উঠলো সার্থকের। পরিচারিকা খাবার দিয়ে গিয়েছে ক্ষণিক পূর্বে। টি টেবিলে ঢেকে রাখা।
৫৪.
বাথরুম থেকে একবালতি কুসুম গরম পানি নিয়ে এলো সার্থক। জ্বর মেপে দেখলো প্রায় ১০৪° ফারেনহাইট! চিন্তার সূক্ষ্ম রেখা দেখা দিচ্ছে সার্থকের মুখে। মেয়েটাকে এখন ঔষধ খাওয়ানো প্রয়োজন। একটা পাতলা কাপড় দিয়ে মাহার সারা শরীর মুছিয়ে দিলো সে। মাহার মুখে পানি হালকা করে ছিটিয়ে দিলো। আলতো করে নরম করে চাপড় মারলো গালে। ডাকলো,
“মাহা, এই মাহা। আমার রাণী। উঠো।”
কিন্তু মাহার জ্ঞান ফিরছেনা। চিন্তারা এসে ভিড় জমাচ্ছে সার্থকের মাথায়। স্বামী হিসেবেই মাহার কাপড় পাল্টে যথাসম্ভব শালীনতার সাথে নিজের টাউজার আর টি-শার্ট পরিয়ে দিয়েছে সার্থক। দ্বিতীয়বার পানির ছিঁটা দিতেই আলতো করে চোখ খুললো মাহা। এই জগৎ দুনিয়ার কিছুই হয়তো সে বুঝতে পারছেনা। সার্থক প্রায় জোর করেই স্যূপটুকু খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দিলো মাহাকে। তারপরই মাহা ঘুমে বিভোর। কফিটা নিয়ে নিজের বিশাল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো সার্থক। আকাশে চাঁদ এখনো ঝকঝক করছে। হালকা হিমেল হাওয়া বইছে। দূর থেকে ভেসে আসছে হাসনাহেনার ঘ্রাণ। মৃদু হেসে কফিতে চুমুক দিলো সার্থক। আজ সবকিছুই ভালোলাগছে তার।
চিরপরিচিত ঘর, বারান্দা সবকিছু যেন মুখরিত হয়ে আছে। এই জড়বস্তুগুলোর মাঝেও আনন্দের ছড়াছড়ি। বহুদিন বাদে যেন তাদের আপনকেউ ফিরে এসেছে তাদের মাঝে। সাদা কম্বলে অর্ধশরীর ঢাকা মেয়েটার পানে বারান্দা থেকেই ফিরে তাকালো সার্থক। নিজের পোশাকে প্রেয়সীকে দেখতে অনন্যময়ী লাগছে তার কাছে। কোঁকড়া চুলগুলো বালিশের দুপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। হলদে মুখে ভয়াবহ বিষণ্ণতা। কিসের যেন কষ্ট। কি চলে যাওয়ার বেদনা। সার্থক বিড়বিড় করে বললো,
“আমার রাণী। আমার রাজপ্রাসাদে আর কোনো দুঃখ থাকবেনা তোমার। কোনো কষ্ট তোমায় ছুঁতে পারবেনা অলকানন্দা।”
কফির কাপটা টি-টেবিলে রেখে খাটের দিকে এগিয়ে এলো সার্থক। টি-শার্ট খুলে উন্মুক্ত বুক নিয়ে বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিলো। মাহাকে টেনে নিলো বুকে। ঠিক হৃদপিণ্ড যেদিকটায় থাকে সেদিকে। মাহাও বোধহয় শক্ত আশ্রয় খুঁজে পেলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সার্থক কে। সার্থক মাহার এলোমেলো চুলে চুমু খেলো। অতঃপর হাত বুলিয়ে দিচ্ছে মাহার কোঁকড়া চুলের অরণ্যে।
_________________
“আমাদের কাজে যদি ব্যাঘাত ঘটে?”
“ঘটবেনা।”
তারপরের কথোপকথন গুলো হলো ইংলিশে। একজন বললো ব্রিটিশ এক্সেন্টে অপরজন মিশ্র।
“তুমি এতোটা সিউর কিভাবে?”
লম্বা, ফর্সা ছেলেটা হাসলো। হেসে বললো,
“এত সহজ সবকিছু? এত বছরের রাজ্য ছেড়ে রাজা কোথায় যাবে! তাছাড়া আসক্তি বড়ই খারাপ রোগ, আলবার্ট।”
সামনে থাকা যুবকটার কথায় আলতো হাসলো আলবার্ট নিজেও। সত্যিই তো! এত সহজ সবকিছু! ঘরটা নিরব। ঢকঢক আওয়াজ হচ্ছে কেবল। নিরবে মদ্য পান করছে দুই মানব। বাইরে যত রাত বাড়ছে ততই নিশুতি রাতের কান্নাও গাঢ় হচ্ছে। মানব দুজন যতই বলুক তারা ভয়ে নেই। বিষয়টা ভুল। উভয়ের মনেই শঙ্কা। ভয়ংকর শঙ্কা। আস্তে আস্তে শঙ্কাগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে কড়া নেশার প্রকোপে। কিন্তু আবার তো ফিরবে তারা!
(চলবে)….
#অলকানন্দা
#পর্ব-১৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
৫৫.
কারো বুকের ধুকপুক আওয়াজে ঘুম ভাঙলো মাহার। মাথাটায় প্রচুর ব্যথা করছে। চারিদিক ধোঁয়াশার মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন। থেমে থেমে স্পষ্ট হয় সব। নিজের পাশে সার্থক কে দেখে যারপরনাই অবাক হয় মাহা। দুর্বল স্বরে চিৎকার করে উঠে। মাহার চিৎকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সার্থক। সারারাত ঘুম হয়নি। মাথা ভারী লাগছে তার। উঠে বসে ডান হাতটা এগিয়ে জ্বর মেপে নেয় মাহার। কমে এসেছে দেখে শান্তি পায় সে। মাহা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। হলদে মুখটা কি যে আদুরে লাগছে! সার্থকের ইচ্ছে করছে গালে একটু আদর দিতে। নিজের ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নেয় সে।
“আ..আমি কোথায়?”
দুর্বল কন্ঠ মাহার। সার্থক সামান্য হেসে বলে,
“তোমার স্বামীর বাড়ি।”
“মানে?”
“আমি তোমার স্বামী। এটা আমার বাসা।”
“আমি এখানে কিভাবে?”
“বড্ড প্রশ্ন করো তুমি মাহা। চলো ফ্রেশ হয়ে নেও। ব্রেকফাস্ট করে ঔষধ খেতে হবে।”
নিজের দিকে তাকিয়ে আরো অবাক হলো মাহা। তার গাঁয়ে এসব কি! এটা তো ছেলেদের টি-শার্ট আর টাউজার। চিন্তিত, ক্লান্ত, দুর্বল স্বরে সে প্রশ্ন করে,
“আমার গাঁয়ে এসব কেন?”
“আমি তোমার স্বামী মাহা। আমি পরিবর্তন করে দিয়েছি।”
মাহা স্তব্ধ হয়ে আছে। এমন অকপট সত্যের উত্তরে কি বলবে সে। কোনো ভাষা তো খোঁজে পাচ্ছেনা! হঠাৎ তড়িৎ গতিতে সজাগ হয় মস্তিষ্ক। বাবা! বাবা তো আর নেই! মাহার একমাত্র আপন মানুষটাও তাকে ছেড়ে চলে গেছে। মাহা কি নিয়ে বাঁচবে। অশ্রুরা এসে ভিড় জমালো মাহার নয়নে। মাহার কান্নার শব্দে ভরকে যায় সার্থক।
“এই কান্না করছো কেন তুমি? আমি সত্যি তোমার সাথে কিছু করিনি মাহা।”
মাহার কান্না থামছেনা। সার্থকের বুকে যে ব্যথা হচ্ছে।
“প্লিজ মাহা কেঁদো না। আমাকে বলো আমি কি কিছু করেছি?”
মাথা নাড়ায় মাহা।
“আপনার কোনো দোষ নেই সার্থক। আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে গতকাল। বহুদূরে।”
মাহার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। নিজেকে সামাল নেওয়া দায়। সার্থক বুকে আগলে নেয় মাহাকে। মাহাও যেন আশ্রয় খুঁজে পায়।
________________
“মাহাকে তার মা বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হোসেন ভাই মারা গেছেন।”
“কি!”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে যায় রেজওয়ান। খুব রাতে বাড়ি ফিরেছিলো ছেলেটা। তাই সাবিনা বেগম ছেলেকে কোনো কথা বলেন নি। তিনি তো জানেন রেজওয়ান কতটা চায় মাহাকে। নাস্তা খেয়েই রেজওয়ান ভেবেছিলো মাহার সাথে দেখা করতে যাবে। মায়ের মুখে এসব শুনে নাস্তা খাওয়া হলোনা তার। দাঁড়িয়ে গেলো সে। ছেলেকে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে সাবিনা বেগম বললেন,
“নাস্তা করে যা।”
অসহায় চোখে মায়ের পানে তাকালো রেজওয়ান। মা কি বুঝেনা রেজওয়ানের ঠিক কতটা কষ্ট হচ্ছে! সে আর কথা বাড়ায় নি। চুপচাপ পাশে রাখা ওয়ালেট আর রিভলবার নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে । সোজা পথে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই মাহার বাড়ি। রেজওয়ান হন্তদন্ত হয়ে ছুটে যায় চারতলায়। কিন্তু হতাশ হয় । দরজায় তালা দেওয়া। মাহার কাছে তো মোবাইলও নেই। কোথায় গেলো মেয়েটা!
৫৬.
“ভাইয়া?”
এশার কন্ঠে পিছু ফিরে রেজওয়ান। শ্যাম বর্ণের মেয়েটার ভীতু চাহনি। বিচলিত কন্ঠে রেজওয়ান প্রশ্ন করে,
“মাহা, মাহা কোথায় গিয়েছে? জানো?”
“আমি সঠিক বলতে পারবোনা ভাইয়া। গতকাল ফুপি আপুকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।”
“মগের মুল্লুক নাকি! একটা জলজ্যান্ত মানুষ কে তার নিজের বাসা থেকে বের করে দিলো। আর তোমরা বসে বসে দেখছিলে। এতটা কাণ্ডজ্ঞানহীন কি করে হও তোমরা!”
ধমকে উঠলো রেজওয়ান। এশা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় মানুষটার মুখে এমন ধমক শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় এশা। মাথার চুলগুলো আলতো টেনে নিজেকে সামলায় রেজওয়ান। এমনিতেই সকাল থেকে মন মেজাজ বিগড়ে আছে। কিছু না বলেই নিচে নেমে আসে । চারতলায় একটা মেয়ে যে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে খেয়াল কি আছে তার!
পুলিশ স্টেশনে ইনভেস্টিগেশনে মন নেই রেজওয়ানের। কোথায় খুঁজবে মাহাকে ! এদিকে কেসের তদন্ত। মোবারক জানিয়েছেন সিলেটে তিনি কোনো ক্লু খুঁজে পাননি। ফিরে আসবেন আগামীকাল। এদিকে স্যার সময় দিয়েছেন এক সপ্তাহ। এক সপ্তাহের ভিতর একটা রিপোর্ট জমা দিতে বলেছেন এসপি প্রলয়। বিভিন্ন চ্যানেল, নিউজ পেপারে লেখালেখি হচ্ছে এই ব্যাপারে। আতঙ্কিত দেশের মানুষজন।
“আসবো মিঃ রেজওয়ান ?”
“আসুন। মিস তাজ।”
তাজ ভিতরে এসে বসলেন। হাতের ফাইলটা এগিয়ে দিলেন রেজওয়ানের দিকে।
“এটা ২০১২ সালের তদন্তের ফাইল।”
রেজওয়ান বিস্মিত হয়ে বলে,
“কোথায় পেলেন?”
“পেয়েছি। কোনো এক সূত্রের মাধ্যমে। সম্পূর্ণ নয়। আংশিক তদন্তের বিস্তারিত আছে। ভিক্টিমের ডিএনএ রিপোর্ট আসতে দেরি হবে। আমাদের উচিত মাতব্বর শরীফের সাথে সেলে দেখা করা।”
“আমিও এই কথাই ভাবছিলাম মিস তাজ। ঘটনার কত সময় পেরিয়ে গেলো। অথচ আমাদের হাতে কোনো তথ্য নেই।”
তখনই ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। একটা অপরিচিত নাম্বার।
“হ্যালো কে?”
“ভাইয়া, আমি মাহা।”
“মাহা, কোথায় তুমি? আন্টি এমন একটা কাজ করলো! তুমি আমাদের বাসায় চলে আসোনি কেন? এখন কোথায় তুমি?”
“আমি নিরাপদ আছি, ভাইয়া। চিন্তা করবেন না। বাবাকে কোথায় কবর দিয়েছে?”
অশ্রুসিক্ত গলায় বলে উঠলো মাহা।
“তোমাদের গ্রামে। নারায়ণগঞ্জ। কোথায় তুমি মাহা?”
“ভাইয়া, আপনি তো জানেন এই ঢাকা তে আমার আপন বলতে কেউই নেই। আপনাকে আমি আমার বড় ভাইয়ের স্থানে বসিয়েছি ছোট থেকেই। আপনি কি একটু গুলশান আসতে পারবেন। কিছু কথা ছিলো আপনার সাথে।”
“আমি আসছি।”
ল্যান্ডলাইনের ফোন দিয়ে রেজওয়ান কে কল করেছিলো মাহা। মাত্রই গোসল করে বাইরে এসেছে সে। সার্থকের ঘরটা ভিষণ বড়। দেয়ালে লাল রঙা কারুকাজ। রাজকীয় খাট, ওয়ারড্রব, পাশে বিশাল বুকশেলফ। ছিমছাম, পরিপাটি ঘর।
“কার সাথে কথা বলছিলে মাহা?”
“রেজওয়ান ভাইয়া।”
রেজওয়ান নামটা শুনেই চরম বিরক্ত হলো সার্থক। অজানা কারণে রেজওয়ান কে বিরক্ত লাগে সার্থকের কাছে। চরম বিরক্তি লুকিয়ে স্নিগ্ধ চোখে মাহার পানে তাকালো সার্থক। কি অপরূপ তার অলকানন্দা! লাল টকটকে থ্রি পিসে কি যে মায়াবী লাগছে। মাথায় তোয়ালে প্যাঁচানো। সার্থক কে এমন গভীর চোখে তাকাতে দেখে লজ্জা, অস্বস্তি ঘিরে ধরে মাহাকে। দীর্ঘ সময় কান্নার ফলে চোখ দুটো টকটকে লাল তার।
৫৭.
“ভাবীকে নাস্তা খাওয়াবেনা ভাইয়া?”
নিভার হাসিমাখা কথায় ঘোর ভাঙে সার্থকের। মাহা যেন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হলো।
“নিভা। ঘরে আসো।”
ঘরে ঢুকে নিভা। সোনালী চুলের বিদেশি রমনী। দেখে বুঝার উপায় নেই এই মেয়েটা কে। কারণ সার্থকের সাথে কোনো মিল নেই তার। সার্থক তার গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“মাহা, ও আমার বোন। নিভা।”
মাহা কি বলবে বুঝে পেলোনা। লোকটা সেই কখন থেকেই মাহার সাথে এমনভাবে কথা বলছে যেন মাহা তার কতদিনের পরিচিত। আচ্ছা, মাহার তো এই পৃথিবীতে কেউ নেই। বিয়েটা তার সার্থকের সাথে হয়েছে। এই কথাটাও সত্য। সার্থকের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে তাকে বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চায়। মাহা যদি মেনে নেয় তাহলে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে!
“চলো ভাবি। নাস্তা করবে।”
মাহা জানেনা কেন। তবে সে তাকালো সার্থকের পানে। সার্থক মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই সে বাইরে বেরিয়ে এলো নিভার সাথে। বাড়িটা ডুপ্লেক্স। উপরে দুইটা রুম আর বিশাল বারান্দা। একরুমে তালা দেওয়া। অপরটা সার্থকের। বারান্দায় হরেকরকম ক্যাকটাস গাছ লাগানো। দুয়েক রকম ফুল গাছও আছে। দুইটা বেতের চেয়ার। মাঝে টেবিল। সম্পূর্ণভাবে দেখার সুযোগ হয়নি মাহার। নিভার সাথে নিচে চলে এলো সে। টেবিলে বসে আছে তিনজন পুরুষ। মাহা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তখনই নিচে নেমে এলো সার্থক। মাহার হাতটা আলতো করে ধরে বললো,
“চলো।”
সাহস পেলো মাহা। ডাইনিং টেবিলে সার্থক নিজের পাশে বসালো মাহাকে। রুটি, জেল, স্যূপ, গরুর মাংস, সবজি ভাজি হরেকরকম খাবারে সাজানো টেবিল। নিভা মুইংচিন কে দেখিয়ে বললো,
“ভাবি, মুইংচিন ভাইয়ার সেক্রেটারি। উনি চীনের বাসিন্দা। শান ধর্মাবলম্বী।”
ছোট ছোট চোখ আর চাইনিজ চেহারা বিশিষ্ট মুইংচিনের পানে তাকালো মাহা। বয়সে তো অনেক বড় হবেন মুইংচিন। মাহা কি বলে সম্বোধন করবে। ভাবনার মাঝেই মুইংচিন বললো,
“বাবি, আপনি আমাকে মুইংচিন বলেই দাকবেন।”
আদো আদো বাংলা বুলি। ভালোলাগে শুনতে। মাহা মাথা নাড়লো। নিভা এবার রবার্টকে দেখিয়ে বললো,
“ভাবি, ও আমার হাসবেন্ড। রবার্ট। রবার্ট ড্যানিয়েল নাইট। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার।”
“হ্যালো, বাবি।”
রবার্টের কথায় হালকা হাসলো মাহা। এবার সার্থক বললো,
“আর ও হচ্ছে আমার বন্ধু লুবান।”
শ্যামলা বর্ণের বলিষ্ঠ পুরুষ লুবান। মাহা সেদিকে তাকিয়ে বললো,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাবি।”
বিভিন্ন কথার মাঝেই নাস্তা খাওয়া শেষ হলো সকলের। রবার্ট, লুবান বাইরে বেরিয়ে গেলো। নিভা, মুইংচিন রয়ে গেছে বাসায়। মাহা শান্ত হয়ে বসে আছে। কোথায় যাবে এখন! সার্থকের ঘরে কি!
“মাহা?”
সার্থকের ডাকে সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় মাহা। মাথা নিচু করে বলে,
“জ্বি?”
“আমার সামনে কখনো মাথা নিচু করে রাখবেনা মাহা। রাণীর মতো মাথা উঁচু করে থাকবে। ঘরে চলো।”
বলেই আর দাঁড়ালো না সার্থক। হনহনিয়ে উপরে চলে যাচ্ছে সে। মাহাও চললো পিছুপিছু। দুজন পরিচারিকা দূর থেকে তা দেখে মিটিমিটি হাসছেন।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো সার্থক। মাহা কিছুক্ষণ আগে এসে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে।
(চলবে)